মহিমান্বিত নকশা (The Grand Design): পর্ব-৫

0
718

[বইটির সূচিপত্র তখা সব পর্বের লিংক দেখুন এখানে]

পঞ্চম অধ্যায়: সার্বিক তত্ত্ব (The Theory Of Everything)

 মহাবিশ্ব সম্পর্কে সবচেয়ে অবোধগম্য বিষয় হচ্ছে যে মহাবিশ্ব আসলে বোধগম্য। -আলবার্ট আইনস্টাইন

মহাবিশ্ব বোধগম্য কারণ এটি কিছু বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলি দ্বারা পরিচালিত হয়; অর্থাৎ, এর আচরণের প্রতিরূপ তৈরি করা যাবে। কিন্তু সেই প্রতিরূপ কিংবা নিয়মাবলিই বা কী কী? মহাকর্ষই সর্বপ্রথম বল যেটিকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছিলো। ১৬৮৭ সালে প্রকাশিত নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র মতে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু অন্য প্রতিটি বস্তুকে নিজ ভরের সমানুপাতিক বলে আকর্ষণ করে। সূত্রটি সেই সময়ের বোদ্ধামহলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলো, কারণ এটি প্রথমবারের মতো নির্দেশ করে যে মহাবিশ্বের অন্তত একটি বিষয়কে নির্ভুলভাবে নিরূপণ করা সম্ভব এবং সেটি করার জন্য সূত্রটি গাণিতিক কলাকৌশল বাতলেছিলো। সুনির্দিষ্ট কিছু প্রাকৃতিক নিয়মাবলি বিদ্যমান- এই ধারণা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে গ্যালিলিওর ধর্মীয় মতবাদের বিরুদ্ধাচরণ করার বিতর্ককে আবার জিইয়ে তোলে। যেমন, বাইবেলে জশুয়ার প্রার্থনার গল্পে বর্ণিত আছে যে সে প্রার্থনা করেছে যেনো সূর্য ও চাঁদ নিজ গতিপথে থেমে যায়, ফলে সে কেনানের এমোরাইটদের সাথে লড়াই শেষ করার জন্য বাড়তি দিনের আলো পাবে। জশুয়ার পুস্তক মতে, প্রার্থনার কারণে সূর্য প্রায় একদিন স্থির হয়ে ছিলো। এখন আমরা জানি যে এর ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে যাওয়ার কথা। পৃথিবী যদি থেমেও যায়, তবে নিউটনের সূত্র অনুযায়ী বন্ধনমুক্ত সবকিছু পৃথিবীর আগের বেগে (বিষুবরেখা সংলগ্নে ঘন্টায় ১,১০০ মাইল বেগে) ছুটতে থাকার (এবং ছিটকে বের হয়ে আাসার) কথা, ফলে বিরাট মাশুল গুণতে হতো বটে। এইসব কিছু অবশ্য নিউটনকে দুশ্চিন্তায় ফেলে নি, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর ইচ্ছে করলে মহাবিশ্বের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করতে পারেন, এবং করেছিলেন-ও বটে।

মহাবিশ্বের যে বিষয়গুলোর জন্য পরবর্তীতে সূত্র বা মডেল আবিষ্কার করা হয়েছিলো সেগুলো হলো তড়িৎ এবং চৌম্বক বল। এই বলগুলো অনেকটা মহাকর্ষের মতো আচরন করে, গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে যে একই রকমের দুটো আধান কিংবা চুম্বক পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, পক্ষান্তরে বিপরীতধর্মী আধান অথবা চুম্বক আকর্ষণ করে। তড়িৎ বল এবং চৌম্বক বল মহাকর্ষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হলেও প্রাত্যহিক জীবনে আমরা সেটি টের পাই না কারণ একটি বড় বস্তুতে প্রায় সমান সংখ্যক ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক আধান থাকে। মানে, কাছাকাছি দুটো বড় বস্তুর মধ্যকার বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় বল পরস্পরকে নাকচ করে দেয়, পক্ষান্তরে মহাকর্ষ বল যোগ হয়ে থাকে।

তড়িৎ ও চুম্বকত্ব সম্পর্কে আমাদের বর্তমান ধারণাসমূহের উন্নয়ন সাধন করা হয়েছিলো মধ্য-অষ্টাদশ শতাব্দি থেকে মধ্য-উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি একশ বছরের মধ্যে- যখন বিভিন্ন দেশের পদার্থবিজ্ঞানিরা তড়িৎ ও চৌম্বক বলের ওপর খুঁটিনাটি পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিলো যে তড়িৎ ও চৌম্বক বল সম্পর্কিত: একটি চলমান তড়িৎ আধান চুম্বকসমূহের উপর এবং একটি চলমান চুম্বক তড়িৎ আধানসমূহের উপর বলপ্রয়োগ করে। ডেনিশ পদার্থবিজ্ঞানি হানস ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেড সর্বপ্রথম এটি উপলব্ধি করেছিলেন। ১৮২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বক্তৃতা দেয়ার ছিলো সেটির প্রস্তুতিকালে তিনি লক্ষ্য করেন যে তিনি যে ব্যাটারিটি ব্যবহার করছেন সেটির বিদ্যুৎপ্রবাহ পাশের একটি কম্পাসের চুম্বকশলাকাকে নাড়াচ্ছে। তিনি সহসাই উপলব্ধি করেন যে প্রবাহমান বিদ্যুৎ একটি চৌম্বক বল সৃষ্টি করেছে এবং তিনি “তড়িচ্চুম্বকত্ব” শব্দটির উদ্ভাবন করেন। কয়েক বছর পরে ব্রিটিশ বিজ্ঞানি মাইকেল ফ্যারাডে যে যুক্তি দেখান সেটি এখনকার পরিভাষায় বললে বলা চলে- একটি বিদ্যুৎপ্রবাহ যদি চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে তবে একটি চৌম্বকক্ষেত্র-ও একটি বিদ্যুৎপ্রবাহ তৈরি করতে পারবে। ১৮৩১ সালে তিনি এটি হাতে-কলমে দেখাতে পেরেছিলেন। চৌদ্দ বছর পরে ফ্যারাডে তড়িচ্চুম্বকত্বের সাথে আলোর সম্পর্ক-ও আবিষ্কার করেন এবং দেখান যে তীব্র চুম্বকত্ব মেরুপ্রবণ আলোর প্রকৃতির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

ফ্যারাডের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো সামান্য। তিনি লন্ডনের কাছাকাছি একটি গরীব কামার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তের বছর বয়েসে ইস্কুল ত্যাগ করেছিলেন সংবাদবাহক ভৃত্য ও বইয়ের দোকানে বাঁধাইকারীর কাজ করার জন্য। বছরের পর বছর ধরে, তিনি যেসব বইয়ের যত্ন নেয়ার কথা ছিলো সেগুলো থেকে বিজ্ঞান শিখেন এবং অবসর সময়ে টুকিটাকি পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। অবশেষে তিনি খ্যাতনামা রসায়নবিদ স্যার হামফ্রে ডেভির গবেষণাগারে সহকারী হিসেবে চাকরি পান। জীবনের পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ বছর তিনি ওখানেই কাটান এবং ডেভির মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন। ফ্যারাডে গণিতে পটু ছিলেন না, কখনো খুব একটি চর্চাও করেন নি, তাই পরীক্ষাগারে যেসব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেটি গাণিতিকভাবে প্রকাশ করতে তাকে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছিলো। তা সত্ত্বেও, তিনি পেরে উঠেছিলেন।

বলক্ষেত্র সম্পর্কে ধারণা করতে পারাটা ছিলো ফ্যারাডের অন্যতম মেধাবী উৎকর্ষতা। আজকাল বিভিন্ন বইপুস্তক চলচ্চিত্রে বড় বড় চোখের ভিনগ্রহবাসী এবং তাদের মহাকাশযানের কাহিনির কারণে অধিকাংশ লোকই বলক্ষেত্র ধারণার সাথে এতো বেশি পরিচিত যে মনে হয় ফ্যারাডের উচিত এর মেধাস্বত্বের জন্য কিছু সম্মানী পাওয়া। নিউটন ও ফ্যারাডের সময়ের মধ্যবর্তী শতাব্দিগুলোতে পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম একটি রহস্য ছিলো কীভাবে বলগুলো শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে সুদূরবিচ্ছিন্ন বস্তুসমূহের উপর ক্রিয়া করে সেটি বের করা। ফ্যারাডে এই প্রশ্নটি পছন্দ করেন নি। তিনি বিশ্বাস করতেন কোনো বস্তুকে স্থানান্তর করতে হলে অবশ্যই অন্য কোনো কিছুকে বস্তুটির সংস্পর্শে আসতে হবে। সুতারাং তিনি কল্পনা করেছিলেন যে তড়িৎ আধান আর চুম্বকের মধ্যকার স্থান এক ধরণের অদৃশ্য নলে ভর্তি এবং নলগুলোই ধাক্কাধাক্কি বা টানাটানি করে থাকে, ফ্যারাডে ওই নলগুলোর নামকরণ করেন বলক্ষেত্র। বলক্ষেত্র হাতেকলমে ভালোভাবে দেখার উপায় হলো একটি দণ্ড চুম্বকের ওপর একটি কাঁচের পাত রাখা, এবং লোহার গুঁড়ো কাঁচের পাতটির ওপর ছড়িয়ে দেয়া। ঘর্ষণ কাটানোর জন্য পাতটিতে কয়েকটি টোকা দিলে দেখবেন যেনো কোনো এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে লোহার গুঁড়োগুলো চুম্বকটির এক মেরু থেকে অন্য মেরু পর্যন্ত বৃত্তচাপের মতো বক্ররেখায় নিজেদের সাজিয়ে নিচ্ছে। এই নকশাটিই হলো স্থানে পরিব্যপ্ত থাকা অদৃশ্য চৌম্বক বলের মানচিত্র। ইদানীং আমরা বিশ্বাস করি যে সকল বলই এভাবে ক্ষেত্রের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়, তাই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে-ও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা।

পরের কয়েক দশক ধরে নগণ্য কিছু স্থূল সূত্র ছাড়া তড়িচ্চুম্বকত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের তেমন কোনো অগ্রগতি হয় নি, কিছু আবছা ধারণা প্রচলিত ছিলো: তড়িৎ ও চুম্বকত্ব রহস্যময়ভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত; আলোর সাথেও তাদের এক রকমের সংযোগ বা সম্পর্ক রয়েছে; এবং বলক্ষেত্র সম্পর্কে কিছু ভ্রুণধারণা। তড়িচ্চুম্বকত্বের কমপক্ষে এগারটি তত্ত্ব প্রচলিত ছিলো, সেগুলোর প্রতিটিই ত্রুটিযুক্ত। অবশেষে ১৮৬০ সালে স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানি জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ফ্যারাডের চিন্তাধারণাকে গাণিতিক নির্মাণকাঠামোয় উন্নতি সাধন করেছিলেন যেটি কিনা তড়িৎ, চুম্বকত্ব এবং আলোর মধ্যকার রহস্যময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলো। ফলে একগুচ্ছ সূত্রের সাহায্যে তড়িৎ ও চৌম্বক উভয় বলকে একই ভৌত অস্তিত্ব অর্থাৎ তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ম্যাক্সওয়েল তড়িৎ ও চৌম্বকত্বকে একটি একক বলে একীভূত করেছিলেন। তাছাড়া তিনি দেখান যে তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র তরঙ্গ আকারে স্থানে সঞ্চারিত বা পরিবাহিত হতে পারে। সেই তরঙ্গের গতি তার সমীকরণগুলোতে ব্যবহৃত একটি সংখ্যা বা ধ্রুবক দ্বারা নির্ধারিত হয়, সংখ্যাটি তিনি কয়েক বছর আগের পরীক্ষানিরীক্ষার উপাত্ত থেকে গণনা করে বের করেছিলেন। তার জন্য বিস্ময়কর ব্যাপার ছিলো তিনি তরঙ্গটির যে গতি নির্ণয় করেছিলেন সেটি আলোর গতির সমান, সেই সময়ে আলোর গতির মান ১% যথার্থভাবে জানা ছিলো। বাস্তবিকই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে আলো নিজেই একটি তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ!

বর্তমানে তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্রের এই সমীকরণসমূহকে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণসমূহ বলা হয়। গুটিকয়েক লোকজন হয়তো এইগুলোর কথা জানে কিন্তু বাণিজ্যিক দিক থেকে সম্ভবত এইগুলোই আমাদের জানা বিভিন্ন সমীকরণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে কম্পিউটার পর্যন্ত সবকিছুর কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও এই সূত্রগুলো দৃশ্যমান আলোসহ ক্ষুদ্রতরঙ্গ, বেতারতরঙ্গ, অবলোহিত আলো এবং এক্সরের মতো অন্যান্য তরঙ্গগুলোকে বর্ণনা করে। শুধুমাত্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কারণে দৃশ্যমান আলো থেকে অন্যান্য তরঙ্গগুলো ভিন্ন। বেতারতরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কয়েক মিটারের কিংবা তারও বেশি, পক্ষান্তরে দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক মিটারের দশ-মিলিয়ন ভাগের কয়েক ভাগের কাছাকাছি এবং এক্সরের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আরো ছোট, এক মিটারের একশ-মিলিয়ন ভাগের চেয়েও ছোট। সূর্য প্রায় সব ধরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিকিরণ করে, কিন্তু দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের হার সবচেয়ে তীব্র। তাই এটি নিছক কোনো অঘটন নয় যে আমরা খালি চোখে সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলোই ভালো দেখতে পাই যেগুলো সূর্য বেশি বিকিরণ করে: সম্ভবত আমাদের চোখ দৃশ্যমান আলোর মতন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উপযোগী হয়ে বিবর্তিত হয়েছে কারণ এগুলোই সবচেয়ে সহজল্ভ্য ছিলো। আমরা যদি কোনো ভিনগ্রহবাসীদের মুখোমুখি হই তবে দেখবো যে তাদের সূর্য যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ সবচেয়ে তীব্রভাবে করে সেগুলোই তারা “দেখতে” পারে, যদিও ব্যাপারটি তাদের গ্রহের বায়ুমণ্ডলে আলোক-বাধাদানকারী ধুলোবালি ও গ্যাসসমূহের কারণে প্রভাবিত বা পরিবর্তিত হবে। সুতারাং কোনো ভিনগ্রহবাসী যদি এক্সরে বিকিরণের গ্রহে বড় হয় তবে সে হয়তো বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যোগ্য প্রার্থী।

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণসমূহ নির্দেশ করে যে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০০,০০০ কিলোমিটার বা প্রায় ঘন্টায় ৬৭০ মিলিয়ন মাইল বেগে ভ্রমণ করে। কিন্তু এই বেগ কোনো তাৎপর্য বহন করে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি যে প্রসঙ্গকাঠামোর সাপেক্ষে এটি পরিমাপ করছেন সেটি উল্লেখ করেন। অবশ্য প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের এই ব্যাপারে চিন্তা করা লাগে না। রাস্তার পাশের কোনো সড়কসংকেতে যখন গতিসীমা ঘণ্টায় ৬০ মাইল বলা হয়, তখন আমরা বুঝে নিই যে রাস্তার সাপেক্ষে এটি বলা হচ্ছে, ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত কোনো কৃষ্ণগহ্বরের সাপেক্ষে নয়। তবে প্রাত্যহিক জীবনেও অনেক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই প্রসঙ্গকাঠামোকে হিসেবে ধরতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একটি উড়োজাহাজের আসন-সারির মধ্যবর্তী পথ ধরে এক কাপ চা বয়ে নিয়ে যান, আপনি হয়তো বলবেন যে আপনার বেগ ঘণ্টায় দুই মাইল। ভূমিতে দাঁড়ানো কেউ হয়তো বলবে যে আপনি ঘণ্টায় ৫৭২ মাইল বেগে চলছিলেন। কার পর্যবেক্ষণ সত্য- আপনি সেটি নিয়ে ভাবতে বসলে মনে রাখুন যে যেহেতু পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে, সূর্যপৃষ্ঠের থেকে পর্যবেক্ষণ করছে এমন কেউ আপনাদের কারো সাথেই একমত হবে না- বরং বলবে যে আপনার গতিবেগ সেকেন্ডে ১৮ মাইল এবং সে সূর্যপৃষ্ঠের গরমের কারণে উড়োজাহাজের ভেতরে আপনার শীতাতপনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ঈর্ষা বোধ করবে। ফলশ্রুতিতে, ম্যাক্সওয়েল যখন দাবি করেন যে আলোর গতিবেগ নির্ণয় করেছেন, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- কীসের সাপেক্ষে আলোর গতি মাপা হয়েছে?

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণসমূহ পৃথিবীর সাপেক্ষে আলোর গতির মান নির্ণয় করেছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তার সমীকরণসমূহ সমগ্র মহাবিশ্বের জন্য প্রযোজ্য। তার প্রশ্নটির জন্য একটি বিকল্প উত্তর ভাবা হলো যে তিনি আলোকবাহী ইথারের (সংক্ষেপে ইথার) সাপেক্ষে আলোর গতি মেপেছেন; অ্যারিস্টটল ইথার শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন এবং বিশ্বাস করতেন যে ভূগোলকের বাইরে সমগ্র মহাবিশ্ব ইথারে পরিপূর্ণ। প্রচলিত বিশ্বাস ছিলো, কাল্পনিক এই ইথার হচ্ছে আলো সঞ্চারিত হওয়ার মাধ্যম, ঠিক যেভাবে বাতাসের মধ্য দিয়ে শব্দ সঞ্চারিত হয়। যদি ইথারের অস্তিত্ব থাকতো, তবে স্থিরতার একটি পরম মান থাকতো (ইথারের সাপেক্ষে স্থির) এবং ফলে গতি নির্ণয়ের একটি পরম পন্থা থাকতো। ইথার আমাদের একটি পরম প্রসঙ্গকাঠামো দিতো যেটির সাপেক্ষে পুরো মহাবিশ্বের যে কোনো বস্তুর গতি নির্ণয় করা যেতো। তাই তাত্ত্বিক পটভূমিতে ইথারের অস্তিত্ব প্রস্তাব করায় কিছু কিছু বিজ্ঞানি ইথার সম্পর্কে গবেষণা অথবা এর অস্তিত্ব প্রমাণের পথ খুঁজতে শুরু করেন, এমনকি সেইসব বিজ্ঞানিদের একজন ছিলেন ম্যাক্সওয়েল নিজেই।

আপনি যদি বাতাসের মধ্য দিয়ে একটি শব্দতরঙ্গের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন তবে তরঙ্গটি আরো দ্রুত আপনার নিকটবর্তী হবে এবং আপনি যদি তরঙ্গটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন, তবে এটি আরো আস্তে আপনার দিকে অগ্রসর হবে। একইভাবে, যদি ইথারের অস্তিত্ব থাকতো তবে আলোর গতি ইথারের সাপেক্ষে আপনার গতির উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতো। বস্তুত, আলো গতি শব্দতরঙ্গের মতো আচরণ করে, তবে শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী বিমানযাত্রীরা যেমন বিমানের পেছন থেকে আগত কোনো শব্দ কখনো শুনতে পাবে না তেমনভাবে কোনো ভ্রমণকারী ইথারের মধ্য দিয়ে যথেষ্ট জোরে দৌড়ালে আলোকে হারিয়ে দিতে পারবে। এই রকম চিন্তা করে তিনি একটি পরীক্ষা করার কথা ভেবে দেখেছিলেন। যদি ইথারের অস্তিত্ব থেকেই থাকে, পৃথিবীকে সূর্যের চারপাশে ঘোরার সময় অবশ্যই ইথারের মধ্য দিয়ে ঘুরতে হবে। এবং যেহেতু পৃথিবী জানুয়ারিতে যেদিকে ঘুরছে, হয়তো অন্য সময় যেমন ধরুন এপ্রিল অথবা জুলাইয়ে সেটির ভিন্ন কোনো দিকে ঘুরবে- ফলে কেউ যদি দুই সময়ে আলোর গতি পরিমাপ করে তবে সূক্ষ্ম পার্থক্য পাওয়ার কথা। নিচের চিত্রটি দেখুন:

ম্যাক্সওয়েলকে Proceedings of the Royal Society এর সম্পাদক বুঝিয়ে সুজিয়ে তার চিন্তা প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখেন, কারণ সম্পাদকের মনে হয়েছিলো যে এইরকম পরীক্ষা কাজ দিবে না। কিন্তু ১৮৭৯ সালে পাকস্থলি ক্যানসারে মৃত্যুর কয়েক দিন আগে, ম্যাক্সওয়েল তার এক বন্ধুকে এই ব্যাপারে চিঠি লিখে জানান। চিঠিটি তার মৃত্যুর পরে নেচার বিজ্ঞান-সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়, অন্য অনেকের মতো আলবার্ট মাইকেলসন নামের এক আমেরিকান পদার্থবিদ-ও চিঠিটি পড়েন। ম্যাক্সওয়েলের ভাবনাচিন্তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৮৭ সালে মাইকেলসন এবং এডওয়ার্ড মরলি আলোর গতি মাপার জন্য একটি সংবেদী পরীক্ষার আয়োজন করেন, যেটিয় ধরে নেয়া হয় যে পৃথিবী ইথারের মধ্য দিয়ে ঘুরছে। তাদের চিন্তাভাবনা ছিলো যে সমকোণে দুটো ভিন্ন দিক অভিমুখ বরাবর আলোর গতি নির্ণয় করা হবে। যদি ইথারের সাপেক্ষে আলোর গতির মান নির্দিষ্ট হয়, আলোকরশ্মির বিভিন্ন দিকের উপর নির্ভর করে আলোর গতি ভিন্ন ভিন্ন হবে। কিন্তু মাইকেলসন এবং মরলি কোনো পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করেন নি।

তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ যে ইথারের মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হয় এমন মডেল স্পষ্টই মাইকেলসন ও মর্লির পরীক্ষার ফলাফলের সাথে সাংঘর্ষিক, এবং এই কারণে ইথার মডেল পরিত্যাগ করা উচিত ছিলো। কিন্তু মাইকেলসনের পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো ইথারের সাপেক্ষে পৃথিবীর গতি নির্ণয় করা, ইথারের অস্তিত্ব প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা নয়, এবং তিনি যে ফলাফল পেয়েছেন সেটি ইথারের অস্তিত্ব নেই এমন উপসংহার টানার দিকে ধাবিত করে নি। এমনকি অন্য কেউ এই উপসংহারে উপনিত হয়-ও নি। পক্ষান্তরে, ১৮৮৪ সালে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানি স্যার উইলিয়াম থমসন (লর্ড কেলভিন) ইথার সম্পর্কে বলেছিলেন, “ইথার হচ্ছে একমাত্র পদার্থ যেটির ব্যাপারে গতিবিদ্যায় আমরা দ্বিধাহীন। আমরা আলোকবাহী ইথারের বাস্তবতা এবং প্রকৃত অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেক নিশ্চিত।”

মাইকেলসন-মরলির পরীক্ষার ফলাফলের পরেও আপনি কীভাবে ইথার মডেলে বিশ্বাস করবেন? আমরা আগে যেমন বলেছিলিম যথারীতি লোকজন ভুজংভাজাং যোগ করে মডেলটি রক্ষা করতে চাইলো। কেউ কেউ দাবি করলেন যে পৃথিবী যখন ঘুরে তখন ইথারকেও টেনে নিয়ে চলে, ফলে আমরা আসলে এটির সাপেক্ষে স্থানান্তরিত হচ্ছি না। ওলন্দাজ পদার্থবিজ্ঞানি হেন্ড্রিক আন্টোন লোরেন্‌ৎস ও আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানি জর্জ ফ্রান্সিস ফিটজেরাল্ড প্রস্তাব করেন- যে প্রসঙ্গকাঠামোয় গতি নির্ণয় করা হচ্ছে সেটিতে এখন-পর্যন্ত-অজানা কোনো কারণে সময় শ্লথ হয়ে যায় এবং দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়, ফলে যে কেউ আলোর গতির একই মানই পরিমাপ করবে। এই রকম আবোলতাবোল দিয়ে ইথার মডেলটি বাঁচানোর প্রচেষ্টা প্রায় বিশ বছর ধরে চলতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি কৃতি-স্বত্ব কার্যালয়ের তরুণ এবং অখ্যাত এক কেরানি আলবার্ট আইনস্টাইন তার অসাধারণ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

১৯০৫ সালে আইনস্টাইন যখন তার গবেষণাপত্র চলমান বস্তুসমূহের তড়িৎগতিবিদ্যা” (Zur Elektrodynamik bewegter Körper) প্রকাশ করেন তখন তার বয়েস মাত্র ছাব্বিশ ছিলো। এতে তিনি একটি সাধারণ স্বতঃসিদ্ধ গ্রহণ করেন যে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো এবং বিশেষ করে আলোর গতি সমভাবে চলমান সকল পর্যবেক্ষকের জন্য একই হবে। স্থান-কাল সম্পর্কে আমাদের চিন্তাধারণার ক্ষেত্রে এটি এক বৈপ্লবিক ধারণা। কেনো সেটি দেখতে চাইলে, দুটো ঘটনা কল্পনা করুন- যেগুলো একটি বিমানে একই অবস্থানে দুটো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সংঘটিত হয়। বিমানের ভেতরের কোনো পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হবে ঘটনা দুটো একই জায়গায় ঘটেছে। কিন্তু ভূমিতে অবস্থান করা দ্বিতীয় পর্যবেক্ষকের কাছে ঘটনা দুটো ওই সময়ের মধ্যে বিমানটি যতদূর যায় ততো দূরে ভিন্ন ভিন্ন দুটো স্থানে ঘটেছে বলে মনে হবে। সুতারাং দেখা যাচ্ছে যে পরস্পরের সাপেক্ষে চলমান দুইজন পর্যবেক্ষক দুটো ঘটনার মধ্যবর্তী দূরত্বের ব্যাপারে একমত হবে না।

এবার মনে করুন দুইজন পর্যবেক্ষক বিমানটির লেজের অংশ থেকে নাকের দিকে ছুটে যাওয়া আলোকরশ্মির গতি পর্যবেক্ষণ করছেন। উপরের উদাহরণটির মতো এবার-ও তারা একমত হবেন না যে আলো নির্গমন ও গ্রহণের মধ্যকার দূরত্ব একই। যেহেতু গতি হলো অতিক্রান্ত দূরত্ব এবং মধ্যবর্তী সময়ের ভাগফল সেহেতু পর্যবেক্ষক দুইজন যদি আলোর গতির মানের ব্যাপারে একমত হন- তবে তারা নির্গমন ও গ্রহণের মাঝখানে অতিক্রান্ত সময়ের ব্যাপারে একমত হবেন না।

ব্যাপারটি অদ্ভুতই মনে হয়: যদিও দুইজন পর্যবেক্ষক ভিন্ন ভিন্ন সময় পরিমাপ করছে তবুও তারা একই ভৌত প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে। আইনস্টাইন এর জন্য কোনো অস্বাভাবিক ব্যাখ্যা তৈরি করার চেষ্টা করেন নি। তিনি যৌক্তিক বিস্ময়কর উপসংহার টানলেন যে অতিক্রান্ত দূরত্বের পরিমাপের মতো সময়ের পরিমাপও যে পর্যবেক্ষক পরিমাপ করছেন তার উপর নির্ভরশীল। এই চিন্তাটি ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রটির মুখ্য অংশ এবং এটিকে বিশেষ আপেক্ষিকতা নামে অভিহিত করা হয়।

সময়-গণনার যন্ত্রের উপর এই বিশ্লেষণ কীভাবে খাটে সেটি আমরা দেখতে পারবো যদি ধরি যে দুইজন পর্যবেক্ষক একই ঘড়িতে লক্ষ্য রাখছেন। বিশেষ আপেক্ষিকতা মতে, ঘড়িটির সাপেক্ষে যে পর্যবেক্ষক স্থির আছেন তার ক্ষেত্রে ঘড়িটি দ্রুততর চলবে। অন্য পর্যবেক্ষক যিনি ঘড়ির সাপেক্ষে চলমান তার ক্ষেত্রে ঘড়িটি ধীরে চলবে। যদি আমরা বিমানের লেজের অংশ থেকে নাকের দিকে চলা একটি আলোকরশ্মির একটি স্পন্দনের সাথে ঘড়ির একটি টিকের সাথে তুলনা করি, আমরা দেখবো যে ভূমিতে দাঁড়ানো পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হবে যে ঘড়িটি ধীরে চলছে- যেহেতু তার প্রসঙ্গকাঠামোয় বড়তর দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। এই ব্যাপারটি কিন্তু ঘড়ির কলকব্জার উপর নির্ভর করে না, সব ধরণের ঘড়ির জন্য এটি প্রযোজ্য, এমনকি আমাদের জৈবিক-ঘড়ি বা দেহঘড়ির ক্ষেত্রেও।

আইনস্টাইনের কীর্তি আমাদের দেখালো যে স্থিরতার ধারণার মতো সময়ও পরম (নিউটন এমন ভাবতেন) হতে পারে না। অন্যভাবে বললে, সব পর্যবেক্ষকের জন্য প্রতিটি ঘটনার একই সময় বা ঘটনাকাল হবে না। বরং, প্রত্যেক পর্যবেক্ষকের পরিমাপ করা নিজস্ব সময় থাকবে, এবং পরষ্পরের সাপেক্ষে চলমান দুইজন পর্যবেক্ষকের সময় একই রকম হবে না। আইনস্টাইনের ধারণা আমাদের অন্তর্জ্ঞানের বিরুদ্ধে যায়, কারণ প্রাত্যহিক জীবনে আমরা যে গতির সম্মুখীন হই তাতে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু পরীক্ষার মাধ্যমে এটিকে অনেকবার নিশ্চিত করা হয়েছে। যেমন, কল্পনা করুন যে পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত একটি ঘড়ি গতিশীল নয়, আরেকটি ঘড়ি পৃথিবীর পৃষ্ঠে এবং তৃতীয় আরেকটি ঘড়ি পৃথিবীর ঘূর্ণনের বিপরীতে বা একই দিকে উড়ন্ত একটি বিমানে রাখা। বিমানটি যদি পৃথিবীর ঘূর্ণনের দিকে অর্থাৎ পূর্বদিকে ছুটে তবে পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত ঘড়িটির সাপেক্ষে বিমানের ঘড়িটি পৃথিবীপৃষ্ঠের ঘড়িটির চেয়ে দ্রুততর ছুটছে, সুতারাং বিমানের ঘড়িটির ধীরে চলা উচিত। আবার বিমানটি যদি পশ্চিমদিকে অর্থাৎ পৃথিবীর ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে ছোটে তবে পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত ঘড়িটির সাপেক্ষে বিমানের ঘড়িটি পৃথিবীপৃষ্ঠের ঘড়িটির চেয়ে ধীরে ছুটছে, সুতারাং বিমানের ঘড়িটির দ্রুততর চলা উচিত। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে যখন একটি অতি নির্ভুল আণবিক ঘড়ি পৃথিবীর চারিপাশে উড়িয়ে এই রকম একটি পরীক্ষা চালানো হয়েছিলো তখন ঠিক এমনটিই পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিলো। সুতারাং আপনি পূর্বগামী বিমানে অবিরামভাবে চড়ে আপনার জীবন দীর্ঘায়িত করতে পারেন, কিন্তু আপনি হয়তো বিমানে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলো দেখে বিরক্ত হয়ে যাবেন। তবে বিমানে চড়ার এই প্রভাব খুবই কম, এক চক্করে সেকেন্ডের ১৮০ বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময় দীর্ঘায়িত হয় (যেটি কিনা মধ্যাকর্ষণের ভিন্নতার কারণে আরো কমে যায়, কিন্তু আমরা এখানে সেই আলোচনায় যাবো না)।

আইনস্টাইনের গবেষণার কারণে পদার্থবিজ্ঞানিরা উপলব্ধি করলো যে আলোর গতি সব প্রসঙ্গকাঠামোতেই একই হবে ধরে নিলে, ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ ও চুম্বকত্বের  তত্ত্ব নির্দেশ করে যে স্থানের তিনটি মাত্রা থেকে সময়কে পৃথক কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। বরং, সময় এবং স্থান একত্রে দলাপাকানো। যেনো ডানে/বামে, সামনে/পিছে, উপর/নিচের সাথে অতীত/ভবিষ্যতের একটি চতুর্থ দিক যোগ করা হচ্ছে। সময় এবং স্থানের এই যুগলবন্ধনকে পদার্থবিজ্ঞানিরা “স্থান-কাল” বলে অভিহিত করেন, এবং যেহেতু স্থান-কালে একটি চতুর্থ দিক রয়েছে তাই তারা একে চতুর্মাত্রিক বলে থাকেন। স্থান-কালে, স্থানের অন্য তিনটি মাত্রা থেকে সময় আর পৃথক কিছু নয়, এবং মোটের উপর বলতে গেলে, ডান/বাম, সামনে/পিছনে, উপর/নিচ ইত্যাদি দিক যেমন একজন পর্যবেক্ষকের উপর নির্ভর করে তেমনি সময়ের দিক-ও পর্যবেক্ষকের উপর নির্ভরশীল। ভিন্ন ভিন্ন গতিতে চলমান দুইজন পর্যবেক্ষক স্থান-কালে সময়ের পৃথক পৃথক দিক বেছে নেবেন। একারণে, আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব একটি নতুন মডেল যেটি পরম সময় ও পরম স্থিতির (যেমন- ইথারের সাপেক্ষে স্থিরতা) ধারণাকে বাতিল করেছে।

আইনস্টাইন সহসাই উপলব্ধি করলেন যে মহাকর্ষকে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আরো একটি পরিবর্তন প্রয়োজন। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব মতে, কোনো সময়ে দুটো বস্তু পরস্পরকে যে বলে আকর্ষণ করে তা ওই তাদের মধ্যকার দূরত্বের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মধ্যকার মহাকর্ষীয় বল ‘ঐ মূহুর্তে’ তাদের মধ্যকার দূরত্বের উপর নির্ভর করে। কিন্তু আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পরম সময়ের ধারণাকে বাতিল করেছে, সুতারাং ঠিক কোন সময়ে বস্তুগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব পরিমাপ করতে হবে সেটি নির্ধারণ করার পথ নেই। ফলে নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এবং পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিলো। আপনার মনে হতে পারে যে এই অসঙ্গতি হয়তো কোনো কারিগরি জটিলতার কারণে সৃষ্ট, তত্ত্বটির বিরাট কোনো পরিবর্তন না করেও একটি সমাধান বের করা যাবে। কিন্তু দেখা গেলো যে ব্যাপারটি তা নয়।

পরবর্তী ১১ বছর ধরে আইনস্টাইন মহাকর্ষ বলের আরেকটি নতুন তত্ত্বের অবতারণা করে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নামে অভিহিত করেন। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে মহাকর্ষের ধারণা মোটেই নিউটনের মতো কিছু নয়। বরঞ্চ, একটি বৈপ্লবিক প্রস্তাবের উপস্থাপন- পূর্বে যেমন ধারণা করা হতো যে স্থান-কাল অনুভূমিক বা সমতল, আসলে তেমনটি নয়- বরং এতে বিদ্যমান ভর ও শক্তির কারণে স্থান-কাল বেঁকে দুমড়েমুচড়ে থাকে।

স্থান-কালের বক্রতা বোঝার জন্য পৃথিবীপৃষ্ঠের কথা কল্পনা করুন। যদিও পৃথিবীপৃষ্ঠ দ্বিমাত্রিক (কারণ এতে শুধু দুটো দিক বা গতিপথ রয়েছে, উত্তর/দক্ষিণ এবং পূর্ব/পশ্চিম), তবুও আমরা পৃথিবীপৃষ্ঠকেই উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করবো কারণ একটি চতুর্মাত্রিক স্থানের বক্রতার চেয়ে একটি দ্বিমাত্রিক স্থানের বক্রতা কল্পনা করা অনেক সহজ। পৃথিবীপৃষ্ঠের মতন বক্র স্থান বা তলের জ্যামিতি আমাদের পরিচিত ইউক্লিডীয় জ্যামিতির মতো নয়। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে দুইটি বিন্দুর মধ্যকার সবচেয়ে ছোট পথ হলো বিন্দু দুটোকে সংযোগকারী একটি সরলরেখা, অন্যদিকে পৃথিবীপৃষ্ঠের ‘পরে দুটো বিন্দুর মধ্যকার সবচেয়ে ছোট পথ হলো বিন্দু দুটিকে সংযোগকারী গুরুবৃত্তের (Great Circle) চাপ। গুরুবৃত্ত হচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠের ধার ঘেঁষে এমন একটি বৃত্ত যেটির কেন্দ্র পৃথিবীর কেন্দ্রের সাথে মিলে যায়। যেমন, বিষুবরেখা হলো একটি গুরুবৃত্ত, সুতারাং বিষুবরেখাকে বিভিন্ন ব্যাসে ঘুরিয়ে যে বৃত্তগুলো পাওয়া যাবে সেগুলো গুরুবৃত্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।

ধরুন, আপনি নিউইয়র্ক থেকে মাদ্রিদে যেতে চান, শহর দুটি প্রায় একই অক্ষাংশে অবস্থিত। পৃথিবী যদি সমতল হতো, তবে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ হতো সোজা পূর্বদিকে যাওয়া। যদি তাই হতো তবে আপনি ৩৭০৩ মাইল পাড়ি দিয়ে মাদ্রিদে পৌঁছাতেন। কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠের বক্রতার কারণে যে পথ ধরে যেতে হবে সেটিকে একটি সমতল মানচিত্রে বড় দেখালে-ও আসলে ছোটই। আপনি গুরুবৃত্তের এই পথটা অর্থাৎ প্রথমে নিউইয়র্ক থেকে উত্তর-পূর্বদিকে, তারপর ধীরে ধীরে পূর্বদিকে মুখ করবেন, এবং সবশেষে দক্ষিণ-পূর্বদিকে চললে মোট ৩৬০৫ মাইল পাড়ি দিতে হবে। পথভেদে দূরত্বের এই পার্থক্যের কারণ হচ্ছে পৃথিবীর বক্রতার কারণে, যা অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির বৈশিষ্ট্য। বিমান পরিবহনব্যবস্থা সংস্থাগুলো এই ব্যাপারটি ঠিকই জানে এবং যখন কার্যকরী তখন তারা তাদের বিমান-চালকদেরকে গুরুবৃত্ত পথ অনুসরণ করতে বলে।

নিউটনের গতিসূত্র মতে, কামানের গোলা, রুটি, গ্রহ ইত্যাদির মতো যে কোনো বস্তু সরলপথে চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না বাইরে কোনো বল, যেমন- মহাকর্ষ বস্তুটির উপর ক্রিয়া করে। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্বে মহাকর্ষ অন্যান্য বলসমূহের মতো নয়; বরং ভরের কারণে স্থান-কাল বেঁকে দুমড়ে যাওয়া থেকে এর সৃষ্টি। আইনস্টাইনের তত্ত্ব মতে, বস্তুগুলো জিওডেসিক পথে চলে, যেটি কোন বক্রতলে দুটি বিন্দুর মধ্যকার ক্ষুদ্রতম দূরত্ব। সমতলে যেমন সরলরেখা হলো জিওডেসিক তেমনি পৃথিবীপৃষ্ঠের জন্য জিওডেসিক হলো গুরুবৃত্ত। পদার্থের অনুপস্থিতিতে, চতুর্মাত্রিক স্থান-কালের জিওডেসিক ত্রিমাত্রিক জগতের স্থান-কালের সরলরেখার সমতুল্য। কিন্তু পদার্থের উপস্থিতিতে, স্থান-কাল বেঁকে যায়, ফলে বস্তুসমূহের গতিপথ-ও বেঁকে যায় যা কিনা নিউটনের তত্ত্বে মহাকর্ষ বলের ফলে সৃষ্ট আকর্ষণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিলো। বক্র স্থান-কালে বস্তুগুলোর পথ দেখে মনে হয় সেগুলো বেঁকে গেছে, যেনো সেগুলোর উপর কোনো বল ক্রিয়া করছে।

মহাকর্ষকে অনুপস্থিত ভাবলে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের দেখা মেলে, এবং আমাদের সৌরজগতের দুর্বল-মহাকর্ষ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের মতো পুরোপুরি না হলে-ও প্রায় একই অনুমান করে। প্রকৃতপক্ষে, যদি সাধারণ আপেক্ষিকতাকে গুরুত্ব না দেয়া হতো তবে জিপিএস পরিচলন ব্যবস্থায় অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রতিদিন প্রায় দশ কিলোমিটার হারে ভুল হতো। তবে, আপনাকে নিত্যনতুন রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাওয়ার জন্য যন্ত্র তৈরি করাতে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রকৃত গুরুত্ব নিহিত নয়, বস্তুত এটি মহাবিশ্বের জন্য অনেক ভিন্ন ধরণের একটি মডেল, যেটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদির নতুন নতুন আচরণ ও প্রভাব অনুমান করে। আপনি মজা করে বলতে পারেন যে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানকে জ্যামিতিশাস্ত্রে রূপান্তরিত করেছে। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে আমরা এখন সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বৈধতা নির্ণয়ের লক্ষ্যে অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরীক্ষা করতে সক্ষম, এবং এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বটি সব কয়টি পরীক্ষা উতরে গেছে।

যদিও ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব এবং আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দুটি পদার্থবিজ্ঞানে বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধন করেছে, তারপরও নিউটনের তত্ত্বের মতো এগুলো-ও সনাতনী তত্ত্ব। কারণ এইসব তত্ত্বের ক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয়েছে মহাবিশ্বের কেবল একটি একক ইতিহাস রয়েছে। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে পারমাণবিক এবং অতিপারমাণবিক পর্যায়ে এই মডেলগুলো পর্যবেক্ষণের সাথে একমত হতে দেয় না। তারচে’, আমাদের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করতে হয় যেটি নির্দেশ করে যে মহাবিশ্বের যে কোনো সম্ভাব্য ইতিহাস থাকতে পারে, প্রতিটি ইতিহাসের নিজস্ব প্রবলতা বা সম্ভাব্যতার বিস্তার রয়েছে। প্রাত্যহিক কাজকর্ম বা প্রায়োগিক হিসাবনিকাশের জন্য আমরা ইচ্ছে করলে সনাতনী তত্ত্বগুলো ব্যবহার করতে পারি, তবে আমরা যদি পরমাণু ও অণুসমূহের আচরণ বুঝতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকত্ব তত্ত্বের কোয়ান্টাম সংস্করণ ব্যবহার করতে হবে; এবং আমরা যদি মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা অর্থাৎ যখন সমস্ত পদার্থ ও শক্তি একটি ছোট আয়তনের মধ্যে সংকুচিত হয়েছিলো- সেই অবস্থা বুঝতে চাই তবে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একটি কোয়ান্টাম সংস্করণের প্রয়োজন পড়বে। তাছাড়া আমরা চাচ্ছি যে প্রকৃতির সবকিছুকে মূলগতভাবে বুঝতে, এখন যদি কিছু সূত্র কেবল কোয়ান্টাম ব্যবস্থার জন্য এবং কিছু সূত্র কেবল সনাতনী ব্যবস্থার জন্য হয় তবে সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। সুতারাং, সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়মাবলির জন্য আমাদের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা সংস্করণ দরকার। এই রকমের তত্ত্বগুলোকে বলা হয় কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব (quantum field theories)।

প্রকৃতির জ্ঞাত বলগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়:

১. মহাকর্ষ বল: চারটি বলের মধ্যে একটি হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বলতম, কিন্তু দূরপ্রসারী বল এবং মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুর উপর

আকর্ষণ বল হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ বৃহৎ বস্তুগুলোর ক্ষেত্রে মহাকর্ষীয় বল যুক্ত হয়ে অন্যান্য বলগুলোর উপর আধিপত্য বিস্তার করে।

২. তড়িচ্চুম্বকীয় বল: এটিও বেশ দূরপ্রসারী বল এবং মহাকর্ষ বলের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, কিন্তু কেবলমাত্র তড়িৎ আধানযুক্ত কণিকার উপর ক্রিয়া করে। সমধর্মী আধানের কণিকাগুলো একে অন্যকে বিকর্ষণ এবং বিপরীতধর্মী আধানের কণিকাগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করে। অর্থাৎ, বৃহৎ বস্তুগুলোর ক্ষেত্রে তড়িৎ বল পরস্পরকে নাকচ করে দেয়, কিন্তু আণবিক বা পারমাণবিক পর্যায়ে এটি আধিপত্য বিস্তার করে। সকল ধরণের জৈব ও রাসায়নিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য তড়িচ্চুম্বকীয় বল দায়ী।

৩. দুর্বল কেন্দ্রকীয় বল: এই বলের কারণে তেজস্ক্রিয়তা ঘটে, এবং নক্ষত্রসমূহে ও আদি মহাবিশ্বে মৌলিক উপাদানগুলোর সৃষ্টিতে এই বলের অত্যাবশ্যকীয় অবদান আছে। তবে, প্রাত্যহিক জীবনে আমরা এই বলের সুস্পষ্ট সংস্পর্শে আসি না।

৪. সবল কেন্দ্রকীয় বল: এই বল পরমাণুর কেন্দ্রে অর্থাৎ নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনকে একত্র করে রাখে। এছাড়া প্রোটন-প্রোটন কিংবা নিউট্রন-নিউট্রনের পাশাপাশি অবস্থান করার জন্য এই বল দায়ী, কারণ তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা যেমন উল্লেখ করেছি যে প্রোটন-নিউট্রন কোয়ার্কের মতো আরো অতিপারমাণবিক কণিকা দ্বারা গঠিত। সৌর শক্তি ও কেন্দ্রকীয় শক্তির মূল হলো এই সবল বলই। তবে দুর্বল কেন্দ্রকীয় বলের মতো প্রাত্যহিক জীবনে আমরা এই বলের সুস্পষ্ট সংস্পর্শে আসি না।

সর্বপ্রথম তড়িচ্চুম্বকত্বের কোয়ান্টাম সংস্করণ তৈরি করা হয়েছিলো। তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বলা হয় কোয়ান্টাম তড়িৎগতিবিদ্যা (quantum electrodynamics) বা সংক্ষেপে কোতগ, ১৯৪০ সালে রিচার্ড ফাইনম্যান ও অনেকে মিলে এটি প্রকাশ করেন, এবং এটি সকল কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বগুলোর মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা পূর্বে যেমন বলেছি, সনাতনী তত্ত্বগুলো মতে, বলসমূহ ক্ষেত্রের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বসমূহ মতে বলক্ষেত্রগুলো বোসন নামক বিভিন্ন অতিমৌলিক কণা দিয়ে গঠিত; বোসন হচ্ছে বলবাহী কণাসমূহ, যেগুলো বিভিন্ন পদার্থকণার মধ্য দিয়ে আগ-পিছ করে বল সঞ্চারিত করে। পদার্থকণাগুলোকে ফার্মিয়ন বলা হয়। ইলেকট্রন, কোয়ার্ক হচ্ছে ফার্মিয়নের উদাহরণ। আলোর কণিকা বা ফোটন হচ্ছে বোসন কণিকার উদাহরণ। বোসন কণিকা তড়িচ্চুম্বকীয় বল সঞ্চারিত করে। ঘটনাটি এইরকম- একটি পদার্থকণা যেমন- ইলেকট্রন একটি বোসন বা বলকণিকা নির্গত করে এবং পিছু হঠে বা পিছনে ধাক্কা দেয়, অনেকটা কামানের গোলা ছোঁড়া হলে কামান যেমন কিছুটা পিছু হঠে আসে বা পিছনে ধাক্কা দেয় সেইরকম। তারপর বলকণিকাটি আরেকটি পদার্থকণার সাথে ধাক্কা খায় এবং শুষিত হয়, ফলে পদার্থকণাটির গতিপথ পাল্টে যায়। কোতগ মতে, তড়িচ্চুম্বকীয় বল অনুভব করতে পারা আধানযুক্ত কণিকা-কণিকার মধ্যকার সব মিথস্ক্রিয়াকে ফোটনের আদানপ্রদান হিসেবে বর্ণনা করা যায় বা হয়।

কোতগের অনুমানগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেগুলো পরীক্ষার ফলাফলের সাথে অতি নির্ভুলভাবে মিলে যায়। যদিও কোতগের জন্য প্রয়োজনীয় গাণিতিক হিসেবনিকেশ করা অনেক জটিল। আমরা নিচে দেখবো, সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন আপনি কণিকাগুলোর নির্মাণকাঠামো বিনিময় (যেমন- সম্ভাব্য যেসকল উপায়ে কণিকাগুলো বল বিনিময় করতে পারে) ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের সম্ভাব্য সব ইতিহাসসমূহ (যেগুলোর মাধ্যমে একটি মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে) যোগ করেন তখন গাণিতিক উপস্থাপন ও হিসেবনিকেশ জটিলতম হয়ে উঠে। সৌভাগ্যজনকভাবে, বিকল্প ইতিহাস ধারণার প্রস্তাবের পাশাপাশি ফাইনম্যান এগুলো হিসেব করার জন্য একটি সুস্পষ্ট চিত্রলেখ পদ্ধতি-ও বিকশিত করছেন যেটি কোতগে প্রয়োগ করা ছাড়াও সকল কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বগুলোতে প্রয়োগ করা হয়।

ফাইনম্যানের চিত্রলেখ পদ্ধতি বিকল্প ইতিহাসের যোগের প্রতিটি অংশকে ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলে। ওই চিত্রগুলোকে ফাইনম্যানের চিত্র বলা হয়, এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারগুলোর একটি। কোতগে, সম্ভাব্য সকল ইতিহাসের যোগফলকে ফাইনম্যানের চিত্রের যোগফল হিসেবে প্রকাশ করা হয়, নিচের চিত্রে তড়িচ্চুম্বকীয় বলের মাধ্যমে কীভাবে দুটো ইলেকট্রন পরস্পরকে বিক্ষিপ্ত করতে পারে তা তুলে ধরা হয়েছে। চিত্রে, সোজা রেখাগুলো ইলেকট্রন এবং ঢেউ-খেলানো রেখাগুলো ফোটনের প্রতিনিধিত্ব করছে। নিচ থেকে উপরের দিকে গেলে সময়প্রবাহ ঘটে, এবং যেসব জায়গায় রেখাগুলো মিলছে সেখানে একটি ইলেকট্রন ফোটনগুলো নির্গত করছে কিংবা শুষে নিচ্ছে এমনটি বোঝানো হচ্ছে। চিত্র A তে দেখাচ্ছে যে দুটো ইলেকট্রন পরস্পরের দিকে অগ্রসর হয়ে একটি ফোটন বিনিময় করে নিজ নিজ পথে চলে যাচ্ছে। এটি সবচেয়ে সরল রূপ যেটিতে দুটো ইলেকট্রন তড়িচ্চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়া করতে পারে, কিন্তু আমাদের অন্যান্য সম্ভাব্য ইতিহাসের দিকে-ও নজর দিতে হবে। তাই চিত্র B তে চোখ রাখা যাক। ওই অংশে মনে হচ্ছে দুটো লাইন এগিয়ে আসছে- অগ্রসরমান ইলেকট্রনগুলো এবং লাইন বের হয়ে যাচ্ছে- বিক্ষিপ্ত ইলেকট্রন; কিন্তু লক্ষ্য করুন এই অংশে ইলেকট্রনগুলো দুটো ফোটন বিনিময় করছে ছড়িয়ে যাওয়ার আগে। এই চিত্রগুলো কিছু সম্ভাব্য মিথস্ক্রিয়াকে তুলে ধরছে: বস্তুত, এই রকম অসীম সংখ্যক বিভিন্ন চিত্র সম্ভব এবং সবগুলোর জন্য গাণিতিক প্রতিপাদন প্রয়োজন।

ফাইনম্যান রেখাচিত্রগুলো শুধুমাত্র কীভাবে মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে সেটি অঙ্কন করা এবং শ্রেণীবিভাগ করার জন্য সহজসুন্দর উপায় নয়। এই রেখাচিত্রগুলো কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম বহন করে, যেগুলো আপনাকে রেখাগুলো ও শীর্ষবিন্দু থেকে একটি গাণিতিক অভিব্যক্তি পড়তে সাহায্য করে। যেমন ধরুন, একটি আদি ভরবেগ সম্পন্ন কতকগুলো ইলেকট্রনের একটি নির্দিষ্ট শেষ ভরবেগে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা কতো তা জানতে হলে প্রতিটি ফাইনম্যান রেখাচিত্র থেকে প্রাপ্ত মানগুলো যোগ করতে হবে। এই কাজটি অনেক সময় নিতে পারে, কারণ আমরা আগেই বলেছি, অসীম সংখ্যক রেখাচিত্র সম্ভব হতে পারে। তাছাড়া, যদিও আগম্যমান ও বহির্গামী ইলেকট্রনের নির্দিষ্ট শক্তি এবং ভরবেগ রয়েছে, তবুও চিত্রের অভ্যন্তরে বদ্ধ লুপের কণিকাগুলোর যে কোনো শক্তি ও ভরবেগ থাকতে পারে। এটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে ফাইনম্যান সমষ্টি পেতে হলে আপনি কেবল রেখাচিত্রগুলোকেই যোগ করলে হবে না, বরং মোটের উপর সব শক্তি ও ভরবেগের মানকে যোগ করতে হবে।

ফাইনম্যান রেখাচিত্রগুলো পদার্থবিজ্ঞানিদের কোতগ বর্ণিত প্রক্রিয়াগুলোর সম্ভাব্যতা হিসাব করতে এবং চিত্রিত করতে ব্যাপক সাহায্য করেছে। কিন্তু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পীড়া সারিয়ে তুলে নি: যখন আপনি অসীম সংখ্যক বিভিন্ন ইতিহাসের মান যোগ করতে যাবেন তখন আপনি একটি অসীম ফলাফল পাবেন। (যদি একটি অসীম ধারার ধারাবাহিক পদগুলোর মান যথেষ্ট দ্রত হ্রাস পায়, তখন যোগফল সসীম-ও হতে পারে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এখানে ব্যাপারটি সেইরকম নয়।) লক্ষণীয় যে, যখন ফাইনম্যান রেখাচিত্রগুলোকে যোগ করা হয় তখন ফলাফল দেখে আপনার মনে হবে যেনো ইলেকট্রনের অসীম ভর এবং আধান রয়েছে। কিন্তু এটি অযৌক্তিক, আমরা ইলেকট্রনের ভর ও আধান পরিমাপ করতে পারি এবং জানি যে সেগুলোর মান সসীম। এই অসীম-অসীম হেজিমনির সাথে বোঝাপড়া করতে পুনর্স্বাভাবিকীকরণ (renormalization) নামের একটি কার্যপ্রণালি বিকশিত করা হয়েছিলো।

পুনর্স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সর্তকভাবে অসীম এবং ঋণাত্মক পদগুলোকে এমনভাবে বিয়োগ করা হয় যেনো ঋণাত্মক অসীম মানগুলো এবং ধনাত্মক অসীম মানগুলোর সমষ্টি অনেকাংশে কাটাকাটি হয়ে যায়, ফলে অবশিষ্ট থাকে শুধু পর্যবেক্ষিত সসীম ভর ও আধানের মান। এই উদ্দেশ্যসাধন প্রক্রিয়া শুনে আপনার মনে হতে পারে যে ইস্কুলে গণিত পরীক্ষায় এইসব করলেই আপনি অশ্বডিম্ব পেতেন, হ্যাঁ, যেমন মনে হচ্ছে পুনর্স্বাভাবিকীকরণ তেমনই গাণিতিকভাবে সন্দেহজনক বটে। এটি ব্যবহারের একটি ফলাফল হচ্ছে যে এই পদ্ধতিতে ইলেকট্রনের ভর ও আধানের মান যেকোনো সসীম মানই হতে পারে। সুবিধা হলো যে পদার্থবিজ্ঞানিরা ঋণাত্মক অসীম সংখ্যাগুলো এমনভাবে বেছে নিতে পারবেন যেনো উত্তরটি সঠিক হয়, কিন্তু অসুবিধা হলো যে এই তত্ত্বটি থেকে ইলেকট্রনের ভর ও আধানের মান অনুমান করা যায় না। কিন্তু একবার আমরা ইলেকট্রনের ভর ও আধান পুনর্স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে ঠিক করে নিলে কোতগের সদ্ব্যবহার করে আরো বিভিন্ন অনুমান করতে পারি যেগুলো কিনা পর্যবেক্ষণের সাথে অতীব ঘনিষ্ঠভাবে একমত হয়। সুতারাং পুনর্স্বাভাবিকীকরণ হচ্ছে কোতগের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। উদাহরণস্বরূপ, কোতগের একটি সাফল্য হচ্ছে ল্যাম্ব শিফটের (Lamb shift- হাইড্রোজেন পরমাণুর একটি অবস্থাতে শক্তির ক্ষুদ্র পরিবর্তন) অনুমান করা- যেটি ১৯৪৭ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিলো।

কোতগ তত্ত্ব ও পুনর্স্বাভাবিকীকরণ মিলিয়ে সাফল্য পাওয়ায় অন্য তিনটি প্রাকৃতিক বলের জন্য কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব খোঁজার উৎসাহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক বলসমূহকে চারটি বিভাগে ভাগ করা বোধহয় স্বাভাবিক নয় এবং সেটি আমাদের উপলব্ধিগত সীমাবদ্ধতার কারণে হয়েছে। সবাই তখন একটি সার্বিক তত্ত্বের অন্বেষণ করা শুরু করলো যেটি সবগুলো বলকে একটি সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করবে এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। সেক্ষেত্রে, এটি হবে পদার্থবিজ্ঞানের শেষ নৈশভোজের মতন।

একীভূতকরণ যে সঠিক পদক্ষেপ সেটি বোঝা যায় দুর্বল কেন্দ্রকীয় বল তত্ত্ব থেকে। দুর্বল বলকে বর্ণনা করতে পারা কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বটিকে নিজ থেকে পুনর্স্বাভাবিকীকরণ করা যায় না; মানে, সসীম সংখ্যক ভর ও আধান বিয়োগের পরেও এটিতে কিছু অসীম থেকে যায়। তা সত্ত্বেও, ১৯৬৭ সালে আবদুস সালাম এবং স্টিভেন ভেইনবার্গ পৃথকভাবে একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন যেটিতে তড়িচ্চুম্বকত্ব ও দুর্বল কেন্দ্রকীয় বলকে একীভূত করা হয়েছিলো, এবং দেখা গেলো যে একীভূতকরণ অসীমের অসুবিধা দূর হয়। একীভূত তত্ত্বটিকে তাড়িৎদুর্বল মিথস্ক্রিয়া বলা হয়। তত্ত্বটিকে পুনর্স্বাভাবিকীকরণ করা সম্ভব হয়েছিলো এবং এটি W+, W ও Z° নামক তিনটি নতুন কণিকার অস্তিত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলো। ১৯৭৩ সালে জেনেভার সের্ন (CERN) গবেষণাগারে Z° কণিকাটির অস্তিত্বের আলামত আবিষ্কৃত হয়। সালাম এবং ভেইনবার্গ ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়, যদিও ১৯৮৩ সালের আগে W ও Z কণিকাসমূহকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় নি।

সবল কেন্দ্রকীয় বলকে এটির নিজস্ব কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বের আলোকে পুনর্স্বাভাবিকীকরণ করা যায়, তত্ত্বটিকে কোয়ান্টাম বর্ণগতিবিদ্যা বা সংক্ষেপে কোবগ (Quantum chromodynamics) বলা হয়। কোবগ তত্ত্ব মতে, প্রোটন, নিউট্রন, এবং পদার্থে অন্যান্য অনেক মৌলিক কণিকাগুলো কোয়ার্ক দ্বারা গঠিত, কোয়ার্কের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আছে যেটিকে পদার্থবিজ্ঞানিরা ‘বর্ণ’ বলেন (এভাবেই “বর্ণগতিবিদ্যা” শব্দটি এসেছে, যদিও কোয়ার্কের বর্ণ কেবল বোঝার সুবিধার্থে ব্যবহৃত হয়, দৃশ্যমান রঙের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই)। তথাকথিত লাল, সবুজ ও নীল এই তিন রঙের কোয়ার্ক হয়ে থাকে। তাছাড়া, প্রতিটি কোয়ার্কের একটি প্রতি-কোয়ার্ক রয়েছে, এবং সেই প্রতিকণার রঙগুলোকে প্রতি-লাল, প্রতি-সবুজ ও প্রতি-নীল বলা হয়। ধারণা করা হয়, শুধুমাত্র রঙের যেসব সন্নিবেশ কোয়ার্ককে সমষ্টিগতভাবে বর্ণহীন করে সেগুলো মুক্ত কণিকা হিসেবে অস্তিত্বময় হয়। দুই উপায়ে এইরকম নিরপেক্ষ কোয়ার্ক সন্নিবেশ (অর্থাৎ সমষ্টিগতভাবে বর্ণহীন) পাওয়া যেতে পারে। একটি বর্ণ ও সেটির প্রতি-বর্ণ পরস্পরকে নাকচ করে দেয়, ফলে একটি কোয়ার্ক ও সেটির প্রতি-কোয়ার্ক মিললে একটি বর্ণহীন জোড় তৈরি হয়, এই ক্ষণস্থায়ী কণিকাটিকে বলা হয় মেসন। আবার, যখন সবগুলো বর্ণ (অথবা সবগুলো প্রতি-বর্ণ) মেলানো হয় তখন সমষ্টিগতভাবে কোনো বর্ণ থাকে না। তিনটি কোয়ার্ক (প্রতিটি ভিন্ন রঙের) সন্নিবেশ ব্যারিয়ন নামক (অথবা তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রঙের প্রতি-কোয়ার্ক মিলে প্রতি-ব্যারিয়ন সৃষ্টি করে) স্থায়ী কণিকার সৃষ্টি করে, প্রোটন ও নিউট্রন হলো ব্যারিয়নের উদাহরণ। প্রোটন এবং নিউট্রন হলো সেইসব ব্যারিয়ন যারা পরমাণুর নিউক্লিয়াস বা পরমাণুকেন্দ্র গঠন করে, এবং এরাই হচ্ছে মহাবিশ্বের সমস্ত স্বাভাবিক পদার্থের মূল উপাদান বা ভিত্তি।

কোবগের আরেকটি বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় অসীমতটিক স্বাধীনতা (asymptotic freedom), নাম উল্লেখ না করেও এই ব্যাপারে আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে আলোকপাত করেছি। অসীমতটিক স্বাধীনতা ব্যাপারটি হচ্ছে যে যখন পরস্পরের কাছাকাছি থাকে তখন কোয়ার্কগুলোর মধ্যকার সবল বল কম হয়ে থাকে, এবং তাদের দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি বাড়তে থাকে, মনে হয় যেনো তারা রাবার ব্যান্ড দিয়ে যুক্ত। অসীমতট স্বাধীনতা কেনো আমরা প্রকৃতিতে মুক্ত কোয়ার্ক দেখি না, এমনকি পরীক্ষাগারে-ও বানাতে সক্ষম নই সেটি ব্যাখ্যা করে। যদিও আমরা একক কোয়ার্কগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি না, তারপরও আমরা কোয়ার্ক মডেলকে গ্রহণ করি কারণ এটি এতো ভালোভাবে কাজ করে যে প্রোটন, নিউট্রন ও অন্যান্য পদার্থকণিকার আচরণ সহজে ব্যাখ্যা করা যায়।

দুর্বল কেন্দ্রকীয় বল ও তড়িচ্চুম্বকীয় বলকে একীভুত করার পরে ১৯৭০ এর দিকে পদার্থবিজ্ঞানিরা সবল কেন্দ্রকীয় বলকে এই তত্ত্বে আনার উপায় খুঁজতে লাগলেন। অনেকগুলো তথাকথিত সার্বিক তত্ত্ব পেশ করা হয়েছে যেগুলো সবল কেন্দ্রকীয় বলকে দুর্বল বল আর তড়িচ্চুম্বকত্বের সাথে একীভূত করে, কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ভবিষ্যদ্বাণী বা অনুমান করে যে আমাদের গাঠনিক উপাদান প্রোটনের ক্ষয়ে যাওয়ার কথা গড়ে প্রায় ১০৩২ বছরে। আপনি যদি মহাবিশ্বের বয়েস প্রায় ১০১০ বছরের সাথে এর তুলনা করেন তবে এই আয়ুষ্কাল অনেক দীর্ঘ। কিন্তু কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে আমরা যখন বলি যে একটি কণিকার গড় আয়ুষ্কাল ১০৩২ বছর তখন আমরা বুঝাই না যে প্রতিটি কণা যথাযথপ্রায় বা কম-বেশি ১০৩২ বছর টিকে থাকে। বরং, আমরা বুঝাই যে প্রতি বছর ১০৩২ তে ১ টি কণার ক্ষয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ফলে, আপনি যদি একটি জলাধারে ১০৩২ টি প্রোটনকে কয়েক বছরের জন্য পর্যবেক্ষণ করেন তবে আপনি সেগুলোর কয়েকটিকে ক্ষয়ে যেতে দেখবেন। এইরকম একটি জলাধার বানানো খুব কঠিন কোনো কাজ নয়, কারণ মোটামুটি হাজার টন জলে প্রায় ১০৩২ টি প্রোটন থাকে। বিজ্ঞানিরা এই ধরণের পরীক্ষা করে দেখেছেন। কিন্তু দেখা গেছে যে প্রোটনের ক্ষয় সনাক্ত করা এবং সেটিকে অন্যান্য মহাজাগতিক রশ্মির কারণে সৃষ্ট ঘটনা থেকে আলাদা করা খুব সোজা ব্যাপার নয়। এই অসুবিধাগুলো থেকে মুক্তি পাবার জন্য বিজ্ঞানিরা কামিওকা খনি এবং জাপানের একটি পর্বতের ৩২৮১ ফুট নিচে ধাতু-বিগলন কোম্পানির খনিতে (মহাজাগতিক রশ্মি থেকে অনেকাংশে মুক্ত) পরীক্ষাগুলো চালিয়ে দেখেছেন। ২০০৯ সালের এক পর্যবেক্ষণের ফলাফল থেকে গবেষকরা উপসংহার টানলেন যে প্রোটন যদি ক্ষয় হয়েও থাকে তবুও এটি আয়ুষ্কাল প্রায় ১০৩২ বছরের চেয়ে বেশি; যেটি কিনা তথাকথিত সার্বিক তত্ত্বের অনুমানের সাথে মিলে না, এবং সার্বিক তত্ত্বের জন্য একটি খারাপ খবরই বৈকি।

যেহেতু প্রথমদিকের পর্যবেক্ষণগত আলামত সার্বিক তত্ত্বকে মোটেই সমর্থন করে নি, অধিকাংশ পদার্থবিজ্ঞানি প্রমিত মডেল নামের একটি তদর্থক তত্ত্বকে পরিগ্রহণ করলো, প্রমিত মডেলটি তাড়িৎদুর্বল বলের একীভূত তত্ত্ব ও শক্তিশালী বলের কোবগ তত্ত্বকে অংশীভূত করে। কিন্তু প্রমিত মডেলে, তাড়িৎদুর্বল বল এবং সবল কেন্দ্রকীয় বল পৃথক পৃথকভাবে কাজ করে এবং সেগুলো সত্যিকারভাবে একীভূত হয় নি। প্রমিত মডেল খুব সফল এবং চলতি সব পর্যবেক্ষণগত আলামতকে সমর্থন করে, কিন্তু এটি চরমভাবে অসন্তোষজনক কারণ, তাড়িৎদুর্বল বল এবং সবল কেন্দ্রকীয় বলকে একীভুত করতে না পারার ব্যর্থতা ছাড়াও এই মডেলে মহাকর্ষ বল অন্তর্ভুক্ত নয়।

মনে হতে পারে যে সবল বলের সাথে তড়িচ্চুম্বকত্ব এবং দুর্বল বলের মিলমিশ করা কঠিন বৈকি, কিন্তু এই সমস্যাগুলো কোনো সমস্যাই নয় যদি মহাকর্ষ বলকে অন্য তিনটি বলের সাথে মেলানো কিংবা মহাকর্ষ বলের একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব তৈরি করার সমস্যার সাথে তুলনা করেন। মহাকর্ষ বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব দাঁড় করানো এতো কঠিন হওয়ার কারণ হলো চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি। এটি সুস্পষ্ট নয়, কিন্তু দেখা যায় যে একটি কণিকার অবস্থান ও বেগের উপর অনিশ্চয়তা নীতি যেমন কাজ করে তেমনি একটি ক্ষেত্রের মান ও এর পরিবর্তনের হারের ব্যাপারে-ও অনিশ্চয়তা নীতি একই ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ, যতো সূক্ষ্ম এবং নির্ভুলভাবে আপনি একটি নির্ণয় করবেন, অন্যটি ততো কম সূক্ষ্ম এবং নির্ভুল হবে। এটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হচ্ছে যে শূন্যস্থান বলে কোনো কিছু নেই। কারণ শূন্যস্থান বলতে বোঝায় একটি ক্ষেত্রের মান ও সেটির পরিবর্তনের হার উভয়ই কাঁটায় কাঁটায় শূন্য হবে (যদি ক্ষেত্রটির পরিবর্তনের হারের মান সর্বদা শূন্য না হয়, তবে শূন্যস্থানটি আর শূন্য থাকবে না)। যেহেতু অনিশ্চয়তা নীতি কোনো ক্ষেত্রের মান এবং সেটির পরিবর্তনের হারকে কখনোই একই হতে দেবে না, স্থানটি কখনোই শূন্য হবে না। এটি একটি সর্বনিম্ন শক্তির অবস্থায় থাকতে পারে, যাকে বলা হয় সম্পূর্ণ পদার্থশূন্য স্থান (vacuum), কিন্তু এই অবস্থা আসলে কোয়ান্টাম অস্থিরতা (quantum jitter) অথবা পদার্থশূন্য অস্থিতি- (vacuum fluctuation) যেখানে কণিকাগুলো এবং ক্ষেত্রগুলো ক্রমাগত অস্তিত্ব লাভ করে এবং মিলিয়ে যায়।

পদার্থশূন্য অস্থিতি ব্যাপারটিকে আপনি এভাবে দেখতে পারেন- কোনো একটি সময়ে কণিকাগুলো জোড়ায় জোড়ায় আবির্ভূত হচ্ছে, এদিকসেদিক সরে যাচ্ছে, আবার কাছাকাছি হয়ে পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে। ফাইনম্যানের রেখাচিত্রের আবদ্ধ লুপের সাথে এগুলোর মিল আছে। এই কণিকাগুলোকে অসদ কণিকা বলা হয়। প্রকৃত কণিকাগুলোর মতো এদেরকে একটি কণিকা-নিরূপকের (particle detector) সাহায্যে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তা সত্ত্বেও, তাদের পরোক্ষ প্রভাব, যেমন- ইলেকট্রনের কক্ষপথে শক্তির তারতম্যের পরিমাপ করা যায়, এবং সেটি তাত্ত্বিক অনুমানের সাথে অতি-সূক্ষ্ম মাত্রায় সঙ্গতিপূর্ণ হয়। সমস্যা হলো যে অসদ কণিকাসমূহের শক্তি রয়েছে, এবং যেহেতু অসদ কণিকার জোড়া অসীম সংখ্যক, তাদের অসীম পরিমাণ সম্মিলিত শক্তি আছে। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মতে, এই কারণে কণিকাগুলোর মহাবিশ্বকে অসীম ক্ষুদ্র আকারে বাঁকিয়ে ফেলার কথা, কিন্তু এমনটি তো অবশ্যই ঘটছে না!

অসীমের এই উপদ্রব অনেকটা সবল, দুর্বল ও তড়িচ্চুম্বকীয় বলের তত্ত্বের ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিলো সেইরকম, পার্থক্য শুধু ওই ক্ষেত্রে পুনর্স্বাভাবিকীকরণ অসীমের উৎপাত দূর করে। কিন্তু মহাকর্ষের জন্য ফাইনম্যানের রেখাচিত্রে আবদ্ধ লুপ যে অসীমসমূহের জন্ম দেয় সেটি পুনর্স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে দূর করা যায় না কারণ সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে তত্ত্বটি থেকে সকল কোয়ান্টাম অসীমগুলো দূর করা জন্য পুনর্স্বাভাবিকীকরণযোগ্য যথেষ্ট চলক (যেমন ভর ও আধানের মান ইত্যাদি) নেই। সুতারাং, বাকি থাকলো মহাকর্ষের এমন একটি তত্ত্ব যেটি অনুমান করে যে নির্দিষ্ট রাশি যেমন স্থান-কালের বক্রতা অসীম, যা কোনোভাবেই বসবাসযোগ্য মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। ফলে একটি বোধগম্য তত্ত্ব পাওয়ার একমাত্র সম্ভাবনা হলো পুনর্স্বাভাবিকীকরণের শরণাপন্ন না হয়ে সব অসীমগুলোকে কোনো এক প্রকারে বাদ দেওয়া।

সমস্যাটির একটি সম্ভাব্য সমাধান পাওয়া গিয়েছিলো ১৯৭৬ সালে। যেটিকে বলা হয় অতিমহাকর্ষ (supergravity) । মহাকর্ষের শুরুতে “অতি” উপসর্গটি জুড়ে দেওয়ার কারণ এই নয় যে পদার্থবিজ্ঞানিরা মনে করেছিলেন যে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের এই তত্ত্বটি কাজ করলে সেটি হবে “খাসা” কোনো ব্যাপার। বরং, তত্ত্বটি মহাপ্রতিসাম্য (supersymmetry) নামক একটি প্রতিসাম্যকে তুলে ধরে।

পদার্থবিজ্ঞানে একটি ব্যবস্থাকে প্রতিসাম্য তখনই বলা হয় যখন এটির বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্দিষ্ট কিছু রূপান্তর যেমন- অক্ষের সাপেক্ষে ঘোরানো কিংবা এটির আয়নাছবি (mirror image) নেওয়ার পরেও ব্যবস্থাটি প্রভাবিত বা পরিবর্তিত না হয়। যেমন, আপনি যদি একটি ডোনাটকে উল্টান-ও, এটি দেখতে যথাযথভাবে একই রকম লাগে (যদি না এটির উপরে চকলেটের প্রলেপ থাকে, তাহলে কেবল খেতে দারুণ হবে বটে- আমাদের উদাহরণে কাজে লাগবে না)। মহাপ্রতিসাম্য এক ধরণের আরো অতিসূক্ষ্ম প্রতিসাম্য যেটিকে একটি সাধারণ স্থানের রূপান্তরের সাথে মেলানো যায় না। মহাপ্রতিসাম্যের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ নিহিতার্থ হচ্ছে যে বলকণা এবং পদার্থকণা অর্থাৎ বল এবং পদার্থ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ব্যবহারিকভাবে বলতে গেলে, একটি পদার্থকণা যেমন- কোয়ার্কের একটি সঙ্গী বলকণা থাকা বাঞ্ছনীয়, তেমনি একটি বলকণা যেমন- ফোটনের একটি সঙ্গী পদার্থকণা থাকা উচিত। এটি হতে পারে অসীমজনিত সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান, কারণ এটি প্রস্তাব করে যে আবদ্ধ লুপের বলকণার অসীমগুলো ধনাত্মক এবং আবদ্ধ লুপের পদার্থকণার অসীমগুলো হলো ঋণাত্মক, ফলে ধনাত্মক অসীম ও ঋণাত্মক অসীম পরস্পরকে নাকচ বা কাটাকাটি করে দেবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মহাপ্রতিসাম্যে শেষ পর্যন্ত কোনো অসীম অনাকচ থেকে যাবে কি না সেটি বের করার হিসেবনিকেশ এতো বেশি দীর্ঘ ও জটিল এবং ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় কেউ সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন নি। তারপরও, অধিকাংশ পদার্থবিজ্ঞানিই বিশ্বাস করতেন যে অতিমহাকর্ষই হচ্ছে মহাকর্ষকে অন্যান্য বলসমূহের সাথে একীভূত করার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সঠিক উত্তর।

আপনি হয়তো ভাববেন যে মহাপ্রতিসাম্যের সত্যতা যাচাই করা খুব সহজসাধ্য কাজ- শুধু প্রচলিত কণিকাগুলো পরীক্ষা করে দেখলেই তো হয় যে সেগুলোর জোড় আছে কি না। সেই রকমের কোনো সঙ্গী কণিকা পর্যবেক্ষিত হয় নি। কিন্তু বিজ্ঞানিদের করা বিভিন্ন হিসেব নির্দেশ করে যে আমরা প্রচলিত যেসব কণিকা দেখি সেগুলোর সঙ্গী কণিকা থাকলে তা প্রোটনের ভরের চেয়ে কমবেশি হাজার গুণ বেশি হবে। যা এই পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষায় পর্যবেক্ষণ করা যেকোনো কণিকার তুলনায় অনেক ভারী, কিন্তু আশা আছে যে জেনেভার বৃহৎ হ্যাড্রন কণাত্বরকে (লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার –  Large Hadron Collider) অবশেষে এমন কণিকা তৈরি সম্ভব হবে।

অতিমহাকর্ষ তত্ত্বের মূলভিত্তি ছিলো মহাপ্রতিসাম্যের ধারণা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ধারণার সূচনা হয়েছিলো অনেক আগেই যখন তাত্ত্বিকেরা স্ট্রিং তত্ত্ব (string theory) নামক একটি অপরিণত তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। স্ট্রিং তত্ত্ব মতে, কণিকাগুলো বিন্দু নয়, বরং কম্পমান স্ট্রিং- যাদের শুধু দৈর্ঘ্য আছে কিন্তু প্রস্থ ও উচ্চতা নেই- যেনো অসীম সুরু সুতোর টুকরো। স্ট্রিং তত্ত্বে-ও অসীমের ব্যাপারটি আছে, তবে বিশ্বাস করা হয় যে সঠিকভাবে হিসেব করলে সেগুলো সব কাটাকাটি হয়ে যাবে। এই তত্ত্ব মতে, প্রচলিত চার মাত্রার বদলে স্থান-কালের দশ মাত্রা রয়েছে। দশ মাত্রার ব্যাপারটি শুনতে উদ্দীপক মনে হলেও সমস্যা বাঁধবে যদি আপনি ভুলে যান যে আপনার গাড়ি দশ মাত্রার কোথায় রেখেছেন। যদি মাত্রাগুলো থেকেই থাকে, তবে আমরা কেনো বাড়তি মাত্রাগুলো দেখতে পাই না? স্ট্রিং তত্ত্ব মতে, এই মাত্রাগুলো খুবই ক্ষুদ্র আকারের স্থানে বেঁকে থাকে। বিষয়টি বুঝতে একটি দ্বিমাত্রিক তল কল্পনা করুন। আমরা তলটিকে দ্বিমাত্রিক বলছি কারণ তলটির উপরে যে কোনো একটি বিন্দুর স্থান নির্দেশ করতে আপনার দুটি সংখ্যার (আনুভূমিক ও উলম্ব স্থানাঙ্ক) প্রয়োজন। দ্বিমাত্রিক স্থান বা তলের একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে পানীয় পান করার নলের পৃষ্ঠভাগ। ওই পৃষ্ঠভাগে কোনো বিন্দুর স্থান নির্দেশ করতে আপনাকে জানতে হবে নলের দৈর্ঘ্য বরাবর ও নলের বৃত্তাকার পথ বরাবর বিন্দুটি কোথায় আছে। কিন্তু নলটি যদি খুবই সরু হয়ে থাকে, তবে আপনি বৃত্তাকার মাত্রা উপেক্ষা করেও নলটির দৈর্ঘ্য বরাবর স্থানাঙ্ক জেনেই বিন্দুটির আনুমানিক অবস্থান পেতে পারেন। এখন নলের ব্যাস যদি এক ইঞ্চির কয়েক হাজার মিলিয়ন ভাগের ভাগ হয়ে থাকে তবে বৃত্তাকার মাত্রা আপনার চোখেই পড়বে না। তাত্ত্বিকেরা স্ট্রিং তত্ত্বের অন্যান্য মাত্রার ক্ষেত্রে এই ধারণাই প্রস্তাব করেন- মাত্রাগুলো এতো বেশি বাঁকানো বা কুণ্ডলি পাকানো যে আমরা সেগুলো দেখি না। স্ট্রিং তত্ত্বে মতে, অতিরিক্ত মাত্রাগুলো অভ্যন্তরীণ স্থানে (internal space) কুণ্ডলি পাকানো থাকে, যা কিনা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অনুভব করা ত্রিমাত্রিক স্থানের বিপরীত। আমরা পরবর্তীতে দেখবো যে এইসব অভ্যন্তরীণ অবস্থাসমূহ কেবল ন্যাকড়ার তলে ধুলোর মতন লুকানো মাত্রা নয়, এগুলোর অনেক ভৌত তাৎপর্য আছে।

মাত্রার ব্যাপারটি ছাড়াও স্ট্রিং তত্ত্ব আরো একটি বেখাপ্পা বিষয় দ্বারা আক্রান্ত: কমপক্ষে পাঁচটি ভিন্ন স্ট্রিং তত্ত্ব বিদ্যমান এবং কয়েক মিলিয়ন উপায়ে অতিরিক্ত মাত্রাগুলো কুণ্ডলি পাকাতে পারে, ব্যাপারটি যারা স্ট্রিং তত্ত্বকে একটি সার্বিক তত্ত্ব বলে ওকালতি করতেন তাদের জন্য অস্বস্তিকর। এরপর ১৯৯৪ সালের দিকে বিজ্ঞানিরা দ্বৈততা আবিষ্কার করতে শুরু করে- সাধারণভাবে বিভিন্ন স্ট্রিং তত্ত্ব এবং মাত্রাসমূহের বিভিন্নভাবে কুণ্ডলি পাকানো হচ্ছে আমাদের চতুর্মাত্রিক জগতে একই ঘটনাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার মতন। এছাড়া, দেখা গেলো যে অতিমহাকর্ষ একইভাবে অন্যান্য তত্ত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত। স্ট্রিং তাত্ত্বিকেরা এখন নিশ্চিত যে পাঁচটি ভিন্ন স্ট্রিং তত্ত্ব এবং অতিমহাকর্ষ আসলে আরো মৌলিক একটি তত্ত্বের বিভিন্ন আসন্নমান, প্রত্যেকটি একেকটি অবস্থায় যুক্তিসংগত।

আরো মৌলিক তত্ত্বটিকে বলা হয় এম-তত্ত্ব, আমরা পূর্বে যেমন উল্লেখ করেছিলিম। “এম” দিয়ে কী বোঝাচ্ছে সেটি মনে হয় কেউই জানে না, হতে পারে “মাস্টার,” “মিরাকল,” অথবা “মিস্ট্রি”। মনে হয় সবগুলোই। মানুষ এখনো চেষ্টা করছে এম-তত্ত্বের অর্থোদ্ধার করতে, কিন্তু সেটি হয়তো সম্ভব হবে না। হয়তো প্রকৃতির একটি সার্বিক তত্ত্বের ব্যাপারে পদার্থবিজ্ঞানিদের ঐতিহ্যগত যে প্রত্যাশা সেটি না-ও পূরণ হতে পারে, এবং হয়তো এমন কোনো একক তত্ত্বের অস্তিত্বই নেই। মহাবিশ্বকে বর্ণনা করতে হলে হয়তো আমাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে বা অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের প্রয়োগ করতে হবে। হয়তো প্রতিটি তত্ত্বের বাস্তবতার নিজস্ব সংস্করণ থাকতে পারে, কিন্তু মডেল-নির্ভর বাস্তবতা মতে, তত্ত্বগুলোর অনুমানগুলো যদি মিলে যায় অর্থাৎ সেগুলো পরস্পরের উপর সমাপতিত হলে একই ঘটনার ক্ষেত্রে উভয় তত্ত্বকেই প্রয়োগ করা যাবে।

এম-তত্ত্ব একটি একক সূত্র কিংবা বিভিন্ন তত্ত্বের জালিকা যা-ই হিসেবে অস্তিমান হোক না কেনো, আমরা এর কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ঠিকই জানি। প্রথমত, এম-তত্ত্বে স্থান-কালের মাত্রা এগারটি, দশ নয়। স্ট্রিং তাত্ত্বিকেরা অনেককাল ধরেই সন্দেহ করছিলেন যে দশ মাত্রার অনুমানটিতে কিছু রদবদল করার দরকার, এবং সাম্প্রতিক গবেষণা দেখিয়েছে যে একটি মাত্রা বাস্তবিকই চোখের আড়ালে থেকে গিয়েছিলো। এছাড়া, এম-তত্ত্বে কেবল কম্পমান স্ট্রিং নয়- থাকতে পারে বিন্দু কণিকা, দ্বিমাত্রিক ঝিল্লি, ত্রিমাত্রিক ব্লব, এবং আরো অন্যান্য পদার্থ যেগুলো কল্পনা করা বেজায় কঠিন এবং এমনকি যেগুলো নয় মাত্রা পর্যন্ত বহু মাত্রার স্থান দখল করে। সেই বস্তুসমূহকে বলা হয় প-ঝিল্লি (p-branes), যেখানে প এর মান শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত হতে পারে।

আর অগণিত ভাবে ক্ষুদ্র মাত্রাগুলোর কুণ্ডলি পাকানোর ব্যাপারটি? এম-তত্ত্বে ওই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো যেকোনো ভাবে কুণ্ডলি পাকাতে পারে না। বরং তত্ত্বটির গণিত অভ্যন্তরীণ স্থানের মাত্রা কীভাবে কুণ্ডলি পাকাবে বা বেঁকে যাবে সেটি নির্ধারণ করে। অভ্যন্তরীণ স্থানের নির্দিষ্ট আকৃতি ভৌত ধ্রুবকগুলোর মান, যেমন- ইলেকট্রনের আধানের মান, এবং মৌলিক কণিকাগুলোর মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া প্রভৃতি নির্ধারণ করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, অভ্যন্তরীণ স্থান প্রকৃতির প্রত্যক্ষ নিয়মাবলি নির্ণয় করে। “প্রত্যক্ষ” বলতে আমরা বোঝাচ্ছি যেইসব নিয়মাবলিকে আমরা আমাদের মহাবিশ্বে পর্যবেক্ষণ করি- চারটি মৌলিক বলের সূত্রাবলি, মৌলিক কণিকাগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা ভর ও আধানের মতো চলকসমূহ। কিন্তু আরো মৌলিক নিয়মাবলি হলো এম-তত্ত্বের নিয়মাবলি।

এম-তত্ত্বের নিয়মাবলি তাই কীভাবে অভ্যন্তরীণ স্থান কুণ্ডলি পাকিয়েছে সেটির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন প্রত্যক্ষ নিয়মাবলি সম্পন্ন বিভিন্ন মহাবিশ্বের উদ্ভব হওয়াকে বিধিসম্মত বলে স্বীকৃতি দেয়। এম-তত্ত্ব সমাধান দেয় যে আনুমানিক ১০৫০০ টি অভ্যন্তরীণ স্থান সম্ভব অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন নিজস্ব নিয়মাবলির অধিকারী ১০৫০০ টি ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব। মহাবিশ্বের সংখ্যা কতগুলো সেই ধারণা পাওয়ার জন্য এমন কোনো সত্ত্বার অস্তিত্ব কল্পনা করুন যিনি এক মিলিসেকেন্ডে যদি একটি মহাবিশ্বের সব নিয়মগুলো বিশ্লেষণ করতে পারেন, তবে মহাবিস্ফোরণের সময় থেকে আজ পর্যন্ত কোনো পানীয়-বিরতি না নিয়ে সেই সত্তা কেবল ১০২০ টি মহাবিশ্বকে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হতেন।

কয়েক শতাব্দি পূর্বে নিউটন দেখিয়েছিলেন যে গাণিতিক সূত্রাবলি কীভাবে বস্তুসমূহ পৃথিবীতে এবং মহাকাশের অন্যত্র মিথস্ক্রিয়া করে তার বিস্ময়কর নির্ভুল বর্ণনা দিতে পারে। বিজ্ঞানিরা বিশ্বাস করতে লাগলেন যে আমরা যদি সঠিক তত্ত্বটি জানি এবং হিসেবনিকেশ করার যথেষ্ট ক্ষমতা থাকে তবে মহাবিশ্বের ভবিষ্যত বের করে ফেলা যাবে। তারপর এলো কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা, স্থানের বক্রতা, কোয়ার্ক, স্ট্রিং তত্ত্ব, বহু মাত্রা এবং শেষ পর্যন্ত জানা গেলো যে ভিন্ন ভিন্ন নিয়মাবলির ১০৫০০ টি ভিন্ন মহাবিশ্ব সম্ভব, যেগুলোর একটি আমাদের এই মহাবিশ্ব। একটি সার্বিক তত্ত্ব যেটি কিনা আমাদের মহাবিশ্বের প্রত্যক্ষ নিয়মাবলি ব্যাখ্যা করতে পারবে- পদার্থবিজ্ঞানিদের এই আদি আশা কিছু কারণে হয়তো ছেড়ে দিতে হতে পারে। তাহলে আমাদের অবস্থান কোথায়? যদি এম-তত্ত্ব ১০৫০০ সেট প্রত্যক্ষ নিয়মাবলির স্বীকৃতি দেয় তবে আমরা কীভাবে এই মহাবিশ্বে আবির্ভূত হলাম? এবং অন্যান্য মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেই বা কী ঘটলো?

[বইটির সূচিপত্র তখা সব পর্বের লিংক দেখুন এখানে]

মূল: স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দো ম্লোডিনো

অনুবাদ: -আশরাফ মাহমুদ
গবেষক, কবি ও লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.