রক্তে লেখা নক্ষত্রের গান

0
530

রক্তের রঙ কেন লাল, এই প্রশ্নটি ধরে এগিয়ে যেতে থাকলে তার শেষ মাথা একদম নক্ষত্রে গিয়ে ঠেকবে। কীভাবে, তা জানতে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করে এগিয়ে যাই। রক্ত কেন লাল? কারণ তাতে হিমোগ্লোবিন নামে একধরনের লাল রঙের কণিকা আছে। হিমোগ্লোবিন কেন লাল হবে? কারণ তাতে লোহা আছে। লোহা থাকলেই লাল হতে হবে? না, লোহার সাথে অক্সিজেন আছে। অক্সিজেন ও লোহা একত্রে মিলে হিম (Heme) নামে এমন একটি রাসায়নিক যৌগ তৈরি করে যা লাল আলো প্রতিফলিত করে। প্রতিফলিত লাল আলো আমাদের চোখের রেটিনায় সাড়া ফেলে বলে রক্তকে লাল দেখি। রক্তে লোহা এলো কোথা থেকে? খাদ্য থেকে প্রক্রিয়াজাত হয়ে দেহে মেশার মাধ্যমে। খাদ্যের মাঝে লোহা এলো কোথা থেকে? মাটি ও পানিতে থাকা বিভিন্ন উপাদান থেকে। বলা যায় পৃথিবীর এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পদার্থ থেকেই এসেছে লোহার যোগান। পৃথিবীতে লোহা এলো কোথা থেকে? সৌরজগৎ যখন গঠিত হয় তখন অনেক অনেক ধুলো ও গ্যাসের পাশাপাশি লোহাও ছিল। সূর্য ও সূর্য পরিবারের অন্যান্য গ্রহগুলো বিস্তৃত এলাকাব্যাপী ধুলো ও গ্যাসের বিশাল মেঘের সন্নিবেশে তৈরি হয়। এদের মাঝে ‘বহিরাগত’ হিসেবে লোহা প্রবেশ করে ফেলে। সৌরজগতের সৃষ্টির সময় লোহা কোথা থেকে এলো? সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে। সুপারনোভা কী? বিশেষ ধরনের ভারী নক্ষত্র। সুপারনোভাতে লোহা এলো কোথা থেকে? অন্য কোনো স্থান থেকে আসেনি, সুপারনোভার পেটের ভেতরেই লোহা সৃষ্টি হয়েছে।

সুপারনোভাতে কীভাবে লোহা সৃষ্টি হয়? নক্ষত্র হিসেবে সুপারনোভা যখন গঠিত হয় তখন প্রাথমিক অবস্থাটি হাইড্রোজেন গ্যাস থেকেই শুরু হয়। হাইড্রোজেন হচ্ছে সবচেয়ে হালকা মৌল। প্রচুর পরিমাণ গ্যাস যদি একত্র হয় তাহলে এত বেশি মহাকর্ষীয় চাপ দেয় যে নক্ষত্রের ভেতরের হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরস্পর একত্র হয়ে হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে। হিলিয়াম হাইড্রোজেনের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি ভারী মৌল। ভেতরের সকল হাইড্রোজেন যখন শেষ হয়ে যায় তখন হিলিয়ামগুলো একত্রে মিলে আরো ভারী মৌল কার্বন তৈরি করতে থাকে। হিলিয়াম শেষ হয়ে গেলে কার্বনের পরমাণু মিলে আরো ভারী মৌল অক্সিজেন তৈরি করে। এভাবে বাড়তে বাড়তে লোহা পর্যন্ত যায়। এবং এক সময় প্রচণ্ড শক্তিশালী ঊর্ধ্বমুখী চাপে নক্ষত্রটি বিস্ফোরিত হয়ে টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এরকমই কোনো সুপারনোভার ধ্বংসাবশেষ এসে ঠাই করে নিয়েছিল সৌরজগতের শিশুকালে। তাদেরকে সাথে নিয়েই পৃথিবী গঠিত হয়েছিল এবং তাদেরকেই আশীর্বাদ হিসেবে ধরে নিয়ে অনেক অনেক প্রাণের রক্তের বহমান ধারা তৈরি হয়েছে। মানুষও তাদের মাঝে একটি প্রজাতি। মানুষের শরীরের শিরায় শিরায়ও নক্ষত্রের তাপীয় গান বাজে। রক্তের প্রতি মিলিমিটার লাল রঙ বলে দেয় মানুষের ভেতরে নক্ষত্র বসবাস করছে। মানুষ নক্ষত্রেরই অংশ।

সূর্যের বুকেও কি লোহা তৈরি হবে?

না। সূর্যের বুকে লোহা তৈরি হতে হলে যে পরিমাণ ভারী হওয়া প্রয়োজন, সূর্য ততোটা ভারী নয়। আকাশের বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের মাঝে সূর্য আসলে খুবই নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় একটি নক্ষত্র। নক্ষত্র যত ভারী হবে তার শক্তি তত বেশি হবে। সুপারনোভার মতো বিস্ফোরিত হতে কিংবা লোহা তৈরি করতে হলে যে পরিমাণ শক্তির দরকার সূর্যের মাঝে তা নেই। সূর্যের বুকে হাইড্রোজেনগুলো পুরে হিলিয়াম হবে এবং তারপর হিলিয়ামগুলো পুড়ে কার্বন হবে। এরপরই সূর্য তার ক্ষমতা হারিয়ে প্রায় মরে যাবে (নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে)।

-সিরাজাম মুনির শ্রাবণ

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.