সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে হাজার হাজার ফুট উপরে বসবাস করা খুব সহজ কোন কাজ নয়। এতো উচ্চতায় বাতাসে অল্প পরিমাণ অক্সিজেন থাকে, সূর্য থেকে আসা অতি বেগুনী রশ্মির (UV) পরিমাণও বেশী হয় এবং খাদ্য সরবরাহ ঋতু ভেদে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এসব বাধা বিপত্তি তিব্বতীয় মালভূমিতে (যা গড়ে ৪ হাজার মিটার উঁচু) প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষের বসবাসকে থামাতে পারেনি।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা তিব্বতীয়দের জিনোমের নমুনার সেট নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আর এখান থেকে তাঁরা প্রায় সাতটি নতুন বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেছেন যার মাধ্যমে তিব্বতীদের জিন অতি উচ্চ খাড়া এলাকায় শরীরের ভর সূচক BMI এবং ভিটামিনের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিজেকে পরিবর্তিত বা মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন যাবৎ জেনে এসেছেন তিব্বতীয় মালভূমির মানুষসহ নেপালের বিখ্যাত পর্বত আরোহণকারী শেরপাগণ সমুদ্র সীমার বিদ্যমান অক্সিজেনের চেয়েও ৪০ ভাগ কম মাত্রার অক্সিজেনের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। বেশীরভাগ পর্বতারোহীর দেহই অল্পসময়ের জন্য হিমোগ্লোবিনের প্রসারণ বাড়িয়ে উচ্চ পরিবাহিতা সহ্য করতে সাহায্য করে। আর তিব্বতীয়দের শরীর জৈব রাসায়নিক অভিযোজনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়ে চরম পরিবেশে অক্সিজেনকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে শিখে গিয়েছে। এটা তিব্বতীদের জন্য সুখবর কারণ অতিরিক্ত হিমোগ্লোবিন রক্তকে সংবহন করা কঠিন করে তোলে এবং স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কিন্তু এক্ষেত্রে তিব্বতীয়ানদের অভিযোজনের ব্যাখ্যা কিছুটা রহস্যজনক। পূর্বের গবেষণায় দেখা গিয়েছিলো যে EPAS1 এবং ELGN1 নামে দুটি জিন হিমোগ্লোবিনের ভূমিকা হ্রাস করে এবং অক্সিজেনের ব্যবহার ত্বরান্বিত করে। অন্যান্য জিন এ কাজে জড়িত কিনা সেটা দেখার জন্য অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জি ইয়াং এবং চীনের ওয়েংজু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জি বিং জিং এর নেতৃত্বে একটি দল ৩০০৮ জন তিব্বতীয়ান এবং ৭২৮৭ জন অ-তিব্বতীয়ানদের জিন তুলনামূলক পরীক্ষানিরীক্ষা পরিচালনা করেন।
এসময় দলটি তিব্বতীয়ানদের জেনোমে কিছু সাধারণ বৈচিত্র খুঁজে পান। এরপর তাঁরা এই বৈচিত্র্য কি প্রাকৃতিক ভাবে ছড়িয়েছে নাকি হঠাৎ করেই হয়েছে সেটা গণনা করেন। EPAS1 এবং ELGN1 জিন দুটি পূর্ব অনুমান অনুসারেই বিবর্তনীয় অভিযোজনের শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে সামনে চলে আসে। MTHFR, RAP1A, NEK7, ADH7, FGF10, HLA-DQB1 এবং HCAR2 এই আটটি জিনও একই কাজ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
ADH7 জিনের পরিবর্তনে তিব্বতীয়দের অধিক ওজন এবং BMI ফলাফলের সাথে জড়িত যা, দেহকে ভবিষ্যৎ সংকটের সময়ের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে সাহায্য করে। MTHFR এর পরিবর্তন দেহে পুষ্টির অভাবের সময় সাহায্য করে। এটি ভিটামিন ফুলেট উৎপাদন ত্বরান্বিত করে যা গর্ভধারনের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। এবং HLA-DQB1 পারিবারিক জিনে বসবাস করে যা ইমিউন সিস্টেমে প্রোটিন নিয়ন্ত্রণ করে। ইয়াং বলেন, এছাড়াও অন্য চারটি জিনের কি কার্যক্রম তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তাঁরা উচ্চ পর্যায়ের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে থাকতে পারে।
এছাড়াও দলটি তিব্বতীয়ান এবং চীনের হান বংশের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির সময় ঠিক করতে এই বিশ্লেষণ ব্যবহার করেছেন। আনুমানিক ৪৭২৫ বছর আগে বা প্রায় ১৮৯ প্রজন্ম আগে এদের মাঝে বিভাজনের সৃষ্টি হয়।
সল্ট লেক সিটির ইউটাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রজনন বিদ্যা বিশেষজ্ঞ লিন জরড যিনি বহু উচ্চ পর্যায়ের প্রজনন গবেষণা করেছেন, তিনি এই গবেষণা সম্পরকে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন- এই বৃহৎ আকারের সমীক্ষা প্রজনন গবেষণায় অনেক অনুপ্ররণা জোগাবে। এসব উপাত্ত গবেষকদের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সনাক্ত করতে এবং মিথ্যা ঘটনাকে বাতিলে সাহায্য করবে। যদিও পরিসংখ্যানিক উপাত্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ তবে সাথে সাথে আমাদের কার্যকারণমূলক গবেষণাকেও অনুসরণ কোড়টে হবে। হতে পারে সেটা ইঁদুর ভিত্তিক অথবা ভিট্রো পদ্ধতিতে যাতে জৈবিক ভিত্তিক পর্যায়ে যাচাই করা যায়।[sciencemag- অবলম্বনে]
-শফিকুল ইসলাম