ধীর রূপান্তরে বিবর্তনের যাদু

0
480

সিন্ডারেলার রূপকথায় যাদুর বুড়ি তার হাতের কাঠির সাহায্যে কুমড়াকে ঘোড়ার গাড়ি, ইঁদুরকে ঘোড়া এবং গিরগিটিকে গাড়ি চালক বানিয়ে ফেলেন। অন্য আরেক গল্পে যাদুর মন্ত্রের প্রভাবে রাজকুমারকে ব্যাঙে এবং পরবর্তীতে ব্যাঙকে রাজকুমারে পরিণত করা হয়। রূপকথার গল্পের মতো এক ধাপে একটি জটিল প্রাণ থেকে অন্য একটি জটিল প্রাণে রূপান্তর করা একদমই বাস্তবতা বহির্ভূত। কিন্তু বিবর্তনের মাধ্যমে একটি জটিল প্রাণ থেকে আরেকটি জটিল প্রাণের উৎপত্তি হচ্ছে। কীভাবে? বাস্তবতা বহির্ভূত জিনিস কীভাবে সম্ভব হলো? বাস্তব জগতে জটিলতাপূর্ণ জিনিস যেমন ব্যাঙ ও রাজকুমার, বাঘ ও সিংহ, বট গাছ ও বানর, লাউ ও কুমড়া, আমি-তুমি-আপনি ইত্যাদির অস্তিত্ব কীভাবে সম্ভব হলো?

জটিল প্রাণ কীভাবে এই জগতে বিকাশ লাভ করলো- এই প্রশ্নটি ইতিহাসে শত শত বছর ধরে মানুষকে ভাবিয়েছে। ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরেই এটি মানুষকে গোলক ধাঁধায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কেউই এর সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। এই সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষ একে ব্যাখ্যা করার জন্য নানা ধরনের কাল্পনিক গল্পের অবতারণা করলো। উদ্ভট এসব গল্প রূপকথার গল্পের কাতারেই পড়ে। অবশেষে ঊনিশ শতকে এই প্রশ্নের উত্তর হাজির করেন একজন বিজ্ঞানী। তিনি এর মাধ্যমে এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা করেছেন বললে হবে না, বলতে হবে খুব চমৎকারভাবে শত শত বছরের এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন ও ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি হচ্ছেন বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন।

ডারউইনের উত্তরটি হচ্ছে মানুষ, কুমির, বানর ইত্যাদির মতো জটিল প্রাণ হুট করেই আজকের মতো হয়ে যায়নি। খুব ধীরে ধীরে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তর পার হয়ে একটু একটু করে আজকের এই অবস্থানে এসেছে। প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তরে তাদের অতি সামান্য হারে পরিবর্তন হয়েছে। মূল প্রাণী থেকে পরবর্তী প্রজন্মে অল্প একটু পরিবর্তন তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। অল্প একটু পরিবর্তনে নতুন প্রজন্ম মূল প্রাণীর মতোই আছে বলে মনে হবে, তেমন পার্থক্য ধরা পড়বে না। কিন্তু অল্প অল্প করে যখন অনেকগুলো প্রজন্ম অতিক্রম হবে তখন মূল প্রাণীর সাথে পার্থক্যটা ভালোভাবেই স্পষ্ট হয়ে দেখা দিবে।

মনে মনে একটা পরীক্ষা করি। ধরে নেই আমরা লম্বা পায়ের ব্যাঙ তৈরি করতে চাই। পরীক্ষার শুরুটা নিজেদের সুবিধামতো করতে পারি। সুবিধার জন্য প্রথমে অনেকগুলো ছোট পায়ের ব্যাঙ বাছাই করে নেই। আমাদের কাজ হবে এই ছোট পা ওয়ালা ব্যাঙ থেকে বড় পায়ের ব্যাঙ তৈরি করা।

Picture1

প্রথমে তাদের সবকটির পায়ের দৈর্ঘ্য মেপে নেই। এদের মাঝে যেগুলো ‘তুলনামূলকভাবে’ লম্বা পায়ের অধিকারী তাদের চিহ্নিত করি। লম্বা পায়ের কিছু পুরুষ ব্যাঙ ও কিছু নারী ব্যাঙ আলাদা করে বিশেষ স্থানে এদের দিয়ে বংশবিস্তার করাই। এর ফলে অনেকগুলো ব্যাঙাচি উৎপন্ন হবে। ব্যাঙাচিগুলো দেখতে দেখতে একসময় পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে পরিণত হবে। নতুন উৎপন্ন হওয়া ব্যাঙগুলোর মাঝে যাদের পায়ের দৈর্ঘ্য বেশি তাদের কিছু পুরুষ ও কিছু নারীকে নিয়ে আবার বংশবিস্তার করাই।

এভাবে ১০ প্রজন্ম পর্যন্ত বিশেষভাবে বংশবিস্তার করিয়ে গেলে আগ্রহোদ্দীপক কিছু একটা লক্ষ্য করা যাবে। ১০ম প্রজন্মের ব্যাঙগুলোর পায়ের স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য, মূল প্রজন্মের ব্যাঙগুলোর পায়ের স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ এমনটাও দেখা যেতে পারে যে, ১০ম প্রজন্মের সকল ব্যাঙের পায়ের দৈর্ঘ্যই ১ম প্রজন্মের যেকোনো ব্যাঙের পায়ের দৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশি। মাঝে মাঝে ১০ প্রজন্মেই এমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নাও দেখা যেতে পারে। এমন ফলাফলের জন্য মাঝে মাঝে ২০ বা ৩০ বা তার চেয়েও বেশি প্রজন্ম পর্যন্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক ধৈর্য নিয়ে করতে পারলে বুক ফুলিয়ে বলা যাবে- ‘আমি নতুন এক ধরনের ব্যাঙ তৈরি করেছি যা তার পূর্বপুরুষের চেয়ে লম্বা পায়ের অধিকারী।’

জটিল প্রাণের মাঝে পরিবর্তন সাধন করতে কোনো যাদুর কাঠির প্রয়োজন হয়নি। কোনো মন্ত্র বা যাদুর ইশারা দরকার লাগেনি। যে পদ্ধতিতে আমরা লম্বা পায়ের ব্যাঙ তৈরি করেছি তার নাম ‘নির্বাচিত উৎপাদন’ বা ‘বাছাইকৃত উৎপাদন’ (Selective Breeding)।
কোন কোন ব্যাঙ কার সাথে বংশবিস্তার করবে আর কোন কোন ব্যাঙ করবে না তা বাছাই করে দেবার মাধ্যমে মূল প্রজন্ম থেকে কিছুটা ভিন্নরকম ব্যাঙ তৈরি করেছিলাম। পদ্ধতিটা খুব সহজ, তাই না? শুধুমাত্র একটি বৈশিষ্ট্য- লম্বা পা নিয়ে কাজ করে সহজেই ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছিলাম। এটি অন্তত এই দিক থেকে অবাক করা একটি ফলাফল যে, আমরা ছোট পা ওয়ালা ব্যাঙ নিয়ে শুরু করেছিলাম, এবং এক সময় ছোট পা থেকে বড় পা পেয়েছি। কিন্তু একটি মাত্র বৈশিষ্ট্যকে না নিয়ে একাধিক বৈশিষ্ট্যকে নিয়ে কাজ করলে কেমন ফলাফল পাওয়া যাবে? ধরি শুধুমাত্র ছোট পা-ই নয়, পাশাপাশি ব্যাঙ নয় এমন কোনো প্রাণী যেমন গিরগিটি আকৃতির গোধিকা (newt) নিয়ে শুরু করলাম। তাহলে কি এটি থেকে লম্বা পায়ের ব্যাঙ উৎপন্ন করতে পারবো?

গোধিকার দেহের তুলনায় পায়ের আকৃতি ছোট। প্রায় ব্যাঙের পায়ের সমানই। অন্তত ব্যাঙের পেছনের দিকের পা (পশ্চাদ পদ)-এর সমান। এই পা-গুলোকে তারা লাফানোর জন্য ব্যবহার করে না, এগুলো ব্যবহৃত হয় হাঁটার জন্য। এদের মোটামুটি লম্বা লেজ আছে, যেখানে ব্যাঙের কোনো লেজই নেই। পাশাপাশি গোধিকা ব্যাঙের চেয়ে অনেক লম্বা। এমন পরিস্থিতিতে গোধিকাকে ব্যাঙে রূপান্তর প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। এখানে উল্লেখ করে রাখা উচিৎ যে বাংলাদেশের পরিচিত গুইসাপও গোধিকা নামে পরিচিত। বাংলাদেশের গুইসাপ (Monitor Lizard) থেকে এটি একদমই ভিন্ন।

গোধিকা
গোধিকা

তবে যদি ধরে নেই আমাদের আয়ু অফুরন্ত, কখনোই বুড়ো হবো না বা মরে যাবো না তাহলে একবার চেষ্টা করা যেতে পারে। হ্যাঁ, দেখতে প্রায় অসম্ভব হলেও, শুধুমাত্র ‘নির্বাচিত উৎপাদনে’র মাধ্যমেই হাজার হাজার প্রজন্ম অতিক্রম করে গোধিকাকে ব্যাঙের মতো করে তৈরি করা যাবে। এক্ষেত্রে হয়তো সময় খুব বেশি লাগবে, কিন্তু তারপরেও হাজার হাজার বার চেষ্টা করার পর অল্প অল্প পরিবর্তনের মাধ্যমে একসময় সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর দেখা পাওয়া যাবে। এক প্রজন্ম থেকে তার পরের প্রজন্মের পার্থক্য হয়তো খুবই ছোট কিন্তু এটি যখন হাজার প্রজন্ম পরের কোনো গোধিকার সাথে তুলনা করা হবে তখন অবশ্যই অনেক অনেক বড় পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে।

এখানে খুব কঠিন কিছু করতে হচ্ছে না, শুধুমাত্র বাছাই করে দিতে হচ্ছে কোন পুরুষটার সাথে কোন নারীটা মিলে বংশবিস্তার করবে আর কোনটা করবে না। যেসব গোধিকার মাঝে তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণ ব্যাঙ-সদৃশ বৈশিষ্ট্য আছে তাদের আলাদা করে করাতে হবে এবং যেসব গোধিকার তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণ ব্যাঙ-সদৃশ বৈশিষ্ট্য আছে তাদের দূরে রাখতে হবে। এ থেকে যে প্রজন্ম তৈরি হবে তাদের বেলাতেই এমনভাবে বাছাই করতে হবে। এভাবে হাজার হাজার বার চালিয়ে যেতে হবে।

এই ফলাফলটা হয়তো হাজার হাজার প্রজন্ম চেষ্টা করার পর নাও পাওয়া যেতে পারে। হাজার বারে পাওয়া না গেলেও লক্ষবার কিংবা কোটিবার চেষ্টা করলে পাওয়া যাবে। শুধু সময়ের ব্যাপার। কিছু ক্ষেত্রে সময় কম লাগবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগবে।
এক্ষেত্রেও কাছাকাছি প্রজন্মের কোনো দুটি গোধিকাকে তুলনা করলে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য দেখা যাবে না। সকলকেই ‘বাপের বেটা বাপের মতোই হয়েছে’ বলে মনে হবে। কিন্তু অনেকগুলো প্রজন্ম পার হয়ে গেলে যখন তুলনা করা হবে তখন দেখা যাবে কিছু পার্থক্য আসলেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। লেজের স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য কমে আসছে এবং পেছনের পায়ের স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে অনেক অনেকগুলো প্রজন্ম যখন পার হয়ে যাবে তখন লক্ষ্য করা যাবে লম্বা পা ও ক্ষুদ্র লেজের অধিকারী নবীনরা তাদের পেছনের লম্বা পা-কে হাঁটার কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যাঙের মতো লাফানোর কাজেও ব্যবহার করছে। এবং অন্যান্য অঙ্গগুলোর ব্যবহারেও পরিবর্তন এনেছে।

কাল্পনিক এই কর্মযজ্ঞে আমরা নিজেরা নির্বাচনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে বংশবৃদ্ধি করাচ্ছি। এটা নতুন কিছু নয়। কৃষকেরা এই কৌশল হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে। ভালো মানের ফসল কিংবা বেশি উৎপাদনশীল গবাদি পশু তৈরি করতে এই কৌশল অহরহ ব্যবহার হয়ে আসছে। যেমন ফলন ভালো হয়েছে এমন ধান বা বৈরি পরিবেশে টিকে থাকতে পেরেছে কিংবা রোগবালাই কাটিয়ে ওঠতে পেরেছে এমন ধানের বীজ নিয়ে পরবর্তীতে ধান চাষ করেছে। এভাবে পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্বাচিত উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকেরা সবদিক থেকে ইতিবাচক একটি ফসল তৈরি করেছে। আরেকটি উদাহরণ দেই। মোটা-তাজা ও বেশি দুধ দেয় এমন গরুকে বাছাই করে বংশবিস্তার অধিকতর উপযোগী গরু উৎপাদন করেছে কৃষকেরা।

কৃত্রিমভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রাণী তৈরি হবার চমৎকার উদাহরণটি হচ্ছে কুকুর। শেয়াল থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মাধ্যমে কুকুরের উৎপত্তি হয়েছে। আর এটি প্রাকৃতিকভাবে হয়নি, মানুষের কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে কুকুরের উৎপত্তি হয়েছে।

কুকুরের উৎপত্তি হয়েছে কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে।
কুকুরের উৎপত্তি হয়েছে কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে।

প্রাকৃতিকভাবেও কি এমন পরিবর্তন হয়? হ্যাঁ, অবশ্যই! অহরহ হয়। চার্লস ডারউইন প্রথম অনুধাবন করেছিলেন এমন ধরনের পরিবর্তনশীল বংশবিস্তার কারো বাছাই ও হস্তক্ষেপ ছাড়াই হচ্ছে। তিনি খেয়াল করে দেখলেন প্রয়োজনের তাগিদে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবেই এমনটা ঘটে চলছে।

কোনো একটা প্রাণী সেটা গোধিকা হোক, ব্যাঙ হোক, হাতি হোক, ঘোড়া হোক প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো এক দিক থেকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য অন্য সব প্রাণী থেকে উত্তম। যদি লম্বা পা কোনো প্রাণী যেমন ব্যাঙ বা গিরগিটির টিকে থাকার জন্য সহায়ক হয় তাহলে লম্বা পা-ওয়ালারা অন্যদের তুলনায় কম মরবে। যেমন ব্যাঙ ও গিরগিটির বেলায় কোনো বিপদ থেকে বা কোনো শিকারি প্রাণীর কবল থেকে পালিয়ে যেতে লম্বা পা খুব কাজে আসতে পারে। কিংবা বাঘ ও হরিণের খেয়াল করতে পারি। হরিণের পা যদি তুলনামূলকভাবে বেশি লম্বা হয় তাহলে তা বাঘের থাবা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। আবার বাঘের পা লম্বা হলে সহজে হরিণ ধরতে পারবে যা তাকে বেশি দিন বাঁচতে সাহায্য করবে এবং এটি বংশবিস্তারেও প্রভাব রাখবে।

Picture4
প্রাণীরা তুলনামূলকভাবে কম মরবে তার মানে অন্যদের চেয়ে বেশি পরিমাণ বংশবিস্তার করতে পারবে অর্থাৎ বেশি পরিমাণ সন্তান সন্ততি উৎপাদন করতে পারবে। ফলে সঙ্গী হিসেবে লম্বা পা ধারণকারীদের সাথে বংশবিস্তারের জন্য অধিক পরিমাণ সদস্য তৈরি হবে। যারা লম্বা পায়ের অধিকারী তারা শিকারের কবল থেকে বেঁচে যাবে এবং যারা ছোট পায়ের অধিকারী তারা শিকারি প্রাণীর কবলে পড়তে থাকবে। এর ফলে ছোট পা-ওয়ালা সদস্যদের পরিমাণ কমতে থাকবে। একদিকে বেঁচে যাওয়ার ফলে বাড়ছে অন্যদিকে ধরা খাওয়ার ফলে কমছে। এভাবে একসময় লম্বা পায়ের আধিক্য দেখা দিবে এবং লম্বা পায়ের সদস্যরাই রাজত্ব করে বেড়াবে। কয়েক প্রজন্ম পরে আমরা খেয়াল করে দেখবো লম্বা পায়ের জিন (বংশগতির বাহক) ধারণকারী সদস্যদের দিয়ে ভরে গেছে এলাকা।

Picture5
আমরা কৃত্রিমভাবে লম্বা পায়ের পরীক্ষাটা করেছিলাম এবং যে ফলাফল পেয়েছিলাম তার প্রভাব এবং প্রাকৃতিকভাবে হওয়া লম্বা পায়ের প্রভাব একই হবে। আমরা যা করেছিলাম তা প্রাকৃতিকভাবেই হচ্ছে অহরহ। এর জন্য বাইরে থেকে কারো কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। দরকার নেই কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বার, দরকার নেই কোনো মানুষের সাহায্য, দরকার নেই কোনো দেব দেবতার ইচ্ছা অনিচ্ছা। প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রাণীরা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। চমৎকার এই প্রক্রিয়াটার নাম ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ (Natural Selection)।

পরিবর্তিত হয়ে চলে তার মানে কিন্তু এই না যে প্রাণীরা ভেতরে ভেতরে পরিবর্তিত হয়। একটা উদাহরণ দেই। জিরাফ লম্বা গলার অধিকারী, লম্বা গলা এদেরকে গাছ থেকে পাতা ছিড়ে খেতে সাহায্য করে। একটা সময় ছিল যখন খাটো গলার জিরাফও ছিল। তাহলে তাদের গলা কি ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে বড় হয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে? না, আসলে প্রক্রিয়াটা এমন নয়। লম্বা গলার জিরাফেরা বেশি বেশি করে পাতা খেতে পেরেছে যা তাদেরকে বেশিদিন বেঁচে থাকতে ও বেশি পরিমাণ সন্তান তৈরি করতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে যাদের গলা ছোট তারা খাদ্য কম পেয়েছে যা তাদের আয়ু এবং সন্তানাদির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। এভাবে চলতে চলতে একসময় দেখা গেল ছোট গলার সদস্যদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে এবং লম্বা গলার সদস্যরা রাজত্বের সবটাই দখল করে নিয়েছে। ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়াটা মূলত এরকম। এই ব্যাপারটা অনেকেই ভুলভাবে বুঝে থাকে। এই অংশটা পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা জরুরী।

 

লম্বা গলার জিরাফ উঁচু ডালের পাতা খাচ্ছে।
লম্বা গলার জিরাফ উঁচু ডালের পাতা খাচ্ছে।

দেখতে গোধিকার মতো প্রাণীর পূর্বপুরুষদের যথেষ্ট পরিমাণ সময় দিলে, তথা অনেক অনেক প্রজন্ম পর্যন্ত সময় দিলে তারা ব্যাঙ সদৃশ প্রাণীতে পরিণত হতে পারে। আরো বেশি পরিমাণ সময় দিলে মাছেদের পূর্বপুরুষরা পরিণত হতে পারে বানরের মতো প্রাণীতে। এর চেয়েও বেশি পরিমাণ সময় দিলে এককোষী ব্যাকটেরিয়া-সদৃশ প্রাণীরাও মানুষের মতো উন্নত প্রাণীতে পরিণত হতে পারে। এবং ঠিক এই জিনিসটাই ঘটেছে পৃথিবীর বুকে। আমরা মানুষেরা আসলে এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকেই ক্রমান্বয়িক রূপান্তরের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে এসেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে যত ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদ জন্মেছে তাদের সকলেই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে।
অতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া থেকে আজকের যুগের এত এত প্রাণিবৈচিত্র্য তৈরি হতে অনেক বেশি পরিমাণ সময়ের দরকার। এতই বেশি যে তা আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে পৃথিবীর বয়স এর চেয়েও বেশি। ব্যাকটেরিয়া থেকে জটিল প্রাণের বৈচিত্র্য তৈরি হতে যে পরিমাণ সময় লাগবে তার তুলনায় পৃথিবীর উৎপত্তির সময় যদি কম হয় তাহলে তো ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে যায়। পৃথিবীর উৎপত্তির আগেই পৃথিবীতে প্রাণ অনেকটা গরুর আগেই বাছুরের মতো! ফসিল রেকর্ড বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানি ৩ হাজার ৫০০ মিলিয়ন (সাড়ে ৩ বিলিয়ন)-এর আগে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল। পৃথিবীর উৎপত্তি এরও অনেক অনেক আগে হয়েছিল, অর্থাৎ প্রাণের বিকাশ ও ধীর গতির রূপান্তরের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সময় আছে পৃথিবীর হাতে।

এটাই ডারউইনের তত্ত্ব, একে বলা হয় ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন’ (Evolution by Natural Selection)। মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে অসাধারণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাঝে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব একটি। আমাদের জানা অজানা সমস্ত প্রাণী সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করে এই তত্ত্ব। জীবজগতের অনেক রহস্যেরই সমাধান পাওয়া যায় এই তত্ত্বে। সামগ্রিক দিক থেকে এই তত্ত্বটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী অধ্যায়ে বিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এখানের জন্য এতটুকু জেনে রাখা প্রয়োজন যে, বিবর্তন খুবই ধীরগতির একটি প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে সাথে খুব অল্প অল্প পরিবর্তনের মাধ্যমে বিবর্তন এগিয়ে চলে।

Picture7
ধীরগতির এই প্রক্রিয়া সচল আছে বলেই বিড়াল, খরগোশ, প্রজাপতি, ফড়িং ইত্যাদির মতো চমৎকার প্রাণীদের অস্তিত্ব আছে। যদি খুব দ্রুত পরিবর্তন হতো তাহলে আকস্মিক পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে সকলে মারা যেত। ফলাফল পৃথিবীতে থাকতো না কোনো প্রাণবৈচিত্র্য, নিষ্প্রাণ হাহাকার নিয়ে ধু ধু করতো চারিদিক। তাই যাদুর বুড়ি যখন যাদুর মাধ্যমে ব্যাঙকে রাজকুমারে পরিণত করে তখন সেটা হবে বাস্তবতা বহির্ভূত ব্যাপার। অবাস্তব।

বিবর্তন হচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্যের সত্যিকার ব্যাখ্যা। এবং এই ব্যাখ্যা কার্যকরও। কেউ যদি বলে হঠাৎ করে জটিল প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছে, যেমন কাঠের মূর্তিতে প্রাণ পেয়ে হয়েছে, আকাশ থেকে পড়েছে কিংবা বহির্বিশ্ব থেকে উড়ে এসে পড়েছে তাহলে সেটাও অবাস্তবতার মাঝেই পড়ে। ব্যাঙ থেকে রাজকুমার তৈরি হওয়া আর কাঠের দেহ থেকে প্রাণ তৈরি হওয়া একই রকম অবাস্তব। এগুলো অবাস্তব, এগুলো এক অর্থে রূপকথার গল্পের কাতারেই পড়ে। এত জটিল প্রাণ হুট করে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। যেটা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সেটা হচ্ছে ক্ষুদ্র সরল প্রাণ থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে জটিল প্রাণ তৈরি হওয়া।

মিষ্টি কুমড়া থেকে গাড়ি তৈরি হওয়াও একারণে অবাস্তব। তার উপর গাড়ি জড় বস্তু। জড়-গাড়ি বিবর্তিত হয় না। অন্তত প্রাকৃতিকভাবে হয় না। মানুষ যখন গাড়িকে কৃত্রিমভাবে উন্নত করে ইঞ্জিন, প্রপেলার, পাখা লাগিয়ে উড়োজাহাজ তৈরি করে তখন বলা যায় জড় গাড়িটি পরিবর্তিত হয়েছে। এগুলো তৈরি সম্ভব হয়েছে মানুষের মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ডের ফল। এবং মানুষের মস্তিষ্ক ধীর গতির বিবর্তনের প্রক্রিয়াতেই গঠিত হয়েছে।

মানুষের মস্তিষ্ক যখন বিবর্তিত হয়েছে তখন এটিকে ব্যবহার করে অনেক জটিল যন্ত্রই তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। যেমন সেলফ ড্রাইভিং কার, স্মার্ট ঘড়ি, স্মার্ট ফোন, এলইডি বাতি, এলইডি টেলিভিশন, কম্পিউটার, মহাকাশযান ইত্যাদি। উল্লেখ্য এগুলোর কোনটিই কিন্তু অলৌকিকভাবে কিংবা কোনো ‘ট্রিক’-এর মাধ্যমে হয়নি। সবগুলোরই সুন্দর বিবর্তনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। এই বইয়ের বাকি অংশে বাস্তবতার এমন বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করা হবে। এদের মাঝে কোনো অলৌকিকতা নেই, সবই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট। যেগুলোকে বলেছিলাম ‘কাব্যিক যাদু’। কাব্যিক একারণে যে, এর সাহায্যে সত্যতার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সৌন্দর্যের কাছে মঞ্চের যাদুকরের পারফরমেন্স কিছুই না। বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা রূপকথার অবাস্তবতাকেও হার মানায়। বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার সাথে তুলনা করলে এগুলোকে খুবই সস্তা ও সামান্য বলে মনে হবে।

বাস্তবতার যাদু কোনো ট্রিক নয়, কোনো অতিপ্রাকৃত জিনিস নয়। খুব সহজভাবেই অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর। অসাধারণ কারণ এটিই সত্যি। অসাধারণ কারণ এটিই সত্যিকার বাস্তবতা। [The Magic of Reality, by Richard Daekins, Free Press, New York, 2011 এর ছায়া অবলম্বনে। ছবি অলঙ্করণঃ Dave McKean। ]

সিরাজাম মুনির শ্রাবণ
বিভাগীয় সম্পাদক, জিরো টু ইনফিনিটি

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.