জার বোম্বা: মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী বোমা

1
743

১৯৬১ সালের ৩০ জুন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বোমার বিস্ফোরণের মাধ্যমে পরীক্ষা চালায় যেটি সর্বকালের সর্ববৃহৎ নিউক্লিয় যন্ত্র এবং মানব সৃষ্ট সর্বকালের সর্ববৃহৎ বিস্ফোরণ হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে এই বোমাটির ডাক নাম দেওয়া হয়েছে জার বোম্বা (Tsar Bomba), যদিও এর প্রকৃত নাম Soviet RDS-220 হাইড্রোজেন বোম্ব। কোড নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে Ivan এবং Vanya।

বোমাটিকে কুজকিনা ম্যাট (Kuzkina mat) নামেও ডাকা হয়। ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় নিকিতা ক্রুশ্চেভ এটি শব্দগুলো উচ্চারণ করেন, যার মোটামুটি অনুবাদ দাঁড়ায় “We will show you” বা আমরা দেখিয়ে দেব”। বোমাটির এসবের বাইরেও আরো কিছু ডাক নাম রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের Central Intelligence Agency বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানোর পরীক্ষার নকশা নির্ধারণ করে যার নাম দেওয়া হয় JOE 111।

লাল চিহ্নিত দ্বীপে বিস্ফোরণটি ঘটানো হয়।

ইউরি খ্যারিটনের নেতৃত্ব পদার্থবিদদের একটি দল জার বোম্বার ডিজাইন প্রণয়ন করে। এই দলের মধ্যে আরো অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আন্দ্রে সাখারভ, ভিক্টর এডামস্কাই, ইউরি ব্যাভিয়েভ, ইউরি ত্রুতনেভ প্রমুভ। জার বোমা একটি তিন ধাপের হাইড্রোজেন বোমা যার প্রথম স্তরে রয়েছে একটি ইউরেনিয়াম ভিত্তিক অপেক্ষাকৃত দুর্বল শক্তির পারমানবিক বোমা। এই প্রথম ধাপের বোমাটি দ্বিতীয় ধাপের তাপগতীয় ব্যবস্থাকে সংকুচিত করে এবং বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বিস্ফোরণের মাধ্যমে তৃতীয় ও মূল হাইড্রোজেন বোমার ধাপটিকে ট্রিগার করা হয়। হাইড্রোজেন বোমা কাজ করে নিউক্লিয় ফিউশনের মূলনীতিতে যে প্রক্রিয়াটি চালু করার জন্য উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন। প্রথম দুটি ধাপের বিস্ফোরণের মাধ্যমে এই উচ্চ তাপমাত্রা সৃষ্টি করা হয়। তবে জার বোমায় একটির বদলে বেশ কয়েকটি তৃতীয় ধাপের বিস্ফোরক ব্যবহারের আলামত পাওয়া গেছে।

জার বোম্বার সংরক্ষিত কয়েকটি খোলসের একটি

জার বোম্বার বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিলো ৫০ মেগাটন টিনএনটির সমান। ইতিপূর্বে সবচেয়ে বড় ক্ষমতার বিস্ফোরণটি ছিলো ১৯৫৪ সালে সংঘটিত যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাসল ব্র্যাভো পরীক্ষার বিস্ফোরণ যার ক্ষমতা ছিলো ১৫ মেগাটন টিএনটির সমান। জার বোম্বার ক্ষমতা অনায়াসেই এর মূল সক্ষমতার দ্বিগুণ অর্থাৎ ১০০ মেগাটন বিস্ফোরণ তৈরি করতে পারত। কিন্তু মূল নকশার ইউরেনিয়াম-২৩৮ টেম্পারের বদলে এতে সীসার টেম্পার ব্যবহার করে সক্ষমতা অর্ধেকে নিয়ে আসা হয়। জার বোম্বা একটিই তৈরি করা হয় তাই ইউরেনিয়াম টেম্পার ব্যবহৃত কোনো বোমা পরবর্তীতে আর তৈরি করা হয় নি। তবে এই বোমার বেশ কিছু খোলস তৈরি করা হয় যেগুলো রাশিয়ার বিভিন্ন জাদুঘরে প্রদর্শনে জন্য রাখা আছে। ১০০ মেগাটনের বদলে ৫০ মেগাটন সক্ষমতার বোমা তৈরির একটি কারণ এটি নিক্ষেপকারী বিমান বোমাটি নিক্ষেপের পরে নিরাপদ স্থানে ফিরে আসতে পারবে না, তার আগেই বিস্ফোরণে উৎপন্ন অগ্নিগোলকের (Fireball) মধ্যে পড়ে যাবে!

বিস্ফোরণ পরীক্ষা:

বোমাটি নিক্ষেপের পরীক্ষার দিন মেজর আন্দ্রেই দুর্নভস্টেভ একটি Tu-95V মডেলের বোমারু বিমানে করে এটি বহন করে নিয়ে যান। একে অনুসরণ করে আরেকটি Tu-16 বিমান যার কাজ ছিলো ঘটনাস্থলের বায়ুর নমুনা সংগ্রহ করা এবং বিস্ফোরণের চিত্র ধারণ করা। বিমানগুলোর উপর তাপীয় ক্ষয়-ক্ষতি হ্রাস করার জন্য সাদা রংয়ের একধরনের প্রতিফলক প্রলেপ ব্যবহার করা হয়।

জার বোমার ওজন ছিলো ২৭ মেট্রিকটন। এটি দৈর্ঘ্যে ২৬ ফুট এবং এর ব্যস ৬.৯ ফুট। বোমাটি একটি প্যারাস্যুটের সাথে যুক্ত ছিলো যার নিজেরই ওজন ১৮০০ পাউন্ড। এই প্যারাস্যুট ব্যবহার করে বোমাটির পতন আরো ধীর করা হয় যা বোমারু এবং পরিদর্শক বিমানদুটিকে নিরাপদে ফিরে আসার জন্য বাড়তি সময় দেয়। এতসব বাড়তি সতর্কতা স্বত্বেও বিমানদুটির নিরাপদে ফিরে আসার সম্ভাবনা ধরা হয় ৫০%।

নিক্ষেপের দিন মস্কোর সময় বেলা ১১ টা ৩২ মিনিটে উত্তর মেরুর কাছে মিতিউশিখা বে নিউক্লিয়ার টেস্টিং রেঞ্জে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বায়ুমন্ডলীয় সেন্সরের মাধ্যমে ভূমির ১৩,০০০ ফুট উপরে থাকতেই বোমাটিকে বিস্ফোরণ ঘটানোর ব্যবস্থা রাখা হয় এবং বোমাটি নিক্ষেপ করা হয় ভূমির ৩৪,০০০ ফুট উপর হতে।

বিস্ফোরণে উৎপন্ন ফায়ারবল বা অগ্নিগোলক

বিস্ফোরিত জার বোম্বার উৎপন্ন শক্তি ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমানিক বোমাদ্বয়ের উৎপন্ন মোট শক্তির  ১৫৭০ গুণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মোট ব্যবহৃত বিস্ফোরক ও গোলাগুলির শক্তির চেয়ে এটি ১০ গুণ বেশী শক্তিশালী!

বিস্ফোরণ পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি:

বিস্ফোরণ বিন্দু বা গ্রাউন্ড জিরোর ৩৪ মাইলের মধ্যে স্থাপিত Severny নগরের সকল কাঠ ও ইটের তৈরি ভবন বিস্ফোরণের ফলে ধূলিষ্যাৎ হয়ে যায়। গ্রাউন্ড জিরোর ১০০ মাইলের মধ্যে স্থাপিত অন্য সব কাঠের তৈরি বাড়ি-ঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং ইট ও পাথরের স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৭০ মাইল দূরে অবস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী কালো গগলস পরেও তাপীয় প্রভাব অনুভব করেছেন বলে জানিয়েছেন। প্রবল উৎপন্ন তাপ ৭২ মাইল দূরেও চামড়ায় পুড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রেখেছিলো বলেও খবর পাওয়া যায়। বিস্ফোরণে উৎপন্ন শক ওয়েভে ৫৬০ কিলোমিটার দুরের জানালার কাচ ফেটে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। শক ওয়েভের বায়ুমন্ডলীয় ফোকাসিংএর কারণে নরওয়ে ও ফিন্ডল্যান্ডের মতো দূরবর্তী অঞ্চলের জানালার কাচও ফেটে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত পারমানবিক বোমা এবং জার বোমায় উৎপন্ন মাশরুম ক্লাউডের আকারের তুলনা। হিরোশিমার মাশরুম ক্লাউড তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র বিধায় ইনসেটে আলাদাভাবে দেখানো হয়েছে।

বিস্ফোরণটি ভূমির ১৩,০০০ ফুট উপরে ঘটানোর পরেও এর উৎপন্ন শক ওয়েভে ভূমিতে ৫ থেকে ৫.২৫ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। পৃথিবীকে তিনবার আবর্তন করার পরেও বিভিন্ন সিসমোগ্রাফি যন্ত্রে এর শকওয়েভ ধরা পড়ে। বিস্ফোরণের পর এটি মাটিতে পতিত হতে পারত কিন্তু তা হয়নি এর নিজের সৃষ্ট শকওয়েভের ধাক্কায়। এর বিস্ফোরণে উৎপন্ন মাশরুম ক্লাউডের উচ্চতা হয়েছিলো ৬১ কিলোমিটার যা বায়ুমন্ডলের ওজন স্তর ছাপিয়ে আরো উপরে আয়ন মন্ডলে পৌঁছে গিয়েছিলো।

সৌভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন পারমানবিক শক্তি কমিশনের অনুমিত তথ্য অনুযায়ী এর বোমাটির উৎপন্ন শক্তি ছিলো ৫৫ -৬০ মেগাটন টিএনটির সমান। তবে শীতল যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এবং সৌভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সকল রাশিয়ান উৎস হতে দেখা যায় এর উৎপাদন ছিলো ৫০ মেগাটন।

তথ্যসূত্র:
১. http://www.atomicheritage.org/history/tsar-bomba
২. https://en.wikipedia.org/wiki/Tsar_Bomba
৩. http://gizmodo.com/5977824/the-biggest-bomb-in-the-history-of-the-world

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
২. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

1 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.