ভাইরাস বললেই আমাদের মনে একধরণের ভয় সৃষ্টি হয়। ভাইরাস শব্দটিই যেন নেতিবাচক। আমরা জানি ভাইরাস নানা ধরণের রোগ সৃষ্টি করে। আমরা মাঝে মাঝে ভাইরাল জ্বরের মাধ্যমে যে কষ্ট পাই তার পেছনেও কিন্তু ভাইরাস দায়ী। কিন্তু আমি যদি বলি ভাইরাসরা ভালো কাজ করতে পারে তাহলে চমকাবার কিছু নেই। কিছুদিন আগে ইউটিউবে একটি Ted Talk দেখছিলাম। বক্তা Dalhousie University এর মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক Patrick Lee। তিনি যা বললেন তা আমরা সচরাচর যা ভাবি ঠিক তার বিপরীত। তিনি বলছেন ভাইরাসের মাধ্যমে ক্যানসারের চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু আমরা এতদিন জেনে এসেছি ভাইরাস দিয়ে ক্যানসার হয়। এখন এই ভাইরাস দিয়েই ক্যানসার চিকিৎসা! যেন বিষে বিষক্ষয়। ষোল মিনিটের ভিডিওটিতে তিনি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কিভাবে ভাইরাস ক্যানসার চিকিৎসার জন্য একটা নতুন দ্বার খুলে দিতে পারে। আমি ওনার কথাগুলো এ লেখায় তুলে ধরবো। লেখাটি তাঁর ভিডিও বক্তব্যের লিখিত ভাবানুবাদ বলা যেতে পারে।
যেসব ভাইরাস ক্যানসারের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম তাদের বলা হয় Oncolytic Virus। ‘Onco’ মানে হচ্ছে ক্যানসার আর ‘lytic’ মানে হলো ধ্বংস। তার মানে যেসব ভাইরাস ক্যানসারকে ধ্বংস করে তারাই Oncolytic Virus। এমন কিছু ভাইরাস হলো Herpes Simplex Virus, Measles Virus, Vaccinia Virus, Reo Virus. পেট্রিক লি রিও ভাইরাস নিয়ে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে কাজ করছেন।
এখন দেখা যাক বর্তমানে ক্যানসারের কি কি চিকিৎসা আছে। সেগুলো হলো সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি এবং কেমোথেরাপি। নতুনভাবে যোগ হয়েছে হরমোন থেরাপি ও ইমিউন থেরাপি। অপারেশনের কিছু সমস্যা আছে। তা হলো অপারেশনের মাধ্যমে পুরো ক্যান্সারটি সমূলে উৎপাটন করা যায় না এবং বেশিরভাগ সময় তা ফিরে আসে। রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপির অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এধরণের চিকিৎসার মূল সমস্যা হলো এরা ক্যানসার কোষের সাথে সাথে সুস্থ কোষকেও আক্রমণ করে। এদিক দিয়ে অনকোলাইটিক ভাইরাস ব্যাবহারে আমরা এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি। এসব ভাইরাসের মূল সুবিধা হলো এরা শুধুমাত্র ক্যানসার কোষকেই আক্রমণ করে। আরেকটা সুবিধা হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে এসব ভাইরাসকে পরিবর্তন করা যায়। ফলে এটা একেবারে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারে। এসব ভাইরাসকে খুব সহজেই ল্যাবে জন্মানো যায়। ফলে এরা খুব সহজলভ্য।
ক্যানসারের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য একটি আদর্শ ভাইরাস হলো রিও (Reo) ভাইরাস। Reo নামটি এসেছে Respiratory Enteric Orphan শব্দটি থেকে। এই ভাইরাসটি খুবই দুর্বল ভাইরাস। আমরা বেশিরভাগই এই ভাইরাসটি দিয়ে আক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু অনেক সময় হয়তো বুঝতেও পারি নি যে আক্রান্ত হয়েছি। তাই এই ধরণের ভাইরাস ক্যানসারের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্যে খুবই উপযোগী। রিও ভাইরাস মূলত ঊর্ধ্ব শ্বসনতন্ত্র ও অন্ত্রনালীতে আক্রমণ করে।
রিও ভাইরাস বা অন্যান্য অনকোলাইটিক ভাইরাস প্রথমে ক্যানসার কোষের সাথে যুক্ত হয় এবং কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। এরা কোষের ভেতরকার জিনিসপত্র ব্যবহার করে নতুন ভাইরাস তৈরি করে। ২৪ ঘণ্টা পর দেখা যায় হাজার হাজার ভাইরাস সৃষ্টি হয়েছে। এরা কোষকে ভেঙ্গে বাইরে বেড়িয়ে আসে এবং অন্য কোষকে আক্রমণ করে। ভাইরাসের এই বংশবৃদ্ধি চেইন রিয়েকশন আকারে চলতে থাকে। এভাবে সব ক্যানসার কোষ ধ্বংস হয়ে যায়।
পেট্রিক লি ও তাঁর ছাত্ররা পনেরো বছর আগে একটা পরীক্ষা করেন। কিন্তু পরীক্ষাটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। তারা তাদের ব্যর্থতার পথ ধরে এগুতে থাকেন। তারা ভাবতে থাকেন এ ভাইরাস দিয়ে ক্যানসার কোষ আক্রমণ করা সম্ভব কি না। তারা দেখলেন এটা করা সম্ভব। তারা ব্যাপারটিকে পরীক্ষা করার জন্য সাধারণ কোষকে ক্যানসার কোষে পরিণত করেন এবং তাতে ভাইরাস দিয়ে দেখেন যে ভাইরাস পরিণত ক্যানসার কোষকে আক্রমণ করছে কি না। দেখা গেলো ক্যানসার কোষগুলোকে রিও ভাইরাস মেরে ফেলছে।
আরেকটি গবেষণায় স্তন ক্যানসার কোষের উপর ভাইরাস প্রয়োগ করে দেখা গেছে স্বাভাবিক কোষের কোন ক্ষতি হচ্ছে না কিন্তু স্তন ক্যানসার কোষকে ভাইরাস মেরে ফেলছে।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে কেন সাধারণ কোষগুলোর কোন ক্ষতি হচ্ছে না। কেবল মাত্র ক্যানসার কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে ভাইরাস যখন স্বাভাবিক কোষগুলোকে আক্রান্ত করে তখন তাদের মধ্যে কিছু কোষ ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়। কিন্তু তারা মারা যাওয়ার আগে ইন্টারফেরন (Interferon) নামের প্রোটিন তৈরি করে যা বাকি কোষদের প্রতিরক্ষা প্রদান করে। কিন্তু ক্যানসার কোষ ইন্টারফেরন তৈরি করতে পারে না। এমনকি তাদেরকে যদি বাহির থেকে ইন্টারফেরন দেয়া হয় তবুও তারা ইন্টারফেরনকে কাজে লাগাতে পারে না। তাই তারা ভাইরাস দিয়ে সহজেই আক্রান্ত হয়।
আরেকটি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে রিও ভাইরাসকে মেরে ফেলে যদি ইঁদুরের টিউমার কোষে দেয়া হয় তাহলে টিউমার সারে না। কিন্তু জীবন্ত ভাইরাস দিলে রোগ সেরে যায়।
অনকোলাইটিক ভাইরাস দুটি উপায়ে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে। একটা হচ্ছে সরাসরিভাবে। আবার দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সজাগ করার মাধ্যমেও তারা ক্যানসার কোষকে মারতে পারে। তখন দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করে ফেলে।
রিও ভাইরাস ব্যবহার করে ক্যানসার বিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা যায়। এটা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রথমে ভাইরাসকে প্রোস্টেট ক্যানসার কোষ দেয়া হয়। তিন চার সপ্তাহ পর ইঁদুরটিতে টিউমার হয়। তারপর ঐ জায়গায় রিও ভাইরাস দেয়া হলো। দেখা গেলো টিউমার কমে গিয়েছে। তারপর ইঁদুরটি থেকে প্লীহা কোষ নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটি ইঁদুরে দেয়া হলো। এখন দ্বিতীয় ইঁদুরটিকে যদি প্রোস্টেট ক্যানসার কোষ দেয়া হয় তাহলে কোন টিউমার গঠন হয় না। কারণ প্লীহা কোষের মাধ্যমে প্রথম ইঁদুরটি থেকে দ্বিতীয় ইঁদুরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চলে এসেছে।
মানুষের উপরেও রিও ভাইরাস প্রয়োগ করা হয়েছে। ডন মরিস মেলানোমা ক্যানসারে রিও ভাইরাস দেয়ার পর দেখেছেন মেলানোমা সেরে যায়।
নিচের ছবিতে যা দেখছি তা হলো দ্বিতীয় ধাপের মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসার। এক্ষেত্রে রিও ভাইরাসের সাথে সাথে কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়েছে। ছবিতে আমরা রিও ভাইরাস দেয়ার আগের ও পরের অবস্থা দেখতে পাচ্ছি।
রিও ভাইরাস ও অন্যান্য অনকোলাইটিক ভাইরাস ক্যানসারের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরক্ষা দিতে পারে। এসব ভাইরাস এখন কাজ চলছে এবং এরা ট্রায়ালের উপর আছে। পেট্রিক লি ও তাঁর মত গবেষকরা এসব ভাইরাস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়। হয়তো এমন এক সময় আসবে ক্যানসার হলে আমরা শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে ভাইরাস দিবো এবং ভাইরাস শরীরের ক্যানসার কোষ চিহ্নিত করে এদের ধ্বংস করে দেবে। ক্যানসার পরবর্তীতে আর ফিরে আসবে না। আমরা এমন দিনের জন্যে অপেক্ষায় থাকলাম!
তথ্যসূত্রঃ
https://www.youtube.com/watch?v=nsoP4SPi2jY
-সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ
অনুজীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]