কোয়ান্টাম ফিজিক্স -২১ : রাদারফোর্ডের নিউক্লিয়াস

0
1651

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

এক
১৯১১ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড একটা পরীক্ষা করলেন। সে বছর ৭ই মার্চ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন। পরীক্ষাটা দেখে নেওয়া যাক।

15419337_1192657574147982_394262687_o
রাদারফোর্ড তাঁর পরীক্ষায় একটা সোনার পাত ব্যবহার করলেন। পাতটা খুবই পাতলা। ২০টি পরমাণুর ব্যাসের সমান। অর্ধস্বচ্ছ পাত বললেও চলে ওটাকে। স্বর্ণপাতের চারপাশে রাখলেন জিঙ্ক সালফাইড পর্দার একটি বেষ্টনি। এই পর্দা আলোক সংবেদী। পর্দার একদিকে সামান্য একটা গলিপথ রাখা হলো। সেই গলিপথের সামনে রাখা হলো একটা সীসার ব্লক। ব্লকটার ভেতরে রাখা হলো একটা আলফাকণার উৎস। ব্লকে একটা সুড়ঙ্গপথ আছে। সেই পথ দিয়ে ছুটন্ত আলফাকণা বেরিয়ে আসে। তারপর আলফাকণার স্রোত (বিম) ঢুকে পড়ে জিঙ্ক সালফাইড পর্দার গলিপথ দিয়ে। এরপর আলফাকণার বিম গিয়ে পড়ে স্বর্ণপাতের ওপর।

আলফা কণা যদি স্বর্ণপাত ভেদ করে চলে যায়, তাহলে সেটা গিয়ে পড়বে জিঙ্ক সালফাইডের বেষ্টনিরও ওপর। পর্দাটা আলোক সংবেদি। তাই আলফা কণা পর্দার ওপর যেখানে আঘাত করবে সেখানে একটা আলোক বিন্দুর ঝলক দেখা যাবে।

স্বর্ণপাতের ওপর একঝাঁক ছুটন্ত আলফাকণা দিয়ে আঘাত করালেন রাদাফোর্ড। দেখলেন, বেশিরভাগ কণা স্বর্ণপাত ভেদ করে চলে যাচ্ছে। স্বর্ণপাত ভেদ করা সবগুলো আলফা কণা এক পথে যায়নি। কিছু কণা স্বর্ণপাত ভেদ করে একেবারে সোজা গিয়ে পড়েছে জিঙ্ক সালফালইড পর্দার ওপর। কিছু আবার একটু দিক পবির্তন করে অর্থাৎ ভিন্ন পথে ভিন্ন কোণে গিয়ে পর্দার ওপর পড়েছে। অল্প কিছু কণা স্বর্ণপাত ভেদই করতে পারেনি। বিভিন্ন কোণে প্রতিফলিত হয়ে পর্দার ওপর পড়েছে।

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড
আর্নেস্ট রাদারফোর্ড

এই পরীক্ষা থেকে রাদারফোর্ড নিশ্চিত হলেন, পরমাণু নিরেট নয়। নিরেট হলে আলফা কণা স্বর্ণপাত ভেদ করে চলে যেতে পারত না। ইলেকট্রন কি পারত না আলফা কণাকে বাধা দিতে?

ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক আর আলফা কণার চার্জ ধনাত্মক। তাহলে ইলেকট্রন আলফা কণাকে আকর্ষণ করে কী আটকে রাখতে পারত না?

পারত, যদি ইলেকট্রনের ভর আলফা কণার কাছাকাছি হতো। ইলেকট্রন আর আলফা কণার ভরের তফাৎ আকাশ-পাতাল। ইলেকট্রনের সাধ্য নেই প্রবল ভরেবেগে চলা ভারী আলফা কণাকে আকর্ষণ করে আটকে রাখে।

সে না হয় হলো, খটকা তো আরও থেকে যাচ্ছে। সবগুলো আলফাকণাই কেন স্বর্ণপাত ভেদ করে সোজাসুজি গিয়ে পর্দায় আঘাত করল না, তাদের পথ কেনইবা বেঁকে গেল? আবার কিছু কণা প্রতিফলিত হয়ে ফিরেই বা এলো না কেন? নিশ্চয়ই স্বর্ণপাতে এমনকিছু আছে যেগুলো আলফাকণার গতিপথকে প্রভাবিত করেছে। কোনো বস্তুতেই পরমাণুর বাইরে কিছু থাকার কথা নয়। পরমাণু মানেই ইলেকট্রন। সেই ইলেকট্রন যদি আলফা কণার ওপর প্রভাব না ফেলতে পারে, তাহলে কে ফেলল?
রাদারফোর্ড নিশ্চিত হন, সকল পরমাণুতেই একটা ঘন জমাট বস্তু আছে। সেই বস্তুটা বেশ ভারি, এবং আলফাকণার গতিপথের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সেটা ঋণাত্মক চার্জের হলে হবে না। সেটার চার্জ ধনাত্মক। আর ধনাত্মক বলেই বলেই সেটা আফলা কণাকে বিকর্ষণ করে। তাই কোল ঘেষে যাওয়া আলফা কণার গতিপথ বেঁকে যায়।

বেঁকেই বা যায় কেন?
সেই ভারি বস্তুটা যদি ধনাত্মক এবং সেটা নিরেট বস্তু হয়, তাহলে আলফা কণা তাতে বাধা পেয়ে ফিরে আসার কথা। পাত ভেদ করে গেল কীভাবে? তাহলে কি পরমাণুর ভেতরে শুধু ধনাত্মক ভারি বস্তুটি আর ইলেকট্রন ছাড়াও ফাঁকা জায়গা আছে?
রাদারফোর্ড সেটাই নিশ্চিত হলেন। বললেন, পরমাণুর গঠন কিছুটা সৌরজগতের মতো। এর কেন্দ্রে রয়েছে অত্যন্ত ঘন ও ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের বাইরে রয়েছে বিরাট ফাঁকা অঞ্চল। কতটা ফাঁকা, সেটা বোঝাতে দারুণ এক উদহারণ দিলেন রাদারফোর্ড। তিনি বললেন, পরামাণু হলো বিশাল এক মন্দিরের মতো। তার ভেতরে যদি একটা মাছি থাকে তাহলে সেটাই হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াস। তারমাণে পরমাণুর ভেতর বেশিরভাগ জায়গায়ই ফাঁকা।

রাদারফোর্ড হিসাব করে দেখালেন, নিউক্লিয়াসের আয়তন পরমাণুর মোট আয়তনের ১০ লক্ষ ভাগের একভাগ। রাদারর্ফোড পরমাণু আর নিউক্লিয়াসের ব্যসার্ধ্য নির্ণয় করতেও সক্ষম হলেন। পরমাণুর ব্যাস পেলেন〖১০〗^(-১০) মিটার আর নিউক্লিয়াসের ব্যাস 〖১০〗^(-১৪) মিটার। তাঁর হিসাব অনুযায়ী, আয়তনে যত নগণ্যই হোক পরমাণুর প্রায় সবটুকু ভর দখল করে থাকে নিউক্লিয়াস। ইলেকট্রনের ভর এত নগণ্য, পরমাণুর মোট ভরের তুলনায় সেটা কিছুই নয়।

রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল

রাদারফোডর আরো বললেন, নেগেটিভ চার্জ যুক্ত ইলেক্ট্রন পজেটিভ চার্যযুক্ত নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা ইলেক্ট্রনের গতি-প্রকৃতি অনেকটা আমাদের সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা গ্রহগুলোর মতো। তাই রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলকে সোলার সিস্টেম অ্যাটম মডেলও বলে। পার্থক্য হলো, সূর্য ও তার গ্রহগুলোর মধ্যে মহকর্ষ বল ক্রিয়া করে আর নিউক্লিয়াস আর ইলেক্ট্রনগুলোর মধ্যে ক্রিয়া করে তুড়চ্চুম্বকীয় বল।

দুই
রাদাফোর্ডের পরমাণু মডেল প্রশংসিত হতে লাগল বিজ্ঞানীমহলে। এই মডেল থেকে পরমাণুর ব্যাখ্যা পাওয়া গেল তড়িৎ নিরপেক্ষতার বিষয়ে। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস। তাকে কেন্দ্র করে ঘোরে ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন। ধণাত্মক আর ঋণাত্মক চার্জ পরস্পরের প্রভাব কাটাকাটি করে দেয়। এজন্যই পরমাণু চার্জ নিরপেক্ষ।
কিন্তু বেশিদিন প্রশংসা বৃষ্টিতে ভিজতে পারল না রাদাফোর্ডের পরমাণু মডেল। বেশ কিছু ত্রুটি বেরিয়ে এলো এই মডেল থেকে।
ত্রুটিটা কী?

ম্যাক্সওয়েলের তুড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণ করল ঝামেলা। ম্যাক্সওয়েল বলেছিলেন, কোনো চার্জযুক্ত কণা সুষম বেগে চললে তখন কোনো তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে না। কিন্তু যদি সেই কণা ত্বরিত হয় কিংবা প্রতি মুহূর্তে দিক বদলায়, তখন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করার ফলে কিছুটা শক্তি হারায় চার্জিত কণা।

রাদারফোর্ডের মডেলে ইলেকট্রনের ঘুর্ণনের কথা বলা হয়েছে। ইলেকট্রন ঋণাত্মক চার্জে চার্জিত কণা। আর সে ঘুরছে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে। আমরা জানি, বেগ ভেক্টর রাশি। প্রতি মুহূর্তে বেগের পরিবর্তন ঘটার হারকে ত্বরণ বা মন্দন বলে। ভেক্টর রাশির দিক পরিবর্তন মানে এর মানেরও পরিবর্তন। ঘূর্ণনশীল কণা প্রতি মূহুর্তে দিক বদলায়। তার মানে এর বেগের দিকের পরিবর্তন ঘটে। ফলে বেগের মানেরও পরিবর্তন ঘটে। সুর্তরাং ঘুর্ণন গতি মানেই ত্বরিত গতি।

ইলেকট্রন প্রতি মুহূর্তে নিজের কক্ষপথে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তার মানে, ইলেকট্রনের এই ঘুর্ণণ গতি আসলে ত্বরিত গতি। আর ত্বরিত ইলেকট্রন নিশ্চয়ই তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি বিকিরণ করে। বিকিরণের জন্য সেই শক্তি ইলেকট্রন পাবে কোথায়? নিশ্চয়ই তার গতিশক্তি থেকে ধার করবে। এর ফলে প্রতিমুহূর্তে কমবে ইলেকট্রনের গতিশক্তি। গতিশক্তি কমার ফলে ক্রমেই কমবে কেন্দ্র থেকে দূরত্ব।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একটা রিংয়ের সাথে একটা সুতো বাঁধুন। সুতোর অন্য মাথায় বেঁধে ফেলুন একটা পাথর। রিংটার ভেতর গলিয়ে দিন আপনার হাতের তর্জনি নামের আঙুলটা। রিংটা কিন্তু ঢিলেঢালা হওয়া লাগবে। এবার রিংসহ আঙুলটা ঘোরান। দেখবেন, সুতোটা আর ঢিলা হয়ে ঝুলে নেই। সেটা তখন সোজা হয়ে শূন্যে ঘুরবে, পাথরের টুকরোটা সাথে নিয়ে। মাটির সাথে সমান্তরালে। ঘুর্ণনের গতির জোর বেশি হলে পাথরের টুকরোটা আপনার আঙুলের সবচেয়ে দূরে অবস্থান করবে। সুতো আর পাথর ঘুরবে আপনার আঙুলকে কেন্দ্র করে। মনে হবে পাথর যেন একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে।

এর কারণ পাথরের ঘূর্ণন গতিশক্তি মহাকর্ষ বলকে উপেক্ষা করতে পারছে। এবার আঙুলটার ঘুর্ণনের বেগ ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলুন। দেখবেন বেগ কমার সাথে সুতোও ঢিল হয়ে আসছে। পাথরটা কিছুটা হেলে পড়ছে মাটির দিকে। এক সময় আঙুলটার ঘোরা বন্ধ করে দিন। তখন সুতোটা হেলে পড়বে আপনার আঙুলের গায়ে। পাথরের টুকরোটাও ধাক্কা খাবে আপনার আঙুলের সাথে। তারপর থেমে যাবে।

এখানে পাথরটার ঘূর্ণন গতি ওটাকে শূন্যে একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে বাধ্য করছিল। ধীরে ধীরে যতই তার গতিশক্তি কমতে শুরু করল, পাথরটা আঙুলের দিকে হেলতে শুরু করল তত। গতিশক্তি থেমে গেল যখন, পাথরটা তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ল আঙুলের গায়ে।

নিউক্লিয়াস আর ইলেকট্রনের ক্ষেত্রেও এমন কিছু ভাবা যেতে পারে। তবে এখানে সুতোর বদলে কাজ করবে বৈদ্যুতিক আকর্ষণ শক্তি। সেই শক্তি আর আর ইলেকট্রনের গতিশক্তি পরষ্পরকে কাটাকাটি করে দেয়। তাই ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘূরতে থাকে। বৈদ্যুতিক আকর্ষণ শক্তির চেয়ে যদি ইলেকট্রনের গতিশক্তি বেশি হত, তাহলে ইলেকট্রন আর কক্ষপথে আটকে থাকতে পারত না। ছিটকে বেরিয়ে যেত পরমাণু থেকে।

গতিশক্তি অনবরত কমতে থাকলেইবা সে নিজের কক্ষপথে ঘুরবে কেন?

তখন বৈদ্যুতিক আকর্ষণ শক্তি তার ওপর প্রভাব ফেলবে এবং ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের দিকে কিছুটা এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ কমে যাবে ইলেকট্রনের কক্ষপথের ব্যস্যার্ধ।

ইলেকট্রন সর্পিলাকারে ঘুরতে ঘুরতে নিউক্লিয়াসে পড়ত যদি রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল ঠিক হত
ইলেকট্রন সর্পিলাকারে ঘুরতে ঘুরতে নিউক্লিয়াসে পড়ত যদি রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল ঠিক হত

আগেই বলা হয়েছে ঘুর্ণনের কারণে ইলেকট্রন তড়িচ্চুস্বকীয়র তরঙ্গ বিকিরণ করে। এরফলে কমে যায় তার গতিশক্তি। ধীরে গতিশক্তি কমছে, তাই ব্যাসার্ধ কমছে কক্ষপথের। এভাবে গতিশক্তি কমতে থাকলে একসময় ইলেকট্রন সর্পিল গতিতে গিয়ে নিউক্লিয়াসের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এটা রীতিমতো অঙ্ক কষে বের করা যায়। তাই যদি হয়, তাহলে তো যেমন পরমাণুর কথা বলছেন রাদারফোর্ড, পরমাণু আসলে তেমন নয়। নিউক্লিয়াস আর পরমাণু মিলে-মিশে ঘন জমাট একটা কণা তৈরি করার কথা। কিন্তু আলফাকণার পরীক্ষা তো তা বলছে না। পরমাণুর বিশাল অঞ্চলই ফাঁকা, এটাই বলছেন রাদারফোর্ড তাঁর পরমাণু মডেলে। পরীক্ষা আর তত্ত্ব যতক্ষণ একসুরে কথা না বলে ততকক্ষণ বিজ্ঞান জগতে সেটার সঠিক মূল্য নেই। সেই মূল্যটাই খোঁজা জরুরি।
এর ব্যাখ্যা অবশ্য রাদাফোর্ডের কাছে ছিল না। তারজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল নীলস বোরের।

[বইটির সূচীপত্র এবং সব খন্ডের লিংক একত্রে দেখুন এখানে]

-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.