কৃষ্ণগহ্বর-৭ : মহাকর্ষের কথা শোনে আলোও

1
756

সাধারণভাবে দেখলে বোঝা যায়, আলো সবসময় সোজাপথে চলে। কেন চলে? কারণ আলো চলার সময় এক স্থান থেকে অন্য যেতে সবচেয়ে কম সময়ের পথ বেছে নেয়। সমতলে দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে সরল রেখা। আপেক্ষিকতা প্রকাশের আগে আমরা জানতাম স্থান-কাল সমতল সুতরাং আমরা দেখতাম আলো সররেখা পথে বা সোজা পথে চলে। আলো যখন এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যায়, তখন আলোর প্রতিসরণ ঘটে। আলোর প্রতিসরণ মানে আলোর দিক পরিবর্তন হওয়া। যেমন আলো শূন্য মাধ্যম থেকে পুরু কাচের দেয়ালে ভেতর ঢুকলে তার দিক পরিবর্তন হয়। নিচের চিত্রের মতো।

এটাকেই আগের যুগে বলা হতো আলোর বেঁকে যাওয়া। কিন্তু প্রতিসরণের সময় আলোর পথ মোটেও বাঁকে না। শুধু দিক পরিবর্তন করে সোজা পথে চলে। তখন আগের পথের সাথে আলোর কৌণিক ব্যবধান সৃষ্টি হয়। একে কিছুতেই আলোর পথের বক্রতা বলা চলে না।

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষতা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত সবাই জানত এবং মানত, আলো চলে সোজা পথে। কিন্তু আইনস্টাইন দেখালেন ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে  যাবার সময় আলো বেঁকে যায়। অর্থাৎ ভারি বস্তুর মহাকর্ষ বল আলোকে বাঁকিয়ে দেয়।

তাহলে হিসাবটা কী দাঁড়ায়?

আলো চলার সময় সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ বেছে নেয়। কিন্তু যখন কোনো বস্তুর মহাকর্ষ ক্ষেত্রের পাশ দিয়ে যায় তখন আলো বেঁকে যায়। তাহলে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মধ্যে আলোর ওই বাঁকানো পথটাই নিশ্চয়ই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ। তাহলে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর দুটি বিন্দুর মধ্যে সংক্ষিপ্ত পথটাও বাঁকানো। এখান থেকেই আইনস্টাইন ধারণা করলেন মহাকর্ষ ক্ষেত্র কোনো সমতল ক্ষেত্র নয়। তা বাঁকানো।

তাই যদি হয়, আমাদের এ মহাবিশ্ব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্র। সবারই জন্যই এমন মহাকর্ষ ক্ষেত্র আছে। সবগুলো মহাকর্ষক্ষেত্র যদি বাঁকানো হয় তাহলে মহাবিশ্বের বিশাল যে স্পেস, সেটাও এই গ্রহ নক্ষত্রের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের কারণেই বাঁকানো হবে। সরল ভাষায় বললে সেটা কুঁকড়ে-মুচড়ে যাবে। অবশ্য মহাবৈশ্বিক স্থানকে শুধু স্থান বললে ভুল হবে। আসলে তা স্থানকালের সমন্বিত রূপ।

স্থানকালের এই কুকড়ে যাওয়াকে আরেকটু সহজভাবে বোঝা যাক। ধরা যাক, শূন্যে ভাসমান বিশাল এক চাদর। এটাই হলো আমাদের মহাবিশ্বের স্থানকাল। ধরা যাক চাদর সমতলের মতো সোজা হয়ে আছে। এখন চাদরের ওপর একটা ভারী বস্তু রাখা হলো। চাদরটা তখন বিকৃত হয়ে যাবে। বস্তু যত ভারী হবে চাদরের বক্রতাও তত বৃদ্ধি পাবে। ধরা যাক চাদরের ওপর একটা পোকা ঘুরছিল। চাদর যতক্ষণ সোজা ছিল, পোকাটির চলার পথও ততক্ষণ সোজা ছিল। কিন্তু ভারি বস্তুটা রাখার পর চাদর বিকৃত হয়ে গেল। পোকাটির চলার পথও এখন সোজা থাকল না। বেঁকে গেল।

এখন আরেকটা ভারী বস্তু যদি আগের বস্তুটার কাছাকাছি ছেড়ে দেওয়া যায় তবে বস্তুটা চাদরের ওই বাঁকা পথ দিয়ে গড়িয়ে আগের বস্তুটার ওপর পড়তে চাইবে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে আগের ভারি বস্তুটা পরের বস্তুটাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে নিতে চাইছে। এখন চাদরটাকে মাবিশ্বের স্থানকাল ধরলে দেখা যাবে গ্রহ-নক্ষত্রগুলোও ঠিক একই কারণে পরস্পকে আকর্ষণ করছে। এই ব্যাপারটাতেই নিউটন বলেছিলেন মহাকর্ষ বল।

আমাদের পৃথিবীর কথাই ধরা যাক। পৃথিবীর ভর স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। ফলে মনে হয় এর চারপাশে একটা মহাকর্ষ ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এই বক্র পথেই চাঁদ ঘুরছে। পৃথিবীর ওপর আমরা চলে ফিরে বেড়াচ্ছি, কোনো বস্তু পৃথিবীর বুক থেকে ছিটকে মহাবিশ্বে পড়ছে না, এর কারণ পৃথিবীর কারণে স্থান কাল এখানে বেঁকে গেছে। স্থানকালের বঙ্কিম গহবরে আটকে গেছে চাঁদ। আমরাও পৃথিবীর বুকে আটকে আছি একই কারণে।

পৃথিবী স্থানকালকে বাঁকিয়ে দিয়েছে। স্থানকালের বক্রতার কারণেই চাঁদ পৃথিবীকে  কেন্দ্র করে ঘুরছে।

কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, এটা কোনো আকর্ষণ বল নয়, স্থানকালের বক্রতার কারণেই এমনটি ঘটছে। অর্থাৎ স্থানকালে বক্র জ্যামিতি একটা ফ্যাক্টর। এটা শুধু বস্তুকেই বাঁকা পথে পরিচালনা করে না, আলোর পথকেও বাঁকিয়ে দেয়।

তবে আইনস্টাইন শুধু বস্তুর ভরের কথা বলেননি। তিনি বলেছিলেন ভরশক্তির কারণেই স্থানকাল বেঁকে যায়। অর্থাৎ ভরশক্তির পরিমাণের ওপরই স্থানকালের বক্রতার মাত্রা নির্ভর। রীম্যানের ব্যর্থতা ছিল এখানেই। তিনি শুধু বলেছিলেন মহাবিশ্বের জ্যামিতির বক্রতার কারণেই প্রাকৃতিক বলগুলো সৃষ্টি হয়। কিন্তু মহাবিশ্বের জ্যামিতি কীভাবে বেঁকে যা সে উত্তর রীম্যানের জানা ছিল না। আসলে রীম্যান জানতেনই নাভরশক্তি ও স্থানকালের মধ্যে কী সম্পর্ক।

আইস্টাইনের রীম্যানের জ্যামিতি ব্যবহার করে ফ্যারাডের তড়িৎ চুম্বক ক্ষেত্রের তত্ত্বের মতো মহাকার্ষের জন্যও ক্ষেত্র তত্ত্ব দাঁড় করালেন। তারপর ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন দাঁড় করালেন মহাকর্ষের নতুন থিয়োরি। এই থিয়োরিতে মহাকর্ষ তত্ত্বের সাথে আপেক্ষিক তত্ত্বের মেলবন্ধন ঘটানো হলো। এই তত্ত্বের নাম দেয়া হলো জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিতা।

নিউটনকে আলোকে কণা মনে করতেন। তাই তাঁর মহাকর্ষ নিয়মে আলোর কণার ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব ছিল। আইনস্টাইনের মহাকর্ষের ধরণ আলাদা। তাছাড়া আইনস্টাইন নিশ্চিত করলেন আলোর বেগের ধ্রুবতা। দেখালেন স্থানকালের বক্রতার কারণে আলোর গতিপথ বেঁকে যায়। আরও বললেন শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আলোর কম্পাঙ্ক মহাকর্ষ ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়।

আইনস্টাইন বললেন, আলোক তরঙ্গের কম্পাঙ্কের মান মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে। যে মহাকর্ষ ক্ষেত্র যত শক্তিশালী সেখানে আলোর কম্পাঙ্ক কমে যায়। যেখানে মহাকর্ষক্ষেত্র কম শক্তিশালী সেখানে আলোর কম্পাঙ্ক তুলনামূলক বেশি।

ধরা যাক, একটা পরমাণু একটা আলোর উৎস। পরমাণুটি যদি পৃথিবীতে থাকে তা হলে সেটার কম্পাঙ্ক ধরা যাক বেগুনি আলোর কম্পাঙ্কের কাছাকাছি। কিন্তু পরমাণুটি যদি সূর্য পৃষ্ঠে থাকে তাহলে তার কম্পাঙ্ক বেগুনি আলোর কম্পাঙ্কের চেয়ে অনেক কম হবে। অর্থাৎ কম্পাঙ্ক লাল আলোর কাছাকাছি হবে।

এখানে বলে রাখা ভালো, সূর্যের সাদা আলো সাত রংধনুর সাতরংয়ের মিশ্রণ। বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ হলুদ, কমলা, লাল। এদেরকে এক কথায় বলা হয় বেনীআসহকলা। বেণীআসহকলার এই সমন্বয়টা কিন্তু এলোমেলো নয়। কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে ক্রমানুসারে সাজানো হয়েছে। যেমন বেগুনি আলোর কম্পাঙ্ক সবচেয়ে বেশি। তারচেয়ে কম নীল আলোর। এর পরের স্থানটা আসমানীর, তারপর সবুজ, হলুদ, কমলা এবং সবশেষে লাল। আমরা এখানে নীল ও লাল আলোর তরঙ্গ নিয়ে কাজ করব। কারণ বেগুণী আলোর বর্ণালী অত স্পষ্ট নয়। সে তুলনায় নীল আলোর বর্ণালী অনেক স্পষ্ট। তাই নীল আলো নিয়ে কাজ করতে অনেক সুবিধা।

এখন আরেকটা বিষয় জানা জরুরি, যে আলোর কম্পাঙ্ক যত বেশি সেই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত কম। সেই হিসাবে বেগুনি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে ছোট। এখন কম্পাঙ্ক ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যটাই বা কী? আমরা আগেই জেনেছি আলোতরঙ্গকারে চলে। আর তরঙ্গ মানেই ঢেউ। আলোর ঢেউ নিচের চিত্রের মতো।

 

প্রত্যেক তরঙ্গের শীর্ষ ও পাদ বিন্দু থাকে। একটা শীর্ষ বিন্দু থেকে আরেকটা শীর্ষ বিন্দু পর্যন্ত তরঙ্গ অর্ধ চক্র পূর্ণ করে। অর্থাৎ ১৮০ ডিগ্রি পথ পাড়ি দেয়। দুটো অর্ধচক্র সম্পন্ন হলে আলো একটা পূর্ণ চক্র পাড়ি দেয়। এক সেকে­ে আলো যে কয়কটি পূর্ণ চক্র সম্পূর্ণ করে তাকে কম্পাঙ্ক বলে।

করতে যখন সরলরৈখিক পথ পাড়ি দেয় সেটাকে ওই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ বলে। তরঙ্গের একটা শীর্ষ বিন্দু থেকে আরেকটা শীর্ষ বিন্দু পর্যন্ত সরল রেখাকেও তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে। একটা পাদ বিন্দু থেকে আরেকটা পাদ বিন্দু পর্যন্ত দূরত্বকেও তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে।

 

নীল আলোর একটা পূর্ণ চক্র বেশ লম্বাটে। তাই এর একটা তরঙ্গ শীর্ষ থেকে আরেকটা তরঙ্গ শীর্ষ পর্যন্ত রৈখিক দৈর্ঘ্যও কম। অন্যদিকে লাল আলোর তরঙ্গের ক্ষেত্রে একটা শীর্ষ থেকে আরেকটা শীর্ষ বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব নীল আলোর তুলনায় অনেক বেশি। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য শুধু নীর রংয়ের আলোর চেয়ে বেশি নয়, যেকোনও দৃশ্যমান আলোর চেয়ে বেশি। নিচের চিত্রের দিকে লক্ষ রাখলেই বুঝতে পারবে। চিত্রে নীল, সবুজ ও বেগুনি আলোর তরঙ্গ দেখানো হয়েছে।

 

 

এখন নীল ও লালের আলোকে বেনীআসহকলার দুটি প্রান্তীক তরঙ্গ ধরে নিই। বেগুনিকে বাদ দেওয়া হলো, কেন তা আগেই ব্যাখ্যা করেছি। তাই দুটোকেই আমাদের তুল্য আলোক তরঙ্গ ধরতে পারি। এখন আমরা যাব ডপলার এফেক্টে। ডপলার এফেক্টের উদাহরণেও আমরা ট্রেন স্টেশনকে ব্যবহার করতে পারি। তবে এখানে আলোক তরঙ্গের বদলে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করা হবে।

ধরুন স্টেশনে বসে আছন। দূর থেকে একটা ট্রেন হুইসেল বাজাতে বাজাতে স্টেশনের দিকে আসছে। আপনি শুনবেন, ক্রমে ট্রেনের হুইসেলের শব্দ তীক্ষ্ন থেকে তীক্ষ্নতর হচ্ছে। এক সময় ট্রেন স্টেশনে দাঁড়াবে। ধরা যাক, স্টেশনে দাঁড়ানে অবস্থাই ট্রেন হুইসেল বাজালো। তখন তুমি হইসেলের শব্দ আগের মতো তীক্ষè শুনবে না। সবাভাবিক হুইসেলই শুনেবেন।

ট্রেনের যাত্রীরা যেমন শোনে আরকি।  যখন ট্রেন স্টেশন ছেড়ে দূরে যেতে থাকবে তখন ট্রেনের হুইসেলের শব্দের তীক্ষ্নতা তত কমবে। হুইসেলের স্বরও তখন বেশ মোটা হয়ে যাবে। ট্রেনের ভেতর যেসব যাত্রী থাকে তারা সবসময় একই রকম শব্দ শুনতে পায়। এটা কেন হয়? এটা হয় ডপলার এফেক্টের কারণে। অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ ক্রিশ্চিয়ান ডপলার ১৮৪২ ডপলার এফেক্ট নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচন করেন।

আপেক্ষিক গতির কারণে শব্দের কম্পাঙ্কের এই পরিবর্তন  ঘটে। আইনস্টাইন হিসাব করে দেখলেন মহাকর্ষ ক্ষেত্র দিয়ে চলার সময় আলোক তরঙ্গের কম্পাঙ্কের এমন তারতম্য ঘটে। আলোর ক্ষেত্রেও ডপলার এফেক্ট কাজ করে। আলোর উৎস যখন নীকটবর্তী হয় তখন আলোর কম্পাঙ্ক তীক্ষ্ন আর কম্পাঙ্কের বিচ্যূতি ঘটে নীলের দিকে।

আর উৎস যখন দূরে সরে যায়, তখন আলোর কম্পাঙ্ক লালের দিকে বিচ্যূত হয়। আইনস্টাইন লক্ষ করে দেখলেন, যেখানে মহাকর্ষ ক্ষেত্র নেই সেখানে আলোর কম্পাঙ্ক একরকম, যেখানে শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্র আছে সেখানে আলোর কম্পাঙ্ক আগের তুলনায় কম। অর্থাৎ শূন্যস্থানের চেয়ে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর আলোর কম্পাঙ্ক কম হয় এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যায়।

এখন তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে সর্বোচ্চ কত বেশি এবং কমে সর্বনিম্ন কত হতে পারে? যেহেতু লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি তাই এটাকে একটা সীমারেখা ধরা হয়। আবার নীল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম। তাই এটাকে আরেকটা সীমারেখা ধরা হয়।

এখন কথা হচ্ছে, মহাকর্ষ ক্ষেত্র যত শক্তিশালী অর্থাৎ হচ্ছে, অর্থাৎ মহাকর্ষীয় বিভব যেখানে সবচেয়ে বেশি সেখানকার আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে লালের দিকে চলে যাবে। যেমন সবুজ আলোর অবস্থান সাতটি আলোর ঠিক মাঝখানে।

ধরা যাক, একটা সবুজ আলোক রশ্মিকে শক্তিশালী একটা মহাকর্ষ ক্ষেত্রে নেওয়া হলো। এর ফলে ধরা যাক, সবুজ আলোটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে হলুদ আলোর সমান হলো। তবুও কিন্তু একে আমরা লালের দিকে বিচূত্যি বলব। নিচের চিত্রের দিকে খেয়াল করুন–

এখানে সবুজ আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে হলুদের সমান হয়ে গেছে। কিন্তু লাল আলোকে আমরা গন্তব্য বিন্দু ধরেছি। তাই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হলুদের দিকে যাওয়া মানেই বিচ্যুতি লালের দিকে হলো।

এখন আলোটা শক্তিশালী মহাকর্ষীয় বিভব থেকে সরিয়ে তুলনামূলক কম শক্তিশালী মহাকষীয় বিভবে নেওয়া হলো। ফলে আলোর কম্পাঙ্ক গেল বেড়ে । কমল তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। সবুজ আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমে পরিণত হলো আসমানীতে। নিচের চিত্রের মতো–

সবজু আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমে আসমানীতে পরিণত হলো, তারমানে সে নীল আলোর দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল। এজন্য একে নীল বিচ্যুতি বলে।

আইনস্টাইন শুধু ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। কিন্তু তিনি এ-ও বলেছিলেন, মহাকর্ষীয় বিভবের তারতম্যের কারণে আলোর লাল ও নীল বিচ্যুতির এই ভবিষদ্বাণী যদি প্রমাণীত না হয় তাহলে ‘সাধারণ আপেক্ষিক’ তত্ত্ব ভুল বলে ধরে নিতে হবে। আর যদি প্রমাণিত হয় তবে, এই তথ্য থেকে নক্ষত্র সহ মহাকাশে গ্রহ নক্ষত্রের ভর সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।

১৯২৪ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যাডামসন আইনস্টাইনের এই ভবিষৎদ্বাণী প্রমাণ করেন। মহাকাশে লুব্ধক নামে একটা তারা আছে। এর সাথে আছে আরেকটি জমজ তারা। সেই তারায় আলোক তরঙ্গের লাল বিচ্যুতির বিষয়টির পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেন তিনি।

এখন আরেকটা কথা বলা জরুরি। মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে যে বিচ্যুতি এটাও কিন্তু ট্্েরনের মতো। ট্রেনের যাত্রীরা যেমন শব্দের তীক্ষèতার পরিবর্তন সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না, তেমনি পৃথিবীতে বসে আমরা পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্রের কারণে আলোক তরঙ্গের যে বিচ্যুতি ঘটে তা বুঝতে পারব না। বুঝতে পারব অন্য কোন মহাকর্ষ ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটলে। আর এই ঘটনার জন্য কিন্তু নিউটনীয় মহাকর্ষ বল দায়ী নয়। বরং স্থানকালের বক্রতার কারণেই এই ব্যাপারটি ঘটছে।

আইনস্টাইন হিসেব করে দেখলেন, দূর নক্ষত্র থেকে পৃথিবীতে আসা আলোক রশ্মি আমাদের সূর্যের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেরত দিয়ে আসার সময় বেঁকে যায়। আমরা আকাশে একটা নক্ষত্রকে জ্বলতে দেখি। আইনস্টাইনের মতে যেখানে নক্ষত্রটাকে জ্বলতে দেখি, তার অবস্থান সেখানে নয়। তার থেকে একটু বিচ্যুত জায়গায়। আইনস্টাইন হিসেব করে দেখালেন সূর্যের কোলঘেঁষে আসার সময় ওইসব নক্ষত্রের আলো কতটুকু পরিমাণ বিচ্যুত হয়। আইনস্টাইন বললেন এই বিচ্যুতির পরিমাণ ১.৭৫ সেকেন্ড-চাপ।

নিউটনও কিন্তু জানতেন দূর নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে আসার সময় বেঁকে যায়। তাই নক্ষত্রটাকে একটু বিচ্যূত জায়গায় আমরা দেখি। নিউটনে ব্যাখ্যা অবশ্য আলাদা। নিউটন আলোর কণা ধর্মের জনক। তিনি মনে করতেন আলো কণা বলেই মহাকর্ষ বলের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। এজন্য দূর নক্ষত্রের আলো পৃথিবীতে আসার সময় বেঁকে যায়।

কিন্তু নিউটনের হিসাব অনুয়ায়ী আলোর এই বিচ্যুতির পরিমাণ ০.৮৫ সেকেন্ড-চাপ। আইনস্টাইনের হিসেবে সেটা এর প্রায় দ্বিগুন। এখন সত্যিকারের পরীক্ষার ফলটা যার সাথে মিলে যাবে তিনিই নিশ্চিতভাবে তাঁর মহাকর্ষ নীতিই ঠিক। আইনস্টাইন বললেন এটা পরীক্ষা করার উপযুক্ত সময় পুর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দিন। কারণ সুর্যের কোলঘেঁষে যেসব আলো পৃথিবীতে আসার অন্যদিনে সুর্যের আলোর আড়ালে তা হারিয়ে যায়। পূর্ণগ্রাস সুর্যগ্রহণই এই পরীক্ষার উপযুক্ত সময়।

১৯১৯ সালের ২৯ মে সূর্য গ্রহণের দিন দুদল বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এই তত্ত্বের প্রমাণ দিতে গেলেন। ইংরেজ জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটনের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী গিয়েছিলেন পশ্চিম আফ্রিকার প্রিন্সিপি নামের এক দ্বীপে। আরেকটি দলের নেতৃত্বে ছিলে ক্রোমোলিন। তাঁরা গেলেনে ব্রাজিলের সোব্রালে।

১৯১৯ সালের ৬ নভেম্বর লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি ওরয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির যৌথ বার্ষিক সভায় দুই দলের পরীক্ষার ফলাফল উত্থাপিত হলো। দুদলই সূর্যগ্রহণের সময় একটা নক্ষত্রের আলোা বিচ্যুতি পরীক্ষা করেছিলেন। দুদলের একদল ফলাফল পেলেন ১.৯৮ সেকেন্ড চাপ, আরেক দলের ফলাফল হলো ১.৬১ চাপ। দুই ফলাফলের গড় করলে দাঁড়ায় ১.৭৯৫ সেকেন্ড চাপ। আইনস্টাইনের অনুমানের খুব কাছাকাছি ফল এলো। অর্থাৎ সন্দেহতীতভাবে প্রমাণ হলো মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আলোক রশ্মি বেঁকে যায়।

চলবে……

আগের সব পর্ব :
কৃষ্ণগহ্বর-৬ : আপেক্ষিকতা ও আধুনিক মহাকর্ষ

কৃষ্ণগহ্বর-৫ : আলোর কচড়া

কৃষ্ণগহ্বর-৪ : নিউটনের কামান আর পৃথিবীর মুক্তিবেগ

কৃষ্ণগহ্বর-৩ : নিউটনের মহাকর্ষে

কৃষ্ণগহ্বর-২ : মহাকর্ষের পটভূমি

কৃষ্ণগহ্বর-১ : ফিরে দেখা ইতিহাস

-আব্দুল গাফফার রনি
সহসম্পাদক, মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

[এই লেখাটি কৃষ্ণগহ্বর ঃ এক মহাজাগতি রহস্যের ঊপাখ্যান বইয়ের অংশবিশেষ। বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশ করবে অন্বেষা প্রকাশন]

1 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.