সৌরজগতে একসময় নয়টি গ্রহই ছিলো, পরবর্তীতে প্লুটোকে গ্রহ তালিকা হতে বাদ দিয়ে আটটি করা হয়। তবে সম্প্রতি নবম আরেকটি গ্রহ এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং তা প্লুটো নয়!
সম্প্রতি দুজন জোতির্বিদ, মাইকেল ই. ব্রাউন এবং কনস্ট্রানটিন ব্যাটিজিন ঘোষনা করেন যে তাঁদের হাতে প্লুটোকে ছাড়িয়ে আরো দূরে নতুন একটি বস্তুর উপস্থিতি থাকার মতো যথেষ্ট সম্ভাবনাময় তথ্য রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক মাইকেল ই. ব্রাউনের ভাষ্য অনুযায়ী, “আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ওই এলাকায় কিছু একটা আছে।” তবে এই দুজন বিজ্ঞানী সত্যিকার অর্থে কোনো গ্রহ খুঁজে বের করেননি তাই গ্রহের তালিকা সহসাই বিবর্ধিত হচ্ছে না।
The Astronomical Journal এর প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে ড. ব্রাউন এবং ড. ব্যাটিজিন নতুন গ্রহটি পাওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক তুলে ধরেন: তাঁরা মূলতঃ দূরবর্তী প্রায় আধাডজন ছোটখাটো বস্তুর উপবৃত্তাকার গতিপথের তথ্য দিয়েছেন। চমকের বিষয়টি হলো ছয়টি কক্ষপথের সবগুলোই সৌরজগতের বাইরের অংশে একই চতুর্ভাগের এলাকা ঘুরে আসে এবং একই কোণে বেঁকে থাকে। ড. ব্যাটিজিন এর মতে একই সাথে সবগুলো বস্তুর এই আচরণের সম্ভাবনা ১৪ হাজার বারের মধ্যে ১ বার। সেই কারণেই ধারনা করা হচ্ছে এই অঞ্চলে নবম কোনো একটি গ্রহ তার মধ্যাকর্ষন বলে এদেরই একই দিকে টেনে নেয়।
বিজ্ঞানীদের গণনা যথাযথ হতে হলে এই গ্রহটির ভর হতে হয় অন্ততঃ পৃথিবীর ভরের সমান এবং সম্ভবতঃ এর চেয়ে অনেক বেশী, হয়তোবা ছোটখাট নেপচুনের মতো যার ক্ষূদ্র অথচ ঘন বায়ুমন্ডলের নীচে একটি পাথুরে সারকেন্দ্র (core) রয়েছে এবং ভর পৃথিবীর ভরের দশগুন। এই ভর প্লুটোর ভরের ৪৫০০ গুন।
প্লুটো সুর্যের কাছ থেকে যখন সবচেয়ে দুরে থাকে তখন দূরত্ব দাঁড়ায় ৪৬০ কোটি মাইল। আর এই নবম গ্রহটি যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে তখনও সূর্য থেকে এর দূরত্ব হয় ২০০০ কোটি মাইল, আর যখন সবচেয়ে দূরে থাকে তখন দূরত্ব দাঁড়াতে পারে ১০,০০০ কোটি মাইল। সূর্যের চারদিকে একবার ভ্রমনে ব্যয় হয় ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ বছর। ড. ব্রাউন বলেন, “আমাদের এর কক্ষপথ সম্বন্ধে ভালো মাপজোঁক আছে, তবে দুঃখজনক দিকটি হলো আমরা জানি না এটি কক্ষপথের ঠিক কোথায় অবস্থান করছে।”
ফ্রান্সের কোট ডি আজুর পর্যবেক্ষনকেন্দ্রের সৌরজগতের গতিবিশেষজ্ঞ আলেসান্দ্রো মরবিডেলি বলেন তিনি এই গ্রহটির ব্যাপারে যথেষ্টই প্রত্যয়ী। তিনি বলেন, “গ্রহটিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আমার মনে হয় এরই মধ্যে এর পিছু ধাওয়া করা শুরু হয়েছে।” ড. ব্রাউন এটি নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সৌরজগতের মানচিত্র হালনাগাদ করায় ভুমিকার রাখলেন। ২০০৫ সালের জানুয়ারীতে তিনি নেপচুনের পেছনে কুইপার বেল্ট নামক বরফের জঞ্জালের মধ্যে প্লুটোর আকারের একটি বস্তু আবিষ্কার করেছিলেন যা এখন এরিস (Eris) নামে পরিচিত।
পরের বছর আন্তর্জাতিক মহাকাশ পরিষদ প্লুটোর গ্রহের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে একে বামন গ্রহ নামের নতুন শ্রেনীতে ফেলে দেয়। কেননা, একটি পরিপূর্ন গ্রহকে এর কক্ষপথে সর্বোসর্বা হওয়া উচিৎ, কিন্তু প্লুটো তা নয়। প্লুটোর বাইরে একটি লুকানো গ্রহের নমুনা পাওয়া যায় তার দু’বছর আগে। কুইপার বেল্ট নেপচুন কে ছাড়িয়ে সূর্য হতে ২৮০ কোটি মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত, যা সূর্য হতে নেপচুনের দূরত্বের দ্বিগুনের কিছু কম। জোতির্বিদগণের ধারণা অনুযায়ী এর পরে প্রায় সবটাই কেবল ফাঁকা শূন্যতা।
ফলে ড. ব্রাউন এবং তাঁর দুজন সহকর্মী যখন ৮০০ কোটি মাইল দূরে প্রায় ৬০০ মাইল প্রশস্ত একটি বরফের জগৎ খুঁজে পেলেন যা এমনকি সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা অবস্থাতেও কুইপার বেল্ট হতে যথেষ্টই দূরে তখন তাঁরা বেশ বিষ্মিত হয়েছিলেন। ড. ব্রাউন যার নাম দিয়েছিলেন সেডনা, ওই দূরবর্তী অঞ্চলে তার উপস্থিতি সম্বন্ধে কারোই সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা ছিলো না, তবে এর আবিষ্কারের ফলে সবাই ধারনা করেছিলো সেডনার মতো দেখতে আরো অনেক কিছুই ওই এলাকায় পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কিন্তু রহস্য আরো ঘনীভূত করে দিয়ে আর কিছুই পাওয়া গেল না।
অবশেষে, ২০১৪ সালে সেডনা আবিষ্কারকালে ড. ব্রাউনের সহকারী চ্যাডউইক ট্রুজিলো এবং কার্নেগী ইনস্টিটিউশন ফর সায়েন্সের জোতির্বিদ স্কট এস. শেফার্ড কুইপার বেল্ট পেরিয়ে সেডনার কক্ষপথের মতো পথে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট বস্তু পাওয়ার ঘোষনা দেন। ড. ট্রুজিলো এবং ড. শেফার্ড উল্লেখ করেন কুইপার বেল্টের অনেক বস্তুরই একই ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং তাঁরা এই বস্তুগুলোর কক্ষপথকে আলোড়িত করতে পারে এমনন একটি গ্রহের সম্ভাবনার কথা বলেন। ড. ট্রুজিলো বলেন, “এটাই আমাদের পাওয়া সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা ছিলো”।
তবে এই ব্যাখ্যা হতে বস্তুটি ঠিক কি তার সম্বন্ধে কোনো ধারনা পাওয়া যায়নি বলে জানান ড. ব্রাউন। তিনি বলেন, “তাত্ত্বিকগণ এটিকে গুরুত্বের সাথে দেখেননি। তাঁরা এটিকে গুরুত্ব দেননি কেননা এই তাত্ত্বিক বস্তুটি তাঁদের বোধগম্য ছিলো না।” অদ্যাবধি এর অদ্ভুতুড়ে কক্ষপথ সত্যিই উপস্থিত আছে বলে মনে হচ্ছে। ড. ব্রাউন বলেন তিনি এবং ড. ব্যাটিজেন “গত দুই বছর ধরে বসে দেয়ালে মাথা ঠুকে মরছেন”।
⚫ বিজ্ঞানপত্রিকা ডেস্ক