দ্বিমেরু ব্যাধি : একটি ভিন্ন ধারার সমস্যা

0
1380

দ্বিমেরু ব্যাধি বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারকে বলা হয়ে থাকে ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ ইলনেস। এটা মূলত একধরনের ব্রেন ডিজঅর্ডার। এর ফলে ব্যক্তির মানসিক অবস্থার খুব দ্রুত পরিবর্তন ঘটে।

মস্তিষ্কের একধরনের অস্বাভাবিক অবস্থার কারণে আমাদের মুডে খুব ঘনঘন পরিবর্তন আসে। তখন কাজ করার স্পৃহা, কর্মক্ষমতা এবং নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজগুলো করা কঠিন হয়ে পড়ে। মোটামুটিভাবে চার ভাগে ভাগ করা যায় এই বাইপোলার ডিজঅর্ডারকে। যার কারণে একজন মানুষের মুড একদম ফুরফুরে মেজাজ থেকে একেবারে খাদে নেমে যেতে পারে। এই যে তার মন খুব ভাল আছে বা খুব সাবলীল তার আচার-আচরণ, এ সময়টাকে বলা হয়ে থাকে ম্যানিক এপিসোড। আর যখন সেই একই ব্যক্তি দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে একদম আশাহত হয়ে পড়ে বা মানসিকভাবে খুব খারাপ বোধ করে সে সময়টাকে বলা হয় ডিপ্রেসিভ এপিসোড। এখানে বলে রাখা ভাল যে ম্যানিক এপিসোডের তীব্রতা যদি তুলনামূলক কম হয় তখন সেটাকে বলে হাইপোম্যানিক এপিসোড।

বাইপোলার ডিজঅর্ডারের রকম ফের

চার রকমের মাঝে সাধারণত যে দুটোর কথা চলেই আসে সেগুলো হল যথাক্রমে বাইপোলার I এবং বাইপোলার II

বাইপোলার I কে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে বলা হয়, ম্যানিক এপিসোড নিদেনপক্ষে এক সপ্তাহব্যাপী থাকবে এমনকি এও হতে পারে যে কারও অবস্থা এতটাই গুরুতর যে তাকে হসপিটালাইজড করতে হতে পারে। আর ওদিকটায় ডিপ্রেসিভ এপিসোড কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে চলে সাধারণত। এই ক্ষেত্রে এমন হওয়াটাও অসম্ভব না যে দুটো এপিসোডই একই সাথে চলছে।

এবারে আসা যাক বাইপোলার II– এ। এই ক্ষেত্রে ডিপ্রেসিভ এপিসোড থাকবে আর তার সাথে চলবে হাইপোম্যানিক এপিসোড অর্থাৎ ম্যানিক এপিসোডের তীব্রতা পুরোপুরি অনুভূত হবে না।

এছাড়াও আরও যে দুটো ভাগ আছে সেগুলো একটার বেশ শক্ত নাম আছে- সাইক্লোথাইমিক ডিজঅর্ডার বা সাইক্লোথাইমিয়া। এই ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায় সেটা হচ্ছে হাইপোম্যানিক এপিসোড এবং ডিপ্রেসিভ এপিসোড উভয়ের সংখ্যাই খুব বেড়ে যায় এবং এর ব্যাপ্তি থাকে কমপক্ষে দুই বছর।তবে শিশু এবং বয়ঃসন্ধিকালে উপনীতদের ক্ষেত্রে এক বছর।

একদম শেষ যে ভাগটা সেটাকে প্রকৃতপক্ষে আলাদা কোনো নামে ডাকা হয় না। এটা বলতে এমন কিছু ভিন্নধর্মী লক্ষণ বোঝায় যেগুলো ওপরের তিনটি ভাগের কোনোটির সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ নয়।

বাইপোলার ডিজঅর্ডারের লক্ষণসমূহ

বাইপোলার ডিজঅর্ডারের কিছু নীরব কারণ থাকে অর্থাৎ সাধারণভাবে অনেকেই এসব কারণকে এড়িয়ে যায়। এবারে সেগুলোর কথাই জেনে নেওয়া যাক।

  • বাইপোলার ডিজঅর্ডারের মধ্য দিয়ে যাওয়া একজন মানুষ ঠিক তেমনটাই অনুভব করতে পারেন যেরকম অনুভব করেন একজন ডিপ্রেশনের রোগী। তাহলে ডিপ্রেশন আর বাইপোলার ডিজঅর্ডারের পার্থক্য কোথায়? বাইপোলার ডিজঅর্ডারে একটা ছন্দ থাকে দুটো পর্যায়ের মাঝে অর্থাৎ পর্যায়ক্রমিকভাবে ম্যানিক আর ডিপ্রেসিভ এপিসোডের পালাবদল ঘটে। তাই খুব জরুরি একটা বিষয়- থেরাপিস্টের সাথে একজন ব্যক্তির নিজস্ব মুডের ফ্লাকচুয়েশন বা ওঠানামাটা উল্লেখ করা। কারণ ডিপ্রেশনের চিকিৎসা আর অন্যদিকে বাইপোলার ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা- দুটো ভিন্নধর্মী আর এ পার্থক্য গড়ে দেয় ম্যানিয়া অথবা ভিন্নভাবে বললে এলিভেটেড মুডের থাকা বা না থাকা। অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট একজন বাইপোলার ডিজঅর্ডারের রোগীকে হুট করেই ম্যানিয়াতে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং খুব সতর্কতার সাথে এ দুইটি আপাতদৃষ্টিতে এক মনে হওয়া বিষয়কে বিচার করা উচিৎ।
  • ঘুমের বেশ একটা তারতম্য হয়। যেটা দেখা যায়- ম্যানিক ফেইজ চলাকালীন সময়ে টানা বেশ কয়েকদিন ঠিকমত ঘুম না হওয়ার পরেও একজন ব্যক্তি যথেষ্ট সবল অনুভব করছেন কিন্তু সেই একই মানুষ যখন ডিপ্রেসিভ ফেইজে চলে যাচ্ছেন তখন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ দীর্ঘক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছেন।
  • মন ভাল হলে তো ভালই হয়, তাই না? এ নিয়ে প্রশ্ন করার কি আছে? কিন্তু মন খুব তীব্রভাবে ভাল থাকাটা এবং তাও আবার টানা সাতদিন বা তারও অধিক সময় ধরে, এটা কি স্বাভাবিক কিছু? এমনটা হতে পারে কেউ যদি বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন এবং এ সময়টা যতক্ষণ স্থায়ী থাকে ততক্ষণ একজন মানুষ খুব ভাল বোধ করতে পারেন তার অতিরিক্ত সৃজনশীলতা বা কর্মক্ষমতার জন্য। এই মন ভাল থাকাটা কখনও এমন হয় যে এটা যে অস্বাভাবিকতা সেটা নিরূপণ করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে কেননা শুধু এতটা মন ভাল থাকা অথবা পর্যায়ক্রমিকভাবে মুড অন- অফ হওয়াটা বাইপোলার ডিজঅর্ডার II এর ক্ষেত্রে এতটাই অল্প হয় যে বোঝাই যায় না।
  • কোনো কাজই ভালভাবে সম্পন্ন করতে না পারাটাও একটা কারণ হতে পারে। ব্যাপারটা আসলে হচ্ছে মন কোনো এক জায়গায় বা একটা সুনির্দিষ্ট কাজে স্থির হতে পারছে না। খুব তাড়াতাড়ি একটা কাজ থেকে আরেকটা কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে ফেলা এবং এরকম করতে থাকা একটা কাজও সম্পূর্ণ শেষ না করেই।
  • বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভুগতে থাকলে কেউ কেউ অসংলগ্ন কিছু আচরণ করে ফেলে। যেমন খুব সামান্য একটা ঘটনাতেও হয়তো মাত্রাতিরিক্ত রাগ দেখিয়ে ফেলা, একজন মানুষের সাথে সাবলীলভাবে না মিশে ক্ষণে ক্ষণে একেক জনের সাথে মেশার চেষ্টা করা বা অনেকটা হয়তো নিজের মুড চেঞ্জের উপর নিজেরই কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ না থাকা।
  • ম্যানিয়া অথবা হাইপোম্যানিয়া এপিসোডে থাকলে অনেক সময় খুব বেশি ঘন কথা বলা এবং খুব দ্রুত চিন্তা করে থাকে অনেকে। ঘন বা দ্রুত অনেকেই কথা বলে কিন্তু এদের ক্ষেত্রে এটা মাত্রা ছাড়ানো হয়ে থাকে। এরা তখন এতটাই দ্রুত কথা বলে যে উপস্থিত অনেকেই হয়তো তার কথার সাথে তাল মেলাতে পারছে না বা বুঝতে পারছে না। অর্থাৎ এদের চিন্তার পরিমাণ এবং সে অনুযায়ী কথা বলার প্রবণতা এতটাই বেশি হয় যে অপর পক্ষের মানুষটি হয়তো একটা শব্দ বলার অবকাশও পান না।
  • সাধারণভাবে বলতে গেলে নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে পারাটা খুব চমৎকার একটা বিষয়। কিন্তু বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ নিজের সম্পর্কে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকেন কিন্তু তবুও এদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো উপযুক্ত বা ফলপ্রসূ হয় না। কিন্তু এ ব্যাপারটাও তাদের চিন্তায় খেলে না কারণ তাদের কাছে যা হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে সবকিছুই খুব ঠিকঠাক মনে হয় সবসময়। ফলে দেখা যায় যে এরা কাজ করে বা সিদ্ধান্ত নেয় পরিণাম বা ফলাফল না ভেবে। তারা হয়তো এতটা খরচের কাজ করে ফেলতে উদ্যত হয় যতটা বাস্তবিকপক্ষে তাদের বহন করা সম্ভব না কিংবা তারা হয়তো হুট করেই একটা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
  • বাইপোলার ডিজঅর্ডারে যারা ভুগে থাকেন তাদের স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি আগ্রহ থাকে মদ্যপানের প্রতি বা মাদকের প্রতি। যখন তারা খুব উত্তেজিত থাকেন অর্থাৎ ম্যানিক দশায় থাকেন তখন তারা মদ্যপান করে থাকেন শান্ত হওয়ার জন্য আর ঠিক বিপরীত কারণে মদ্যপান করেন যখন ডিপ্রেসিভ দশায় থাকেন।

তবে এ কারণগুলোকে আবার এভাবেও দেখানো যায় যে কীভাবে তারা বিপরীত একটা সম্পর্ক বজায় রাখে। অর্থাৎ ম্যানিক এপিসোডে যা অনুভূত হচ্ছে ডিপ্রেসিভ এপিসোডে সেগুলো অনেকাংশেই উল্টো হয়ে যাচ্ছে।

কেন হয় বাইপোলার ডিজঅর্ডার?

আজ অবধি বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেন নি কেন বাইপোলার ডিজঅর্ডার হয়। তবে তাদের মতামত এরকম যে বেশ কিছু বিষয় জড়িত থাকে এই সমস্যাটার সঙ্গে।

  • দেখা গেছে মস্তিষ্কের গঠন এবং কাজ করার পদ্ধতি অনেকটা আলাদা বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের মাঝে, তাদের তুলনায় যারা সুস্থ বা হয়তো অন্য কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত।
  • কিছু নির্দিষ্ট জিন বহনকারী মানুষের মাঝে বাইপোলার ডিজঅর্ডার হওয়ার হারটা বেশি দেখা গেছে। তবে অবশ্যই এ কথা বলা যাবে না যে জিনই একমাত্র দায়ী ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। এর স্বপক্ষে প্রমাণ যা আছে তা হল- আইডেন্টিক্যাল টুইন নিয়ে গবেষণার ফলাফল এটাই বলে যে তাদের একজন যদি বাইপোলার ডিজঅর্ডারের শিকার হয়ও তবুও সবসময় অন্যজন আক্রান্ত হবেন না যদিও তারা একই জিন শেয়ার করেছে।
  • বংশপরম্পরায় এই রোগ বহন করার ঘটনা বেশ দেখা গেছে। যাদের কোনো ধরনের পারিবারিক ইতিহাস নেই বাইপোলার ডিজঅর্ডার থাকার, তাদের তুলনায়- যাদের মা-বাবা অথবা ভাই-বোনের এই অসুখটি আছে তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে এটাও সবসময় সত্য নয় যে পারিবারিক ইতিহাস থাকলেই কেউ এই রোগে আক্রান্ত হবেন।

 চিকিৎসা

চিকিৎসা বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে খুব তীব্র পর্যায়ের বাইপোলার ডিজঅর্ডারও ভাল হয়। মূলত এই অসুখটা সমগ্র জীবনব্যাপী। সবচেয়ে ইতিবাচক সমাধান হল একই সাথে মেডিকেশন এবং সাইকোথেরাপি নেওয়া যেটাকে বলা হয়ে থাকে টক থেরাপি। এই যে মুডের হুটহাট পরিবর্তনের সমস্যা এটা কারও কারও জীবনে একদম স্বাভাবিক হয়ে আসে আবার কখনও কখনও দীর্ঘ সময় পরে হলেও ফিরে আসে। সেজন্য সামগ্রিকভাবে অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট, পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক, নিজস্ব ব্যবহারের একটা ধারাবাহিক পরিবর্তন, সামাজিক জীবনে চলাফেরা এবং এরই মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন চলার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিৎ।

তথ্যসূত্র
Reader’s Digest
National Institute of Mental Health

-রাশিদ তাকী সাকীব
বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি, শাবিপ্রবি

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.