ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি ১১ : স্ট্যান্ডার্ড মডেল

0
1172

কেতন উড়িয়ে যখন নতুনের জয়ধ্বনি ঘোষিত হয়, তখন বাজে পুরোনোর বিদায় রাগিনি। সামাজিক জীবনে পুরোনোকে বিদায় দিতে, দীর্ঘদিনের নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক ছিন্ন করতে বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে ওঠে। নস্টালজিক হয়ে ওঠে মন। কিন্তু পদার্থবিদ্যার জগতে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলে চলে না। সানাই বাজিয়ে মহাসমারোহে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার রীতিই এখানে আছে, পুরোনোর জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলার মানুষ এ জগতে মিলবে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী যায়, নতুন নতুন তত্ত্বে সমৃদ্ধ হয় পদার্থবিদ্যার জগৎ। দলে দলে তরুণ গবেষকরা ঝাঁপিয়ে পড়েন নতুন এই বিজ্ঞানের নাড়ি-নক্ষত্র জানার উদ্দেশ্যে।

৭ অক্টোবর ১৯০০ সাল। জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। হেনরিখ রুবেন্স তাঁর গবেষণা সহকর্মী। ওইদিন রুবেন্স আর তাঁর স্ত্রী বেড়াতে আসেন প্ল্যাঙ্কের বাড়িতে। সেখানেই রুবেন্স জানান কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের একটা পরীক্ষার কথা। পরীক্ষা থেকে কী ফল পেয়েছেন তাও বলেন। আসলে সমস্যাটা ছিল বিকিরণ সংক্রান্ত। আদর্শ কৃষ্ণবস্তু, যে নাকি শোষণ করতে পারে তারওপর পড়া সবুটুকু আলো এবং তাপশক্তি, তারপর সেই কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ করে আলোকরশ্মি। কিন্তু সেই বিকিরণ প্রক্রিয়া মেনে চলে না তখনকার পাদার্থবিজ্ঞানের চিরায়ত দুটি গতিতত্ত্ব। সেই গতিতত্ত্বের একটা হলো নিউটনের গতিবিদ্যা এবং ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুত্গতিবিদ্যা। কৃষ্ণবস্তর বিকিরণের ব্যাখ্যার জন্য অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী লুডভিক বোলজম্যান একটা সূত্র দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা পুরোপুরি সেই বিকিরণের ব্যাখ্যা দিতে পারে না। অন্য দিকে জার্মান বিজ্ঞানী উইলেহেম ভিন একটা সূত্র দাঁড় করিয়েছিলেন। এছাড়াও দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে ও জেমস জিনস আরো একটি সূত্র দাঁড় করান। কিন্তু কোনোটাই কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

সেদিন রুবেন্স প্ল্যাঙ্ককে বলেন, দীর্ঘ তরঙ্গের বিকিরণের ব্যাখ্যা ভীনের সূত্র দিয়েই করা যায়। কিন্তু ক্ষুদ্র তরঙ্গের জন্য সেটা অচল। আবার রেলে-জিনসের সূত্র দিয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গের বিকিরণ ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু দীর্ঘ তরঙ্গে রেলে-জিনস তত্ত্ব অচল। তারমানে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যার জন্য দুটো সমীকরণের দরকার হচ্ছে। অথচ সমীকরণ দুটি পরস্পর বিরোধী।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যান রুবেন্স ও তাঁর স্ত্রী। প্ল্যাঙ্ক তখন সমস্যাটা নিয়ে বসে গেলেন টেবিলে। এবং সেইদিনই পেয়ে গেলেন আনকোরা একটা তত্ত্ব—কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এই সূত্র দিয়ে একই সাথে ছোট ও বড় দু ধরনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিকিরণই ব্যাখ্যা করা যায়। সূত্রটি প্ল্যাঙ্ক লিখলেন একটা পোস্টকার্ডে । তারপর সেটা পাঠিয়ে দিলেন রম্নবেন্সের কাছে। রম্নবেন্স মীকরণের গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝেছিলেন সেদিন।

১৯ অক্টোবর ১৯০০। জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটি একটা সভার আয়োজন করে। সভার মূল বিষয়বস্তু কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল। বরাবরের মতোই বিজ্ঞানীরা সেদিনও ভীন ও রেলে জিনসের সূত্রের সাথে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ষোলআনা মেলাতে পারলেন না। তখন প্ল্যাঙ্ক রুবেন্সকে বললেন, তাঁর সমীকরণটা যেন বিজ্ঞানীরা যাচাই করে দেখেন। বলে সেখান থেকে বাসায় ফিরে আসেন প্ল্যাঙ্ক। পরদিন রুবেন্স প্ল্যাঙ্ককে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন, তাঁর সূত্রটা অভ্রান্ত বলে রায় দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে প্ল্যাঙ্ক নিজেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কারণ তাঁর সূত্র অনেকটা অনুমাননির্ভর। বিজ্ঞানে অুনমাননির্ভর সূত্র প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। নিশ্চয়ই এ সূত্রের কোনো শেকড় আছে পদার্থবিজ্ঞানে। প্ল্যাঙ্ক আসলে পদার্থবিজ্ঞানের আগের কোনো সূত্র বা ফর্মুলা খুঁজছিলেন যেটা থেকে তাঁর সূত্রটা প্রতিপাদন করা যায়। অনেক চেষ্টা করেও প্ল্যাঙ্ক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যকোনো সূত্রের সাথে তাঁর নিজের সূত্রটির সম্পর্ক খুঁজে পেলেন না।

তাহলে কি পদার্থবিজ্ঞানের নতুন কোনো দ্বার খুলে গেল তাঁর হাতে? তাহলে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা মহাবিপ্লবের ইঙ্গিত করছে। নাকি প্ল্যাঙ্কের সূত্রে কোনো গলদ লুকিয়ে আছে, যা তাঁ চোখে ধরা পড়ছে না। কিন্তু প্ল্যাঙ্ক নিজে কোনো গলদ খুঁজে পেলেন না। সেদিন সভায় যেসব বিজ্ঞানী উপস্থিত ছিলেন তারাও কোনো গলদ খুঁজে পাননি।

প্ল্যাঙ্ক তখন অন্য পথে হাঁটলেন, তাঁর সূত্র দিয়ে ভীন ও রেলে-জিনস—দুটি সূত্রই প্রতিপাদন করা যায় কিনা সে চেষ্টা করলেন। এবং অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর সূত্র দিয়ে ভীনের সূত্র প্রতিপাদন করা যায়। প্রতিপাদন করা যায় রেলে জিনসের সূত্রও। শুধু তাই নয়, এই সূত্র দিয়ে বোলজসম্যানের পুরোনো সূত্রটিও প্রতিপাদিত হয়। অথচ তাঁর সূত্র চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না। প্ল্যাঙ্ক তখন নিশ্চিত হলেন বিজ্ঞান ইতিহাসের নতুন দ্বার তিনি খুলে দিয়েছেন। অর্থাত্ প্রকৃতির সম্পূর্ণ মৌলিক একটি নিয়ম তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক খোলনলচে বদলে দিলেন পদার্থবিজ্ঞানের চিরায়ত জগত্। আলোর জন্য নিয়ে এলেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এই তত্ত্ব বলে আলো শুধু তরঙ্গও নয়। একই সঙ্গে এটা শক্তির একটা গুচ্ছও। অর্থাত্ উত্স থেকে বিকিরিত হওয়া আলো শক্তির গুচ্ছ বা প্যাকেট আকারে নির্গত হয়। গুচ্ছ শক্তির এই প্যাকেটের নাম পরে দেওয়া হয় কোয়ন্টাম। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তার বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সেটা বড়দের জগত্। ক্ষুদে কণাদের জগতেও তিনি এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। আলোক-তড়িত্ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন বিখ্যাত জার্মান জার্নাল অ্যানালেন ডার ফ্যুর ফিজক-এ। এই প্রবন্ধই মোড় ঘুরিয়ে দেয় কণা পদার্থবিজ্ঞানের জগতে। প্রতিষ্ঠিত হয় প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল সূর হলো, আলো একই সঙ্গে কণা এবং তরঙ্গ।

সপ্তদশ শাতাব্দীতে আইজ্যাক নিউটন বলেছিলেন আলো হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার স্রোত। কিন্তু তারই সমসাময়িক ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস আলো আসলে তরঙ্গ। কিন্তু আলো কণা না তরঙ্গ সেটা নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি হলো না। কারণ নিউটন তখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। তার কথার উল্টোপিঠে কথা বলার সাহস কারও ছিল না। তাছাড়া আলোর বেশ কিছু ধর্ম হাইগেনস ব্যাখ্যা করতে পারলেন তাঁর তরঙ্গ তত্ত্বের সাহায্যে। তাই টিকে গেল নিউটনের কণাতত্ত্ব। কিন্তু বিজ্ঞানে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

প্রায় শোয়া শতাব্দী পর থমাস ইয়াং নামে এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফিরিয়ে নিয়ে এলেন আলোর তরঙ্গতত্ত্ব। আলোর যেসব বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা হাইগেনস দিতে পারেনি, থমাস সেগুলোর সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন তরঙ্গতত্ত্ব ব্যবহার করেই। বিজ্ঞানীরা তখন নড়েচড়ে বসলেন। একবাক্যে মেনে নিলের তরঙ্গতত্ত্ব। কিন্তু বিজ্ঞানে সমস্যার শেষ নেই। একটার সমাধাণের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা সমস্যা হাজির হয়। মাধ্যম ছাড়া কি তরঙ্গ চলতে পারে? শব্দ তরঙ্গ যেমন মাধ্যম বেয়ে বেয়ে চলতে পারে, আলোও কি এমন কোনো মাধ্যমে ভর দিয়ে চলতে পারে? তখন সামনে চলে এলো বহুদিন ধরে চলা আসা ইথারতত্ত্ব।

বিজ্ঞানীরা ইথার নামের এক কাল্পনিক মাধ্যমের কল্পনা করলেন। সেই মাধ্যম ঢেউ তুলে এগিয়ে চলে আলোক তরঙ্গ। তবে সে ইথার বেশিদিন রাজত্ব করতে পারল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝমাঝি সময়ে ইথারের অসিত্মত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করলেন স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েল। তার সেই সন্দেহ অচিরেই সত্যি প্রমাণ করলেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী আলবার্ট মাইকেলসন এবং এডওয়ার্ড মর্লি। তারা একটা পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন, ইথার মানুষের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনার ফসল, বাস্তবে ইথার বলে কিছু নেই। মাইকেলসন-মর্লির এই পর্যবেক্ষণই আলবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রণয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

দুমাস সূত্রটা নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া করলেন প্ল্যাঙ্ক। তবুও কোনো ত্রুটি খুঁজে পেলেন না। তারপর অনেক খেটেখুটে একটা প্রবন্ধ লিখলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘অন দ্য থিওরি অব দ্যা এনার্জি ডিস্ট্রিবিউশন ল অব দ্য নরমাল স্পেকট্রাম’। অর্থাত্ ‘স্বাভাবিক বর্ণালীর শক্তিবিভাজন সূত্র’। সে বছর ১৪ ডিসেম্বর জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটির আরেকটা সভা আহবান করা হলো। সেই সভায় নিজের প্রবন্ধটি পড়ে শোনালেন প্ল্যাঙ্ক। সেখানে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর বিস্তুরারিত আলোচনা করলেন তিনি।

প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনেক বিজ্ঞানীই তখন মেনে নিতে পারেননি। হুট কররে এক জার্মান বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক এক শাখার কথা বলছেন—সেটা হজম করতে অনেকেরই কষ্ট হয়েছিল। অনেকেই প্ল্যাঙ্কের রোমান্টিক মনের অতি কল্পনা ভেবে গুরুত্ব দেননি বিষয়টাতে। তাঁরা ভেবেছিলেন কিছুদিন আলেচনা চলবে, তারপর কোনো খুঁতটুত বেরিয়ে পড়েবে,  তখন সব আলোচনা থেমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টো ঘটনা। দিন যত গড়াল কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত তত মজবুত হলো।

প্ল্যাঙ্ক যখন কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সমস্যা সমাধান করছেন, ঠিক তখনই আরেকটা সমস্যা হাজির হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে। সেটা হলো আলোক-তড়িত্ ক্রিয়া। ধাতব পাতের ওপর আলো ফেললে সেই পাত থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয়। কেন হয়? এর গাণিতিক ব্যাখ্যা কী?

নিটনের গতিতত্ত্বের পক্ষে এর ব্যাখ্যা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। ম্যাক্সওয়েল তড়িচুম্বকীয় তত্ত্ব ও এর ব্যাখ্যা দিতে পারে না। তাহলে?

তখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা আলোকে শুধুই তরঙ্গই ভাবতেন। কণা তত্ত্ব বহু আগেই বাতিল হয়ে গেছে। তাছাড়া আলোক-তড়িত্ ক্রিয়া আলোর কম্পাঙ্কের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। সুতরাং আলোক-তড়িত্ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা তরঙ্গ তত্ত্বের ভেতরেই খুঁজতে হবে। মুশকিল হলো, তরঙ্গের পক্ষে কীভাবে সম্ভব একটা কণাকে ধাতুর ভেতর থেকে আলাদা করা?

লাল আলোর পক্ষে সম্ভব নয় ধাতু থেকে ইলেকট্রন বের করা। সম্ভব নয় দৃশ্যমান কোনো আলোর পক্ষেই। কখনো-সখনো দৃশ্যমান অতি বেগুনি রশ্মির আঘাতে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে বটে, কিন্তু সেসব ইলেক্টনের গতি খুবই কম। দেখা যায়। যে ধাতু থেকে ওই ইলেক্ট্রন নির্গত হয়েছে, তাতে ইলেকট্রনগুলো বেশ ঢিলেঢালাভাবে অবস্থান করছিল। কিন্তু আলোর কম্পাঙ্ক বাড়ালে অর্থাত্ অতি বেগুনি রশ্মির চেয়েও বেশি কম্পাঙ্কের আলোর আলো ব্যবহার করলে নিঃসৃত ইলেকট্রনের বেগ অনেক বেশি হয়। আবার কতগুলো ইলেকট্রন একবারে বের হয় সেটা নির্ভর করে আলোর তীব্রতা বা উজ্জ্বলতার ওপর। এই বিষয়গুলো বিজ্ঞানীরা অনেক ভাবলেন। ব্যাখ্যা দাঁড় করারও চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো সমাধান বেরুলো না।

ততোদিনে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাঁর কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। তবে বিজ্ঞানী মহলে সাড়া ফেলতে পারেনি তখনো। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের পেটেন্ট অফিসের অখ্যাত কেরানিটি কিন্তু অন্যরকম ভেবেছিলেন। অফিসে-বাড়িতে বসেই তিনি থিয়োরি অব রিলেটিভিটির খসড়া কষছেন মনে মনে আর খাতা-কলমে। তৈরি করছেন ব্রাউনীয় গতির যুত্সই ব্যাখ্যাও। একইসাথে ভাবছেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়েও। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল, আলোক-তড়িত্ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা খোঁজা। আর সেজন্য প্রথম যে ভাবনাটি আইনস্টাইনের মাথায়, সেটা যুগান্তকারী। আলো শুধু শক্তি বা তরঙ্গ নয়, একই সাথে কণাও।

আইনস্টাইন বললেন একথা। অর্থাত্ বিজ্ঞানে আবার ফিরে এলো আলোর কণা তত্ত্ব। তবে নিউটনের কণাতত্বের সাথে আইনস্টানের কণাতত্ত্বের কোনো মিল নেই। আলো কণা হিসেবে আখ্যায়িত করলেন আইনস্টাইন। তবে তিনি আলোক-তড়িত্ ক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য চিরার কণাবিদ্যা বা বিদত্চুম্বকীয় তত্ত্বের দিকে হাত বাড়ালেন না। বরং বিকিরণের জন্য ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়েছিলেন সেটা দিয়েই ব্যাখ্যা করলেন আলোক-তড়িিক্রয়া। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক আলোর ক্ষুদ্র শক্তি গুচ্ছকে বলেছিলেন প্যাকেট বা কোয়ান্টাম। আইনস্টাইন আলোর সর্বনিম্ন শক্তির সেই প্যাকেটকেই বললেন আলোর কণা। পরে সেবই কণার নাম হয় ফোটন ।

ফোটন ভরহীন কণা। তবে গতিশীল ফোটনের ভরবেগ আছে বলে উল্লেখ করলেন আইনস্টাইন। ভরবেগ ও শক্তিসম্পন্ন কণাকে তিনি তুলনা করলেন কামানের গোলার সাথে। কামানের গোলা প্রচ্ল বেগে কোনো বস্তুর আঘাত হানে। গুড়িয়ে দেয় সেই বস্তুকে। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় আঘাত পাওয়া বস্তুটি। সেই বস্তুর টুকরো টুকরো অংশ প্রবল বেগে ছিটকে বেরিয়ে যায়। আইনস্টাইন বললেন, আলোর ফোটন কণা প্রবল বেগে কামানের গোলার মতো গিয়ে আঘাত হানে ধাতুর পরমাণুতে। তখন পরমাণুর ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় ইলেট্রন কণা।

যে আলো ফটো-তড়িিক্রয়ায় অংশ নেয়, তার উজ্জ্বলতাও আলোক তড়িিক্রয়ায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। আলোক রশ্মি যত উজ্জ্বল হবে তার ইলেকট্রন নির্গমনের ক্ষমতা তত বেশি থাকবে।

যে আলোর কম্পাঙ্ক যত বেশি, তার শক্তিও তত বেশি। সুতরাং সেই আলো ধাতুর ওপর যে ধাক্কা দেবে সে ধাক্কার জোরও তত বেশি হবে। সুতরাং ইলেকট্রন বের করার ক্ষমতা সেই আলোর বেশি থাকবে। একসাথে দুটো সমস্যার সমাধান হলো। আলোক-তড়িিক্রয়ার সমস্যাটা মিটল। সেই সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বও প্রতিষ্ঠিত হলো শক্তপোক্তভাবে। আলোক-তড়িত্ ক্রিয়া ব্যাখ্যার পর থেকে তরুণ বিজ্ঞানীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন বিজ্ঞানের এই নতুন শাখাটিতে। এর ১৬ বছর পর ১৯২১ সালে আইনস্টাইন পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। হ্যাঁ, আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত আবিষ্কার থিওরি অব রিলেটিভিটির জন্য নোবেল পাননি। পেয়েছিলেন আলোক-তড়িিক্রয়া ব্যাখ্যার জন্য। আইনস্টাইন ঠিক আগের বছর নোবেল পেয়েছিলেন প্ল্যাঙ্ক। তবে প্ল্যাঙ্ক কিন্তু বিকিরণের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার পর খুব বেশি এগুতে পারেননি।

১৯১১ সাল। বিখ্যাত স্বর্ণপাত পরীক্ষাটা সদ্য করেছেন ব্রিটিশ প্রবাসী নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। সেই পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করেছেন একটা পরমাণু মডেল। কিন্তু তাঁর পরমাণু মডেলে কিছ ত্রুটি ছিল। সেই মডেলে রাদারফোর্ড বলেছিলেন, পরমাণুকে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে ইলেকট্রনগুলি, ঠিক যেভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে গ্রহগুলি। তাই এই মডেলের নাম দেওয়া হয় সোলার সিস্টেম অ্যাটম মডেল। কিন্তু স্কটিশ বিজ্ঞান জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েল আগেই বলেছিলেন, চার্জিত কণা বৃত্তাপথে ঘুরলে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। তার ফলে কণাটি শক্তি হারায়।

আইরিশ বিজ্ঞানী যোসেফ ল্যারমর ম্যাক্সওয়েলের সুত্র ধরে সেই শক্তির পরিমাণটা বের করার একটি গণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।  কিন্তু ইলেকট্রনের ও তার কক্ষপথে নিশ্চয়ই অফুরন্ত শক্তি নেই। সুতরাং শক্তির অবিরাম ক্ষয় হতে পারে না। শক্তি এক সময় পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। শক্তি ক্ষয় হওয়ার সাথে সাথে একটু করে কমবে ইলেকট্রনের সাথে নিউক্লিয়াসের দূরত্ব। তারমানে ইলেকট্রন কক্ষপথের ব্যাসার্ধ ক্রমেই ছোট হতে থাকবে। শক্তি শেষ হবার সাথে সাথে পুরোপুরি শূন্য হয়ে যাবে ব্যাসার্ধ। তখন ইলেকট্রন গিয়ে পড়বে নিউক্লিয়াসের বুকে। ম্যাক্সওয়েলের সূত্র আর রাদারফোর্ডের মডেল অনুসারে হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন এই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে সর্পিল গতিতে ঘুরতে ঘুরতে নিউক্লিয়াসে গিয়ে পড়বে। তাহলে রাদারফোর্ডের সৌর মডেলের অস্তিত্ব থাকল কোথায়?

ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসে পতিত হবার সাথে সাথে পরমাণুর ভারসাম্য আর থাকার কথা নয়। তখন ভেঙে পড়বে রাদারফোর্ডের মডেল। রাদারফোর্ড মডেল তাহলে নিজেই নিজেকে বাতিল করে দিচ্ছে। এত বড় একটা অসঙ্গতি নিয়ে বিজ্ঞান চলতে পারে না। তাই  আরও একবার বড় ধরনের একটা সমস্যার মুখোমুখি পদার্থবিদ্যা। যেমনটা হয়ে ছিল কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণে, যেমনটা হয়েছিল আলোক-তড়িত্ ক্রিয়ায়। দুই ক্ষেত্রে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছিল কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এবার তাহলে কী হবে? এ প্রশ্নের জবাব রাদাফোর্ডের কাছে ছিল না। তারজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ডেনিস বিজ্ঞানী নীলস বোরের।

বোর ভাবলেন, একটু ভিন্নভাবে। তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব দিয়ে রাদাফোর্ডের মডেল ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। পদার্থবিদ্যার নতুন তত্ত্বটা কী ব্যবহার করা যায়? প্ল্যাঙ্ক-আইনস্টাইনের প্রতিষ্ঠা করা কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্ব তখনো বিজ্ঞানীরা হজম করতে পারেননি। অনেকের কাছে এটা কাল্পনিক হাইপোথিসিস। এমনকী বোরেরও আস্থা ছিল না ওই তত্ত্বে। তবু তাঁর মনে হলো পরমাণু মডেলে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহারের কথা। তত্ত্বটির আগের দুটি সাফল্যই বোধহয় বোরকে অনুপ্রাণীত করেছিল।

সাধারণ বলবিদ্যায় ইরেকট্রনের কক্ষপথের স্থায়ী আকার ছিল না। থাকবে কী করে, সর্পিলাকারে যে কক্ষপথ ছোট হতে হতে নিউক্লিয়াসে পতিত হয়, তার আবার নির্দিষ্টতা কী? এই সমস্যার হাত থেকে বাঁচাতে পারে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। বোর বললেন, পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের কক্ষপথের একটা নির্দিষ্ট আকার থাকা উচিত্। নির্দিষ্ট আকার না থাকলে পরমাণু স্থায়ী হবে না। তেমনি রাদারফোর্ডের মডেল আর বিদুত্চ্চুম্বকীয় তত্ত্বও মেনে চলবে খানিকটা। অর্থাত্ ঘুরতে থাকা ইলেকট্রন তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তিও বিকিরণ করবে। কিন্তু দুটো বিপরীতমুখি ঘটনা এক সাথে কীভাবে ঘটবে?

বোর বললেন ঘটবে, তবে একই সাথে নয়। ইলেকট্রনের জন্য পরমাণুর একটা নয়, একাধিক কক্ষপথ আছে। সেসব কক্ষপথ মোটেও সর্পিল নয়। বৃত্তাকার। একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে যখন ইলেকট্রন অবস্থান করে তখন সেই ইলেকট্রন কোনো শক্তি নির্গমন করে না। বোর ইলকট্রনের কক্ষপথে শক্তির একটা মাপকাঠি তৈরি করে দিলেন। একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথ একটা নির্দিষ্ট শক্তি ধারণ করে। সেই শক্তির চেয়ে ইলেকট্রনে শক্তি কমবেশি হলে, সেই কক্ষপথে আর থাকতে পারবে না। চলে যাবে নিচের বা ওপরের কোনো কক্ষপথে। অর্থাত্ বোরোর কক্ষপথ নিরবিচ্ছিন্ন শক্তির কক্ষপথ নয়। বরং কক্ষপথগুলো নির্দিষ্ট শক্তি নিয়ে অবস্থান করে পরমাণুর বিভিন্ন স্তরে। নিউক্লিয়াস থেকে সবচেয়ে কাছের কক্ষপথটি সবচেয়ে কম শক্তি ধারণ করে। নিউক্লিয়াসের থেকে কক্ষপথের দূরত্ব যত বেশি, কক্ষপথের শক্তিও তত বেশি।

কথা হচ্ছে, কক্ষপথ থাকলেই বা লাভ কি, ইলেকট্রন যদি সব কক্ষপথে থাকতে না পারে? ধরা যাক, হাইড্রোজন পরমাণুর কথা। এই পরমাণুতে একটামাত্র ইলেকট্রন আছে। তাই বলে কি এর কক্ষপথও একটা? তাই যদি হয়, তো রাদারফোর্ডের পরমাণুতেই ফিরে যেতে হবে!

বোর বললেন, হাইড্রোজেন পরমাণুতে একাধিক কক্ষপথ আছে। সেগুলোর সবগুলোতেই থাকতে পারে ইলেকট্রন। কিন্তু ইলেকট্রন তো আর ভূত-প্রেতের গপ্পের মতো নয়, যে একই সাথে সবগুলো কড়্গপথে থাকবে! বোর বললেন, ইলেকট্রন সবগুলো কক্ষপথেই থাকতে পারবে তবে একসাথে নয়। পরমাণুটি কখন কোন অবস্থায়, কী পরিমাণ শক্তি নিয়ে আছে, তার ওপর নির্ভর করে ইলেকট্রন কোন শক্তিস্তরে থাকবে। একেক সময় একেকটা কক্ষপথে থাকতে পারে।

তারমানে ইলেকট্রন যেমন নিম্ন শক্তির কক্ষপথে থাকতে পারে, তেমনি বেশি শক্তির কক্ষপথেও থাকতে পারে। ধরা যাক, ইলেকট্রন ওপরের দিকের একটা কক্ষপথে আছে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি নিঃসরণ করে সে নিচের শক্তিস্তরে আসতে পারবে। তাহলে কিন্তু তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি নিঃসরণের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট কক্ষপথে যখন ঘোরে, তখন তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি নিঃসরণ করতে পারে না।

তাহলে কি ইলেকট্রন শুধু উচ্চ শক্তির কক্ষপথ থেকে নিচের শক্তিস্তরে আসতে পারে? নিচের থেকে ওপরে যেতে পারে না। বিদুত্চ্চুম্বকীয় তরঙ্গ তত্ত্বে বলা হয়েছে ঘূর্ণনশীল চার্জিত কণা বিদুত্চ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। বিদুত্চ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বা শক্তি শোষণের কথা বলা হয়নি সেই সমীকরণে। শক্তি বিকিরণ করা মানে ইলেকট্রনের শক্তি কমে যাওয়া। শক্তি কমে গেলে শুধু নিচের কক্ষপথে যেতে পারে। ওপরের কক্ষপথে যেতে হলে শক্তি শোষণ করে ইলেকটনকে আরো শক্তিশালী হতে হবে। এখানেই বোরের কৃতিত্ব। তিনি বললেন, একটা নির্দিষ্ট কড়্গপথে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রন শক্তি শোষণও করতে পারে। তবে শক্তি শোষণ করলে তার শক্তি বেড়ে যায়, সুতরাং সেই কক্ষপথে সে ঘুরতে পারবে না। লাফ দিয়ে চলে যাবে ওপরের কোনো কক্ষপথে। এই ঘটনা বিদুত্চ্চুম্বকীয় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় চিরায়ত বলবিদ্যার কোনো তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করাও। বোর তাই কোয়ন্টাম তত্ত্বের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন।

বোর বলেছিলেন, পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনের কক্ষপথগুলো নিরবিচ্ছন্ন নয়, বিচ্ছিন্ন। প্ল্যাঙ্ক যেমন বলেনছিলে কৃষ্ণবস্তুর  নিরবিচ্ছন্নভাবে শক্তি নিঃসরণ করতে পারে না। শক্তি আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বা গুচ্ছ আকারে। বোর অনেকটা একইরম কথা বললেন পরমাণুর কক্ষপথের ক্ষেত্রেও। পরমাণুর কক্ষপথ নিরবিচ্ছিন্ন নয়। বিকিরণরে শক্তি পস্ন্যাঙ্কের ধ্রম্নবকের সরল গুণিতকে থাকে 1h, 2h, 3h, 4h…ইত্যাদি আকারে। কখনো ভগ্নাংশ আকার যেমন, 1/2h, 2/3h, 5/3h,… ইত্যাদি আকারে থাকে না। বোর বললেন, ইলেকট্রনের কক্ষপথের শক্তিও কখনো নিরবিচ্ছিন্ন নয়। এজন্য তিনি হাত বাড়ালেন কৌণিক ভরবেগের দিকে। অবশ্য ভরবেগের হিসাবটা চিরায়ত তত্ত্ব দিয়ে মাপলে চলবে না। মাপতে কোয়ান্টামের হিসাব দিয়ে। বোর বললেন, বৃত্তাকার কড়্গপথে ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ হবেব h/2 –এর সরল গুণিতক।

এটা ঠিক হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটা ইলেকট্রন, কিন্তু তার ভেতরে অনেকগুলো কক্ষপথ আছে। ইলেকট্রনের শক্তি যখন যে কক্ষপথের সাথে মিলে যাবে, তখন ইলেকট্রন সেই কক্ষপথে থাকবে। সেই অবস্থায় ইলেকট্রন যদি শক্তি নিঃসরণ করে, তবে সেই কক্ষপথ থেকে লাফ দিয়ে চলে যাবে নিচের কক্ষপথে। আর যদি শক্তি শোষণ করে, তবে লাফ দিয়ে ওপরের কক্ষপথে উঠে যাবে। ইলেকট্রনের লাফ দিয়ে এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে চলে যাবার ঘটনাকে বোর নাম দিলেন ‘ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম লাফ’। শক্তি শোষণ করে উচ্চ শক্তিস্তরে গেলেও ইলেকট্রন সেখানে স্থায়ীভাবে থাকতে পারে না। উচ্চ শক্তিস্তরে যাবার পর পরই শক্তি বিকিরণ করতে শুরু করে ইলেকট্রন। শক্তি কমতে কমতে আগের অবস্থায় ফিরে আসে একসময় তখন ইলেকট্রন দিয়ে আবার আগের শক্তিস্তরে ফিরে আসে। বোর কক্ষপথে ইলেকট্রনের শক্তি নির্ধারণ করে দিলেন। ইলেকট্রনের সুস্থিতি এলো। বোরের সূত্র এমন কোনো কক্ষপথ ইলেকট্রনের জন্য অনুমোদন করে না যেটা নিউক্লিয়াসে ঝাপ দেবে।

শেষমেষ, পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতেও সক্ষম হলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব। যদিও বোরের মডেলেও অনেক ত্রুটি ছিল, সেগুলো সমাধান করেন আর্নল্ড সোমারফেল্ড। কিন্তু সেই সমাধানটাও আসে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভেতর থেকেই। সুতরাং বলা যায়, প্ল্যাঙ্ক বিকিরণের জন্য যে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিলেন, আইনস্টাইন সেটাকে এগিয়ে নিয়েছিলেন একধাপ—সেই কোয়ানন্টাম তত্ত্বকেই ক্ষুদে কণিকাদের জগতে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেন নীলস বোর।

প্ল্যাঙ্ক আলোর জন্য কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করলেন। কিন্তু সেটা ষোলআনা নিখুঁত হয়ে উঠল না। কারণ কোয়ন্টাম তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তখন একেবারেই আনকোরা এক তত্ত্ব। সেই তত্ত্ব নিউটনের গতিতত্ত্ব যেমন মেনে চলে না, মানে না ম্যাক্সওয়লের বিদ্যুত্গতিবিদ্যায়। কিন্তু প্ল্যাঙ্ক যে সমীকরণটা তৈরি করেছিলেন, তার একটা অংশ ছিল বিদ্যুত্গতিবিদ্যার। এটা এই তত্ত্বের বড় ত্রুটি। আইনস্টাইনও তত্ত্বের ত্রুটিটা বুঝেছিলেন, সমাধানের চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু পারেন নি। পারেনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। সেই সমাধান এলো একজন বাঙালির হাত ধরে। তিনি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন তরুণ অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ওরফে সত্যেন বোস। তার সেই সমাধানটা পাঠিয়েছিলেন আইনস্টাইনের কাছে।

আইনস্টাইন সেটা পড়ে অ্যান্যালেন ডার ফ্যুর ফিজিক-এ প্রকাশ করলেন। সত্যেন বোসের সেই তত্ত্ব সাড়া ফেলে দিল বৈজ্ঞানিক সমাজে। এরপর আইনস্টাইন আরেকটু গুছিয়ে আরো সুন্দর করে সেই সমাধানটা আবার প্রকাশ করলেন। কালজয়ী সেই তত্ত্বটার নাম হয়ে গেল বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। পরিসংখ্যান—কারণ, ওটা ছিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্য প্রথম কোনো পারিসংখ্যিক বলবিদ্যা। এরই সঙ্গে আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব এগিয়ে গেল কোয়ন্টাম বলবিদ্যার দিকে।

সত্যেন বোসের কাজের কয়েক বছর আগে আরেকটি অভূতপুর্ব কাজ করলেন ডেনিস বিজ্ঞানী নীলস বোর। তিনি পরমাণুর ঘঠন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন প্ল্যাঙ্ক-আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম তত্ত্বের। এর আগে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেছেন, তারও কিছুদিন আগে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেছেন স্যার জে জে থমসন। আর নিউক্লয়াসের চারপাশে ইলেকট্রন যে ঘুরছে, কেন ঘুরছে, কোন শক্তি বলে ঘুরছে এসব ব্যাখ্যার জন্য কোয়ান্টামে পথ ধরেছিলেন বোর। আর সেই পথে তাঁর সঙ্গী হলেন আরনল্ড সোমারফেল্ড।

এরপর বস্তু কণিকাদের জন্যও কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী লুইস দ্যা ব্রগলি। বিল্পব ঘটে গেল কোয়ান্টাম তত্ত্বে। সত্যিকারের এক কোয়ান্টাম বলবিদ্যা তৈরি হলো ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, এরউইন শ্রোয়োডিঙ্গার, পল ডিরাক আর এনরিকো ফার্মিরা মিলে গড়ে তুললেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। এই বলবিদ্যা হয়ে উঠল ক্ষুদে কণিকাদের চরিত্র ব্যাখ্যা করার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাহায্যেই একে একে উন্মোচিত হয়ে মহাবিশ্বের নানা রহস্য। একের পর এক কণা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সার্বজনীন নয়। ক্ষুদে কণিকাদের জগতেই এর যত বাহাদুরি। অন্যদিকে বৃহত্ বস্তুদের চাল-চলন আচরণ বোঝার জন্য এখনো বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে চিরায়ত বলবিদ্যা।

মোটকথা মহাবিশ্বকে বুঝতে, সৃষ্টির রহস্যকে উন্মোচন করতে দুটো তত্ত্ব চালু রয়েছে মোটা দাগে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর সাধারণ আপেক্ষিকতা। এই দুটি তত্ত্বকে একত্রিত করার চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরেই। আইনস্টাইন চেষ্টা করেছিলেন জীবনের শেষ তিন দশক। কিন্তু সাফল্যের দেখা পাননি। আইনস্টাইনের পরবর্তী প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা সেই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান এ ব্যাপারে যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।

কথা হচ্ছে, এই দুই তত্ত্বের একীভূত হওয়াটা কী জরুরি? নিশ্চয়ই জরুরি। আমরা যে কৃষ্ণগহ্বরে ভেতরের খবর জানতে পারছি না, ডার্ক ম্যাটারের দেখা পাচ্ছি না—এসবের মূলে রয়েছে এই দুই তত্ত্বের পারস্পারিক বিরোধিতা। কৃষ্ণগহ্বরকে বুঝতে হলে একই সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর সাধারণ আপেক্ষিতার প্রয়োগ ঘটানো জরুরি। মুশকিল হলো একইসঙ্গে এই দুটো তত্ত্বকে কাজে লাগানোর উপায় আজও বিজ্ঞানীরা বের করতে পারেননি।

 

লেখাটি ‌’গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে’ বইয়ের অংশবিশেষ। বইটি অমর একুশে বইমেলায় প্রথমার (৮নং) প্যাভিলিয়নে পাওয়া যাবে

সাধারণ আপেক্ষিকতা আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মেলবন্ধন ঘটানো হয়তো সম্ভব হয়নি, তাই বলে বিজ্ঞানীরা যে ষোলআনা ব্যর্থ সে কথা বলা যায় না। প্রকৃতির চারটি বলকে একত্রিক করার চেষ্টা বহুদিন থেকে করে যাচ্ছেন। সে চেষ্টার সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো দুর্বল ও বিদুত্চ্চুম্বকীয় বলকে ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা একসূত্রে গেঁথে ফেলেছেন। চেষ্টা চলছে সবল নিউক্লীয় বলকে এই দুই বলের সঙ্গে একত্রিত করার। এজন্য গড়ে উঠেছে পদার্থবিদ্যার আদর্শ মডেল অর্থাত্ স্ট্যান্ডার্ড মডেল।

স্ট্যার্ন্ডাড মডেলে স্থান দেওয়া হয়েছে মহাবিশ্বের সমস্ত মৌলিক কণাদের। গোটা মহাবিশ্ব কিছু মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি। সেসব মৌলিক কণাদের খবর আমরা একাদশ অধ্যায়ে বলেছি। এও বলেছি এসব কণাদের আবার দুটো শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যেসব মৌলিক কণা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে তাদের বলা বোসন। আবার যেসব কণারা এনরিকো ফার্মি ও পল ডিরাকের তৈরি করা ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে তাঁদের বলা ফার্মিয়ন। বোসন আর ফার্মিয়নদের সবগুলোকে ঠাই দেওয়া হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে। ফার্মিওন কণাদের আবার বলা ব্যারিওন। ব্যারিওনকে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করে এদের জায়গা দেওয়া হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের টেবিলে। সেই দুটো শ্রেণি হলো কোয়ার্ক ও লেপটন। কোয়ার্কের আবার তিনটি জেনারেমন। প্রতিটা জেনারেশনের সদস্য আবার দুটি করে। কোয়ার্কের প্রথম জেনারেশনের সদ্যসা হলো আপ কোয়ার্ক এবং ডাউন কোয়ার্ক। দ্বিতীয় জেনারেশনে আছে চার্ম ও স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক। তৃতীয় জেনারেশনের দুই সদস্য হলো টপ কোয়ার্ক ও বটম কোয়ার্ক।

অন্যদিকে লেপটনেরও তিনটি জেনারেশন আছে। প্রতিটা জেনারেশনে আবার দুটি করে সদস্য। প্রথম জেনারেশনের প্রথম সদস্য হলো ইলেকট্রন এবং দ্বিতীয় সদস্য ইলেকট্রন-নিউট্রিনো। দ্বিতীয় জেনারেশনের দুই সদস্য হলো মিউয়োন ও মিউয়োন নিউট্রিনো। তৃতীয় জেনারেশনে আছে টাউ ও টাউ নিউট্রিনো। এই হলো ব্যারিওনের খতিয়ান। ব্যারিওনের প্রতিটি সদস্যকে বলা হয় একটি করে ফ্লেভার। এটা পদার্থবিজ্ঞানের ফ্লেভার। এর সাথে সত্যিকারের গন্ধের কোনো যোগ নেই। তাহলে হিসাবটা দাড়াচ্ছে কোয়ার্কের ছয়টি সদস্য অর্থাত্ ছয়টি ফ্লেভার। লেপটনেরও ছয়টি ফ্লেভার অর্থাত্ ছয়টি সদস্য। এছাড়া কোয়ার্কগুলোর প্রতিটা ফ্লেভারের আবার তিনটি করে কালার বা রং আছে। কিন্তু সেই কালারের অর্থ সত্যিকারের রং নয়। এদের বৈশিষ্ট্যের ওপরে ভিত্তি করে লাল নীল ও বেগুনি এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। তাহলে কোয়ার্কের ছয়টি ফ্লেভারের প্রতিটার তিনটি করে কালার থাকলে মোট কোয়ার্কের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮টি। লেপটনের কোনো কালার নেই। তাই লেপটনের মোট সংখ্যা ৬টিই। তাহলে মোট বেরিয়নের সংখ্যা ২৪টি।

 

লেখকের আরও কিছু বই পাবেন প্রথমা, অন্বেষা ও তাম্রলিপির প্যাভিলিয়নে

এবার আসা যাক জেনারেশনের কথায়। কোয়ার্ক এবং লেপটন দুই শ্রেণিতেই রয়েছে তিনটি করে জেনারেশন।  উভয়েরই প্রথম জেনারেশনের কণাদের ভর সবচেয়ে কম। দ্বিতীয় জেনারেশনের ভর তারচেয়ে বেশি। কোয়াকদের প্রতি জেনারেশনের প্রথম কণার চার্জ +২/৩ এবং দ্বিতীয় সদস্যের ভর -১/৩।

এবার আসা যাক বোসনের কথায়। বোসনরা হলো বলবাহী কণা।  বোসন মোট দুই প্রকার। গেজ বোসন আর হিগ‌স বোসন। বলের বাহক হিসেবে অর্থাত্ মৌলিক বলগুলোর মিথস্ক্রিয়ার জন্য দায়ী যেসব কণাগুলো তাদের গেস বোসন। গেস বোসনের স্পিন ১। বিদ্যুত্চম্বকীয় বল, সবল নিউক্লীয় বল আর দুর্বল নিউক্লীয় বলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই গেস বোসনেরা। অন্য দিকে হিগস বোসন জড়িয়ে আছে হিগস ফিল্ডের সঙ্গে। মৌলিক বলগুলো নিয়ে আগেই আগেই আলেচনা করেছি। এখন শুধু বলব, বিদ্যুত্চুম্বকীয় বলের মিথস্ক্রিয়ায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে ফোটন কণা। অন্যদিকে সবল নিউক্লীয় বলের জন্য দায়ী গ্লুয়ন কণা। আর দুর্বল নিউক্লীয় বলের জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে ডাব্লু ও জেড বোসন কণারা। আমরা স্ট্যান্ডর্ড মডেলের একটা তালিকা করে ফেলতে পারি। নিচে সেই তালিকাটা দেওয়া  হলো।

এই বইয়ের সব পর্ব

  1. গুপ্ত ভরশক্তির খোঁজে
  2. প্রাচীন মহাবিশ্ব
  3. আধুনিক মহাবিশ্ব
  4. মহাবিস্ফোরণ
  5. কী ঘটেছিল মহাবিস্ফোরণের পর?
  6. গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং
  7. জুইকি থেকে রুবিন
  8. যা চেয়েছি আর যা পেয়েছি
  9. ছায়াপথ স্তবক
  10. মূল কণিকাদের গল্প
  11. স্ট্যান্ডার্ড মডেল
  12. প্রতিসাম্যতা
  13. ডার্ক পার্টিকেলের খোঁজে
  14. মিলেনিয়াম সিমুলেশনে ডার্ক ম্যাটার
  15. নিউট্রিনো কি ডার্ক ম্যাটার?
  16. স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ত্রুটি সুপারসিমেট্রিতে সমাধান
  17. ডার্ক ম্যাটারের প্রার্থী কারা?
  18. কীভাবে শনাক্ত হবে ডার্ক পার্টিকেল?
  19. গামা রশ্মির সন্ধানে
  20. মহাবিশ্বের সম্প্রারণ ও ডার্ক এনার্জি
  21. সুপারনোভার জন্ম
  22. আদর্শ বাতির খোঁজে
  23. আদিম আলোয় বিশ্ব দেখা
  24. মহাকাশের মানচিত্রে গুপ্ত ভরশক্তি
  25. কুইন্টেসেন্স তত্ত্ব
  26. ডার্ক ফোটনের সন্ধানে
  27. উপসংহার

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.