আল হাজেন: আলোকবিজ্ঞানের জনক
এর শুরুটা হয়েছিল অনেক অনেক দিন আগে। আল হাজেন নামের প্রাচীন আরবের এক বিজ্ঞানী প্রথমবারের মতো বললেন, কোন কিছু থেকে আমাদের চোখে আলো এসে পড়লেই কেবল আমরা সেই জিনিসটাকে দেখি। আল হাজেনের আসল নাম আবু আলি আল হাসান ইবনুল হাসান ইবনুল হাইসাম। আমাদের খুব পরিচিত না হলেও মানুষ হিসেবে উনি মোটেও হেলাফেলা করার মতো না। তাঁর আগে মানুষের মাঝে আলো নিয়ে ইউক্লিডের একটা মতবাদ ছিল। ইউক্লিড বলেছিলেন, আলো জিনিসটা মানুষের চোখ থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোন কিছুর উপরে পড়লে আমরা সেই জিনিসটাকে দেখি। ইউক্লিড গ্রিস বিজ্ঞানী আর সেই যুগে তাদের প্রভাবও ছিল ভয়াবহ। অ্যারিস্টটল, থিওফ্রাস্টাস, টলেমি সহ গ্রীক বিজ্ঞানীদের তখন জয়জয়কার। তাঁরা যে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন নি, তা নয়। কিন্তু তাঁদের প্রভাবের কারণে অনেক ভুল মতবাদও মানুষ প্রতিবাদ না করেই মেনে নিয়েছিল এবং সেই মতবাদ যুগের পর যুগ চলেও এসেছে দিব্যি।
আল হাজেন যে ইউক্লিডের ভুল মতবাদ ভেঙ্গে দিয়েই থেমে গেছেন, এমন নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির(Scientific method) কথাও তিনিই প্রথম বলেছিলেন। স্পষ্ট করেই আল হাজেন বলেছিলেন, সব কিছু, সব কিছুর ব্যাপারে প্রশ্ন করতে হবে এবং ধাপে ধাপে প্রত্যেকটা জিনিসকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মানুষটাও ভুল বলতে পারে, কাজেই প্রশ্ন এবং পরীক্ষা না করে কোন কিছু মেনে নেয়া যাবে না। সরল কথায়, বিজ্ঞানের নামে ভুল কিছু চালিয়ে দেয়ার দিন তখন থেকেই শেষ।
কোন কিছু থেকে আলো এসে আমাদের চোখে পড়লেই কেবল আমরা সেটাকে দেখি, এই তথ্যটা বিজ্ঞানের জগতে একটা বিপ্লবের শুরু করেছিল। কে জানতো, মহাকাশের দূর দূর প্রান্তের কোন এক নক্ষত্র থেকে আমাদের কাছে যে আলো এসে পৌঁছায়, সেই আলোর মাঝেই লুকিয়ে আছে মৌলের টিপসই! যে টিপসই দেখে আমরা ঠিক ঠিক বের করে ফেলতে পারবো, সেই নক্ষত্রের মাঝে ঠিক কী কী পদার্থ আছে!
নিউটনের প্রিজম পরীক্ষা: সাদার মাঝে সাতরঙা আলো
নিউটন সাহেবের আপেল এবং মহাকর্ষের গল্প যেমন সবার জানা, প্রিজমের গল্পও মোটামুটি তাই। গল্পটা এমন কিছু আহামরিও না। তিনটা কাঁচ দিয়ে তৈরি পিরামিড আকৃতির একটা জিনিসকে বলে প্রিজম। নিউটন একটা অন্ধকার ঘরে একটা ছোট্ট ফুটা করে রাখলেন, যাতে এর মধ্য দিয়ে সামান্য একটু আলো সরল রেখা মতোন হয়ে ভেতরে আসতে পারে। ওই ফুটার সামনে রেখে দিলেন প্রিজম। সূর্যের সাদা আলো ফুটোর মধ্য দিয়ে প্রিজমে এসে পড়ল এবং সাত রঙে বিভক্ত হয়ে গেল। ওই সাত রঙ আবার যেন তেন রঙ না, আকাশের মাঝে রংধনুতে ঠিক এই সাতটা রংকেই দেখা যায়! জানা গেল, সাদা আলো মানেই সাদা আলো না, এটা মূলত এই সাত রঙের আলোর সমষ্টি। বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা এবং লাল। সংক্ষেপে বেনীআসহকলা।
এখানে একটা কথা একটু বলে নেই। প্রিজম জিনিসটা নিউটন সাহেবের আগে থেকেই ছিল, এবং প্রিজম থেকে যে এই সাত রঙের আলো বের হয়ে আসে- এইটাও মানুষ আগে থেকেই জানতো। তো, নিউটন সাহেব আসলে কী করেছিলেন?
আসলে, আগে মানুষের ধারণা ছিল, সাদা আলো মূলত বর্ণহীন। প্রিজমের উপরে সাদা আলো পড়লে সেখান থেকে যে সাত রঙের আলো বেরিয়ে আসে, এর মানে, মানুষ ভাবতো, এটা মূলত প্রিজমের কেরামতি। নিউটন এই ভুল ধারণাটা ভেঙ্গে দিয়ে বললেন, আসলে এই সাত রঙ সাদা আলোর মধ্যেই লুকায়িত ছিল। সাতরঙা এই আলোকে বলা হলো বর্ণালী। কিন্তু এটা উনি প্রমাণ করলেন কিভাবে?
দুইভাবে কাজটা করা হলো।
এক, একাধিক প্রিজমকে সাদা আলোর সামনে রেখে দেখা গেল, সব প্রিজম এই সাদা আলোকে একইভাবে সাতরঙে ভাঙ্গছে।
দুই, একটা প্রিজম থেকে বেরিয়ে আসা সাত রঙা আলোকে আরেকটা প্রিজমের উপরে ফেলে দেখা গেল, সাতরঙা ওই আলো দ্বিতীয় প্রিজম থেকে সাদা আলো হিসেবে বেরিয়ে আসছে।
আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, বিকিরন এবং শোষন নিয়ে নিউটন আরো বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। সেসব কিছু উনি একটা বইতে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে গেছেন। সেই বইয়ের নাম, Opticks: Or, a Treatise of the Reflexions, Refractions, Inflexions and Colours of Light। আরেকটু ছোট্ট একটা কাজ করলেই নিউটন হয়তো আরেকটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেটা করেন নি। সেই কাজটা হতে হতে লেগে গেল আরো প্রায় দেড়শ বছর!
এই দেড়শ বছরে একজন রসায়নবিদ আলো নিয়ে এক-আধটু ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন অবশ্য। তাঁর নাম উইলিয়াম হেইড ওলাস্টন (William Hyde Wollaston)। ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে তিনি জিনিসগুলো দেখেছিলেন। বর্ণালীর মাঝে কয়েকটা কালো রেখা। কিন্তু এই সামান্য কালো রেখাগুলো নিয়ে তিনি মাথা ঘামানোর একটুও প্রয়োজন বোধ করেন নি। আলো নিয়ে কাজ, কালো নিয়ে মাথা ঘামাতে বয়েই গেছে!
আলোর মাঝে কালো: ফ্রনহফার লাইন এবং জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জন্ম
জার্মানির স্ট্রাবিং (Straubing) শহরের বাজে এক কাঁচ ব্যবসায়ীর অধীনে কাজ করত জোসেফ ভন ফ্রনহফার। এগারো বছর বয়সে এতিম হয়ে গিয়েছিল ছেলেটা। ব্যবসায়ী লোকটা ওকে দিয়ে দিনেই যে শুধু কারখানায় কাজ করাতো, তা না। রাতে ফ্রনহফারকে দিয়ে গৃহস্থালী কাজ-কর্মও করিয়ে নিত। পড়াশোনা করার ভাগ্যটাও হয় নি বেচারার। ওভাবেই হয়তো জীবনের ঘানি টেনে যেতে হতো, কিন্তু আশীর্বাদ হয়ে এলো ভবনধ্বস। কেউ নাড়া দেয় নি অবশ্য, তবু কেমন করে যেন সেই কাঁচ ব্যবসায়ীর বাড়ি কাম কারখানাটা হঠাত ধ্বসে পড়ল। একরকম জ্যন্ত কবর হয়ে গেল বেচারার।
সেই কবর থেকে ফ্রনহফারকে উদ্ধার করলেন এলাকার যুবরাজ। তাঁর নামও জোসেফ (Maximilian I Joseph)। পরবর্তীতে তিনি ব্যাভারিয়ার রাজা হয়েছিলেন। তিনি ফ্রনহফারকে বেনেডিক্টবার্ন অ্যাবিতে ভর্তি করিয়ে দেন। এখানেই ফ্রনহফার কাঁচ বানানোর ব্যাপারে তাত্ত্বিক সব কিছু শিখলেন এবং পিয়েরে লুইস গুইনান্ড(Pierre Louis Guinand) নামের এক ভদ্রলোকের সাথে তাঁর পরিচয় হলো। ভদ্রলোক ছিলেন কাঁচ প্রযুক্তিবিদ। ওনার কাছ থেকে ফ্রনহফার কাঁচের ব্যাপারে গোপন এবং চমৎকার বেশ কিছু জিনিসপত্র শিখলেন। কাঁচ নিয়ে ফ্রনহফার বিস্তর কাজ করেছেন এবং তাঁর সময়ে ব্যাভারিয়া কাঁচের জন্যে বানিজ্যিকভাবে বেশ প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের জন্যে কী করেছেন ফ্রনহফার?
এই, এতোদিনের সব জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ফ্রনহফার চমৎকার কিছু প্রিজম এবং টেলিস্কোপ লেন্স বানালেন। তারপর সেই প্রিজম টেলিস্কোপের সামনে ধরে চোখ রাখলেন পেছনে। বর্ণালীর মাঝে কালো কালো দাগ দেখতে পেয়ে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, কেন? আলোর মাঝে কালো কেন?
ঠিক এই মুহুর্তে, নিউটনের প্রিজম পরীক্ষার প্রায় দেড়শ বছর পরে, পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের মাঝে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হলো। এই সম্পর্কের ফলে জন্ম নিল বিজ্ঞানের নতুন শাখা, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান।
ফ্রনহফার বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৯ বছর। এই সময়ের মাঝেই তিনি বেশ চমৎকার কিছু কাজ করলেন। বর্ণালী বিশ্লেষণের জন্যে তিনি বেশ চমৎকার একটা যন্ত্র বানালেন, এর নাম স্পেক্ট্রোস্কোপ(Spectroscope)। এটা দিয়ে আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে প্রতিটা আলাদা আলাদা বর্ণের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য, তীব্রতা বা শক্তি ইত্যাদি মেপে দেখা যায় এবং খুঁটিনাটি সব কিছু বিশ্লেষণ করা যায়। সবচেয়ে চমৎকার যে জিনিসটা ফ্রনহফার দেখালেন, সেটা হলো আলো যেখান থেকেই আসুক, হোক সেটা সূর্য কিংবা চাঁদ কিংবা অন্য কোন তারা- একটা নির্দিষ্ট ধরণের রেখা সবসময় বর্ণালীর একটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই পাওয়া যাচ্ছে। এটার মানে যে কী, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি সেটা বের করে যেতে পারেন নি।
ছোট বেলায় কাঁচ বানানোর কারখানায় রাসায়নিক নিয়ে কাজ করার ফলে তিনি হঠাত করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৩৯ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর সম্মানে এই কালো রেখাগুলোর নাম দেয়া হয় ফ্রনহফারের রেখা (Fraunhofer lines)।
কার্শফ থেকেন নীলস বোর: কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্ম
ফ্রনহফার বেশ ভালোরকম একটা নাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানকে। কাজেই, ফ্রনহফারের কিছু দিন পরেই কার্শফের গবেষণা থেকে এই নিয়ে বেশ চমৎকার একটা জিনিস বেরিয়ে এলো। কেন আলো এবং কেন অন্ধকার। কার্শফ ঠিক কী বলেছিলেন, সেটা একটু পরে বলি। কারণ, ওটকু বোঝার জন্যে আমাদের পরমাণু নিয়ে বিজ্ঞানীদের কাজ-কারবারের মাঝে একটুখানি ঢুঁ দিতে হবে।
আগে মনে করা হতো, পরমাণু জিনিসটাকে আর ভাঙ্গা যায় না। মানে, আমাদের জানা সবচেয়ে ক্ষুদ্র জিনিস এই পরমাণু এবং এর চেয়ে ছোট আর কিছু হতে পারে না। এই চিন্তার উপরে ভিত্তি করে জন ডাল্টন একটা মতবাদ দাঁড়া করেছিলেন। এর পরে অনেক কিছু ঘটে গেছে, ফ্রনহফার জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান নামের আস্ত একটা বিজ্ঞানের শাখার জন্ম দিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু পরমাণুর চেয়েও যে ছোট কিছু থাকতে পারে, সেটা তখনো কেউ বুঝতে পারেন নি। এই ব্যাপারটার শুরু হলো থমসন (J. J. Thomson) সাহেবের ইলেকট্রন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এর কিছুদিন পরে রাদারফোর্ড (Ernest Rutherford) নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করলেন এবং পরমাণুর গঠন নিয়ে একটা তত্ত্ব দাঁড় করালেন। এর নাম রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল। সেই মডেলের হিসেবে, পরমাণুর নিউক্লিয়াস সৌরজগতের সূর্যের মতো এর কেন্দ্রে থাকে এবং গ্রহগুলো যেমন করে সূর্যের চারপাশে ঘোরে, ইলেকট্রনগুলো তেমনি নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। এই মডেলের বেশ কিছু সমস্যা আছে। এর মাঝে মূল সমস্যাটা হলো এই, কোন কিছু যদি আরেকটা কিছুকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে, তাহলে সে শক্তি হারিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই কেন্দ্রের ওই জিনিসটার টান খেয়ে কেন্দ্রে এসে আছড়ে পড়বে। আঙ্গুলের সাথে কোন কিছুকে সুতায় বেঁধে ঘুরালে সেটা যেমন আঙ্গুলের উপরে এসে পড়ে, ঠিক তেমন। এখানে একটা জিনিস বলে রাখা ভালো, আঙ্গুল যেমন সুতোকে নিজের দিকে টানে, তেমনি নিউক্লিয়াসের মাঝে থাকা ধনাত্মক প্রোটনও ঋণাত্মক ইলেকট্রনকে টান দেয়। এইটা হলো তড়িৎচৌম্বকীয় ভালোবাসা। সৌরজগতে যেহেতু পৃথিবী বা সূর্যের কোন ধণাত্মক বা ঋণাত্মক ব্যাপার নেই, কাজেই এদের মধ্যে এই ঝামেলাও নেই। যাঁরা আরেকটু এগিয়ে মহাকর্ষের টানের ব্যাপারে জানতে চান, তাঁদের জন্যে বলি। পৃথিবীও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে ঘুরতে নিয়মিত একটু একটু শক্তি হারায়। যেহেতু সূর্য পৃথিবীকে মহাকর্ষ শক্তি দিয়ে টানে, কাজেই পৃথিবী থেকে এই শক্তি বেরিয়ে যায় মহাকর্ষ তরঙ্গ হিসেবে। এই হারানো শক্তির পরিমাণ খুবই কম। কাজেই, আগামী বেশ কয়েক বিলিয়ন বছরে আমাদের এই নিয়ে কোন চিন্তা নেই। চিন্তা অন্য জায়গায়। যতদিনে সূর্যের টানে পৃথিবী সূর্যে এসে আছড়ে পড়ার কথা, তার অনেক আগেই সূর্যের জ্বালানী শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বর্তমান হিসেব অনুযায়ী, সূর্যের আর মাত্র ৫ বিলিয়ন বছরের মতো জ্বালানী বাকি আছে। ততদিনে আদৌ যদি আমরা বেঁচে থাকি আরকি, তাহলে আগে আমাদের ওটা নিয়ে ভাবতে হবে।
পরমাণুর গঠনর কথায় ফিরি।
রাদারফোর্ডের পরমাণুর এই মডেলকে সংশোধন করে তাঁর ছাত্র নীলস বোর আরেকটা নতুন মডেল দাঁড় করালেন। বোর বললেন, পরমাণুর গঠণ আমাদের চিরচেনা পদার্থবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। কারণ হিসেবে তিনি তাঁর মডেলে ইলেকট্রনের একটা বিচিত্র জিনিস দেখালেন। বললেন, পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে আছে কিছু স্তর। এদের মাঝের জায়গাটা ফাঁকা। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি না পেলে ইলেকট্রনটা আগের স্তর থেকে লাফ দিয়ে উপরের স্তরে যেতে পারবে না কিংবা ওই একই নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি ছেড়ে না দিলে নিচের স্তরে চলে যেতে পারবে না। এই, স্তরগুলোকে চিহ্নিত করা হলো ‘প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা’ নামে এক ধরণের সংখ্যা দিয়ে। আর, এই নির্দিষ্ট পরিমাণের নাম দেয়া হলো ‘কোয়ান্টা’। ব্যপারটা অনেকগুলো কারণে বিচিত্র। এর মাঝে একটা হলো, একটা বল যেমন একটু শক্তি পেলে একটুখানি এগিয়ে যায়, আরেকটু শক্তি পেলে আরেকটু এগিয়ে যায়, এখানে ইলেকট্রন অমন আচরণ করছে না। নির্দিষ্ট ওই পরিমাণ শক্তিই তার লাগবে, নাহলে সে কিছুতেই এই লেভেল ছেড়ে নড়বে না। ওই পরিমাণ মানে, ওই পরিমাণের পূর্ণসংখ্যার গুণিতকও হতে পারে। যেমন, এক কোয়ান্টা কিংবা দুই কোয়ান্টা হতে পারে, কিন্তু দেড় কোয়ান্টা হবে না। কোয়ান্টার এই ধারণাকে ঘিরে ম্যাক্সওয়েল নামে একজন বিজ্ঞানীর হাত ধরে পদার্থবিজ্ঞানের যে নতুন ধরণের শাখার জন্ম হলো, এরই নাম কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
পরমাণুর মডেল নিয়ে সমস্যার শেষ এখানেও হয় নি। আমাদের আলোচনার জন্যে যদিও আর কিছু আপাতত জানার প্রয়োজন নেই, তবু ব্যাপারটা আরেকটু ঘেঁটে দেখা যাক! সমারফিল্ড আবার বোরের মডেলকে সংশোধন করে দেখিয়েছিলেন, প্রতিটা স্তরে কিছু উপস্তর থাকে। ইলেকট্রনেরা সরাসরি স্তরের মধ্যে থাকে না, থাকে উপস্তরে। কিছুটা অ্যাপার্টমেন্টের হলওয়েতে বসবাস না করে ফ্ল্যাটে বসবাস করার মতো। কিন্তু ইলেকট্রন আর প্রোটনের মাঝের ভালোবাসাটা যেহেতু তড়িতচৌম্বকীয় ভালোবাসা, কাজেই এদেরকে চৌম্বকক্ষেত্রে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হলো দেখার জন্যে, এরা কী করে। দেখা গেল এরা চৌম্বকক্ষেত্রে বেড়াতে আসলে সমতল ফ্ল্যাট হিসেবে আর থাকতে চায় না। মানে এদের স্তর আর উপস্তর মিলে ঝিলে ত্রিমাত্রিক ভাবে বিভিন্ন আকৃতি নেয়, যেমন, বলের মতো গোল আকৃতি। আরো কিছু সমস্যা তখনো রয়ে গিয়ে ছিল। পাউলি দেখালেন, এক বাসার এক রুমে সর্বোচ্চ দুটো ইলেকট্রন থাকতে পারে, সরল কথায় যাদের একজন ডান দিকে ঘুরলে আরেকজন বাম দিকে ঘুরবে, কাজেই এদের মধ্যে কোন রকম মারামারি হবে না। একটু বৈজ্ঞানিকভাবে বললে, একটা যদি ঘড়ির কাঁটার দিকে(ডানদিকে) ঘোরে, আরেকটা ঘুরবে ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে(বামদিকে)। এখান থেকে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বোঝা যায়। যে কোন দুটো ইলেকট্রনকে নিয়ে আমরা যদি কোন একটা পরীক্ষা করি, দেখবো যে, এরা একই অ্যাপার্টমেন্টের একই ফ্ল্যাটে, একই রুমে থাকলেও এরা কখনোই একই দিকে ঘুরবে না।
আগেই বলেছি, স্তরগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা’ নামে এক ধরণের সংখ্যা দিয়ে। উপস্তরগুলোকে চিহ্নিত করা হলো ‘সহকারি কোয়ান্টাম সংখ্যা’ দিয়ে। চৌম্বকক্ষেত্রে এদের বিভিন্ন আকৃতিকে চিহ্নিত করা হলো ‘চৌম্বকীয় কোয়ান্টাম সংখ্যা’র মাধ্যমে। আর, কোন দিকে ঘুরবে, এটাকে চিহ্নিত করা হলো ‘স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা’ দিয়ে। এবারে, উপরের গুরুত্বপূর্ণ কথাটা আবার একটু এই সংখ্যাগুলো দিয়ে বুঝে নেয়া যাক। পাউলির হিসেবে, ইলেকট্রনের চারটা কোয়ান্টাম সংখ্যা কখনোই এক হবে না।
এখন, একটা কথা বলে নেয়া ভালো। এই আলোচনায় পরমাণুর ভেতরের সব কিছুকে খুবই সরল করে বলা হলেও বাস্তবে ব্যাপারগুলো মোটেও এতোটা সরল নয়। কিন্তু, এইবেলা আর জটিল ব্যাপার স্যাপারের দিকে না গিয়ে আমরা আমাদের প্রসঙ্গে ফিরি!
বর্ণালী: মৌলের টিপসই
বর্ণালীর ব্যাপারে জানার জন্যে আমাদের কোয়ান্টার ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে। ওই যে, ইলেকট্রন নিচের লেভেলে নামতে গিয়ে কোয়ান্টা হিসেবে শক্তি ছেড়ে দিচ্ছে এবং উপরের লেভেলে উঠতে গেলে কোয়ান্টা হিসেবে শক্তি টেনে নিচ্ছে- এই ব্যাপারটা।
শক্তির যে অনেকগুলো রূপ আছে, সে তো আমরা জানিই। তাপ হোক, আলো হোক কিংবা বিদ্যুৎ- এসবই শক্তির বিভিন্ন রূপ। কাজেই, একটা জিনিস কিছু শক্তি ছেড়ে দিলে সেটা তাপ হিসেবে যেমন দিতে পারে, আলো হিসেবেও দিতে পারে- দুটো একই কথা। আরেকটু এগিয়ে এসে ব্যাপারটাকে এভাবেও বলা যায় যে, কোন কিছু যদি কিছু আলো ছেড়ে দেয় তাহলে সে কিছু তাপ হারাবে! এই কারণেই সূর্যের আলোতে হাঁটতে গেলে আমাদের গরম লাগে, মানে আমরা আলোর সাথে সাথে শক্তি হিসেবে তাপটাকেও অনুভব করি।
আচ্ছা, ইলেকট্রন কী করছে আসলে? নিচের স্তর থেকে উপরের স্তরে যাওয়ার জন্য কিছু শক্তি টেনে নিচ্ছে। তার মানে, যেখান থেকে সে শক্তিটুকু টেনে নিচ্ছে, সে জায়গায় শক্তি একটুখানি কমে যাচ্ছে। আলো হিসেবে যদি বলি, ইলেকট্রন যদি একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গের আলো টেনে নেয়, তাহলে সে জায়গায় ওই নির্দিষ্ট তরঙ্গের অংশটুকু কালো হয়ে যাবে, তাই না?
ধরা যাক, এবারে ইলেকট্রনটা উপরের স্তর থেকে নিচের স্তরে নেমে আসছে। কাজেই, সে উপরের স্তরে উঠে যাওয়ার জন্য যেটুকু শক্তি টেনে নিয়েছিল, এবারে ঠিক সেইটুকু শক্তিই ছেড়ে দিবে। আলো হিসেবে যদি বলি, এর ফলে ওই নির্দিষ্ট তরঙ্গের ওই অন্ধকার অংশটুকু আবার আলোকিত হয়ে উঠবে, তাই না?
এই হিসেবে, আলোর বর্ণালী হলো দুইরকম।
এক, শোষণ বর্ণালী (Absorption Spectrum)। শোষণ করে নিলে সে যেটুকু শক্তি, আলো হিসেবে বললে নির্দিষ্ট তরঙ্গের যেটুকু আলো শুষে নিয়েছে, সে জায়গাটায় কালো হয়ে যাবে।
দুই, নিঃসরণ বর্ণালী(Emission Spectrum)। এই নিঃসরণ বর্ণালীটা ভালো বোঝা যাবে অন্ধকারে। আগের উদাহরণে আমরা বলেছিলাম, যে জায়গাটা থেকে আলো নিচ্ছে, ইলেকট্রন সেখানেই আলোটা ছাড়বে। কিন্তু সেখানে না ছেড়ে যদি অন্যকোথাও, অন্ধকারের মাঝে নির্দিষ্ট তরঙ্গের ওই আলোটা ছাড়ে, তাহলে কী হবে? খুব সহজ। অন্ধকারের মধ্যে কিছু আলোর রেখা দেখা যাবে। মনে রাখতে হবে, অন্য জায়গায় ছাড়লেও সে কিন্তু যে তরঙ্গের যে পরিমাণ আলো শুষে নিয়েছিল, সেই একই তরঙ্গের একই পরিমাণ আলো ছাড়ছে। কাজেই, ওই আলোর রেখাগুলো আগের জায়গায় যে নির্দিষ্ট অংশে দেখা যাওয়ার কথা, এখনও নতুন জায়গার ওই নির্দিষ্ট অংশেই দেখা যাবে।
এই যে অন্ধকারের মাঝে নির্দিষ্ট তরঙ্গের আলোর রেখা কিংবা আলোর মাঝে কালো কালো রেখা- এরা কি সব পদার্থের জন্যে এক হবে? পরীক্ষা করে দেখা গেল, প্রতিটা পদার্থের বর্ণালী ভিন্ন হয়। হাইড্রোজেন যে তরঙ্গের শোষণ বা নিঃসরণ বর্ণালী দেয়, অন্য কেউ তেমনটা দেয় না। একইভাবে সোডিয়াম যেটা দেয়, সেটাও আর কেউ দেয় না। সরল কথায় এদেরকে তুলনা করা যায় আমাদের টিপসইয়ের সাথে। মানুষের যেমন হাত এবং আঙ্গুল দূর থেকে দেখতে একইরকম লাগলেও টিপসই নিলে ভিন্ন ভিন্ন ছাপ পাওয়া যায়, তেমনি সব পদার্থের ইলেকট্রনগুলোকে দেখতে একইরকম লাগলেও বর্ণালী নিলেই দেখা যায় আলাদা।
এখন, কথা হলো, আমাদের জন্য নিঃসরণ বর্ণালী থেকে শোষণ বর্ণালী গুরুত্বপূর্ণ কেন? কেন দূর নক্ষত্র থেকে আসা আলোর মাঝে স্পেক্ট্রোস্কোপে আলোর ফাঁকে ফাঁকে কালো পাওয়া যাচ্ছে, কালোর মাঝে আলো পাওয়া যাচ্ছে না?
মনে আছে, কার্শফ কী বলেছিলেন, সেটি আমরা একটু পরে ব্যাখ্যা করবো বলেছিলাম? আসুন, দেখা যাক, কার্শফ কী বলেছিলেন! সেটা বলার আগে আরেকটা কথা একটু বলে নেয়া দরকার। কার্শফের মাহাত্ম্যটা হলো, আমরা এতক্ষণ ইলেকট্রনের যেসব কাজ কারবার দেখলাম, কার্শফ পরীক্ষা করে বর্ণালীর ব্যাপারটা বের করে নিয়ে ব্যাখ্যা করার সময়ও সেসব আবিষ্কার হয় নি। কোয়ান্টা শক্তি এবং ইলেকট্রনের লেভেল আপ-ডাউনের ব্যাপারে এই মানুষটা কিচ্ছু জানতেন না!
কার্শফ কিছু মৌল নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন, এদেরকে উত্তপ্ত করা হলে এরা এক ধরণের তরঙ্গ ছেড়ে দেয়। ফলে বেশ খানিকটা অন্ধকার অঞ্চলের মাঝে কিছু উজ্জ্বল রেখা পাওয়া যায়। আসলে, তাপ শোষণ করে নিয়ে ইলেকট্রনেরা উপরের লেভেলে উঠে গিয়ে আবার নেমে আসার সময় যে শক্তি ছেড়ে দিয়েছে, সেটাই কার্শফ দেখেছিলেন। এখন, ওই উত্তপ্ত মৌল থেকে আসা শক্তি বা আলোকে যদি ঐ একই মৌলের শীতল বাষ্পের মধ্যে দিয়ে চালনা করা হয়, তাহলে কী হবে?
আমরা জানি, উত্তপ্ত বস্তু থেকে শীতল বস্তুতে তাপ চলে আসে। আর, তাপ মানেই শক্তি। এখন এই শক্তির অন্য আরেক রুপ আলো দিয়ে যদি বলি, তাপের হিসেবে উত্তপ্ত আলো থেকে শীতল বাষ্প ঠিক যেই মুহুর্তে কিছুটা তাপ বা শক্তি নিয়ে নিবে, ঠিক সেই সময় আসলে শীতল বাষ্পের মধ্যে থাকা মৌলটার মাঝের ইলেকট্রন নির্দিষ্ট তরঙ্গের নির্দিষ্ট পরিমাণ আলোকে শক্তি হিসেবে টেনে নিবে। এখন, আমরা যদি ঠিক এই মুহুর্তে এর বর্ণালী পরীক্ষা করে দেখি, দেখতে পাবো আলোর মাঝে কালো কালো রেখা। ফ্রনহফারের রেখা! যে নির্দিষ্ট তরঙ্গের আলো ইলেকট্রনেরা শুষে নিয়েছিল, সেটার অনুপস্থিতির চিহ্ন। শোষণ বর্ণালী!
কার্শফ কোয়ান্টার ব্যাপারে কিছু না জেনেই এটা বের করে ফেলেছিলেন। খুব সরল হিসেবে পরীক্ষাটা ছিল এমন, সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাবার লবণের বর্ণালী পরীক্ষা করে সোনালী হলুদ একটা উজ্জ্বল রেখা পাওয়া গেল। সেটা সোডিয়াম থেকে আসছে নাকি ক্লোরিন থেকে আসছে, নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ক্লোরিনের আরেকটা যৌগ হাইড্রোক্লোরিক এসিড দিয়ে পরীক্ষাটা আবার করা হলো। সোনালী হলুদ রেখাটা পাওয়া গেল না। এবারে সোডিয়ামের আরেকটা যৌগ, সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড নিয়ে পরীক্ষাটা আবারো করা হলো। পাওয়া গেল সোনালী হলুদ রেখা। এভাবে কার্শফ ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণালীর ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন। পরে এমন আরো অনেক মৌল নিয়ে একে একে বর্ণালী পরীক্ষা করে দেখা হলো। নিঃসরণ বর্ণালীর মতো শোষণ বর্ণালীও তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন। এইসব পরীক্ষা করে কার্শফ একটা সূত্র দাঁড়া করালেন। নাম দিলেন, three laws of spectroscopy। কার্শফ শোষণ এবং নিঃসরণ বর্ণালীর সাথে সাথে আরেক ধরণের বর্ণালীরও কথাও এই সূত্রের মাঝে বলে গেছেন। এর নাম অবিচ্ছিন্ন বর্ণালী, যার মাঝে কোন কালো রেখা থাকে না। এই বর্ণালীটা আমাদের কাছে কৃষ্ণবস্তু বিকিরন(Black body radiation) নামে বেশী পরিচিত।
প্রসঙ্গে ফিরি। সূর্য থেকে যে আলোটা আসে, সেটা অবশ্যই আমাদের পৃথিবীর চেয়ে অনেক উত্তপ্ত জায়গা থেকে এসেছে। এই আলো যখন তুলনামূলকভাবে শীতল এবং বাষ্পীভূত আমাদের বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে ঢুকবে, তখন এটা থেকে স্বাভাবিকভাবেই শোষণ বর্ণালী পাওয়া যাবে। কারণ, আমাদের বায়ুমণ্ডলে ওই পদার্থগুলোর তুলনামূলক শীতল বাষ্প ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এমন যদি হয় যে, ওই আলোতে এমন কোন পদার্থ আছে যার শীতল বাষ্প আমাদের বায়ুমণ্ডলে নেই? এজন্যে, গবেষণাগারে এই আলোকে বিভিন্ন মৌলের শীতল বাষ্পের মধ্য দিয়ে চালনা করেও দেখা হয়।
আগেই বলেছি, একটা নির্দিষ্ট মৌলের বর্ণালী সবসময় একইরকম হয়। এরা একই তরঙ্গের আলো শোষণ করে বা ছেড়ে দেয়। এভাবেই, সূর্য এবং অন্যান্য নক্ষত্র থেকে আসা আলো থেকে শোষণ বর্ণালী পাওয়া যায়। এই শোষণ বর্ণালীর মাঝে লুকায়িত মৌলের টিপসই দেখেই আমরা বুঝতে পারি কোন নক্ষত্রের মাঝে কী কী মৌল আছে।
তথ্যসূত্র:
১. উইকিপিডিয়া
২. পরমাণুর গহীন নিসর্গে, আইজ্যাক আসিমভ, অনুবাদ: ইমতিয়াজ আহমেদ
৩. Cosmos: A Spacetime Odyssey (2014)
উচ্ছ্বাস তৌসিফ
শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সাইয়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।