বিগ ব্যাংয়ের অন্যতম বড় রহস্যের সমাধান

0
672

মহাবিশ্বের গঠনপ্রকৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভের উদ্দেশ্যে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চের (সংক্ষেপে সার্ন) বিজ্ঞানীরা ১৯৫৪ সাল থেকে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে যাচ্ছেন। ফ্রান্সের এই সংস্থাটিতে নিযুক্ত প্রকৌশলী ও পদার্থবিদরা কণাত্বরক যন্ত্র ও ডিটেক্টরের সাহায্যে প্রকৃতির বিভিন্ন সূত্র ও পদার্থের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্তর্নিহিত বিষয়সমুহ জানার চেষ্টা করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সম্প্রতি সার্নের বিজ্ঞানীরা সম্ভবত পদার্থবিজ্ঞানের  স্ট্যান্ডার্ড মডেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের সেই গবেষণাপত্র কিছু দিন আগে নেচার ফিজিক্সে প্রকাশিত হয়েছে।

বিগ ব্যাং তত্ত্বানুসারে,” মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় সমসংখ্যক পদার্থ (ম্যাটার) ও প্রতিপদার্থ (অ্যান্টিম্যাটার) তৈরি হয়েছিল। এই ম্যাটার এবং অ্যান্টিম্যাটার আবার পরস্পরের সাথে সংঘর্ষের ফলে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যায় এবং শক্তি বিকিরণ করে। “ তাই এই সূত্রমোতাবেক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে খুবই অল্প সংখ্যক কণিকা (বিশেষত বিকিরণ) বিদ্যমান থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমাদের এই মহাবিশ্ব অসংখ্য কণার সমন্বয়ে গঠিত। তাহলে সূত্রের কোথাও নিশ্চয়ই কোন ঘাটতি আছে। কিন্তু সেটা কি?  পদার্থ ও প্রতিপদার্থের সংখ্যার মাঝে এতটা ব্যাবধানইবা কিভাবে সৃষ্টি হল?

কণাপদার্থবিজ্ঞানের সাহায্যে এই অপ্রতিসাম্যতার খানিকটা ব্যাখ্যা করা গেছে। তবে বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময়ে বিভিন্ন পদার্থ সৃষ্টির কারণ এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। তত্থ্যের অপ্রতুলতার কারণে বিজ্ঞানীরা তাই ধারণা করেন, ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটারের   (অথবা কণা এবং প্রতিকণা) ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের  সূত্র  এক নয়। তারা কেন একে অপরের থেকে ভিন্ন? সূত্রগুলো ঠিক কোথায় পৃথক হয়ে পড়ে? এই প্রশ্নগুলো গবেষকদের মাঝে বহুকাল ধরে এক ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে রেখেছে।

ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটারের ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের এই আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে চার্জ প্যারিটি ভায়োলেশন বলে। মেসন নামক হ্যাড্রোনিক কণিকায় এটি প্রাথমিকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছিল। তবে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার জন্য অপর হ্যাড্রোনিক কণা ব্যারিয়নকে বেছে নেন। তাদের ধারণা ছিল, ব্যারিয়ন কণাতে চার্জ প্যারিটি ভায়োলেশন খুঁজে পেলে তারা মহাবিশ্বের মোট পদার্থের পরিমাণ বের করতে পারবেন। যার ফলে অপ্রতিসাম্য মহাবিশ্বের মূল কারণটাও জানা সম্ভব হবে। দীর্ঘ কয়েক দশকের প্রচেষ্টার পরে সার্নের বিজ্ঞানীরা তাদের এই গবেষণায় সফল হয়েছেন বলে দাবি করেছেন।

ব্যারিয়ন কণাতে চার্জ প্যারিটি ভায়োলেশন পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানীরা লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (সংক্ষেপে এলএইচসি) ডিটেক্টর ব্যাবহার করেন। তারা প্রথমে ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটার ব্যারিয়নের মাঝে সংঘর্ষ ঘটান। এর ফলে তারা উভয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভিন্ন উপাদান তৈরি করে। গবেষকরা সেই মুহূর্তে ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটার ব্যারিয়নের পরিমাণ নির্ণয় করেন। তখন এদের পরিমাণে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। গবেষক দলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটার ব্যারিয়নের ক্ষয় হওয়ার পরিমাণে যথেষ্ট অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে এই  ব্যাবধান প্রায় ২০ শতাংশের মত। কিন্তু চার্জ প্যারিটি ভায়োলেশনের উপযুক্ত প্রমান হিসেবে এই আবিষ্কার এখনও পরিসংখ্যানগতভাবে অসম্পূর্ণ রয়েছে।  তবে অনেকেই মনে করছেন এটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

এই অভূতপূর্ব ও অনবদ্য আবিষ্কার বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময়ে, এমনকি এর আগে ও পরের ঘটনাও অনুধাবনে অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে বলেই আশা করা হচ্ছে। সার্নের বিজ্ঞানীরা যদি প্রমান করতে পারেন ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানের  সূত্রগুলো পৃথক , তবে আমাদের জানা বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ই নতুন করে চিন্তা করতে হবে। এমনকি বাহ্যিক পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের চিন্তাধারাটা পুর্নমুল্যায়ন করারও প্রয়োজন হতে পারে।

-নাসরুল্লাহ মাসুদ

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.