অদূর ভবিষ্যতে একটি মাত্র ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে সারা জীবনের জন্য কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া সম্ভব হতে পারে।
কিছু কিছু মানুষ জন্মগতভাবেই মিউটেশনের মাধ্যমে উদ্ভব এমন জিন নিয়ে জন্মায় যার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি প্রাকৃতিকভাবেই কম থাকে। এই প্রক্রিয়ার কোনো প্বার্শ প্রতিক্রিয়াও দেখা যায় না। সম্প্রতি প্রাকৃতিক মিউটেশনের মতো একই কাজ প্রানীর দেহে কৃত্রিমভাবে করা হয়েছে ইঞ্জেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে।
এই সম্ভাবনাময় চিকিৎসাব্যবস্থার সাথে মানবদেহের কিছু কোষের অভ্যন্তরস্থ ডিএনএ-র স্থায়ী পরিবর্তনসাধন জড়িত। কাজেই মানুষের দেহে এটি পরীক্ষা করে দেখার আগে চিকিৎসক ও গবেষকদের সবদিক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে নিতে হবে। তবে একবার সফলতা এলে এটি হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কোটি কোটি মানুষকে এই পদ্ধতিতে জন্মগত রোগব্যাধি হতে স্থায়ীভাবে নিরাময় করা সম্ভব হবে এবং দীর্ঘ ও সুস্বাস্থ্যময় জীবন দেয়া যাবে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে অনুষ্ঠিত একটি জিনোমিক্স মিটিংএ গবেষক লরেনজ মায়ার প্রানীর উপর ইঞ্জেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে ডিএনএ পরিবর্তনের এই ফলাফল পেশ করেন। তিনি এই গবেষণা সম্পর্কে বলেন, “এই গবেষণার ধরনাটি হবে এককালীন। জীবদেহে এটির প্রভাব হবে স্থায়ী”। মায়ার AstraZeneca নামের একটি ঔষধ উৎপাদন ও গবেষনা প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় পদে রয়েছেন। তিনি একটি নব উদ্ভাবিত ডিএনএ-বিষয়ক গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেন যার নাম CRISPR। এই পদ্ধতিটি ডিএনএ সম্পাদনার সাথে জড়িত। অবশ্য মায়ার এই পদ্ধতিতে মানুষের উপর গবেষণা করে দেখার বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দেন নি।
ধনী দেশগুলোতে একচতুর্থাংশ মানুষই মারা যান হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে। যার পেছনে আবার দায়ী উচ্চ মাত্রার LDL কোলেস্টেরল। রক্তে এই কোলেস্টেরলের উপস্থিতি হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। এই উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল কমানোর জন্য কোটি কোটি মানুষ নিয়মিত স্ট্যাটিন নামক একটি ওষুধ সেবন করে থাকেন। এর ফলে অনেক মানুষ নানাবিধ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াতেও আক্রান্ত হন।
প্রকৃতিক প্রকরণ
২০০৫ সালে আবিষ্কৃত হয় কিছু কিছু মানুষ জন্মগত ভাবে খুব স্বল্পমাত্রার কোলেস্টেরল ধারন করেন। তাঁদের শরীরে একটি মিউটেশনের (ডিএনএ-র কোডিংএ বিক্ষিপ্ত পরিবর্তন) কারণে যকৃতে PCSK9 নামের একটি প্রোটিন তৈরি বাধা প্রাপ্ত হয়। “তাঁদের রক্ত সংবহন তন্ত্র তথা হৃদরোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায় কম এবং বলাই বাহুল্য ওষুধ সেবন জনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও তাঁরা মুক্ত।” বলছিলেন গিলস ল্যামবার্ট, যিনি ইউনিভার্সিটি অব রিইউনিয়ন আইল্যান্ডে PCSK9 প্রোটিন নিয়ে গবেষনা করছেন।
এই প্রোটিনটি স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে সঞ্চালিত হয় এবং রক্তনালিকার পৃষ্ঠে বিদ্যমান একটি প্রোটিনকে ভেঙ্গে দেয়। এই দ্বিতীয় প্রোটিনটি রক্তের LDL কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রনে ভুমিকা রাখে। কাজেই PCSK9 যত দ্রুত এই দ্বিতীয় প্রোটিনটিকে রক্ত নালিকা হতে অপসারিত করতে থাকে ততোই দ্রুত রক্তে LDL কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু জিনগত মিউটেশনের কারণে যেসব মানুষ PCSk9 এর ঘাটতিতে থাকেন তাঁদের শরীরে LDL নিয়ন্ত্রক প্রোটিনটি উচ্চ মাত্রায় থাকে, ফলে তাঁদের কোলেস্টেরলের মাত্রাও নিয়ন্ত্রিত থাকে।
এই প্রভাবটি অনুকরণ করার জন্য দুটি কোম্পানী অনুমোদিত এ্যান্টিবডি তৈরি করেছে যা রক্তের PCSK9 প্রোটিনটি অপসারণ করতে পারে। এই এ্যান্টিবডিগুলো বেশ কার্যকর এবং ল্যাম্বার্টের কথা অনুযায়ী অদ্যাবধি তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায় নি। তবে এর মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি সত্যিই কমে কিনা এখনো সেধরনের কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য উন্মুক্ত হয় নি, তবে মার্চ মাস নাগাদ এই বিষয়ক ফলাফল ঘোষিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে, মুষ্কিলের বিষয় হলো, এই এ্যান্টিবডি ওষুধগুলো মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়বহুল এবং প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহ অন্তর ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়। কাজেই এগুলো কার্যকরভাবে কোলেস্টেরল কমালেও তা স্ট্যাটিনের মতো কোটি মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছুবে না। এর বাইরে গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় PCSK9 রোধী ওষুধ তৈরির সব প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে।
তবে জিন সম্পাদনা হতে পারে এই ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী বিকল্প। CRISPR পদ্ধতি প্রয়োগ করে AstraZeneca কোম্পানীর গবেষক দল ইঁদুরের রক্ত হতে মানুষের PCSK9 প্রোটিন উৎপদনকারী জিনের প্রকরণ নিষ্ক্রিয় করতে পেরেছেন। তাঁরা প্রানীর দেহে একটি CRISPR Cas 9 প্রোটিন এবং একটি প্রদর্শক RNA-ক্রম ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে কাজটি করেছেন। এই RNA গাইডটি Cas 9 প্রোটিনটিকে জিনের সুনির্দিষ্ট স্থানে যুক্ত হতে পথ নির্দেশনা দেয়। এটি জিনটিকে ওই স্থানে কেটে দেয় এবং ডিএনএ যখন নিজস্ব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিরাময় করে তখন দেখায় যায় যে জিনটির কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে গেছে।
এই প্রক্রিয়ায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এ্যান্টিবডি প্রবেশ করিয়ে যেমন ফল পাওয়া যায় তার চেয়েও ভালো ফল পাওয়া গেছে। এবং তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই প্রক্রিয়াটি স্থায়ী; এন্টিবডির মতো কিছুদিন অন্তর ইঞ্জেকশন নিতে হয় না।
এপিজিনোম সম্পাদনা
এই পদ্ধতিতে জিন সম্পাদনা, মিউটেশনের মাধ্যমে জন্মগতভাবে PCSK9 উৎপাদন-অক্ষমতার খুব কাছাকাছি ফলাফল দেয়। এটি তাই এ্যান্টিবডির মাধ্যমে চিকিৎসা নেওয়ার চেয়ে অনেক গ্রহনযোগ্য ও প্রাকৃতিক। তাই, লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজিস্ট প্যাট্রিসিয়া ম্যাকগেটিগানের মতে “এটি প্রকৃতই কর্যক্ষম একটি পদ্ধতি হতে পারে”।
তবে জিন সম্পাদনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, লক্ষ্যের বাইরে গিয়ে অযাচিতভাবে এটি অন্যান্য জিনের উপর পরিবর্তন সাধন করে ফেলতে পারে। সবচেয়ে খারাপ ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে কোষগুলো ক্যান্সারজাতীয় হয়ে উঠতে পারে।
তবে, এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, CRISPR পদ্ধতিটি দিনে দিনে উন্নততর হয়ে উঠছে। কিছু গবেষকদল ও প্রতিষ্ঠান CRISPR প্রোটিনের এমন প্রকরণ তৈরি করেছে যেগুলো লক্ষ্যের প্রতি এতই অবিচল থাকে যে এর মাধ্যমে যদিওবা অযাচিত মিউটেশন হয়, তা হয় কোষের স্বাভাবিক মিউটেশনের তুলনায় কম। তবে এতকিছুর পরেও ল্যাম্বার্ট মনে করেন মানুষের উপর এই পরীক্ষা করতে আরো নিদেন পক্ষে একদশক সময় লাগবে।
তবে এই পদ্ধতির আরেকটি অপেক্ষাকৃত মোলায়েম বিকল্প প্রয়োগ হতে পারে CRISPR প্রোটিনটির মাধ্যমে ডিএনএ-তে পরিবর্তন না ঘটিয়ে কেবল PCSK9 উৎপাদনকারী জিনটিকে বিকল করে দেয়া। এই পদ্ধতিতে জিনোম পরিবর্তন না করে এপিজিনোম এর প্রতি নিশানা করা হয়। এপিজিনোম হলো জীবের বাহ্যিক কর্মকান্ডের ফলে ডিএনএ-তে সৃষ্ট “রাসায়নিক ট্যাগ”। বর্তমানে অনেকেই মনে করছেন গতানুগতিক জিনোম সম্পাদনার চেয়ে এপিজিনোম সম্পাদনাই রোগ নির্মূলে অধিকতর কার্যকর হবে। [New Scientist অবলম্বনে]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]