পরমাণুর গহীন নিসর্গে | ৪: নিউক্লিয়াসসমূহ | ৪.১: পরমাণু নিয়ে গবেষণা

0
292

অধ্যায়-৪: নিউক্লিয়াসসমূহ
অনুচ্ছেদ-১: পরমাণু অনুসন্ধান
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]

বিজ্ঞানীরা যখন থেকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন, ইলেক্ট্রন পরমাণুর মধ্যেই অন্তুর্ভুক্ত থাকে তখন একটি সমস্যা দেখা দিল।  ইলেক্ট্রন ঋনাত্মক চার্জ বহন করে অথচ পরমাণু বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ। তার মানে হলো, ইলেক্ট্রনের ঋনাত্মক চার্জের সমপরিমাণ ধনাত্মক চার্জ পরমাণুর মধ্যে থাকতে হবে, যা ইলেক্ট্রনের চার্জের সাথে মিলে মোটের উপর পরমাণুকে নিরপেক্ষ করে রাখবে।

যদি তা-ই হয়, তাহলে পরমাণু থেকে ইলেক্ট্রন সরিয়ে দেওয়ার পর যা থাকবে তাকে অবশ্যই ধনাত্মক চার্জ বহন করতে হবে। আর একটি পরমাণুতে যদি বাড়তি ইলেক্ট্রন যোগ করা হয়, তাহলে অতিরিক্ত ইলেক্ট্রনটির ঋনাত্মক চার্জের কারণে পরমাণুকে ঋনাত্মক চার্জযুক্ত হয়ে উঠতে হবে। ফ্যারাডে এবং আরহেনিয়াস যেই ধনাত্মক এবং ঋনাত্মক আয়নের কথা বলেছিলেন, সেসব আয়ন এই ধরনের ঘটনার মাধ্যমেই সৃষ্টি হবে।
তড়িৎ চার্জকে আমলে নিয়ে একটি পরমাণু ব্যবস্থার কথা প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন জে. জে. থমসন ১৮৯৮ সালে। তিনি পরমাণুর ক্ষুদ্রত্ব এবং একে একটি নগণ্য গোলক হিসেবে কল্পনাকৃত যে মতবাদ শতাব্দী ধরে চলছিল তা অক্ষুন্ন রেখে বলেন, সবই ঠিক আছে তবে পাশাপাশি এটি ধনাত্মক চার্জ ধারণ করে বলেও ধরতে হবে। তিনি বললেন, এই ধনাত্মক চার্জযুক্ত পরমাণুতে যথেষ্ট পরিমাণ ঋনাত্মক ইলেক্ট্রন প্রবিষ্ট থাকে। যেমনটি পায়েসের মধ্যে থাকে কিসমিস ও বাদাম।

থমসনের ধারণার পরেও পরমাণুকে কঠিন বস্তু হিসেবেই ধরা যায়। যদি অনেকগুলো পরমাণুকে এক লাইনে গাদাগাদি করে ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পিছে এবং উপরে-নিচে সাজানো হয়, তাহলে তারা একটি কঠিন বস্তুই গঠন করবে।

তারপরও ব্যাপারটি আসলে এমন ছিল না। ১৯০৩ সালে লেনার্ড খেয়াল করলেন, গতিময় ইলেক্ট্রনগুলো ক্যাথোড রশ্মি তৈরির মাধ্যমে পাতলা ধাতব পর্দার মধ্য দিয়ে পার হয়ে যেতে পারে। এ থেকে এই ধারণা পাওয়া যায় যে, পরমাণুর ভিতরে কিছু ফাঁকা যায়গা আছে। লেনার্ড প্রস্তাব দিলেন, পরমাণু ছোট ছোট কণিকার মেঘ দিয়ে তৈরি যার কিছু কিছু হচ্ছে ইলেক্ট্রন এবং কিছু কিছু একই আকৃতির ধনাত্মক চার্জ যুক্ত কণিকা। একটি ধনাত্মক এবং একটি ঋনাত্মক কণিকা পরস্পরের সাপেক্ষে ঘূর্ণায়মান থাকে। যাতে তাদের একটি যুগল তৈরি হয়। একই ধরনের অনেক জোড়ার সমন্বয়ে পরমাণু সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ হয়।  তবে এই জোড়াগুলোর ভিতরে এবং বাইরে প্রচুর ফাঁকা জায়গা আছে। এর ভিতর দিয়ে একটি ক্ষুদ্র কণিকা, যেমন, গতিময় ইলেক্ট্রন সহজেই পার হয়ে যেতে পারে।

তাই যদি হয় তাহলে একটি পরমাণু উভয় ধরনের কণিকাই হারানোর কথা। যদি আলোর উপস্থিতিতে একটি ধাতব খন্ড থেকে ঋনাত্মক ইলেক্ট্রন নিষ্ক্রান্ত হতে পারে, তাহলে ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণিকা কেন বের হতে পারবে না, অন্ততঃ আগে-পরে হলেও? আবার একটি ক্যাথোড থেকে উচ্চ গতির ইলেক্ট্রন নির্গত হয়, কিন্তু কেন একটি অ্যানোড থেকে ধনাত্মক কণিকা নির্গত হয় না? স্পষ্টতই, যদি ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণিকা থেকেই থাকে তাহলে তাদের প্রকৃতি অবশ্যই ইলেক্ট্রনের চেয়ে ভিন্ন হবে। কোনো বিশেষ কারণে ধনাত্মক কণিকাগুলো ইলেক্ট্রনের চেয়ে অনড় হবে, তাই তারা নির্গত হতে পারবে না।

১৯০৪ সালে জাপানী পদার্থবিদ হান্তারো নাগাওকা (Hantaro Nagaoka, ১৮৬৫-১৯৫০) প্রস্তাব করলেন, থমসনের ধারণার মতো ধনাত্মক কণিকা আসলে সম্পূর্ণ জায়গা দখল করে না। আর লেনার্ডের প্রস্তাবিত ধারণা অনুযায়ী, তারা ইলেক্ট্রনের সমপরিমাণ স্থানও দখল করে না। নাগাওকা একধরনের আপোষরফার প্রস্তাব করলেন।  তিনি বিশ্বাস করতেন, ধনাত্মক চার্জযুক্ত অংশটি পরমাণুর কেন্দ্রে অবস্থিত এবং সমগ্র পরমাণুর তুলনায় আকারে ছোট। এটি ঘুর্ণায়মান ইলেক্ট্রন দ্বারা পরিবেষ্টিত ফলে তড়িৎচৌম্বক আকর্ষণের মাধ্যমে স্থিতিশীল থাকে যেমনটি সৌরজগতে সূর্যের  চারপাশে অন্যগ্রহগুলো মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে স্থিতিশীল থাকে।

নাগাওকার মডেল অনুযায়ী একটি নিরপেক্ষ পরমাণু পাওয়া গেল যা ধনাত্মক এবং ঋনাত্মক আয়ন উৎপন্ন করতে পারে এবং উচ্চ গতির ইলেক্ট্রনকে এর মধ্য দিয়ে পার হয়ে যেতে দেয়। একই সাথে এটি ব্যাখ্যা করে, কেন ইলেক্ট্রনকে সহজেই পরমাণু থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় কিন্তু ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণিকাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। সব মিলিয়ে ইলেক্ট্রনগুলো পরমাণুর বাইরের দিকে থাকে আর ধনাত্মক চার্জযুক্ত অংশ কেন্দ্রের সুরক্ষিত এলাকায় থাকে।

তবে, এখন পর্যন্ত আলোচনায় এই প্রস্তাবনাগুলোর কোনোটিই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এগুলো অনুমানধর্মী। এই মুহূর্তে যা দরকার তা হচ্ছে সরাসরি সাক্ষ্যপ্রমাণ যা পরমাণুর আভ্যন্তরীণ গঠন ব্যাখ্যা করবে। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হলো, এই ধরনের নমুনা খুঁজে পাওয়া খুব সহজ কিছু নয়। আর তাছাড়া কেমন করেই বা পরমাণুর এত ক্ষুদ্র একটি বস্তুর একেবারে অভ্যন্তরে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব? তারপরও থমসন, লেনার্ড এবং নাগাওকা যখন তাঁদের প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই সময়েও এমন একটি হাতিয়ার ছিল, যা পরমাণুর গভীরে অনুসন্ধান চালাতে পারে। এটি আবিষ্কারের গল্প হচ্ছে এমন:

যে মুহূর্তে বিজ্ঞানী রন্টজেন এক্স রে আবিষ্কার করলেন, সেই সময় থেকে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এই বিকিরণ নিয়ে গবেষণায় আবদ্ধ হয়ে গেলেন। ভাবতে থাকলেন, এটিকে অন্য কোথাও পাওয়া সম্ভব কিনা। যেখানে এর আগে কেউ খুঁজে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি বলেই পায় নি।

ফরাসী পদার্থবিদ অ্যান্টনি হেনরি বেকরেল (Antoine  Henri  Becquerel, ১৮৫২-১৯০৮) বিশেষভাবে দীপ্তিমান (fluorescent) যৌগসমূহের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এই বস্তুসমূহ সূর্যালোক (কিংবা অন্যান্য শক্তির উৎস) শোষণ করে এবং বিশেষ কিছু বিচ্ছিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো হিসেবে সেই শক্তি বিকিরণ করে। ফ্লোরোসেন্ট পদার্থগুলো ফসফোরেসেন্ট (Phosphorescent, আমরা বাড়িতে হঠাৎ অন্ধকার হলে ঘড়ির ডায়ালে বা অন্যান্য বস্তুতে যেসব সবুজাভ বস্তুকে জ্বলতে দেখি) পদার্থের মতোই, তবে এদের ক্ষেত্রে বিকিরণ ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ এরা শক্তি শোষণ করতে থাকে। শক্তির উৎস সরিয়ে ফেললে এদের দীপ্তিও শেষ হয়ে যায়। অপরদিকে ফসফোরেসেন্ট বস্তুগুলো শক্তি শোষণ করার পর বেশ দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে শক্তি বিকিরণ করে।

দীপ্তিমান বস্তুগুলো দৃশ্যমান আলোর পাশাপাশি এক্স রে-ও বিকিরণ করে কিনা এই ভেবে বেকরেল পুলকিত হলেন। এই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি আলোক সংবেদী প্লেটকে কালো কাগজ দিয়ে মোড়ালেন এবং সমগ্র ব্যবস্থাটিকে সূর্যালোকে উন্মুক্ত রাখলেন এর মধ্যে একটি দীপ্তিমান বস্তুর ক্রিষ্টালও রাখা ছিল। সূর্যালোক কালো কাগজ ভেদ করতে পারবে না এবং দীপ্তিমান বস্তুর ক্রিস্টালটিও যেই বিকিরণ উৎপন্ন করবে তা-ও কালো কাগজ ভেদ করে যাবে না।  কিন্তু যদি দীপ্তিমান বস্তুটি বিকিরণ হিসেবে কোনো এক্স রে উৎপন্ন করে তাহলে তা কালো কাগজ ভেদ করে গিয়ে আলোক সংবেদী প্লেটে পড়ে সেটিকে ঝাপসা করে তুলবে।

যেই দীপ্তিমান বস্তুটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন সেটির নাম পটাশিয়াম ইউরেনাইল সালফেট, একটি প্রসিদ্ধ দীপ্তিমান বস্তু। এই যৌগটির প্রতিটি অণুতে একটি করে ইউরেনিয়াম পরমাণু থাকে। ১৮৯৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে বেকরেল তাঁর পরীক্ষাটি করলেন এবং যথেষ্ট নিশ্চয়তার সাথে দেখা গেল আলোকসংবেদী প্লেটটি ঝাপসা হয়েছে। তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, দীপ্তিমান বস্তুর ক্রিস্টালটি এক্স রে উৎপন্ন করছে এবং তিনি পরীক্ষাটি আরেকবার করে নিশ্চিত হতে চাইলেন।  অবশ্য, তার পরের কয়েকটি দিন মেঘাচ্ছন্ন কাটল। বেকরেল তাঁর কালো কাগজে মোড়ানো আলোক সংবেদী প্লেটটি ক্রিস্টাল সমেত ড্রয়ারে রেখে দিলেন এবং সূর্যালোকের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

মাচের্র এক তারিখ নাগাদ বেকরেল অস্থির হয়ে উঠলেন। নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য তিনি ড্রয়ারে আলোর অনুপস্থিতিতে রাখা আলোক সংবেদী প্লেটটি ডেভেলপ করার উদ্যোগ নিলেন যাতে তিনি নিশ্চিত হতে পারেন যে অন্ধকারের মধ্যে প্লেটটির মধ্যে কিছুই এসে পৌঁছাচ্ছে না। কিন্তু বিস্ময়াবিভূত হয়ে তিনি দেখলেন কালো কাগজ ভেদ করে কিছু একটা প্রবেশ করছে এবং তা যথেষ্ট পরিমাণে। কারণ, প্লেটটি প্রবলভাবে ঝাপসা হয়ে আছে। দেখা গেল, আলোর অনুপস্থিতিতেও ক্রিস্টালের টুকরোটি এক্স রে ত্যাগ করেছে এবং এই ঘটনা আলোর উপস্থিতি কিংবা ফ্লোরোসেন্স প্রদর্শনের উপর নিভর্রশীল নয়। সূর্যের  কথা ভুলে গিয়ে বেকরেল বিকিরণ নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলেন।

তিনি সহসাই উপলব্ধি করলেন যে, পটাশিয়াম ইউরেনাইল সালফেট হতে যে বিকিরণ উৎপন্ন হয় তার উৎস হচ্ছে এর মধ্যস্থিত ইউরেনিয়াম। কেননা ইউরেনিয়ামযুক্ত অন্যান্য যৌগসমূহও একই ধরনের বিকিরণ দেয় এমনকি যারা ফ্লোরোসেন্স প্রদর্শন করে না তারাও। ১৮৯৮ সালে পোলিশ-ফরাসি পদার্থবিদ মেরি কুরি (Marie Curie, ১৮৬৭-১৯৩৪) দেখালেন, অন্য আরেকটি ধাতু থোরিয়ামও একধরনের বিকিরণ প্রদর্শন করে। তিনি এই আচরণকে ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়াম তেজষ্ক্রিয়তা হিসেবে অভিহিত করলেন। বেকরেল এবং কুরি উভয়ই ধারণা করেছিলেন এই দুই পদাথের্র বিকিরণ ভিন্ন ধরনের।

১৮৯৯ সালে নিউজিল্যান্ড বংশদ্ভুত পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড (Ernest Rutherford ১৮৭১-১৯৩৭) অ্যালুমিনিয়াম ধাতুর পাতের মধ্য দিয়ে ছেদ করে যাওয়া তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের আচরণ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তিনি দেখলেন কিছু বিকিরণ ১/৫০০ সেন্টিমিটার পুরু অ্যালুমিনিয়ামের পাতেই আটকে যায়, আবার অন্য ধরনের বিকিরণকে থামানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পুরু পাতের প্রয়োজন হয়। গ্রিক বর্ণমালার প্রথম বর্ণ অনুযায়ী রাদারফোর্ড প্রথমোক্ত বিকিরণকে আলফা রশ্মি নাম দিলেন। আর অন্যধরনের বিকিরণটিকে গ্রিক দ্বিতীয় বর্ণ অনুসাওে বিটা রশ্মি নাম দিলেন।  ১৯০০ সালে ফরাসি পদার্থবিদ পল উলরিখ ভিলার্ড (Paul Ulrich Villard, ১৮৬০-১৯৩৪) তৃতীয় আরেক ধরনের রশ্মি আবিষ্কার করলেন, যার ভেদন ক্ষমতা আরো অনেক বেশি। গ্রিক বর্ণমালার তৃতীয় বর্ণ অনুসারে এর নাম দেওয়া হলো গামা রশ্মি।

আলফা, বিটা ও গামা রশ্মির প্রকৃতি
আলফা, বিটা ও গামা রশ্মির প্রকৃতি

প্রথম আবিষ্কারের পর বিভিন্ন ধরনের বিকিরণ পরিমাপ করতে বেশি সময় লাগেনি। বিটা রশ্মি চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা এমনভাবে বিচ্যূত হয়, এই ঘটনা থেকে এরা যে ঋনাত্মক চার্জগ্রস্থ সেটি স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৯০০ সালে বেকরেল এই কণিকাগুলোর ভর এবং চার্জের আকার পরিমাপ করলেন এবং তা থেকে বোঝা গেল যে বিটা রশ্মি ক্যাথোড রশ্মির মতোই উচ্চ গতির ইলেক্ট্রন দিয়ে গঠিত। এই কারণে একটি উচ্চগতির ইলেক্ট্রনকে অনেক সময় বিটা কণিকা বলা হয়।

গামা রশ্মি চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা বিচ্যূত হলো না এবং তাই বোঝা গেল তারা কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে না। রাদারফোর্ড ধারণা করলেন, গামা রশ্মির প্রকৃতি তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের মতো এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি এই ধরনের কিছু পরিমাণ রশ্মিকে ক্রিস্টালের ভিতর দিয়ে পাঠালেন। একটি ব্যতিচার প্যাটার্ন পাওয়ায় বোঝা গেল, এরা এক্স রে’র খুব কাছাকাছি কোনো বিকিরণ তবে আরো ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে গঠিত।

চুম্বক দ্বারা আলফা রশ্মি যেভাবে বিচ্যূত হয় তা থেকে মনে হয় তারা ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট। তবে শুধু চার্জের দিক থেকে নয় বরং অন্যান্য দিক থেকেও আলফা রশ্মি ইলেক্ট্রনের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিল। ১৯০৬ সালে রাদারফোর্ড দেখালেন, আলফা কণিকা একটি ইলেক্ট্রনের চেয়ে অনেক বেশি ভারী। আমরা এখন জানি, এটি ইলেক্ট্রনের চেয়ে ৭৩৪৪ গুণ বেশি ভারী।

যখনই রাদারফোর্ড বুঝলেন যে আলফা কণিকাগুলো বিশেষভাবে ভারী, তখনই তাঁর ধারণা হলো এটিই সেই বস্তু যা দিয়ে পরমাণুর অভ্যন্তরে অনুসন্ধান কাজ চালানো যায়। একঝাঁক আলফা কণিকাকে যদি পাতলা ধাতব পর্দার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো যায়, তাহলে সেগুলোর পর্দাটিকে ভেদ করে যাওয়ার কথা এবং এই ভেদ করার প্রকৃতি থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার সুযোগ আছে।

রাদারফোর্ড একটুকরো তেজষ্ক্রিয় বস্তুকে তাই একটি সীসার বাক্সে স্থাপন করলেন এবং এর সামনে একটি ছিদ্র রাখলেন।  বিকিরণ যদিও সীসার দেয়াল ভেদ করতে পারবে না তবে সামনে ছিদ্র রাখায় সরু একগুচ্ছ বিকিরণ ছিদ্র দিয়ে নিঃসৃত হবে এবং বাইরে বেরিয়ে এসে একটি পাতলা সোনার তৈরি পর্দায় আঘাত করতে পারবে। সোনার পর্দার পেছনে একটি আলোক সংবেদী পর্দা রাখা থাকবে। এই পর্দা কোনো আলফা কণিকা যদি সোনার পাত ভেদ করে চলে আসে তবে তার প্রভাবে ঝাপসা হবে।

সোনার পাতটি এতোই পাতলা ছিল যে, এটিকে প্রায় অর্ধস্বচ্ছ দেখা গেল। কিন্তু অন্যদিকে পরমাণু নিজেও এতই ক্ষুদ্র যে পাতলা সোনার পাতেরই পুরুত্ব ছিল ২০০০০টি পরমাণুর ব্যাসের সমান। এমনকি এরপরও আলফা কণিকা পাতের ভিতর দিয়ে এমনভাবে গলে গেল যেন এই ২০০০০ টি পরমাণুর কোনো অস্তিত্ত্বই নেই।  এরা আলোক সংবেদী প্লেটটিকে এমনভাবে ঝাপসা করল যে তাদের গমন পথে কোনো সোনার পাত না রাখা হলেও একই পরিমাণ ঝাপসা করতে পারত।

তবে পুরোপুরি নয় অবশ্য। রাদারফোর্ড লক্ষ্য করলেন, সামান্য কিছু আলফা কণিকা বিচ্যূত হচ্ছে। আলফা কণিকাগুলো আলোক সংবেদী প্লেটের যেখানে পড়ার কথা তার চারপাশেও খুব হালকাভাবে ঝাপসা হচ্ছে। দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে এই ঝাপসা এলাকা ক্রমশঃ মিলিয়ে যায়, তবে একেবারে পুরোপুরি মেলায় না। প্রায় প্রতি ৮০০০ আলফা কণিকার একটি নব্বই ডিগ্রী কিংবা তারচেয়ে বেশি কোণে বিচ্যূত হয়। প্রকৃতপক্ষে, হঠাৎ হঠাৎ কোনো কোনো আলফা কণিকা পাতের কোথাও আঘাত পেয়ে সরাসরি একবারে উল্টো দিকে চলে আসছে বলে মনে হয়।

picture6
রাদারফোর্ডের স্বর্ণপাত পরীক্ষা। (ক) চিত্রে স্থূলভাবে সরঞ্জামটি দেখানো হচ্ছে। (খ) চিত্রে স্বর্ণপাতের উপর আলফা কণিকার অনুমিত প্রভাব দেখা যাচ্ছে যা থেকে নিউক্লিয়াসের ধারনা পাওয়া যায়।

এই বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য ১৯১১ রাদারফোর্ড তার পরমাণুর গঠনের ধারণা নিয়ে এগোলেন। তিনি বললেন পরমাণুর প্রায় সবটুকু ভর একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্রও ধনাত্মক চার্জযুক্ত এলাকায় ঘনীভুত অবস্থায় থাকে, যা এটির একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান করে। যদি আলফা কণিকাগুলো এই কেন্দ্রের কাছাকাছি আঘাত করে তাহলে তারা বিচ্যূত হয় (আলফা কণিকা নিজেও ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট)। বিচ্যুতির অনুপাত থেকে রাদারফোর্ড নিউক্লিয়াসের আকারও নির্ণয় করতে সক্ষম হলেন। ইতিপূর্বে উল্লিখিত নাগাওকার কাছে এই ধরনের কোনো আলামত ছিল না।
ফলে রাদারফোর্ডই এই আবিষ্কারের পূর্ণ স্বীকৃতি পেলেন। ছোট কেন্দ্রীয় অংশটুকুকে নাম দেওয়া হলো নিউক্লিয়াস যা একটি গ্রিক শব্দ থেকে আগত যার অর্থ ছোট বাদাম, কেননা এটি একটি বিশাল জায়গাবহুল পারমাণবিক খোলসের মধ্যে একটি ছোট বাদামের মতোই অবস্থান করে। যেহেতু জীববিজ্ঞানে জীবকোষেও একটি কেন্দ্রীয় বস্তুকে নিউক্লিয়াস নামে অভিহিত করা হয়, তাই পরমাণুর ভিতরের নিউক্লিয়াসটিকে অনেক সময় পারমাণবিক নিউক্লিয়াস বলে সুস্পষ্ট করা হয়। তবে এই বইয়ের আলোচনায় সুস্পষ্টকারী ‘পারমাণবিক’ শব্দটিকে সব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় নি।

রাদারফোডের্র পরমাণুর চিত্রটি বেশ সন্তোষজনক বলে প্রতীয়মান হলো যদিও অনেক বিস্তারিত বিষয়াদি আবিষ্কৃত হয়েছিল এর আরো এক শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ সময় পরে। এই বিষয়টি এবং অন্যান্য কাজের জন্য রাদারফোর্ড ১৯০৮ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রাদারফোর্ড পুরস্কারটি পেয়েছিলেন রসায়ন ক্যাটাগরিতে, যে কারণে তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন কেননা তিনি নিজেকে পদার্থবিদ ভাবতেন।

[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৯১৫৯৩৯৬৬৮]

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.