অধারাই থেকে যাবে ডার্ক পার্টিকেল

1
518

‘অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে?
অচেনাকেই চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে ॥’

অচেনাকে চিনতে রবীন্দ্রনাথ আশায় বুক বেঁধেছেন। বিজ্ঞানীরাই বা কম কীসে। অচেনা গুপ্ত পদার্থকে চিনতে তাঁদের চেষ্টার এতটুকও খামতি নেই। মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি। এদের কবজাতেই রয়েছে মহাবিশ্বের ৯৬ শতাংশ ভর! অথচ এরাই  রয়েছে বিজ্ঞানীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এরা ব্ল্যাকহোলও নয়। ভূত-টুতের ব্যাপার বিজ্ঞানে চলে না। তবু কেনইবা এই আজগুবি বস্তু আর শক্তির অবতারণা? সে ইতিহাস বহু পুরোনো। বস্তুটির ভর আছে। ভর থাকা মানেই তার প্রভাব ছড়িয়ে থাকে আশাপাশে। থাকবে তার মহাকর্ষশক্তিও। ভর-শক্তির আকারে থাকা এই গুপ্ত বস্তুগুলো (এবং শক্তি) যতই নিজেদের আড়াল করে রাখুক, শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা তাদের যাচাই করছেন মহাকর্ষ বলের কষ্টিপাথরে। মহাকর্ষ বল যার থাকবে, স্থানকালের জালে তাদের জড়াতেই হবে। সাফল্য বলতে ওটুকুই। বিজ্ঞানীরা জানেন, ডার্ক ম্যাটার নামে গুপ্ত বস্তুটি ছড়িয়ে আছে মহাবিশ্বের এখানে-ওখানে। তবু তাদের দেখা মিলছে না। কেন? কারণ যেকোনো এক অজানা-অচেনা বস্তু দিয়ে তৈরি এই গুপ্ত পদার্থ ও গুপ্ত শক্তি। ইলেকট্রন, কোয়ার্ক কিংবা অন্য কোনো ফার্মিওন কণার অস্তিত্ব নেই সেই গুপ্ত বস্তুর অভ্যন্তরে। কিংবা গুপ্ত শক্তিগুলো, যা আকার প্রায় মহাবিশ্বের মোটা ভরশক্তির ৭৫ শতাংশ, সেই শক্তির উৎস ফোটন বা অন্যান্য বোসন কণার মতো কোনো কণা নয়। তাহলে এর দেখা মিলবে কীভাবে?

ভেরা রুবিন

মিলবে কি মিলবে না সেটা পরের কথা, বিজ্ঞানীরা তো আর হাত গুটিয়ে থাকার পাত্র নন। ঘোরতর বৈজ্ঞানিক রহস্যের পেছনেই তাঁদের নিরন্তর ছুটে চলা। গুপ্ত পদার্থ আর শক্তির পেছনেও তাঁরা ছোটেন। ঘটনার শুরু গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে। ডাচ বিজ্ঞানী ইয়ান ওর্ট আর মার্কিন ফ্রিৎজ যুইকি ভর মাপার চেষ্টা করেন মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর । গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং ব্যবহার করে। আর সেখানেই বাধে গোল। মহাবিশ্বের মোটা বস্তুকণার একটা হিসাব বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল। সেটা থেকেই বের করা যায় মহাবিশ্বের মোট ভর। সেই ভর আর ওর্ট-জুইকির মাপা ভর এক হওয়ার কথা। কিন্তু ওর্ট-জুইকির হিসাব থেকে মহাবিশ্বের মোট ভর অনেক অনেক গুণ বেশি পাওয়া গেল । এই বাড়তি ভরের জোগান কোত্থেকে এল?  অনেক বিজ্ঞানীই এটা নিয়ে গবেষণা করলেন। কিন্তু হিসাব মিলল না।

১৯৭০-এর দশকে মার্কিন জ্যোতির্বিদ ভেরা রুবিন একটা সমাধান দিলেন, বললেন, দুভাবে বের করা মহাবিশ্বের ভর সমান হবে, যদি মহাবিশ্বে বিপুল পরিমাণ ভর ও শক্তি লুকিয়ে থাকে। রুবিন বলেন, এসব গুপ্ত বস্তু তৈরি এমন  কণা দিয়ে, যেগুলো আমাদের চেনা-জানার বাইরে। আলোও এর ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই খুব সহজেই আমাদের চোখ, আমাদের শক্তিশালী ডিটেক্টরকেও ফাঁকি দিতে পারে।

এখন আমরা জানি, গোটা মহাবিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ দৃশ্যমান বস্তু দিয়ে গড়ে উঠেছে। ৯৬ শতাংশই রয়ে গেছে অদৃশ্য। অদৃশ্য গুপ্ত ভরের ২১ শতাংশ গুপ্ত পদার্থ বাকি ৭৫ শতাংশ গুপ্ত শক্তি। এই বিশাল পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জিকে আমলে নিয়েই বিগ ব্যাং, মহাবিশ্বের প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাখ্যা করা যায় আইনস্টাইনের মহাকর্ষও। অর্থাৎ এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। শুধু কি এতে মন ভরে? বিজ্ঞানীরা জানতে চান সেই ভুতুড়ে গুপ্ত বস্তুগুলো আসলে কী দিয়ে তৈরি?

মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মডেল প্রতিষ্ঠিত করেন স্টিভেন ওয়েনবার্গ, আবদুস সালাম আর সেলডন গ্ল্যাশো। সেই মডেলে আমাদের পরিচিত সব রকম বস্তুকণা (ফার্মিওন) ও বলবাহী কণাদের (বোসন) স্থান হয়েছে। কিন্তু গুপ্ত কণাদের খোঁজ ওই মডেল দিতে পারে না। গত শতাব্দীর ৭০ দশকে ‘সুপার সিমেট্রি’ নামের আরেকটি মডেল দাঁড় করানো হয়। উদ্দেশ্য কৃষ্ণগহ্বর কিংবা ডার্ক ম্যাটারের মতো বিষয়গুলো যেখানে নিউটন আইনস্টাইনের মডেল অকার্যকর, কোয়ান্টাম মেকানিকসও ঠিকঠাক কাজ করে না সেই সব বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা। সুপার সিমেট্রির মডেলের সূত্র ধরেই বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটারের জন্য একধরনের কণার কথা বলেন। নাম তার উইম্প। পূর্ণাঙ্গ নাম উইকলি ইন্টার‌্যাক্টিং ম্যাসিভ পার্টিক্যালস (Weakly interacting massive particles)। অর্থাৎ দুর্বল মিথস্ক্রিয়াশীল ভারী কণা। বিজ্ঞানীদের দাবি, এটা এমন এক কণা শুধু মহাকর্ষ বলের সঙ্গেই এর মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। বিদুৎচুম্বকীয়, সবল নিউক্লীয় বল, এমনকি দুর্বল বলের সঙ্গেও এর মিথস্ক্রিয়া ঘটে না। তাই যেমন কঠিন পদার্থের সঙ্গে এর ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা নেই, আলোর কণা ফোটনের সঙ্গেও এর সংঘর্ষের কোনো সুযোগ নেই। আর আলোর সঙ্গেই যদি সখ্য তৈরি না হয়, সেটা আমাদের চক্ষু-কর্ণের মানভঞ্জন ঘটাবে কী করে?

ডার্ক পার্টিকেল ধরার জন্য বসানো লাক্স নামের বিশাল ডিটেক্টর

কোনো কোনো পদার্থবিদ মনে করেন, খুব কম শক্তির দুর্বল নিউক্লীয় বলের সঙ্গে উইম্প কণার মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে। মার্কিন বিজ্ঞানী ক্যাথরিন ফ্রিসি মনে করেন, কোনো কোনো উইম্প কণা কালেভদ্রে বস্তুকণার নিউক্লিয়নগুলোর (প্রোটন ও নিউট্রনের সাধারণ নাম নিউক্লিয়ন) সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাতে পারে। নিউক্লিয়নের সঙ্গে উইম্পের সংঘর্ষ ঘটার সম্ভব কতাটা সেটা নিয়ে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা চালানো হয়েছে সার্নের এলএইচসিতে। কিন্তু কোনো ফলই উইম্পের হদিস দিতে পারেনি। উইম্প আর ডার্ক ম্যাটার গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ড্যাকোটার সানফোর্ড আন্ডারগ্রাউন্ড রিসার্চ ফ্যাকাল্টিতে বসানো হয়েছে  লাক্স (লার্জ আন্ডার গ্রাউন্ড জেনন) নামে এক বড়সড় ডিটেক্টর মাটির ১ হাজার ৫০০ মিটার গভীরে একটি বিশেষ এক পাথরের চেম্বারে। এই পাথুরে দেয়াল ভেদ করে পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে ক্ষয় হওয়া তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বেরিয়ে যেতে পারে না। আসলে দুর্বল নিউক্লীয় বলের প্রভাবেই তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরিত হয়। অর্থাৎ লাক্স ডিটেক্টর দুর্বল নিউক্লীয় বলের বিশাল আধার। এ কারণেই তেজস্ক্রিয় রশ্মি ধরে রাখার এই আয়োজন।

দুই মিটার উঁচু একটা টাইটেনিয়ামের ট্যাকে ৩৭০ কেজি জেনন গ্যাসকে ১০৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল করে রাখা হয়েছে। নিচের দিকে আছে একটি ইলেকট্রিক ফিল্ড। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, কালেভদ্রে হয়তো জেননের পরমাণুর সঙ্গে উইম্পের সংঘর্ষ ঘটতে পারে। সংঘর্ষের পর জেনন পরমাণুটি স্থিতিশীল হওয়ার সময় একটা মুক্ত ইলেকট্রন তৈরি এর। সেই সঙ্গে নির্গত হবে আলোক বিকিরণ। সেই মুক্ত ইলেকট্রন আবার ইলেকট্রিক ফিল্ডের প্রভাবে ত্বরিত হবে এবং দ্রুত ট্যাংকের ওপর দিকে উঠে আসবে। ত্বরিত এই ইলেকট্রন ট্যাংকের ওপরের স্তরে এসে আরও আলো বিকিরণ করবে। পুরো ব্যবস্থাটিতে রাখা আছে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি লাইট ডিটেক্টর। সেই ডিটেক্টর ট্যাংকের জেনন আর উইমসের সংঘর্ষ থেকে আসা আলো যেমন আলাদা করে চিনতে পারবে, তেমনি মাপতে পারবে ত্বরিত ইলেকট্রন থেকে বিকিরিত আলোর ঠিকঠাক উজ্জ্বলতাও। যদি গুপ্তকণা আঘাত করে জেননকে, এই প্রক্রিয়াতে সে ধরা পড়বে লাক্সের ডিটেক্টরে।

সম্প্রতি লাক্সের ডিটেক্টরে ধরা পড়া কিছু সিগন্যাল বিজ্ঞানীদের আশাবাদী করেছিল। ডিটেক্টরের ডেটা নিয়ে তাঁরা কোমর বেঁধে গবেষণা শুরু করেন। সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস-এ। সেই গবেষণাপত্র বলছে, যতটা আশা নিয়ে বিজ্ঞানীরা ডেটা বিশ্লেষণে নেমেছিলেন, সেই আশার ফুল এখনই ফুটছে না। অর্থাৎ হিসাব বলছে, লাক্সের জেননে এখনো আঘাত হানেনি উইম্প। তাই বলে রণে ভঙ্গ দেননি লাক্সের বিজ্ঞানীরা।  গুপ্ত কণা আজ ধরা দেয়নি তো কি হয়েছে, একদিন না একদিন ফাঁদে তাকে পড়তেই হবে। তাঁদের মতো, গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানপ্রেমীরা আশায় বুক বাঁধছেন দশকের পর দশক ঘুরিয়েও যেমনিকরে হিগস বোসন কিংবা ভাইল ফার্মিওন ধরা পড়েছে বিজ্ঞানীদের জালে, উইম্পও একদিন লাক্সের জালে জড়িয়ে ফেলবেন নিজেকে।

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

1 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.