অধ্যায়-৫: আইসোটোপ
অনুচ্ছেদ-১: নিউক্লিয় শক্তি
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]
পরমাণুতে ইলেক্ট্রন বিন্যাস নিয়ে কাজ করা একদিক থেকে বেশ সহজ সমস্যা। যেহেতু সব ইলেক্ট্রন একই রকম, তাই তারা একই পরমাণুতে অবস্থান করুক বা ভিন্ন পরমাণুতে, তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না কিংবা বলা যায় তারা স্বাধীনভাবে বিরাজ করে। পরমাণুগুলো পরস্পরের সাথে পার্থক্য তৈরি করে তাদের ইলেক্ট্রনের সংখ্যার ভিত্তিতে, ইলেক্ট্রনের প্রকরণ অনুযায়ী নয়।
তাহলে পরমাণুর নিউক্লিয়াস সম্বন্ধে কী বলা যায়? এরা বিভিন্ন ধরনের অ্যাটমের সাথে ভর এবং বৈদ্যুতিক চার্জের পার্থক্যজনিত কারণে পৃথক। তারা কি একটি মাত্র কণা যা বিভিন্ন পরমাণুতে আলাদা নাকি তাদেরও নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কাঠামো আছে? তারা কি বিভিন্ন সংখ্যক সরল কণিকা দ্বারা গঠিত এবং সেই সরল কণিকাগুলো কি প্রতিটি মৌলের নিউক্লিয়াসের জন্য একই রকম? সর্বোপরি, নিউক্লিয়াস খুবই ক্ষুদ্র একটি বস্তুু এবং তা বিভিন্ন স্তরের ইলেক্ট্রনের আড়ালে অবস্থান করে। কেমন করে এদের কাছে পৌঁছানো এবং এদের নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব?
নিউক্লিয়াসের কাঠামো বিষয়ক প্রথম ইঙ্গিতটি আসে প্রথম পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের উপস্থিতি প্রদর্শনের পনের বছর আগে তেজষ্ক্রিয়তার আবিষ্কারের মাধ্যমে। তেজষ্ক্রিয়তার সাথে সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই তখন জেগেছিল; সেটি হচ্ছে, তেজষ্ক্রিয়তার জন্য বিপুল পরিমাণ শক্তি আসে কোথা হতে? ইউরেনিয়ামকে বিরামহীন ভাবে আলফা এবং বিটা কণিকা নিঃসরণ করতে দেখা যায়, যেগুলো যথাক্রমে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস এবং ইলেক্ট্রনের স্রোত। এই কণিকাগুলোর প্রতিটিই অত্যন্ত উচ্চ গতিতে ভ্রমণ করে; আলফা কণিকার গতির আলোর গতির এক দশমাংশ এবং বিটা কণিকার গতির নয় দশমাংশ। স্থির অবস্থা থেকে এদেরকে খুব দ্রুত এই গতিতে তুলতে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। সর্বোপরি, ইউরেনিয়াম পরমাণু কিন্তু আগে থেকেই গতিশীল নয়। তাছাড়াও, এদের পাশাপাশি গামা রশ্মি-ও রয়েছে, যারা এক্সরের চেয়েও অনেক বেশি শক্তি সম্বলিত।
ইউরেনিয়ামের বিকিরণ কেবল একটি তাৎক্ষণিক শক্তির দলা ছিল না। ইউরেনিয়ামের একটি নমুনা অনির্দিষ্টকালের জন্য এবং সুস্পষ্টভাবে সমহারে বিকিরণ চালিয়ে যেতে থাকে, যা বাস্তবিকই একটি বড় সমস্যা ছিল। শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি অনুসারে মনে হতো যে শক্তি শূন্য থেকে সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তার ক্ষেত্র বরং মনে হলো যেন শক্তি শূন্য থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে।
তবে এটিও হতে পারে যে শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতিটি ভুল এবং সুনির্দিষ্ট কিছু অবস্থার ক্ষেত্রেই তা সীমাবদ্ধ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই নীতিটিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এতোই ভালো ফল পেয়েছিলেন, এটিকে তাঁরা বাতিল করতে পারলেন না। তাঁদের মধ্যে একটি প্রবণতা দেখা গেল, শক্তি সংরক্ষণশীলতা নীতিটিকে বাতিল না করেই তেজষ্ক্রিয়তাকে ব্যাখ্যা করতে হবে। এবং যদি এটিকে বাতিল করতেই হয় তাহলে তা করতে হবে একেবারে শেষ মুহূর্তে, একান্তই বাধ্য হলে। এটি বিজ্ঞানীদের বুদ্ধিদীপ্ত রক্ষণশীলতার একটি উদাহরণ। একটি তত্ত্ব যদি বারবার নিজেকে সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে, তাহলে সেটিকে এক কথায় বাতিল করে দেওয়া যায় না। এটিকে তখনই বাতিল করতে হবে বা করা উচিৎ যখন আর কোনো বিকল্প থাকে না, সেই ক্ষেত্রে অবশ্য সবাইকে নিশ্চিত হতে হবে যে, সত্যিই আর কোনো বিকল্প ছিল না।
তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পরবর্তী বছরে পরিস্থিতি খুব দ্রুতই আরো খারাপের দিকে গেল। মেরি কুরি এবং তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরি (১৮৫৯-১৯০৬) ইউরেনিয়াম বিশিষ্ট একটি আকরিক পিচ ব্লেন্ড নিয়ে কাজ করছিলেন, যেখান থেকে তাঁরা গবেষণার জন্য ইউরেনিয়ামের নমুনা পাবেন বলে আশা করেছিলেন। বিস্মিত হয়ে তাঁরা দেখলেন, পিচ ব্লেন্ড যতটা তেজষ্ক্রিয়তা দেখানোর কথা তার চেয়ে বেশি দেখাচ্ছে। সম্ভবত এতে এমন কোনো মৌলিক পদার্থ আছে যা ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি তেজষ্ক্রিয়। সাধারণ বিশ্লেষণে এধরনের কোনো মৌল পাওয়া গেল না, কাজেই এগুলো অবশ্যই খুব অল্প পরিমাণে আছে, এবং যদি তা-ই হয় তাহলে অবশ্যই তা তীব্র তেজষ্ক্রিয়।
অনেক দীর্ঘ, ক্লান্তিকর এবং কষ্টসাধ্য কর্মকান্ডের পর ১৮৯৮ সালে কুরি দম্পতি টনে টনে পিচব্লেন্ড নিয়ে আরম্ভ করে সামান্য কিছু তেজষ্ক্রিয় গুঁড়ো উদ্ধার করতে সক্ষম হলেন- এখান থেকে দুটি মৌল পৃথক করা হলো। একটি পোলোনিয়াম (মেরিকুরির মাতৃভুমি পোল্যান্ড অনুসারে) এবং অপরটি রেডিয়াম (তেজষ্ক্রিয়তার ইংরেজি রেডিওঅ্যাক্টিভিটি (radioactivity) অনুযায়ী)। উভয় মৌলই ইউরেনিয়ামের চেয়ে অনেক বেশি তেজষ্ক্রিয়।
যদি কেউ ইউরেনিয়ামের তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ দেখেই চমৎকৃত হয়ে থাকে, তাহলে রেডিয়াম দেখে তাদের কী অবস্থা হবে যেটি ইউরেনিয়ামের চেয়ে ত্রিশ লক্ষ গুণ বেশি হারে শক্তি বিকিরণ করে? ১৯০১ সালে পিয়েরে কুরি রেডিয়ামকর্তৃক নিঃসৃত শক্তি মেপে দেখলেন এবং দেখতে পেলেন ১ গ্রাম রেডিয়াম ঘণ্টায় ১৪০ ক্যালরি শক্তি বিকিরণ করে। এটি এমনিতে তেমন বেশি নয় কিন্তু ঘটনাটি অনির্দিষ্টভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে থাকে। এত শক্তি আসে কোথা থেকে?
কিছু কিছু বিজ্ঞানী তাজ্জব হয়ে ভাবলেন, তেজষ্ক্রিয় পরমাণু পরিবেশ থেকে শক্তি শোষণ করে পরে একে বিকিরিত শক্তিতে পরিণত করে না তো! কিন্তু এই প্রকল্প তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে ভেঙে ফেলবে এবং বিজ্ঞানীরা তা করতে অনিচ্ছুক ছিলেন যেমনটি তাঁরা অনিচ্ছুক হয়েছিলেন প্রথম সূত্রটি অর্থাৎ শক্তি সংরক্ষণশীলতা নীতি ভাঙার ব্যাপারে।
১৯০৩ সালে রাদারফোর্ড প্রস্তাব করলেন, প্রতিটি পরমাণুই তাদের কাঠামোতে বিশাল আয়তনের শক্তি ধারণ করে। সাধারণভাবে এই শক্তি অনুভব করা যায় না, তাই মানুষ এর উপস্থিতির ব্যাপারে অসচেতন থাকে। তেজষ্ক্রিয়তা এই শক্তির সামান্য স্বতস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। এটি একটি খেয়ালি প্রস্তাবনা কিন্তু মানুষ এই ধারণা গ্রহণ করল এবং পারমাণবিক শক্তি নামে একধরনের নতুন এবং অতিঘনীভূত রূপের শক্তি নিয়ে আলোচনা করা শুরু করল, সেই শক্তির বিষয়ে এর আগে কোনো ধারণা ছিল না। ইংলিশ লেখক এইচ. জি. ওয়েলস এমনকি তাঁর একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক গল্পে বাস্তবিকভাবে আবির্ভাবের ৪০ বছর আগেই “পারমাণবিক বোমা” সম্বন্ধে লিখেছিলেন।
এবং এরপরও রাদারফোর্ডের প্রস্তাবনাটিকে টুপির নীচ থেকে খরগোশ বের করে আনার মতোই মনে হতে লাগল। পরমাণু শক্তি ধারণ করে, শুধু এটুকু বললে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু তারপর, ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন বিশ্বাস করাতে সক্ষম হলেন, ভর হচ্ছে আসলে অত্যন্ত ঘনীভূত শক্তি। যদি তেজষ্ক্রিয় বস্তুগুলো এমনকি খুব সামান্য পরিমাণ ভরও শক্তিতে পরিণত করে, তাহলে যে পরিমাণ শক্তি তেজষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে উন্মুক্ত হচ্ছে তা ব্যাখ্যা করা যায়।
একবার নিউক্লিয়াসযুক্ত পরমাণু আবিষ্কৃত হয়ে যাওয়ার পর এটি স্পষ্ট হয়ে গেল, কেননা একটি পরমাণুর প্রায় সম্পূর্ণ ভরই এর নিউক্লিয়াসে পুঞ্জীভুত থাকে, তাই ভরের হ্রাস অবশ্যই সেখানেই ঘটবে। ফলে এটি বোঝা গেল যে, নিউক্লিয়াসই হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে তেজষ্ক্রিয়তার উৎস নিহিত এবং ফলাফলস্বরূপ লোকজন পারমাণবিক শক্তির বদলে নিউক্লিয় শক্তি নিয়ে বলাবলি করতে লাগল।
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৯১৫৯৩৯৬৬৮]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]