ডপলার প্রভাব (Doppler Effect) আমাদের সবার কাছেই পরিচিত। একটা উদাহরণ দিলে এই ব্যাপারটিকে আপনারা চিনতে পারবেন। ধরুন আপনি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, একটা মোটরসাইকেল দ্রুত গতিতে আপনার পাশ দিয়ে চলে গেল, আপনি শব্দের একটা ধারাবাহিক বৈচিত্র্য অনুভব করবেন–এটাই ডপলার প্রভাব। মোটরসাইকেল আপনার যত কাছে আসতে থাকবে, ততই নিম্ন স্বরের গুঞ্জন নাটকীয়ভাবে উচ্চ স্বরের গর্জনে পরিবর্তীত হতে থাকবে। আবার এর বিপরীত পরিবর্তনটা অনুভব করবেন যখনই মোটর পাশ কাটিয়ে দূরে যেতে শুরু করবে। মোটরসাইকেল যত কাছ দিয়ে যাবে, শব্দের পরিবর্তন হবে তত আকস্মিক; মোটরসাইকেলের গতি যত বেশি হবে, পরিবর্তন হবে তত বড় পরিসরে। শুধু মোটরসাইকেল না, শব্দ কম্পাঙ্কের এই বিশিষ্ট পরিবর্তন আমরা সচরাচর শুনতে পাই ছুটে চলা রেস-কার, এরোপ্লেন এবং ট্রেনের দ্বারা। এটা এতই পরিচিত যে গতি ইঙ্গিত করতে এটা ব্যবহার করা হয় এবং বাচ্চারা প্রায় এই সুর অনুকরণ করে খেলা করে, ভান করে তারা গাড়ি চালাচ্ছে !
তাহলে সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায়, ডপলার প্রভাব হচ্ছে শব্দ উৎস অথবা শ্রোতার গতির কারণে শ্রুত কম্পাঙ্কের পরিবর্তন। একটু কম পরিচিত হলেও এই প্রভাবকে সহজে লক্ষ্য করা যায় একটা স্থির শব্দ-উৎস এবং গতিশীল শ্রোতার মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপঃ আপনি স্থির ট্রেনে বসে আছেন, স্টেশনে ওয়ার্নিং বেল বেজে উঠল (আপনি জানেন বেলের কম্পাঙ্ক সবসময় স্থির)। কিন্তু ট্রেন চলতে শুরু করলে আপনি অনুভব করবেন কম্পাঙ্কের মান উচু থেকে নিচুতে নেমে যাচ্ছে। উৎস ও শ্রোতার মধ্যে আপেক্ষিক গতির জন্য কম্পাঙ্কের বাস্তব পরিবর্তনকে বলা হয় ডপলার সরণ (Doppler Shift)। এই Doppler Effect এবং Doppler Shift এর নামকরণ করা হয়েছে অস্ট্রিয় পদার্থবিদ ও গণিতবিদ Christian Johann Andreas Doppler (1803-1853) এর নামে যিনি 1842 সালে এ বিষয়টি নিয়ে প্রথম একটি অনুকল্প দিয়েছিলেন। 1845 সালে পদার্থবিদ C.H.D. Buys Ballot শব্দের উপর অনুকল্পটি পরীক্ষা করলেন। তিনি কয়েকজন বাদককে চলন্ত উন্মুক্ত ট্রেনে বসে আবার ট্রেনলাইনের পাশে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট সুর বাজাতে বলেন, তাদের সুর সঙ্গীত তিনি পর্যায়ক্রমে ট্রেনের ভিতর এবং বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং কম্পাঙ্কের পরিবর্তন হিসাব করলেন । এবং বিজ্ঞানী Doppler এর অনুকল্প সঠিক প্রমাণিত হল। এছাড়া 1861 সালে বিজ্ঞানী Ernst Mach ও 1865 সালে বিজ্ঞানী Rudolph König এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন।
গতিশীল গাড়ির হর্ণে ডপলার প্রভাবঃ (wikipedia)
ডপলার সরণ কী দ্বারা এবং কিভাবে ঘটে ? চিত্র-১, চিত্র-২ ও চিত্র-৩ এ স্থির বায়ু মাধ্যমে স্থির ও গতিশীল শব্দ-উৎস থেকে নির্গত শব্দ-তরঙ্গের পার্থক্য করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকটি তরঙ্গমুখ সেই বিন্দু থেকে গোলকাকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে যেই অবস্থান থেকে শব্দ নির্গত হয়েছিল। যখন উৎসটি স্থির, তখন শব্দ তরঙ্গের বায়ু সংকোচনকে প্রকাশকারী সবগুলো গোলক একই কেন্দ্রবিশিষ্ট হয় এবং উৎসের উভয় পাশের স্থির শ্রোতার কাছেই তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক একই হবে; [চিত্র-১]। যদি উৎস চলমান হয় [চিত্র-২], পরিস্থিতি অন্যরকম হবে। আগের মত যেখান থেকে শব্দ নির্গত হচ্ছে সেখানই থেকে প্রত্যেকটা বায়ু সংকোচন গোলকাকারে বের হবে, কিন্তু সেই উৎস বিন্দুটি এবার গতিশীল। এই গতিশীল উৎসবিন্দু বায়ু সংকোচনগুলোর মধ্যকার দূরত্ব একপাশে কমিয়ে দেয় এবং বিপরীতভাবে অপর পাশে বাড়িয়ে দেয়। এভাবে যেদিকে উৎসটি চলমান, সেই দিকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যায় [চিত্র-২ এর ডান পাশ] এবং বড় হয়ে যায় গতির বিপরীত দিকে [চিত্র-২ এর বাম পাশ]। সবশেষে যদি শ্রোতারা গতিশীল হয় [চিত্র-৩], তবে যে সংকোচন তাদের কাছে পৌছায় তাতে কম্পাঙ্ক বদলে যায়। উৎসের দিকে গতিশীল শ্রোতা ওগুলোকে উচ্চ কপাঙ্কে গ্রহণ করে এবং উৎসের বিপরীতে গতিশীল শ্রোতা ওগুলোকে নিম্ন কম্পাঙ্কে গ্রহণ করে।
চিত্র-১: উৎস থেকে শব্দ গোলকাকারে নির্গত হচ্ছে। উৎস, শ্রোতা এবং মাধ্যম (বায়ু) স্থির। তাই সবদিকে এবং সব শ্রোতার কাছে তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং কম্পাঙ্ক একই।
চিত্র-২: উৎসটি ডানদিকে গতিশীল। ফলে সময়ের সাথে উৎসবিন্দুর অবস্থান ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে (1,2,3,4,5 চিহ্নিত)।এবং তরঙ্গমুখ যে পরিবর্তীত বিন্দুগুলো থেকে নির্গত হচ্ছে, সেই বিন্দুগুলোকে কেন্দ্র করেই ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে গতির দিকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে এবং কম্পাঙ্ক বাড়ে, এজন্য ডানের শ্রোতা উচ্চস্বরের শব্দ শোনে। আর বামের শ্রোতা ক্ষেত্রে সবকিছু বিপরীত।
চিত্র-৩: একই রকম ফল দেখা যায় যখন শ্রোতারা উৎসের সাপেক্ষে গতিশীল হয়। একই সময়ে স্থির শ্রোতার তুলনায় উৎসের দিকে গতিশীল শ্রোতা অধিক তরঙ্গমুখ অতিক্রম করে, ফলে তার কাছে কম্পাঙ্ক বেড়ে যায়। অনুরূপ কারণে উৎসের বিপরীতে চলমান শ্রোতা একই সময়ে অপেক্ষাকৃত কম তরঙ্গমুখ অতিক্রম করে বিধায় তার কাছে কম্পাঙ্ক কমে যায়।
আমরা জানি, তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্কের মধ্যে সম্পর্ক সূচিত করে। যেখানে, হল শব্দের ধ্রুব দ্রুতি। শব্দ মাধ্যমের মধ্যে চলাচল করে এবং উৎস চলমান হোক বা না হোক শব্দের দ্রুতি ঐ মাধ্যমে সবসময় একই থাকে। তাই গুণন একটা ধ্রুবক। চিত্র-২ এর ডান পাশের শ্রোতা ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্য পাচ্ছে, তার মানে সে যে কম্পাঙ্ক শুনছে তা অবশ্যই উচ্চ বা বড় মানের। একইভাবে বাম পাশের শ্রোতা শুনছে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্য কিন্তু নিম্ন কম্পাঙ্কের শব্দ। এই একই ঘটনা ঘটছে চিত্র-৩ এ। উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পায় সেই শ্রোতা যে উৎসের দিকে গতিশীল এবং উৎসের বিপরীতে গতিশীল শ্রোতা শোনে নিম্ন কম্পাঙ্কের শব্দ। অর্থাৎ সাধারণভাবে, উৎস ও শ্রোতার কাছে আসার আপেক্ষিক গতি শ্রুত কম্পাঙ্ককে বৃদ্ধি করে এবং দূরে যাওয়ার আপেক্ষিক গতি কম্পাঙ্ককে হ্রাস করে। আপেক্ষিক গতি যত বেশি, এর প্রভাবও তত বেশি।
এবার চলুন ডপলার প্রভাবকে গণিতের ভাষায় দেখি,
একটি স্থির পর্যবেক্ষক এবং গতিশীল উৎসের ক্ষেত্রে আপাত কম্পাঙ্ক বা পর্যবেক্ষক যে কম্পাঙ্ক গ্রহণ করবে তা হলে আমরা লিখতে পারি,
যেখানে উৎসে কম্পাঙ্ক বা প্রকৃত কম্পাঙ্ক, উৎস ও পর্যবেক্ষকের সংযোজক রেখা বরাবর উৎসের দ্রুতি এবং শব্দের বেগ।
চিহ্ন দিয়ে পর্যবেক্ষকের দিকে গতি এবং চিহ্ন দিয়ে পর্যবেক্ষকের বিপরীত দিকে গতি প্রকাশ করা হয় যাতে কম্পাঙ্কের তারতম্য যথাযথ ভাবে হিসাব করা যায়। লক্ষ্যণীয়, যত বেশি উৎসের বেগ তত বেশি এই প্রভাব।
একইভাবে, একটি স্থির উৎস এবং গতিশীল পর্যবেক্ষকের ক্ষেত্রে আপাত কম্পাঙ্ক কে আমরা লিখতে পারি,
যেখানে, উৎস ও পর্যবেক্ষকের সংযোজক রেখা বরাবর পর্যবেক্ষকের দ্রুতি। এখানে ধনাত্বক চিহ্ন উৎসের দিকে গতি এবং ঋণাত্বক চিহ্ন উৎসের বিপরীতে গতি প্রকাশ করে।
তাই ডপলার প্রভাবের কারণে আপাত কম্পাঙ্কের সাধারণ সূত্রটি হবেঃ
আবার কিছু শর্ত ও রাশি যুক্ত করে এ সূত্রকে আরো ব্যবহারিক পর্যায়ে আনা যায়, যেমনঃ আমরা মাধ্যমের বেগের কথা ভাবতে পারি। যদি মাধ্যমের বেগ কে বিবেচনায় আনি তবে সূত্রটি হয় এমন,
আবার উৎস ও শ্রোতার গতিপথ সরলরৈখিক না হলে এ সূত্র খাটে না। তাই উৎসের গতিপথ যদি শ্রোতা ও উৎসের সংযোজক রেখার সাথে ঘড়ির কাটার বিপরীতে কোণে থাকে, সেক্ষেত্রে সূত্রটি দাঁড়ায়,
সনিক বুম
পরিস্থিতি কেমন হবে যদি গতিশীল উৎসের বেগ শব্দের বেগের নিকটবর্তী কিংবা শব্দের বেগকে অতিক্রম করে যায় ? জেট প্লেনের ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটাই হয়।
ধরুন, একটা জেট প্লেন আপনার দিকে উচ্চ বেগে ধেয়ে আসছে (ভয় পাবেন না, আপনার পাশ দিয়ে চলে যাবে।) এবং ওটা কম্পাঙ্কের শব্দ নির্গত করছে। আমরা কিছুক্ষণ আগেই জেনেছি প্লেনের বেগ যত বেশি হয়, তত বেশি হবে ডপলার সরণ এবং তত বেশি হবে শ্রুত বা আপাত কম্পাঙ্ক । এখন শব্দের বেগের কাছাকাছি গেলে এর মান অসীমের কাছাকাছি হয়, কারণ তখন এর হর হয় শূন্যের নিকটবর্তী। উৎসটি শব্দের বেগে গমন করলে উৎসের সামনের প্রতিটি অগ্রগামী তরঙ্গ তার পূর্ববর্তীটির উপরিপাতিত হয়। শ্রোতা এদের সবগুলোকে একই মুহূর্তে গ্রহণ করবে এবং তাই কম্পাঙ্ক হয়ে যাবে অসীম। (প্লেনের শব্দের বেগ অতিক্রম করার পূর্বে কিছু লোক মনে করত এটা অসম্ভব, কারণ তারা ধারণা করত ওমন গঠনমূলক উপরিপাতন যে চাপ তৈরি করবে তা প্লেনকে ধ্বংস করার পক্ষে যথেষ্ট হবে।) যা হোক, যদি উৎস শব্দের বেগকে হার মানায়, তাহলে শ্রোতা কোন শব্দই শুনবে না যতক্ষণ না উৎসটা তাকে অতিক্রম করে। শ্রোতাকে অতিক্রম করে দূরে যেতে থাকা উৎস থেকে নির্গত শব্দ কিছুক্ষণ পূর্বের সেই শব্দের সাথে মিশে যায় যা নির্গত হয়েছিল উৎসটির কাছে আসার সময়। শব্দের এই মিশ্রণ কিছুটা বিশ্রী শোনায়, কিন্তু একটা চমৎকার ঘটনা ঘটে। সৃষ্টি হয় একটা সনিক বুম (sonic boom)।
চিত্র-৪: শব্দের চেয়ে দ্রুত ধাবমান উৎস থেকে শব্দ তরঙ্গগুলো গোলকাকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সেই বিন্দু কেন্দ্র করে যে অবস্থান থেকে তারা নির্গত হয়েছে। উৎসটি কিন্তু এদের প্রত্যকের সম্মুখে অবস্থান করে। বেগুনী রেখা বরাবর (তিন মাত্রায় এটা আসলে একটা কোণক) সৃষ্ট গঠনমূলক ব্যতিচার একটা ঘাত-তরঙ্গ (shock wave) তৈরি করে, এটাকেই বলা হয় সনিক বুম। এক্ষেত্রে উৎসের বেগ যত বেশি হয়, কোণ তত ছোট হয়।
এখানে এ কোণক বরাবর গঠনমূলক ব্যতিচার দেখানো হয়েছে যা তৈরি হয়েছে সেখানে যুগপৎ ভাবে আগত একই শব্দ তরঙ্গ থেকে। এই উপরিপাতন যে আন্দোলন তৈরি করে তাই সনিক বুম। কোণকের ভেতর ব্যতিচারের বেশিরভাগটা ধ্বংসাত্বক, সেজন্য ঘাত-তরঙ্গের তুলনায় সেখানে শব্দের তীব্রতা (intensity) বেশ কম হয়।
নিচের চিত্র গুলোতে লাল বিন্দুটি দ্বারা গতিশীল শব্দ উৎস এবং উৎস থেকে নির্গত শব্দ তরঙ্গকে নীল বৃত্তগুলো চিহ্নিত করা হয়েছেঃ (Wikipedia)
1.Doppler Effect: এখানে , তাই উৎসের সামনের শ্রোতার কাছে এবং পিছনের শ্রোতার কাছে ।
2.Breaking the sound barrier: এখানে , তাই উৎসের সামনের শ্রোতার কাছে (মানে, উৎস যতক্ষণ তার কাছে না পৌঁছায় ততক্ষণ সে কিছুই শুনবে না) এবং পিছনের শ্রোতার কাছে ।
3.Supersonic: এখানে , তাই উৎসের সামনের শ্রোতার কাছে (মানে, শ্রোতা শব্দ শোনার আগে উৎস তাকে পার করে চলে যাবে) এবং পিছনের শ্রোতার কাছে ।
4.Hypersonic: এখানে । ডানের চিত্রে লাল উৎসটি mach 5 বা শব্দের চেয়ে 5 গুণ বেগে গতিশীল এবং বামের-টা হল mach 7 গতিবেগে চলা জেটপ্লেন NASA X-43 এর CFD চিত্র।
একটা বিমান দুইটি সনিক বুম সৃষ্টি করে, একটা হয় তার শীর্ষ (nose) থেকে এবং অপরটা তার পশ্চাৎ (tail) থেকে [চিত্র-৫]। আবার স্পেস শাটল অবতরণ টিভিতে সম্প্রচারের সময় প্রায়ই দুইটি সুস্পষ্ট বুম শোনা যায়। এদের সময় ব্যবধান হবে ততটুকুই যতটুকু সময়ে সম্পূর্ণ শাটলটা একটা বিন্দুকে অতিক্রম করতে পারে। বেশিরভাগ সময় ভূমিতে থাকা শ্রোতারা সনিক বুম সৃষ্টিকারী বিমানকে দেখতে পায় না, কারণ ঘাত-তরঙ্গের কোণক তাদের কাছে পৌঁছানোর আগে বিমানটা পাশ কাটিয়ে চলে যায়, যেমনটা দেখা যাচ্ছে চিত্র-৫ এ। সনিক বুম শুনতে অনেকটা বাজ পড়ার বা বিস্ফোরণের শব্দের মত। এর ঘাত-তরঙ্গ প্রতি বর্গমিটারে প্রায় 167 MW ক্ষমতার শক্তি নিঃসরণ করতে পারে, শব্দের তীব্রতা লেভেল ছাড়িয়ে যেতে পারে 200 dB। যদি কোন উচ্চ গতির বিমান কম উচ্চতায় উড়ে, তবে সনিক বুমের ভিতরে তৈরি চাপ ধ্বংসাত্বক রূপ নিতে পারে – জানালা ভেঙে যেতে পারে এবং স্নায়ুকে করতে পারে উত্তেজিত এবং বিঘ্নিত। সনিক বুমের বিধ্বংসীতার কারণে জনবহুল লোকালয়ের উপর সুপারসনিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ।
চিত্র-৫: দুটি সনিক বুম সৃষ্টি হয়েছে প্লেনের শীর্ষ ও পশ্চাৎভাগ দ্বারা এবং ভূমির শ্রোতারা তা শুনছে প্লেন চলে যাওয়ার পর। কিন্তু কেবল চলে গেলেই হবে না, শ্রোতা যতক্ষণ ঘাত-তরঙ্গের সীমার ভিতর না পৌঁছায়, ততক্ষণ সে কিছুই শুনবে না।
সনিক বুম একটি বৃহত্তর পরিচিত ঘটনার উদাহরণ যার নাম bow wake। একটা bow wake তৈরি হয় যখন তরঙ্গ-উৎস তরঙ্গ সঞ্চালনের তুলনায় বেশি বেগে চলে। পানি তরঙ্গ যেখানে সৃষ্টি হয় সেখান থেকে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং উৎসের পেছনে পানিতে সৃষ্ট bow wake এর আকৃতি হয় ইংরেজি ‘V’ এর মত [চিত্র-৬]। আরো অদ্ভুত ও বিচিত্র bow wake তৈরি হয় যখন কোন অতিপারমাণবিক কণা একটা মাধ্যমের ভেতর দিয়ে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ভ্রমণ করে।এ কথাটা শুনে(পড়ে) পাঠকদের খটকা লাগতে পারে, কারণ আমরা জানি কোন কিছু আলোর চেয়ে দ্রুত যেতে পারে না। মূলত এক্ষেত্রে ঐ মাধ্যমের ভিতর আলোর দ্রুতি, এর সাথে তুলনা করা হয়েছে। শূন্য মাধ্যমে আলোর দ্রুতি । কিন্তু কোন মাধ্যমের মধ্যে এটা কমে যায়, যেমন পানিতে আলোর দ্রুতি প্রায় । সবসময় হয়; এক্ষেত্রে মাধ্যমের ভেতর অতিপারমাণবিক কণার বেগ হলে হতে পারে, কিন্তু কখনো হয় না; তাই পদার্থবিদ্যার নিয়ম অক্ষুন্নই থাকে। কণাটি যদি চলার পথে আলো উৎপন্ন করে, তাহলে ঐ আলো ছড়িয়ে পড়ে কণাটির গতিপথের সাথে নির্দিষ্ট কোণ করে এবং কোণক আকারে [চিত্র-৭]। এই ধরনের bow wake কে বলা হয় চেরেনকভ বিকিরণ (Cerenkov Radiation); কণা-পদার্থবিদ্যায় এটা খুব পরিচিত এবং আলোচিত একটা বিষয়।
চিত্র-৬: পানিতে হাঁসের এবং জাহাজের গতির ফলে তৈরি bow wake। গঠনমূলক ব্যতিচার অধিকতর সুগঠিত wake উৎপন্ন করে। wake এর ভেতরের অংশে তরঙ্গের এ আচরণ অপেক্ষাকৃত কম থাকে, ভেতরে বেশিরভাগটাই ধ্বংসাত্বক ব্যতিচার।
চিত্র-৭: Research Reactor Pool এর এই নীল আভা হল চেরেনকভ বিকিরণ, যা পানিতে আলোর চেয়ে দ্রুত গতিশীল কোন অতিপারমাণবিক কণার ভ্রমণের ফলাফল।
ডপলার সরণ এবং সনিক বুম শব্দের খুবই আকর্ষণীয় বিষয়। শুধু শব্দে নয়, যেকোন তরঙ্গেই হয়; তবে শর্ত হল পর্যবেক্ষক ও উৎসের মধ্যে আপেক্ষিক গতি থাকতে হবে। ডপলার প্রভাবকে ব্যাপকভাবে ব্যবহারও করা হয়। উদাহরণস্বরূপঃ চিকিৎসাবিদ্যায় শব্দোত্তর শব্দের (ultrasound) ডপলার সরণ দিয়ে রক্তের বেগ হিসাব করা হয়। আবার রাডারের মাধ্যমে ডপলার সরণ দিয়ে নির্ণয় করা হয় গাড়ির বেগ। আবহবিদ্যায় এটা ব্যবহৃত হয় ঝড়ো মেঘের গতি অনুসরণে। যেমনঃ ‘ডপলার রাডার’এর মাধ্যমে আমরা বায়ুপ্রবাহের বেগ, দিক, এবং আসন্ন আবহাওয়ায় বৃষ্টি বা তুষারপাতের সম্ভাব্য পরিমাণ ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাই। এখানেই শেষ নয়, আমরা যদি আলোর ডপলার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে এই আর্টিকেল দৈর্ঘ্যে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়ে যাবে। তাই সে আলোচনায় আজ যাব না। কিন্তু কয়েকটা উদাহরণ না বললেই নয়। যেমনঃ আলোর ডপলার প্রভাবকে ব্যবহার করেই দূর গ্যালাক্সিগুলো থেকে আসা আলো পরীক্ষা করা হয় এবং আমাদের সাপেক্ষে তাদের গতি নির্ণয় করা হয়। যদি গ্যালাক্সিগুলো দূরে সরে যেতে থেকে তবে তাদের থেকে আসা আলোর কম্পাঙ্ক কমে যাবে এবং বেড়ে যাবে তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য, অর্থাৎ আলো বর্ণালীর লালের দিকে সরে যাবে; এটাকে বলে লোহিত সরণ (red shift)। এর বিপরীত ঘটনা ঘটলে আলোর বর্ণ নীলের দিকে সরে যায় এবং এর নাম নীল সরণ (blue shift)। আলোর এই আচরণ থেকেই জানা সম্ভব হয়েছে গ্যালাক্সিগুলোর পশ্চাদপসরণ সম্পর্কে, জানা গেছে মহাবিশ্ব সম্প্রসারনের কথা, নির্ণয় করতে পেরেছি আমাদের মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর। এজন্য ডপলার সরণের পর্যবেক্ষণ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানকে বিশেষ করে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে। বহুদূর এগিয়ে গেছে মহাবিশ্বের উদ্ভব ও সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান। [লেখাটি ইতিপূর্বে বিজ্ঞান ব্লগে প্রকাশিত]
-মুবতাসিম ফুয়াদ
শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিজ্ঞান ব্লগে লেখাটির লিঙ্কঃ http://bigganblog.org/2017/01/শব্দের-ডপলার-প্রভাব-এবং-স/