মহিমান্বিত নকশা (The Grand Design): পর্ব-২

0
466

[বইটির সূচিপত্র তখা সব পর্বের লিংক দেখুন এখানে]

দ্বিতীয় অধ্যায়: সূত্রের নিয়মনীতি (The Rule of Law)

Skoll the wolf who shall scare the Moon
Till he flies to the Wood-of-Woe:
Hati the wolf, Hridvitnir’s kin,
Who shall pursue the sun.
-“GRIMNISMAL,” The Elder Edda

ভাইকিং পুরাণের একটি প্রচলিত উপকথা হলো যে স্কল এবং হেইতি নামক দুটি নেকড়ে সূর্য এবং চাঁদকে তাড়া করে বেড়ায়। যখন এই নেকড়েগুলো যে কোনো একটিকে ধরে ফেলে তখনই সূর্যগ্রহণ অথবা চন্দ্রগ্রহণ হয়। এবং তখন পৃথিবীর মানুষ চন্দ্র সূর্যকে পুনরুদ্ধার করার জন্য খুব জোরে হৈচৈ করতে থাকে যাতে নেকড়ে দুটো ভয়ে পালিয়ে যায়। অন্যান্য সংস্কৃতিতেও এই রকম পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। কিন্তু একসময় মানুষ খেয়াল করতে শুরু করে যে তারা যতোই হৈচৈ করুক বা না করুক, চাঁদ কিংবা সূর্য ঠিকই গ্রহণ কাটিয়ে ওঠে। এবং মানুষজন পরে এটিও খেয়াল করলো যে এইসব গ্রহণ এলোমেলো ভাবে ঘটে না, বরং নিয়মিত এবং পুনরাবৃত্ত ধারায় ঘটে। চন্দ্রগ্রহণের এই ধারাটা পর্যবেক্ষণ করা এতোই সহজসাধ্য যে প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ানরা চন্দ্রগ্রহণের প্রায় নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতো, যদিও তারা জানতো না যে চন্দ্রগ্রহণ ঘটে পৃথিবীর মাঝখানে এসে পড়ার কারণে সূর্যের আলো আটকে যাওয়ার ফলে। তুলনামূলকভাবে সূর্যগ্রহণের সময়কাল নির্ণয় করা কঠিন ছিলো, কারণ সূর্যগ্রহণ পৃথিবীপৃষ্ঠের শুধুমাত্র ৩০ মাইল চওড়া এলাকা থেকে দেখা যায়। তবুও গ্রহণের এই পুনরাবৃত্ত ধারাটি একবার বুঝে ফেললে এটি স্পষ্ট বোঝা যায় যে গ্রহণ কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তার খামখেয়ালির উপর নির্ভর করে না, বরং নির্দিষ্ট সূত্র মেনে চলে।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা যদিও কিছু গ্রহ নক্ষত্রের গতি সফলভাবে হিসাব করতে পেরেছিলো তারপরও প্রকৃতির বেশিরভাগ ঘটনাই তাদের কাছে ছিলো ব্যাখ্যাতীত। আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প, ঝড়, মহামারি, পায়ের নখের বেড়ে যাওয়া এইসব যেনো ঘটছে কোনো কারণ কিংবা পুনরাবৃত্ত ধারা ছাড়াই। প্রাচীনকালে প্রকৃতির এসব বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডকে কোনো বদরাগী ঈশ্বর বা ধ্বংসাত্মক দেব-দেবীর কুকাণ্ড বলে মনে করা হতো। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দেখা হতো দেব-দেবীদের রাগিয়ে দেওয়ার প্রতিফল হিসাবে। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬০০ বছর আগে ওরিগানের মাজামা পর্বতের আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুত্পাত হয়, যার ফলে কয়েক বছর জ্বলন্ত কয়লা এবং আগ্নেয় শিলা বৃষ্টিপাতের মতো ঝরে, এরপর বহু বছরের বৃষ্টিতে সেই জ্বালামুখ পানিপূর্ণ হয়ে ক্রেটার লেক গঠন করে। কালামাথ ইন্ডিয়ানদের পৌরাণিক কাহিনিতে এই ঘটনার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার সাথে মূল ঘটনার সকল ভূতাত্বিক বর্ণনার মিল রয়েছে, যদিও বাড়তি নাটকীয়তা যোগ করে তারা এই দুর্ভাগ্যের কারণ হিসাবে একজন মানুষের কর্মফলকে দায়ী করে। আসলে মানুষের অপরাধবোধে ভোগার ক্ষমতাটাই এতো বেশি যে যেকোনো কিছুতেই তারা শেষমেষ নিজের কোনো না কোনো দোষ খুঁজে নিতে পারে। কথিত আছে, নিম্ন পৃথিবীর ঈশ্বর লাও কালামাথ সর্দারের সুন্দরী মানব কন্যার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটি সেই প্রেম প্রত্যাখান করে এবং ফলে প্রতিশোধস্বরূপ লাও পুরো কালামাথকেই আগুন দিয়ে ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টা করে। আরো কথিত আছে, ভাগ্যক্রমে তখন উর্ধ্ব পৃথিবীর ঈশ্বর স্কেল মানব জাতির উপর সদয় হয়ে তাদের রক্ষা করার জন্য লাও এর সাথে লড়াই করে, শেষ পর্যন্ত লাও আহত হয়ে মাউন্ট মাজামার মধ্যে পড়ে যায়, ফলে পানিতে ভরে যাওয়া সেই জ্বালামুখের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকৃতির নিয়মনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতাই প্রাচীনকালের মানুষদের মানবজীবনের সব বিষয়াদিতে কর্তার মতন বিভিন্ন দেব-দেবীর উদ্ভাবন করতে প্রলুব্ধ করেছে। তাদের ভালোবাসার এবং যুদ্ধের জন্য দেবতা ছিলো; ছিলো সূর্যের, পৃথিবীর এবং আকাশের জন্য; দেবতা ছিলো নদী ও মহাসমুদ্রের; ছিলো বৃষ্টি ও বজ্রপাতের; এমনকি ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির জন্যও। দেবতারা যখন সন্তুষ্ট থাকতো তখন মানবজাতি পেতো সুন্দর আবহাওয়া, শান্তি, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি থেকে মুক্তি। আর যখন তারা অসন্তুষ্ট হতো, তখনই খরা, যুদ্ধ, মহামারি আর দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি ঘটতো। যেহেতু প্রকৃতির বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে তাদের ধারণা ছিলো না তাই তারা দেবতাদের মনে করতো অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য, এবং মানুষ ছিলো তাদের হাতের পুতুল। তবে ২৬০০ বছর আগে মিলেতাসের থালেসের (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪ – ৫৪৬) সময় থেকে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। প্রকৃতি কিছু সুসংহত নিয়মাবলি মেনে চলে এবং সেগুলোর মর্মোদ্ধার করা সম্ভব- এই রকম ধারণার বিকাশ ঘটে। ফলে দেবদেবীর কর্তৃত্ব বিষয়ক ব্যাপারস্যাপার ঘুচিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে মহাবিশ্ব পরিচালিত হয় এমন ধারণার যাত্রা শুরু হয়, হয়তো একদিন আমরা সেটির নীলনকশা পড়ে ফেলবো।

মানব-ইতিহাসের সময়রেখা ধরে হিসাব করলে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান অনেকটাই নবীন একটি অভীক্ষা। আমাদের প্রজাতি, হোমো সেপিয়েন্সর উদ্ভব হয়েছিলো প্রায় ২০০০০০ বছর পূর্বে উপ-সাহারান আফ্রিকায়। সেই তুলনায় লেখ্য ভাষার দেখা মেলে মাত্র খ্রিষ্টপূর্ব সাত হাজার বছর আগের কৃষিনির্ভর সমাজে। (প্রাচীনতম সেইসব লিখিত কিছু দলিলের বিষয়বস্তু ছিলো একজন নাগরিকের জন্য কতটুকু মদের ভাগের অনুমোদন করা হবে)। গ্রীক সভ্যতার প্রাচীনতম লিখিত দলিলগুলো প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দির, সভ্যতার শিখর অর্থাৎ ‘ক্লাসিক্যাল যুগের’ কয়েক শত বছর পরের খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে। অ্যারিস্টটলের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) বর্ণনামতে, মূলত এই সময়েই থালেস জগতকে বোঝা যাবে এমন ধারণার সূত্রপাত করেন, আমাদের চারপাশে ঘটতে থাকা বিভিন্ন জটিলতাকে সহজতর নিয়মের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব কোনো ধরণের পৌরাণিক বা ধর্মীয় ব্যাখ্যা ছাড়াই।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৫ সালে থালেসই সর্বপ্রথম সফলভাবে সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন, যদিও বলা হয়ে থাকে যে তার নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী অনেকাংশে ভাগ্যক্রমে পাওয়া অনুমান ছিলো। তিনি ছিলেন একজন নিভৃতচারী মানুষ, নিজের কোনো লেখাই রেখে যান নি। গ্রীকদের উপনিবেশ আয়োনিয়াতে (Ionia) তার বাড়িটি ছিলো একটি অন্যতম জ্ঞানকেন্দ্র, যেটির প্রভাব পরবর্তীতে তুরুষ্ক থেকে সুদূর ইতালি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আয়োনিয়ান বিজ্ঞানের মূল অভীক্ষা ছিলো মৌলিক সূত্রাবলির সাহায্যে প্রাকৃতিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা করা যেটি কিনা মানুষের বুদ্ধিভিত্তিক অগ্রগতির ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক ব্যাপার। তাদের পদ্ধতি ছিলো যুক্তিনির্ভর এবং অনেক বিষয়েই তারা আমাদের পরিশীলিত পদ্ধতিতে পাওয়া ফলাফলের কাছাকাছি উপসংহারে পৌঁছাতে পেরেছিলো, যা ছিলো একটি মহিমান্বিত সূচনা। অথচ পরবর্তী কয়েক শতাব্দিব্যাপী সময়স্রোতে আয়োনিয়ান বিজ্ঞানের অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পরে একাধিকবার পুনরাবিষ্কৃত ও পুনরুদ্ভূত হয়।

কথিত আছে, আজকাল আমরা যেসব নিয়মকে প্রাকৃতিক সূত্র বলে চিনি সেইরকম প্রথম গাণিতিক সূত্র আবিস্কার করেছিলেন পিথাগোরাস (আনুমানিক. খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮০-৪৯০) নামের একজন আয়োনিয়ান, সূত্রটি তার নামে অর্থাৎ পিথাগোরাসের উপপাদ্য নামে পরিচিত: একটি সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের (সবচে’ বড় বাহুটি) বর্গ, অন্য দুইটি বাহুর বর্গের সমষ্টির সমান। বলা হয়ে থাকে পিথাগোরাস বাদ্যযন্ত্রের টানা তারের দৈর্ঘ্য ও সেই দৈর্ঘ্য সৃষ্ট স্বরসঙ্গতির মধ্যকার গাণিতিক সম্পর্ক নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখনকার ভাষায় বলতে চাইলে বলতে পারেন যে একটি নির্দিষ্ট টানের তারের কম্পাঙ্ক (প্রতি সেকেন্ডে তারটি যতোবার কাঁপে) তারটির দৈর্ঘ্যের ব্যস্তানুপাতিক। বুঝতেই পারছেন কেনো বেজ গিটারের তারের দৈর্ঘ্য সাধারণ গিটারের চেয়ে বেশি হওয়া প্রয়োজন। হয়তো এই সম্পর্কটি পিথাগোরাস নিজে আবিষ্কার করেন নি কিংবা পিথাগোরাসের উপপাদ্য-ও তার আবিস্কার নয়, কিন্তু এটি প্রমাণ করে যে টানা তারের দৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্কের মধ্যকার সম্পর্ক সেই সময়ের মানুষদের জানা ছিলো। সেক্ষেত্রে এই সাধারণ গাণিতিক সূত্রকেই আমরা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম নিদর্শন হিসেবে ধরতে পারি।

পিথাগোরাসের তারের সূত্র ছাড়া যে কয়েকটি মাত্র ভৌতসূত্র প্রাচীনকালে ভালোভাবে জানা ছিলো সেগুলো হলো প্রাচীনকালের উজ্জ্বলতম পদার্থবিজ্ঞানি আর্কিমিডিসের (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৭-২১২) প্রস্তাবিত তিনটি সূত্র। এখনকার পরিভাষা ব্যবহার করে বলতে গেলে, লিভারের সূত্র মতে, খুব ছোট বলও অনেক বড় ওজন তুলতে পারে কারণ লিভারের স্থিরবিন্দু থেকে বলপ্রয়োগ-বিন্দু পর্যন্ত এই দুই বিন্দুর দূরত্বের অনুপাতে বল বিবর্ধিত হয়ে ওঠে। ভাসমান বস্তুর সূত্র বাতায় যে একটি ভাসমান বস্তু বস্তুটি কর্তৃক অপসৃত তরলের ওজনের সমপরিমাণ উর্ধ্বমুখী বল অনুভব করে। আর প্রতিফলনের সূত্র মোতাবেক যে কোনো আয়নার উপর আলোকরশ্মির ফলে সৃষ্ট আপতিত কোণের মান প্রতিফলিত আলোকরশ্মির ফলে সৃষ্ট কোণের সমান। তবে আর্কিমিডিস এইসব সূত্রকে প্রাকৃতিক সূত্র হিসেবে সুপারিশ করেন নি, এমনকি পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের সাহায্যে বিশদ ব্যাখ্যা-ও দেন নি। বরং তিনি এগুলোকে ইউক্লিডের জ্যামিতিতে ব্যবহৃত স্বতসিদ্ধগুলোর মতো গাণিতিক স্বতসিদ্ধ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।

আয়োনিয়ানদের প্রভাব যখন বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তখন দেখা গেলো যে অনেকেই ভাবছেন যে আসলে মহাবিশ্বে এক ধরণের বিন্যস্ততা আছে, যেটিকে পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির সাহায্যে উপলব্ধি করা সম্ভব। থালেসের এক বন্ধু, কিংবা খুব সম্ভবত একজন ছাত্র, আনাক্সিমান্দার (Anaximander) (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬১০-৫৪০) যুক্তি পেশ করেন যে যেহেতু মানবশিশু জন্মের পর খুব অসহায় হয়ে থাকে তাই পৃথিবীর বুকে প্রথম মানুষ যদি শিশু হিসেবে আসতো তবে সে টিকতে পারতো না। এই চিন্তা মানব-ইতিহাসে বিবর্তনীয় ধারণার প্রাচীনতম নিদর্শন, আনাক্সিমান্দার যুক্তি মোতাবেক মানুষ নিশ্চয় অন্য কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে যাদের শিশুগুলো মানবশিশুদের চেয়ে বেশি সুঠাম ছিলো। অন্যদিকে সিসিলিতে এম্পেদোক্লেস (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০-৪৩০) ক্লেপ্সিড্রা নামক এক যন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করেন। সেটি দেখতে অনেকটা তরকারী বাড়ার হাতার মতো, যন্ত্রটির লাঠির মাথায় একটি গোলক থাকে, গোলকের উপরের অংশ ফাঁকা আর নিচে একটি ছোট ছিদ্র রয়েছে। গোলকটিকে পানিতে ডুবিয়ে পানিপূর্ণ করে উপরের অংশটি বন্ধ করে দিয়ে উপরের ফাঁকা অংশটা আটকে ক্লেপ্সিড্রাটি তুলে ফেললেও নিচের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে যায় না। আবার উপরের অংশ আগেই বন্ধ করে পানিতে ডুবালে-ও ক্লেপ্সিড্রা পানিপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এম্পেদোক্লেস ভেবে বের করলো যে অদৃশ্য কিছু নিশ্চয়ই পানিকে নিচের ছিদ্র দিয়ে ঢুকতে বা বের হতে বাধা দিচ্ছে- এভাবেই তিনি একটি জড় পদার্থ আবিস্কার করেন যেটিকে আমরা বর্তমানে বায়ু বলে থাকি।

একই সময়ে উত্তর গ্রীসের একটি আয়োনিয়ান কলোনিতে ডেমোক্রিটাস (আনুমানিক, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০) একটি বস্তুকে বারবার ভাঙতে বা কাটতে থাকলে কী ঘটবে সেটি নিয়ে ভাবছিলেন। তিনি যুক্তি দিলেন যে বস্তুটিকে অসীম সংখ্যক বার ভাগ করা যাবে না। বরং তিনি স্বতসিদ্ধ প্রস্তাব করেছিলেন যে সকল জীবিত সত্ত্বাসহ সমস্ত জিনিসই কিছু মৌলিক কণিকার দিয়ে গঠিত যাদেরকে আর ভাগ করা বা কাটা যাবে না। তিনি এই মৌল কণিকার নাম দিয়েছিলেন পরমাণু (atom), গ্রীক ভাষায় যার অর্থ ‘অকর্তনীয়’। ডেমোক্রিটাস বিশ্বাস করতেন সকল ভৌত ঘটনাই এই পরমাণুর মধ্যকার সংঘর্ষের ফলাফল। তার এই পরমাণুবাদ মতে সকল পরমাণু শূন্যে চলাফেরা করে এবং যদি না সেগুলোকে বাহ্যিকভাবে প্রভাবিত করা হয় তবে তারা চিরকাল একই দিকে চলতে থাকবেই। বর্তমানে একে জড়তার সূত্র বলা হয়।

আমরা যে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসবাসরত কোনো বিশেষ সত্ত্বা নই বরং তুচ্ছ কিছু বসবাসকারী- এই চমকপ্রদ ধারণাটি প্রথম পেশ করেন অ্যারিস্টার্কাস (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০-২৩০), অন্যতম শেষ আয়োনিয়ান বিজ্ঞানি। শুধুমাত্র তার একটি গাণিতিক হিসাবই এখন টিকে আছে, তিনি সতর্ক পর্যবেক্ষণের পরে জটিল জ্যামিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের ‘পরে পৃথিবীর ছায়ার আকার নির্ণয় করেছিলেন। প্রাপ্ত তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে তিনি উপসংহারে টানেন যে সূর্যের আকার পৃথিবী থেকে বহু গুণ বড়। যেহেতু ক্ষুদ্র বস্তুকেই বৃহৎ বস্তুর চারিদিকে আবর্তিত হতে হবে, উল্টোটা নয়, তিনিই প্রথম যুক্তি দেন যে পৃথিবী আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র নয় বরং অন্য গ্রহগুলোর মতো এটিও সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। পৃথিবী যে নগণ্য একটি গ্রহ, এই ছোট ভাবনা তাকে চিন্তা করতে বাধ্য করে যে সূর্যও বিশেষ কিছু নয়। অ্যারিস্টার্কাস সন্দেহ করেছিলেন যে রাতের আকাশে আমরা যে তারাগুলো দেখি সেগুলো দূরবর্তী সূর্য ছাড়া অন্য কিছু নয়।

প্রাচীন গ্রীকে যে কেবল বাঘা বাঘা পণ্ডিতেরাই ছিলেন এমন নয়, বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা ভিত্তিক “জ্ঞাননিকেতন” ছিলো- যেগুলো নিজেরাই ছিলো পরষ্পরবিরোধী এবং প্রথাবিরোধী। দুর্ভাগ্যক্রমে, প্রকৃতি সম্পর্কে আয়োনিয়ান মনোভঙ্গি অর্থাৎ প্রকৃতিকে সাধারণ কিছু সূত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা ও প্রকাশ করা যাবে এই ধারণা কেবল কয়েক শতাব্দি ধরে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলো। এর অন্যতম কারণ হলো যে আয়োনিয়ান তত্ত্বে স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তির (free will) বা স্বেচ্ছাউদ্দেশ্যের (free purpose) এবং বিশ্ব-পরিচালনায় ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের কোনো স্থান ছিলো না। এই ধারণাসমূহের অনুপস্থিতি তখনকার অনেক গ্রীক পণ্ডিতদের ভীষণ উদ্বিগ্ন করে তুলেছিলো, ঠিক যেমন এখনকার অনেক মানুষকে বিষয়টি আলোড়িত করে। উদাহরণস্বরূপ, দার্শনিক এপিকিউরাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪১-২৭০) পরমাণুবাদ তত্ত্বকে বর্জন করে বলেছিলেন যে “প্রাকৃতিক দার্শনিকদের ভাগ্যের ‘দাস’ হবার চেয়ে দেবদেবী সম্পর্কিত পুরাণকথাগুলোকে অনুসরণ করা শ্রেয়।” অ্যারিস্টটল-ও পরমাণুবাদকে বর্জন করেন, কারণ পরমাণুর মতো আত্মাহীন জড়বস্তু দিয়ে মানুষ গঠিত- এমন ধারণা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। মহাবিশ্ব যে মানবকেন্দ্রিক নয়- এই আয়োনিয়ান দর্শন আমাদের মহাজাগতিক উপলব্ধির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক, অথচ গ্যলিলিওর আগ পর্যন্ত বারো শতাব্দি ধরে এই ধারণা বর্জিত ছিলো বা সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয় নি।

প্রকৃতি সম্পর্কে গ্রীকদের কিছু অনুমান অনেক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হলে-ও তাদের বেশিরভাগ ধারণাই এমন ছিলো যে সেগুলো আধুনিক বিজ্ঞানের মানদণ্ড উর্ত্তীর্ণ হতে পারবে না। কারণ, গ্রীকরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার করে নি, এমনকি তাদের তত্ত্বগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করার জন্য-ও তৈরি করা হতো না। ফলে যদি কোনো পণ্ডিত দাবি করতেন যে যতক্ষণ না অন্য আরেকটি অণুর সাথে সংঘর্ষ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত একটি অণু সরলপথেই চলতে থাকবে, এবং যদি আরেক পণ্ডিত দাবি করতেন যে একটি অণু সরলপথেই চলতে থাকবে যতক্ষণ না সেটি সাইক্লপ্সের (cyclops) সাথে ধাক্কা খায়; তখন তাদের এই মতভেদ দূর করার জন্য কোনো ব্যবহারিক পদ্ধতি ছিলো না। তাছাড়া, তাদের কাছে প্রাকৃতিক নিয়ম এবং মানুষের বানানো নিয়মের মধ্যে পরিষ্কার কোনো পার্থক্য ছিলো না। যেমন, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দিতে আনাক্সিমান্দার লিখেছিলেন যে সবকিছুর সূচনা হয় একটি প্রাথমিক বস্তু থেকে, একসময় সেটিতেই ফিরে যায় পাছে তাদেরকে নীতিবিরুদ্ধতার জন্য জরিমানা দিতে হয়! আবার, আয়োনিয়ান দার্শনিক হেরাক্লিটাসের (আনুমানিক খৃপূ ৫৩৫- খৃপূ ৪৭৬) মতে সূর্য সুনির্দিষ্ট আচরণ করে কারণ তা না হলে ন্যায়নীতির দেবী সেটিকে পাকড়াও করবেন। কয়েক শতাব্দি পরে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের দিকে গ্রীকের একটি জ্ঞাননিকেতনের স্টয়িক্স (Stoics) দার্শনিকেরা প্রাকৃতিক নিয়ম এবং মানুষের বানানো নিয়মের মধ্যে পার্থক্য করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তারা কিছু মানব আচরণবিধি যেমন- ঈশ্বরকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং পিতা-মাতার প্রতি আনুগত্য থাকা ইত্যাদিকে মহাজাগতিক নিয়ম মনে করতেন এবং সেগুলোকে প্রাকৃতিক নিয়মের তালিকায় ফেলেছিলেন। এছাড়া তারা প্রায়ই আইনি পরিভাষার মাধ্যমে ভৌত ঘটনাবলির বর্ণনা দিতেন, যেনো জড়বস্তুগুলো ভৌতনিয়মসমূহ ঠিকঠাক মতো “মানে” তার জন্য এভাবে জোর দিয়ে বলা উচিত, অথচ নিয়মকানুনগুলো-ও নিষ্প্রাণ বটে। আপনি যদি মনে করেন যে মানুষকে ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা বেশ কঠিন কাম, তবে চিন্তা করেন গ্রহগুলো আইন করে উপবৃত্তাকার পথে চলতে বাধ্য করতে গিয়ে আপনি কী অবস্থার সম্মুখীন হতেন!

চিন্তাধারার এইরকম রক্ষণশীলতা গ্রীকদের উত্তরসূরি চিন্তাবিদদের মধ্যেও বহু শতাব্দি ধরে প্রচলিত ছিলো। ত্রয়োদশ শতকে খ্রিস্টান দার্শনিক থমাস অ্যাকুইনাস (আনুমানিক ১২২৫-১২৭৪) ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে এই চিন্তাধারা গ্রহণ করে যুক্তি দেখান যে, “এটি সুস্পষ্ট যে জড়বস্তুগুলো দৈবক্রমে নয় বরং স্বেচ্ছায় তাদের কার্যসীমায় পৌঁছে… নিশ্চয় কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিসত্তা প্রকৃতির সবকিছুকে এভাবে কার্যসীমায় পৌঁছানোর আদেশ দিয়েছেন।” অবাক করা ব্যাপার হলো, ষোড়শ শতাব্দির মহান জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানি জোহানেস কেপলার (১৫৭১-১৬৩০) বিশ্বাস করতেন যে গ্রহগুলোর অনুভূতি ও চেতনা আছে, এবং তারা সচেতনভাবেই “মন” দিয়ে অনুধাবন করে গতির সূত্রসমূহ মেনে চলে।

সবকিছুকে প্রকৃতির নিয়মগুলো সচেতনভাবে মেনে চলতে হয়, এই ধারণা থেকে বোঝা যায় যে প্রাচীনকালের পণ্ডিতেরা ‘কীভাবে’ প্রকৃতি আচরণ করে সেটি জানার চেয়ে ‘কেনো’ প্রকৃতি এমন আচরণ করে সেটি জানতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। এই মনোভঙ্গীর অন্যতম প্রবক্তা অ্যারিস্টটল পর্যবেক্ষণভিত্তিক বিজ্ঞানের ধারণাকে বাতিল গণ্য করেন। তবে সূক্ষ্ম পরিমাপ এবং গাণিতিক হিসাবনিকাশ সেই প্রাচীনকালে-ও সহজসাধ্য ছিলো না। এখনকার হিসাবনিকাশে বহুল ব্যবহৃত দশভিত্তিক (ten base) সংখ্যা-ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলো ৭০০ সালের দিকে হিন্দুরা। যোগ এবং বিয়োগ চিহ্নের দেখা মেলে নি পঞ্চদশ শতকের আগে। এমনকি সমান-চিহ্ন এবং সেকেন্ডে সময় মাপতে পারে এমন ঘড়ির অস্তিত্ব ছিলো না ষোড়শ শতকের আগে।

অন্যদিকে, অ্যারিস্টটল পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিমাপ ও হিসাবনিকাশের এই বাধাকে কোনো সমস্যাই মনে করেন নি। বরং তিনি হিসাবনিকাশকে প্রয়োজনীয় মনে করতেন না। অ্যারিস্টটল তার কাছে বৌদ্ধিক আবেদন সৃষ্টি করতে পারতো এমন সব নীতির উপর ভর করে পদার্থবিজ্ঞানের কাঠামো তৈরি করেছিলেন। বৌদ্ধিক আবেদনহীন তথ্যসমূহ তিনি চেপে যেতেন এবং ‘কীভাবে’ সবকিছু ঘটে তা না জানতে চেয়ে ‘কেনো’ সব কিছু ঘটে সেটি জানতেই তিনি পুরোপুরি সচেষ্ট ছিলেন। এর ফলে যদি তার গবেষণা বাস্তবতাবিবর্জিত হয়ে উঠতো তখন তিনি তার ‘হিসাবনিকাশে’ কিছু কিছু পরিবর্তন করতেন। কিন্তু এইসব জোড়াতালি দেয়া পরিবর্তন ভুলগুলোকে ঢেকে ফেলা ছাড়া বিশেষ কিছু করতো না। এভাবে তার তত্ত্বের সাথে বাস্তবতার যতোই অমিল থাকতো না কেনো তিনি সংঘাত দূর করতে প্রায় কিছু টুকটাক ঘষামাজা করে দিতেন। উদাহরণস্বরূপ, তার গতিসূত্র মোতাবেক ভারী বস্তু তার ওজনের সমানুপাতিকভাবে ধ্রুব গতিতে নিচে পড়ে। কিন্তু বস্তু যতো পড়তে থাকে ততোই বস্তুর গতি বাড়তে থাকে- এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি নতুন এক নীতি প্রস্তাব করে বসলেন- বস্তু যতোই নিচে পড়তে থাকে ততোই স্বাভাবিক অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছে যায় বলে উৎফুল্ল হয়ে পড়ে এবং আরো জোরে তরান্বিত হয়, কিন্তু এই নীতি জড়বস্তুর মতিগতি ব্যাখ্যার চেয়ে এক ধরণের মানুষের আচরণকে বর্ণনা করার জন্য ‘চলে’ বোধহয়। যদিও অ্যারিস্টটলের তত্ত্বগুলো অনেক সময়ই খুব অল্প কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলো, তারপরও তার চিন্তাপদ্ধতির প্রভাব পশ্চিমাদের উপর প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বিস্তারিত ছিলো।

মহাবিশ্ব যে চেতনাহীন প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হ্‌য়- এই ধারণা গ্রীকদের খ্রিস্টান উত্তরসূরিরা বর্জন করেছিলো। মহাবিশ্বে মানুষের বিশেষ কোনো স্থান নেই এমন ধারণাকে-ও তারা বর্জন করেছিলো। যদিও মধ্যযুগে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো দার্শনিক ধারণা ছিলো না, তবুও মূলভাব ছিলো যে মহাবিশ্ব হচ্ছে ঈশ্বরের খেলাঘর, এবং প্রাকৃতিক বিষয়াবলি নিয়ে গবেষণা করার চেয়ে ধর্মচর্চা করা বহুগুণে ভালো। এমনকি ১২৭৭ সালে প্যারিসের বিশপ ট্যাম্পিয়ার পোপ জন XXI এর পক্ষ থেকে শাস্তিযোগ্য ২১৯ টি ভুল বা নাফরমানির একটি তালিকা প্রকাশ করেন। অন্যতম একটি নাফরমানি ছিলো, প্রকৃতি শুধু প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে- এই ধারণা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। মজার ব্যাপার হলো, কয়েক মাস পরে প্রাকৃতিক নিয়ম মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে প্রাসাদের ছাদ ভেঙ্গে পড়লে পোপ জন নিহত হন।

প্রাকৃতিক নিয়মাবলি সম্পর্কিত আধুনিক ধারণা আবির্ভুত হয় সপ্তদশ শতকে। মনে হচ্ছে কেপলারই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে এই নিয়মাবলি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যদিও আমরা পূর্বে বলেছি যে তিনি জড়বস্তুর সত্ত্বাইন্দ্রিয় আছে বলে মনে করতেন। গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) তার অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক লেখনিতে ‘সূত্র’ শব্দটি ব্যবহার করেন নি (যদিও তার লেখার কিছু অনুবাদে শব্দটি পাওয়া যায়)। যাহোক, শব্দটি তিনি ব্যবহার করুন বা না করুন তিনি অনেক প্রাকৃতিক সূত্র উদ্ঘাটন করেছিলেন, এবং পর্যবেক্ষণই হলো বিজ্ঞানের ভিত্তি আর বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন ভৌত ঘটনাবলির মধ্যকার পরিমাণগত সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা- তিনি এই মতবাদের প্রবক্তা হয়েছিলেন। তবে আমরা এখন যেমন বুঝি, ঠিক সেইরকমভাবে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম প্রাকৃতিক নিয়মগুলো সুনির্দিষ্ট এবং যৌক্তিক ভাবে সূত্রবদ্ধ করছিলেন তিনি হলেন রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০)।

দেকার্ত বিশ্বাস করতেন যে সকল ভৌত ঘটনাকে অবশ্যই চলমান বস্তুগুলোর মধ্যকার বিভিন্ন সংঘর্ষের আলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে, যেগুলো নিউটনের বিখ্যাত গতিসূত্রের পূর্বসূরি তিনটি মৌলিক সূত্র দ্বারা পরিচালিত হয়। তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে প্রকৃতির এই মৌলিক সূত্রগুলো সকল স্থান ও কালেই কার্যকরী এবং এই আইনগুলো মেনে চলার অর্থ এই নয় যে বস্তুগুলোর নিজস্ব চেতনা আছে। আমরা যেটিকে এখন “প্রাথমিক অবস্থা” (initial conditions) বলি, দেকার্ত সেটির গুরুত্ব-ও বুঝতে পেরেছিলেন। প্রাথমিক অবস্থা হচ্ছে কোনো একটি সিস্টেমের আদি অবস্থা, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে যে সিস্টেমের শেষ অবস্থা কী হবে সেটি আমরা বের করতে চাই। যদি এক গুচ্ছ প্রাথমিক অবস্থা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় তবে প্রাকৃতিক নিয়মাবলিই নির্ধারণ করবে ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে সিস্টেমটি কীভাবে বিবর্তিত হবে, যদি সিস্টেমের প্রাথমিক অবস্থা নির্দিষ্ট করে বলা না হয় তবে সিস্টেমটির বিবর্তন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা যাবে না। যেমন, কোনো সময়সীমার শুরুতে ঠিক মাথার উপরে থাকা একটি কবুতর যদি কোনো বস্তু ছেড়ে দেয় তবে সেই বস্তুটির গতিপথ নিউটনের গতিসূত্র দ্বারা নির্ধারিত হবে। কিন্তু আমরা ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল পাবো যদি কবুতরটি সময়সীমার শুরুতে কোনো টেলিফোন তারে স্থির হয়ে বসে বস্তুটি ছাড়ে কিংবা ঘন্টায় ২০ মাইল বেগে উড়ে চলার সময় ছাড়ে। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রাবলি প্রয়োগ করতে হলে একটি সিস্টেম কীভাবে শুরু হয়েছে অথবা নির্দিষ্ট সময়ে সিস্টেমটির অবস্থা কী সেটি অবশ্যই জানা থাকতে হবে। (আবার যে কেউ উল্টোভাবে এই সূত্রাবলি ব্যবহার করতে পারেন সিস্টেমটির পূর্বাবস্থা নির্ণয় করার জন্য)।

প্রাকৃতিক নিয়মাবলি সম্পর্কিত এই নতুন ধারণার সাথে নতুন করে ঐশ্বরিক ধারণার মেলবন্ধন করার চেষ্টা শুরু হয়। দেকার্তের মতে, ঈশ্বর ইচ্ছা করলে নৈতিক-প্রস্তাবগুলোর সত্য মিথ্যা কিংবা গাণিতিক উপপাদ্যগুলো পরিবর্তন করতে পারবেন, কিন্তু প্রকৃতিকে নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বরের অন্য কোনো পছন্দ ছিলো না বলেই তিনি এই প্রাকৃতিক নিয়মাবলিই নির্ধারণ করেছিলেন; শুধুমাত্র এই নিয়মগুলোই সম্ভব ছিলো। আপনার মনে হতে পারে যে এতে ঈশ্বরের ক্ষমতাকে খর্ব করে দেখা হচ্ছে, কিন্তু দেকার্ত পাল্টা যুক্তি দিলেন যে আসলে নিয়মগুলো ঈশ্বরের অন্তর্নিহিত প্রকৃতিরই প্রতিচ্ছবি। যদি এরকমই সত্যি হয় তবে আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে ঈশ্বর ইচ্ছে করলে বিভিন্ন প্রাথমিক অবস্থা নির্ধারণ করে দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে পারতেন, কিন্তু দেকার্ত এই সম্ভাবনাকে-ও অগ্রাহ্য করেন। তার মতে, যে ধরণের প্রাথমিক অবস্থাই নির্ধারণ করে দেয়া হোক না কেনো সময়প্রবাহে একসময় ঠিকই আমাদের মহাবিশ্বের মতো মহাবিশ্বের উদ্ভব হবে। তাছাড়া দেকার্ত আরো বিশ্বাস করতে যে মহাবিশ্বের সূচনা করে দিয়ে ঈশ্বর এটিকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছেন।

প্রায় একই ধরনের অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন আইজ্যাক নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭)। নিউটন হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যার বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলো সর্বজনস্বীকৃত হয়েছিলো, মূলত তার তিনটি গতিসূত্র এবং মহাকর্ষ সূত্র- যেগুলো পৃথিবী, চাঁদ, ও অন্যান্য গ্রহগুলোর কক্ষপথ নির্ণয় করতে এবং জোয়ার ভাটার মতো ঘটনাও ব্যাখ্যা করা করতে পেরেছিলো। যে দরকারি সমীকরণগুলো তিনি আবিষ্কার করেছিলেন সেগুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আমাদের বর্তমানের গাণিতিক সংগঠন, সেগুলো আজও শেখানো হয়, এবং প্রয়োগ করা হয়- যখনই কোনো স্থপতি একটি অট্টালিকার নকশা করেন বা কোনো প্রকৌশলি গাড়ির নকশা করেন বা একজন পদার্থবিজ্ঞান হিসাব করেন কীভাবে নিশান ঠিক করলে একটি রকেট মঙ্গলগ্রহে গিয়ে অবতরণ করবে। তাইতো কবি আলেক্সান্দার পোপ বলেছিলেন,

প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সূত্রাবলি লুকানো ছিলো রাতের অন্ধকারে
ঈশ্বর বললেন, চালাও নিউটন! ওমনি সব উঠলো আলোয় ভরে

এখনকার অধিকাংশ বিজ্ঞানিই একটি প্রাকৃতিক সূত্রকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলবেন যে এটি এমন একটি নিয়ম যেটিকে কোনো ভৌত ঘটনার নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হয় এবং যেটির ভবিষ্যদ্বাণী ওই তাৎক্ষণিক অবস্থা পেরিয়েও অন্যান্য ঘটনার জন্য প্রযোজ্য। যেমন, আমরা খেয়াল করলাম যে আমাদের জীবনের প্রত্যেক সকালেই সূর্য পূর্বদিকে উদয় হচ্ছে, এবং একটি প্রাকৃতিক সূত্র প্রস্তাব করলাম যে, “সূর্য সবসময় পূর্বদিকে উদয় হয়।” এই সাধারণীকৃত করা সূত্রটি কিন্তু আমাদের সূর্যোদয় পর্যবেক্ষণের সীমিত ঘটনা পেরিয়েও অন্যান্য ব্যাপারে এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে নিরীক্ষণযোগ্য অনুমান সরবরাহ করে। অন্যদিকে, যদি বলা হয় “এই অফিসের কম্পিউটারগুলো কালো,” তবে এটি কোনো প্রাকৃতিক সূত্র নয় কারণ এটি কেবলমাত্র এই অফিসের কম্পিউটারগুলো সম্পর্কেই সত্য এবং এমন কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করছে না যে “যদি আমি আমার অফিসের জন্য একটি নতুন কম্পিউটার কিনি, তবে সেটি কালোই হবে।”

“প্রাকৃতিক নিয়ম” সম্পর্কিত আমাদের আধুনিক বোঝাপড়া ঠিক কী সেটি নিয়ে দার্শনিকেরা সুদীর্ঘ বিতর্ক করেছেন, এবং প্রশ্নটি আসলে যতটা মনে হয় তারচেয়ে-ও বেশি নিগূঢ়। যেমন, দার্শনিক জন ক্যারল “সোনার সকল গোলকের ব্যাস এক মাইলের ছোট” এই বাক্যটির তুলনা করেছেন “ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর সকল গোলকের ব্যাস এক মাইলের ছোট” বাক্যটির সাথে। আমাদের জাগতিক জ্ঞান বলছে যে এক মাইলের চেয়ে বড় সোনার কোনো গোলক আসলেই নেই এবং ভবিষ্যতে-ও না থাকার ব্যাপারে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত। তারপর-ও আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না যে ভবিষ্যতে এমনটি হবে না, তাই এটি কোনো প্রাকৃতিক সূত্র নয়। অন্যদিকে, আপনি “ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর সকল গোলকের ব্যাস এক মাইলের ছোট” বাক্যটিকে একটি প্রাকৃতিক সূত্র হিসেবে ধরতে পারেন, কারণ কেন্দ্রকীয় পদার্থবিদ্যা (nuclear physics) থেকে আমরা জানি যে ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর কোনো গোলকের ব্যাস ছয় ইঞ্চির বেশি গেলে সেটি পারমাণবিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে। সেহেতু আমরা নিশ্চিত ধরে নিতে পারি যে এমন কোনো গোলক নেই (এইরকম একটি বানানোর চেষ্টা করা-ও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না)। এই গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য থেকে বোঝা যায় যে আমাদের পর্যবেক্ষিত সব রকমের সাধারণীকরণই প্রাকৃতিক সূত্র নয়, এবং অধিকাংশ প্রাকৃতিক সূত্রই পরস্পর সংযুক্ত আরো বিশাল কোনো সূত্রাবলির সিস্টেমের (system of laws) অংশ।

আধুনিক বিজ্ঞানে প্রাকৃতিক সূত্রগুলোকে সাধারণত গণিতের ভাষায় প্রকাশ হয়। সূত্রগুলো পুরোপুরি পূর্ণাঙ্গ অথবা যথাযথপ্রায় হতে পারে, কিন্তু সেগুলোকে অবশ্যই সার্বজনীন না হলে-ও অন্তত কিছু শর্ত সাপেক্ষে কোনো ধরণের ব্যতিক্রম ছাড়াই টেকসই হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা এখন জানি যে বস্তু যদি আলোর বেগে বা আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে চলে তবে নিউটনের সূত্রগুলোকে পরিবর্তন করতে হবে। তথাপি, নিউটনের সূত্রগুলোকে আমরা প্রকৃতির সূত্র হিসাবেই মানি কারণ সেগুলো পৃথিবীর দৈনন্দিন জীবনের অবস্থার প্রেক্ষিতে (যেখানে আমরা আলোর গতির চেয়ে অনেক কম দ্রুতির সম্মুখীন হই) খুব ভালো আসন্নমান প্রদান করে।

যদি প্রকৃতি নির্দিষ্টি কিছু সূত্র মেনেই চলে, তবে তিনটি প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে:

১. এই সূত্রগুলোর উৎসমূল কী?

২. এই সূত্রাবলির কোনো ব্যতিক্রম যেমন ধরুন- অলৌকিকতা আছে কি?

৩. সম্ভাব্য সূত্রাবলির কি একটি মাত্র সেট?

এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তর বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞানি, দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক জানতে চেষ্টা করেছেন। প্রথম প্রশ্নটির প্রথাগত উত্তর হলো- কেপলার, গ্যালিলিও, দেকার্ত এবং নিউটনের উত্তর- প্রাকৃতিক নিয়মাবলি ঈশ্বরের কীর্তি। কিন্তু এটি প্রাকৃতিক নিয়মাবলির মূর্তপ্রকাশ হিসেবে ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করা ছাড়া আর কিছু না। যদি না কেউ ঈশ্বরের উপর কিছু গুণাবলি আরোপ করেন, যেমন ধরুন বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের গুণাবলি, তবে প্রথম প্রশ্নের উত্তর হিসেবে ঈশ্বরকে টেনে এনে স্রেফ একটি রহস্যকে আরেকটি রহস্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করছেন। তর্কের খাতিরে আমরা যদি ঈশ্বরর কীর্তিকে প্রথম প্রশ্নের উত্তর হিসেবে ধরি তবে গিট্টু বাঁধে দ্বিতীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে: এই সূত্রাবলির কোনো ব্যতিক্রম বা অলৌকিকতা আছে কি?

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রে নানা মতির নানা মত। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মতো প্রভাবশালী প্রাচীন গ্রীক চিন্তাবিদদের মতে নিয়মগুলোর ক্ষেত্রে কোনো প্রকারের ব্যতিক্রম নেই, কিন্তু আপনি যদি বাইবেলের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন তবে লক্ষ্য করবেন যে ঈশ্বর কেবল নিয়মাবলিই সৃষ্টি করেন নি, বরং প্রার্থনার মাধ্যমে এইসব নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটার সুযোগ রেখেছেন- যেমন ধরুন মুমূর্ষু রোগীকে সারিয়ে দেয়া, খরা শেষ করতে পারেন আগেভাগেই, অথবা ক্রোকেইকে (croquet) অলিম্পিকের খেলা হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা-ও করতে পারেন। অধিকাংশ খ্রিস্টান চিন্তাবিদ মনে করেন যে ঈশ্বর অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর জন্য প্রাকৃতিক নিয়মাবলি স্থগিত করতে সক্ষম, এই ধারণাটি দেকার্তের চিন্তার বিপরীত। এমনকি নিউটন-ও এক ঘরানার অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করতেন। তিনি ভেবেছিলেন গ্রহগুলোর কক্ষপথ ভারসাম্যহীন হয়ে উঠবে কারণ একটি গ্রহের উপর আরেকটি গ্রহের মহাকর্ষ বল কক্ষপথে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে এবং সময়ের সাথে সাথে সেটি বাড়তেই থাকবে, ফলে একসময় গ্রহগুলো হয় সূর্যে পতিত হবে অথবা সৌরজগত থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবে। তিনি ভাবতেন যে ঈশ্বরকে নিশ্চয় সময়ে সময়ে এই কক্ষপথগুলোকে পুনর্স্থাপন করতে হয়। অবশ্য, পিয়ের-সিমো, মারকুই দঅ লাপ্লাস (১৭৪৯-১৮২৭), যিনি লাপ্লাস নামেই বেশি পরিচিত, যুক্তি দেখান যে গ্রহগুলোর এই বিচ্যুতি ক্রমবর্ধনশীল না হয়ে পুনরাবৃত্ত চক্রের মতো পর্যাবৃত্ত হবে। ফলে সৌরজগত নিজেই নিজেকে পুনর্স্থাপন করবে, ঠিক এই কারণে আজ পর্যন্ত সৌরজগতের টিকে থাকা ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই।

বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদকে (Scientific Determinism) প্রথম সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপনা করতে পারার কৃতিত্ব লাপ্লাসকেই দেয়া হয়: যদি কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সমগ্র মহাবিশ্বের অবস্থা জানা থাকে তবে প্রাকৃতিক সূত্র বা নিয়মাবলির একটি পরিপূর্ণ সেট অতীত এবং ভবিষ্যত উভয়ই নির্ধারণ করবে। ফলে নিয়মগুলো অলৌকিক কিছু ঘটা কিংবা ঈশ্বরের সক্রিয় ভূমিকা নাকচ করে দেয়। লাপ্লাসের সূত্রবদ্ধ করা বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদই দ্বিতীয় প্রশ্নের প্রেক্ষিতে একজন আধুনিক বিজ্ঞানির উত্তর। বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদই আধুনিক বিজ্ঞানের মূলভিত্তি এবং এই বইটি জুড়ে-ও এর গুরুত্ব অনেক। একটি বৈজ্ঞানিক সূত্র বৈজ্ঞানিক সূত্র হিসেবে কখনোই গণ্য হবে না যদি এটি কেবল কোনো অতিপ্রাকৃত সত্ত্বার হস্তক্ষেপ না হলেই কাজ করে। ব্যাপারটি জেনে নেপোলিয়ন লাপ্লাসের কাছে জানতে চেয়েছিলেন মহাবিশ্বের এইরকম চিত্রে ঈশ্বরের অবস্থান কোথায় হবে। লাপ্লাস উত্তর দিলেন, “মশাই, আমার এমন কোনো চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজনই পড়ে নি।”

যেহেতু মানুষ মহাবিশ্বেই বসবাস করে এবং অন্যান্য বস্তুগুলোর সাথে মিথস্ক্রিয়া করে, সেহেতু বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদ মানুষের জন্য-ও বলবত্ হবে। অবশ্য অনেকে ভৌত জগত নিশ্চয়তাবাদ অনুযায়ী কাজ করে এটি মানলেও মানুষকে এর ব্যতিক্রম হিসেবে ধরেন, কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে আমাদের স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি রয়েছে। যেমন, দেকার্ত স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তির ধারণাকে রক্ষা করতে গিয়ে দাবি করলেন যে মানুষের মন ভৌত জগতের চেয়ে আলাদা এবং ভৌত জগতের নিয়ম মেনে চলে না। তার মতে মানুষ দেহ ও আত্মা এই দুইটি ভিন্ন গাঠনিক উপাদান নিয়ে গঠিত। দেহ হলো সাধারণ যন্ত্রের মতো, তবে আত্মা বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলির আয়ত্তাধীন নয়। দেকার্ত শরীরতত্ত্বে এবং অঙ্গসংস্থানতত্ত্বে আগ্রহী ছিলেন, এবং মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যভাগে অবস্থিত পিনিয়াল গ্রন্থটিকে আত্মার উৎসমূল বলে মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই গ্রন্থিটিই আমাদের যাবতীয় চিন্তা এবং স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তির উৎস।

মানুষের কি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি আছে? যদি আমাদের স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি থেকেই থাকে, তবে বিবর্তন-বৃক্ষের (evolutionary tree) ঠিক কোথায় এর উদ্ভব হয়েছে? নীলচে সবুজ শৈবাল বা ব্যাক্টেরিয়ার কি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি আছে, নাকি তাদের আচরণ স্বয়ংক্রিয় এবং বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলির আয়ত্তাধীন? শুধু কি বহুকোষী জীবদের স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি আছে, নাকি কেবলমাত্র স্তন্যপায়ীদের? আমরা হয়তো ভাবতে পারি যে একটি শিম্পাঞ্জি কলা চিবানোর সময় বা বিড়ালটা আপনার সোফা ছিঁড়ে ফেলার সময় স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি প্রয়োগ করছে, কিন্তু মাত্র ৯৫৯ টি কোষ নিয়ে গঠিত Caenorhabidis elegans গোলকৃমির বেলায়? সেটি নিশ্চয় কখনো চিন্তা করে না, “ওই বজ্জাত স্বাদহীন ব্যাকটেরিয়াটাকে আমার খেতে হয়েছে,” কিন্তু দেখা যায় যে সেটির-ও খাবারদাবারের ব্যাপারে কিছু অভিরুচি রয়েছে এবং সাম্প্রতিক কোনো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সেটি হয় কোনো অনাকর্ষণীয় খাবারই গলদ করে অথবা আরো ভালো কিছুর অন্বেষণ করে। সেটি কি মূলত স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ?

যদিও আমরা ভাবি যে আমরা কী করি না করি সেই ব্যাপারে আমরাই সিদ্ধান্ত নিই কিন্তু জীববিজ্ঞানের আণবিক ভিত্তি সম্পর্কিত জ্ঞান আমাদের বাতায় যে জৈব প্রক্রিয়াগুলো আসলে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের সূত্রাবলি মেনেই সংঘটিত হয়, সুতারাং সেগুলো গ্রহগুলোর কক্ষপথের মতোই নিরূপণযোগ্য। স্নায়ুবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে নিয়মাবলির উর্ধ্বে কোনো কিছু নয়- আমাদের মস্তিষ্কই বিজ্ঞানের সূত্রাবলি অনুযায়ী আমাদের সকল কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ, জাগ্রত অবস্থায় রোগীর মস্তিষ্কে অপারেশন করার সময় দেখা গেছে যে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশকে বৈদ্যুতিকভাবে উত্তেজিত করে রোগীর মধ্যে হাত, বাহু বা পা নাড়ানোর, কিংবা ঠোঁট নাড়িয়ে কথা বলার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করা সম্ভব। যদি আমাদের আচরণ ভৌত সূত্রাবলি মেনেই নির্ণিত হয়, তবে স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি আমাদের পরিচালিত করে এমন চিন্তা করা প্রগলভতা, মূলত আমরা জৈবিক-যন্ত্র ছাড়া বিশেষ কিছু নই, এবং স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি কেবলই বিভ্রম।

আমাদের আচরণ প্রাকৃতিক নিয়মাবলি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত বটে, তারপরও এটি চিন্তা করা যৌক্তিক যে এই আচরণ এতো বেশি সংখ্যক চলকের উপর নির্ভর করে ও এতো জটিলভাবে সংঘটিত হয় যে কারো সমগ্র আচরণাবলি অনুমান করা বাস্তবে অসম্ভব। কারণ হিসেব কষতে হলে আপনাকে মানুষটির দেহের হাজার ট্রিলিয়ন অণু-পরমাণুর প্রাথমিক অবস্থা কী ছিলো সেটি জানতে হবে এবং প্রায় সমসংখ্যক সমীকরণ সমাধান করতে হবে। এই হিসেবনিকেশ কয়েক বিলিয়ন বছর সময় নেবে, তাতে এতো বেশি দেরী হয়ে যাবে যে যদি সামনের কোনো লোক ঘুষি মারে তবে মাথা সরিয়ে নেয়ার-ও সময় পাওয়া যাবে না।

যেহেতু ভৌতজগতের নিয়মাবলি ব্যবহার করে হিসেব কষে মানুষের আচরণ অনুমান করতে যাওয়া অবাস্তব বৈকি, আমরা এই ক্ষেত্রে একটি কার্যকর তত্ত্ব (Effective Theory) অবলম্বন করি। পদার্থবিজ্ঞানে কার্যকর তত্ত্ব হচ্ছে এমন একটি নির্মাণকাঠামো যেটির সাহায্যে পুরো প্রক্রিয়াগুলো বিশদভাবে বর্ণনা না করেই কোনো পর্যবেক্ষণমূলক ঘটনার মডেল তৈরি করা যায়। উদাহরণ দিতে গেলে, একজন মানুষের প্রতিটি পরমাণুর সাথে পৃথিবীর প্রতিটি পরমাণুর মধ্যকার মহাকর্ষীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সমীকরণসমূহ আমরা সমাধান করতে পারবো না। কিন্তু তারপর-ও প্রায়োগিক কাজকর্মের জন্য আমরা অল্প কিছু সংখ্যা যেমন মানুষ ও পৃথিবীর ভর দিয়েই মানুষ এবং পৃথিবীর মধ্যকার মহাকর্ষীয় বলের গণনা করতে পারি। অনুরূপভাবে, আমরা জটিল সব অণু-পরমাণুর মধ্যকার ক্রিয়া-বিক্রিয়ার সমীকরণগুলো সমাধান করতে পারবো না, বরং আমরা রসায়নের মতো কার্যকর তত্ত্বের সূচনা করেছি যেটির মাধ্যমে রাসায়নিক বিক্রিয়াতে অণু-পরমাণু কীভাবে আচরণ করে সেটি ব্যাখ্যা করতে পারি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোর সমস্ত খুঁটিনাটি হিসাবে না ধরেই। মানুষের ক্ষেত্রে, যেহেতু আমরা আচরণ নির্ধারণী সব সমীকরণ সমাধান করতে পারবো না, সেহেতু আমরা একটি কার্যকর তত্ত্ব মতে ধরে নিই যে মানুষের স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি আছে। মনোবিজ্ঞান আমাদের প্রবৃত্তি বা ইচ্ছা এবং সংশ্লিষ্ট আচার-আচারণ নিয়ে অধ্যায়ন করে। মানুষের স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি আছে এবং মানুষ বিভিন্ন বিকল্প সিদ্ধান্ত বিচার করে সেরাটাই গ্রহণ করে- এই ধারণাকে সত্য বলে মেনে নিয়ে গড়ে ওঠা অর্থনীতি-ও একটি কার্যকর তত্ত্ব। মানুষের আচরণ অনুমানের ক্ষেত্রে এই কার্যকর তত্ত্ব মাঝারি সাফল্য দেখায়, কারণ সিদ্ধান্তগুলো সব সময় যুক্তিনির্ভর হয় না অথবা পছন্দ করার পরিণতি কী হবে সেটি সম্পর্কে ভুল বিশ্লেষণ করা হয়। মূলত এই কারণেই বর্তমানে পৃথিবীর জগাখিচুড়ি অবস্থা।

তৃতীয় প্রশ্নের প্রতিপাদ্য ছিলো মহাবিশ্ব ও মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে যেসব নিয়মাবলি সেগুলো স্বতন্ত্র কি না। আপনি যদি প্রথম প্রশ্নটির উত্তর দেন যে ঈশ্বর নিয়মগুলো সৃষ্টি করেছেন, তবে এই প্রশ্নটি জানতে চাচ্ছে যে এই নিয়মগুলো বাছাইকরণে ঈশ্বরের হাতে কোনো বিকল্প ছিলো কি না। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েই, দেকার্তের মতো এবং পরবর্তীতে আইনস্টাইন-ও বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতির সূত্রাবলি “প্রয়োজনেই” উদ্ভুত হয়েছে, কারণ একমাত্র এই নিয়মগুলোই যৌক্তিক মনে হয়। প্রাকৃতিক সূত্রাবলির উৎসমূলে রয়েছে যুক্তিনির্ভরতা- এই ধারণায় বিশ্বাস করে অ্যারিস্টটল এবং তার অনুসারীরা উপলব্ধি করছিলেন যে প্রকৃতি প্রকৃতপক্ষে কীভাবে কাজ করে সেটি না দেখেই যুক্তিনির্ভর যে কেউই প্রাকৃতিক নিয়মগুলো উদ্ভুত করতে পারতো। প্রাকৃতিক নিয়মগুলো আসলে কী কী সে চিন্তায় মনোযোগী না হয়ে বস্তুসমূহ কেনো এই নিয়মগুলো মেনে কাজ করে সে চিন্তায় বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণেই তিনি কিছু গুণগত নিয়ম আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন, যদিও সেগুলোর অধিকাংশই ছিলো ভুল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরকারী কিছু প্রমাণ করে পারে নি, এমনকি যদি প্রমাণ করে-ও থাকে তবে তা বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছে অনেক শতাব্দি যাবত। অনেক পরে গ্যালিলিওর মতো লোকেরাই অ্যারিস্টটলের কর্তৃত্বকে খাটো করার সাহস দেখায় এবং মৌলিক যুক্তি মোতাবেক প্রকৃতির কী করা উচিত বদলে প্রকৃতি আসলেই কী করেছে সেটি পর্যবেক্ষণ করে।

এই বইটির ভিত্তিমূল নিহিত আছে বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তাবাদের ধারণায়, যা দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরে বলছে যে প্রাকৃতিক নিয়মাবলির ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নেই, নেই কোনো প্রকারের অলৌকিকতা। প্রথম এবং তৃতীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কীভাবে সূত্র বা নিয়মগুলো উদ্ভুত হলো এবং সেগুলোই সম্ভাব্য একমাত্র নিয়মগুচ্ছ কিনা সে বিষয়ে আমরা পরে আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো। কিন্তু তার আগে সামনের অধ্যায়ে প্রাকৃতিক নিয়মাবলি কী বর্ণনা করে সেটি নিয়ে আমরা আলোচনা করবো। অধিকাংশ বিজ্ঞানিই বলবেন যে নিয়মগুলো মূলত বহির্জগতের একটি গাণিতিক প্রতিবিম্ব যার অস্তিত্ব কোনো পর্যবেক্ষকের উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু যদি আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি এবং সেই পর্যবেক্ষণের আলোকে পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে ধারণা গঠনের প্রক্রিয়াকে বিবেচনা করি, তবে প্রশ্ন জাগে- বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা (Objective Reality) বিদ্যমান আছে এমন ধারণা করার কারণ আছে কি?

[বইটির সূচিপত্র তখা সব পর্বের লিংক দেখুন এখানে]

মূল: স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দো ম্লোডিনো

অনুবাদ: -আশরাফ মাহমুদ
গবেষক, কবি ও লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.