অধ্যায়-৩: ইলেক্ট্রন
অনুচ্ছেদ-৪: ইলেক্ট্রন এবং পরমাণু
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন]
এটি পরিস্কার যে পর্যবেক্ষন হতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে ইলেক্ট্রনকে ভরযুক্ত পদার্থ হিসেবে কল্পনা করা যায়। মনে করি, আমরা বিদ্যুতের প্রাথমিক অবস্থার গবেষণা নিয়ে চিন্তা করছি যখন আমরা দেখেছিলাম কাচদন্ডের সাথে অ্যাম্বারের ঘর্ষণের মাধ্যমে কিছুটা তড়িৎ চার্জ উৎপন্ন হয়। এটি কি এই কারণে নয় যে, ইলেক্ট্রন যে বস্তুকে ঘষা হয় সে বস্তু থেকে যে বস্তুর মাধ্যমে ঘষা হয় সে বস্তুতে ভ্রমণ করে, কিংবা এর উল্টোটা ? যে বস্তুকে অতিরিক্ত ইলেক্ট্রন নিতে বাধ্য করা হয় তার মধ্যে ঋনাত্মক চার্জ জড়ো হয় আর যে বস্তু কিছুটা ইলেক্ট্রন হারায় তার মধ্যে ধনাত্মক চার্জ জড়ো হয়। এবং যদি তাই হয়, তাহলে ইলেক্ট্রনকে সেই বস্তুর মধ্যে অবশ্যই আগে থেকে বিদ্যমান থাকতে হবে যা থেকে সে স্থানান্তরিত হবে।
আবার, একটি বৈদ্যুতিক প্রবাহ কোন একটি বস্তুর মধ্য দিয়ে ভ্রমণরত ইলেক্ট্রনের সমন্বয়েও তৈরি হতে পারে যেখানে ওই প্রবাহ বিদ্যমান। এভাবেই, ক্যাথোড রশ্মি টিউবের ভিতরেও, তড়িৎ প্রবাহ যখন ক্যাথোডে পৌঁছায় তখন সেখানে ইলেক্ট্রন জড়ো হয় (এবং ক্যাথোডকে ঋনাত্মক চার্জ প্রদান করে যার কারণে এটি ক্যাথোড হয়েছে) এবং একটি শূন্য মাধ্যমের ভিতর দিয়ে ক্যাথোড রশ্মি কণিকার নিঃসরণে বাধ্য হয়।
বৈদ্যুতিক এই “প্রণোদনা” আলোর গতিতে ভ্রমণ করে, ফলে আপনি যদি নিউ ইয়র্ক থেকে লস এঞ্জেলস পর্যন্ত টেলিফোনের তার টানিয়ে একটি বাণী টেলিফোনের তারের মধ্য দিয়ে নিউইয়র্ক থেকে প্রেরণ করেন তা লস এঞ্জেলসে পৌঁছে পুনরায় সেই বাণীতে পরিণত হতে মাঝখানে সময় লাগবে এক সেকেন্ডের ষাট ভাগের এক ভাগ। যদিও ইলেক্ট্রন নিজে এক পরমাণু থেকে আরেক পরমাণুতে ধাক্কা খেতে খেতে বেশ আস্তে চলাচল করে।
এই ঘটনা ক্যারাম খেলায় একটি ঘুঁটি দিয়ে এক লাইনে স্থাপিত অনেকগুলো ঘুঁটিতে আঘাত করার ঘটনার সাথে তুলনীয়। আপনি যদি প্রথম লাইনের প্রথম ঘুঁটিটিকে আঘাত করেন তাহলে দেখা যাবে তাৎক্ষণিক ভাবে লাইনের শেষ ঘুঁটিটি বের হয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝখানের ঘুঁটিগুলো তেমন একটা নড়ে না বললেই চলে। কিন্তু প্রথম ঘুঁটিটির উপর আঘাতের প্রভাবে তৈরি সংকোচন ও প্রসারণ শব্দের বেগে লাইনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভ্রমণ করে এবং শেষ ঘুঁটিটিকে লাইন থেকে বের করে দেয়।
এই পর্যন্ত এসে মনে হয় যেন ইলেক্ট্রন বস্তুগতভাবেই বিদ্যমান থাকে। কোনো কারণে এটি ধরে নেওয়া হয়েছিলো যে ইলেক্ট্রন স্বাধীনভাবে, পরমাণু হতে পৃথকভাবে অবস্থান করে কেননা পরমাণুকে ইতিমধ্যে অবিভাজ্য এবং সরল ক্ষুদ্রতম বস্তুকণা হিসেবে কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে তা থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুসারে পরমাণুকে অবিভাজ্য বলেই ধারণা পাওয়া যায়, কিন্তু এরা যে খুবই সরলপ্রকৃতির এটি একটি স্থুল অনুমান। তথাপি, বিজ্ঞানীরাও মানুষ আর মানুষের চিন্তা-ভাবনার অন্যান্য দিকের মতোই দীর্ঘদিনের লালিত অনুমান অনেক সময় সর্বজনীন সূত্রের চেয়েও বেশি প্রভাব বিস্তার করে। মানুষ ভুলে যায় যে, এটি নিছকই একটি অনুমান এবং এটি যে ভুলও হতে পারে এই চিন্তা করা তখন দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
এর সাথে সম্পর্কযুক্ত এই বিষয়টি বিবেচনা করুন যে, তড়িৎ প্রবাহ কিছু কিছু দ্রবণের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে পারে কিন্তু অন্যগুলোর মধ্য দিয়ে পারে না। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই ঘটনা প্রথম অনুশীলন করেছিলেন মাইকেল ফ্যারাডে। এভাবেই জানা যায়, খাদ্য লবণের (সোডিয়াম ক্লোরাইড) দ্রবণ তড়িৎ পরিবহন করে; ভোল্টা এমনই পেয়েছিলেন যখন তিনি প্রথম ব্যাটারী প্রস্তুত করেন। সোডিয়াম ক্লোরাইড তাই তড়িৎ বিশ্লেষ্য। একটি তড়িৎ প্রবাহকে চিনির দ্রবণের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা যায় না। তাই চিনি তড়িৎ অবিশ্লেষ্য।
এই পরীক্ষাগুলো হতে ফ্যারাডে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, দ্রবণে অবস্থিত কিছু একটা, ঋনাত্মক চার্জকে একদিকে এবং ধনাত্মক চার্জকে বিপরীত দিকে বহন করে। তিনি সঠিকভাবে জানতেন না কী সেই বাহক যা চার্জগুলোকে বহন করে কিন্তু তিনি এর একটি নাম দিলেন। তিনি এই চার্জ বাহকের নাম দিলেন আয়ন (রড়হ, গ্রীকভাষায় যার অর্থ পরিব্রাজক)।
১৮৮০ সালে একজন তরুন সুইডিশ রসায়নের ছাত্র স্যাভান্তে অগাস্ত আরহেনিয়াস (Svante August Arrhenius, ১৮৫৯-১৯২৭), একটি অভিনব পদ্ধতিতে এই সমস্যার মোকাবেলা করলেন। বিশুদ্ধ পানির একটি সুনির্দিষ্ট হিমাংক আছে যা হচ্ছে ০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশুদ্ধ পানিতে চিনি যুক্ত করলে দ্রবণের হিমাংক কমে যায়। যত বেশী চিনি যুক্ত করা হয় ততোই হিমাংক নামতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে হিমাংকের এই ক্রম অবনতি দ্রবণে চিনির অণুর সমানুপাতিক। এই ঘটনা অন্যান্য তড়িৎ অবিশ্লেষ্য বস্তুর জন্যও সত্য। একই পরিমাণ অন্য তড়িৎ অবিশ্লেষ্য অণু হিমাংকের একই পরিমাণ অবনমন ঘটায়।
তবে তড়িৎ বিশ্লেষের জন্য পরিস্থিতি ভিন্ন। যদি সোডিয়াম ক্লোরাইডকে পানিতে দ্রবীভূত করা হয় তাহলে হিমাংকের অবনমন হয় যা হওয়ার কথা, তার দ্বিগুণ, যদি আমরা অণুর সংখ্যা বিবেচনা করি। এর কারণ কী হতে পারে?
সোডিয়াম ক্লোরাইডের অণু একটি সোডিয়াম(Na) পরমাণু এবং একটি ক্লোরিন (Cl) পরমাণু দিয়ে গঠিত, তাই এর সংকেত হচ্ছে NaCl। দ্রবণের বাইরে প্রতিটি NaCl এর জন্য দ্রবণে দুটি অর্ধাণু Na এবং Cl পাওয়া যায়। অর্থাৎ আমরা যেমনটি হিসেব করি তার দ্বিগুণ কণিকা দ্রবণের মধ্যে থাকে এবং এর ফলে হিমাংক দ্বিগুণ পরিমাণ হ্রাস পায়। (যেসব অণু দুইয়ের অধিক পরমাণু দিয়ে গঠিত তারা এমনকি তিনভাগ বা চারভাগে ভেঙে যেতে পারে এবং হিমাংকের কাঙ্খিত পরিমাণের চেয়ে তিনগুণ বা চারগুণ অবনমন তৈরি করতে পারে)।
সাধারণ চিনির একটি অণুতে ১২ টি কার্বন পরমাণু, ২২ টি হাইড্রোজন পরমাণু এবং ১১ টি অক্সিজেন পরমাণু, সব মিলিয়ে ৪৫টি পরমাণু থাকে। এটি যখন পানিতে দ্রবীভূত হয় তখন বিয়োজিত হয় না বরং এরা অণুর পর্যায়েই থেকে যায়। তাই এই ক্ষেত্রে দ্রবণে কাঙ্খিত সংখ্যার অণুই পাওয়া যায় এবং হিমাঙ্কেরও কাঙ্খিত পরিমাণ অবনমনই ঘটে।
অবশ্য যখন সোডিয়াম ক্লোরাইড পানিতে দ্রবীভূত হয় তখন এটি সাধারণ সোডিয়াম এবং ক্লোরিন পরমাণুতে পরিণত হয় না। সোডিয়ামএবং ক্লোরিন পরমাণুর ধর্ম জানা আছে কিন্তু পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় সেই ধর্ম প্রদর্শিত হয় না। কিছু একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটে যা দ্রবণে বিয়োজিত সোডিয়াম ক্লোরাইডের সোডিয়ামএবং ক্লোরিন পরমাণুর সাথে সাধারণ সোডিয়াম এবং ক্লোরিন পরমাণু অপেক্ষা ভিন্নতা তৈরি করে।
আরহেনিয়াসের কাছে মনে হলো, ফ্যারাডে যেই আয়নের কথা বলেছিলেন তার উত্তর হচ্ছে এই বিয়োজিত সোডিয়াম ক্লোরাইড অণুর একেকটি খন্ড যারা বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে। সোডিয়াম ক্লোরাইডের দ্রবণের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চালানোর পরীক্ষা থেকে ধরে নেওয়া সহজ যে সোডিয়াম কণা গঠিত হয় বিয়োজনের মাধ্যমে যা ধনাত্বক চার্জ ধারণ করে এবং Na+ প্রতীক হিসেবে লেখা যায়। একই সাথে প্রতিটি ক্লোরিন কণা একটি ঋণাত্বক চার্জ ধারণ করে এবং একে Cl- প্রতীক দিয়ে লেখা যায়। এর কারণ হচ্ছে তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থগুলো এমন ভাবে বিভাজিত হওয়ার প্রবণতা দেখায়, যেন তারা প্রত্যেকেই চার্জ ধারণ করে এবং বিদ্যুৎ পরিবহনেও সক্ষম।
চার্জযুক্ত সোডিয়াম এবং ক্লোরিন পরমাণুর রাসায়নিক ধর্ম চার্জবিহীন সোডিয়াম এবং ক্লোরিন পরমাণুর চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। এই কারণেই জীবদেহের জন্য লবণের দ্রবণের প্রভাব মৃদু অথচ সোডিয়াম এবং ক্লোরিন উভয়েই বিপদজনক। তড়িৎ অবিশ্লেষ্য যেমন চিনি যেহেতু বিয়োজিত হয় না তাই এদের চার্জ ধারী কোনো খন্ডও পাওয়া যায় না যা বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করতে পারে, তাই এরা বিদ্যুৎ পরিবহনও করে না।
১৮৮৪ সালে আরহেনিয়াস তাঁর পিএইডি থিসিস হিসেবে আয়নিক বিয়োজন তত্ত্ব প্রস্তুত করেন। পরীক্ষা কমিটি শীতলভাবে তাঁর তত্ত্বটিকে স্বাগত জানাল, কেননা তাঁরা এমন কোনো তত্ত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না যা চার্জ বহনকারী পরমাণুর কথা বলে। পরমাণু যেখানে সবচেয়ে মৌলিক এবং সরল প্রকৃতির বস্তু এবং কোনো রকমের পরিবর্তন সাধানে অক্ষম সেখানে এর পক্ষে কীভাবে চার্জ ধারণ করা সম্ভব? (তাঁরা নানাবিধ অনুমানের প্রভাবে অসহায় অবস্থায় ছিলেন।)
কমিটি থিসিসটিকে পুরোপুরি বাতিল করে দিতে পারে নি কেননা এখানে যুক্তিতর্কগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল এবং এতে এতো কিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছিলো যেগুলো অন্য কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। যাহোক, তাঁরা আরহেনিয়াসকে ন্যূনতম গ্রেড দিয়ে পাস করিয়ে দিয়েছিলেন।
১৩ বছর পর জে.জে. থমসন যখন ইলেক্ট্রন আবিষ্কার করেছিলেন তখন হঠাৎ করেই এটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠল যে, পরমাণু সম্ভবতঃ একটি বা দু’টি অতিরিক্ত ইলেক্ট্রন ধারণ করতে পারে কিংবা তাদের স্বাভাবিক বহন ক্ষমতার চেয়ে একটি বা দু’টি ইলেক্ট্রন ছেড়ে দিতে পারে। প্রতিটি বছর পার হওয়ার সাথে সাথে নতুন নতুন আবিষ্কার হতে থাকে এবং এই সম্ভাবনা আরো জোরদার হতে থাকে এবং ১৯০৩ সালে আরহেনিয়াস সেই একই থিসিসের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেলেন যেটি ১৯ বছর আগে কোনো মতে পাস করে গিয়েছিলো।
অবশ্য শুধুমাত্র তড়িৎ বিশ্লেষ্যের আচরণ থেকে পরমাণুতে ইলেক্ট্রনের উপস্থিতি অনুমান করে নেওয়া পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। পরমাণু থেকে সরাসরি ইলেক্ট্রন পর্যবেক্ষণ করা কি কোনো ভাবে সম্ভব? দৃষ্টান্তস¡রূপ, কেউ কী পরমাণু থেকে ইলেক্ট্রন বের করে এনে সেগুলোকে সণাক্ত করতে পারবে?
১৮৮৭ সালে যখন হার্জ তাঁর সনাক্তকারী যন্ত্রের মাধ্যমে বেতার তরঙ্গের উপস্থিতি সনাক্ত করেছিলেন, সেই বছরেরই পরের দিকে তাঁর যন্ত্রের ফাঁকা জায়গা বরাবর একটি স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেয়েছিলেন যেখানে তড়িৎ প্রবাহ লাফিয়ে সেই ফাঁকা স্থান অতিক্রম করেছিলো। স্পষ্টভাবেই আলোর তড়িৎক্ষরণের উপর কিছু প্রভাব রয়েছে যা photoelectric effect (আলোক-তড়িৎক্রিয়া) হিসেবে প্রচারণা পেলো যেখানে photo- উপসর্গটি গ্রীক আলো অর্থে ব্যবহৃত হয়।
ঠিক পরের বছরই অর্থাৎ ১৮৮৮ সালে আরেকজন জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম হলওয়াকস (Wilhelm Hallwachs, ১৮৫৯-১৯২২) দেখতে পেলেন যে, ফটোতড়িৎ ক্রিয়া দুই ধরনের বৈদ্যুতিক চার্জের উপর একই ধরনের প্রভাব ফেলে না। ঋনাত্মক চার্জবাহী এক টুকরো ধাতব জিংক যখন অতিবেগুনী রশ্মির সান্নিধ্যে থাকে তখন তা চার্জ হারিয়ে ফেলে। একই জিংকের টুকরো যখন ধনাত্মক চার্জ বহন করে তখন অতিবেগুনী রশ্মি দ্বারা মোটেও প্রভাবিত হয় না এবং এর চার্জ ধরে রাখে। এই ঘটনার কোনো তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি যদ্যাবধি না থমসন ইলেক্ট্রন আবিষ্কার করেন এবং সেই থেকে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু হয়েছিলো যে, পরমাণু ইলেক্ট্রন ধারণ করলেও করতে পারে।
এই ক্ষেত্রে, যন্ত্রের ফাঁকা স্থানের মধ্যে ইলেক্ট্রন দেখা গিয়েছিলো কেননা ইলেক্ট্রন ধাতব প্রান্ত হতে নিঃসৃত হতে বাধ্য হয়েছিলো। যদি আলো ইলেক্ট্রনকে কোনো ভাবে নিঃসৃত হতে বাধ্য করতে পারত তাহলে স্ফুলিঙ্গ আরো সহজে গঠিত হত। ঋনাত্মক জিংক যা সম্ভবতঃ অতিরিক্ত ইলেক্ট্রন বহন করে, তা যদি আলোর প্রভাবে ইলেক্ট্রন হারাতে পারত তাহলে তা চার্জহীন হয়ে পড়ত। ধনাত্মক চার্জযুক্ত জিংক যা সম্ভবতঃ ইলেক্ট্রনের ঘাটতিযুক্ত তা আলোর সংস্পর্শে এসেও ইলেক্ট্রনের ঘাটতি মিটিয়ে চার্জহীন হয়ে যাওয়ার কথা নয় কেননা আলোর পক্ষে ইলেক্ট্রন সরবরাহ করতে পারার সম্ভাবনা নেই।
অন্ততপক্ষে এটিই আলোক তড়িৎক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা। অবশ্য এটি বিজ্ঞানীদের জন্য তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত না টানার জন্য একটি সতর্ক সংকেতও কেননা অনেক সময় হুট-হাট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফাঁদেও পড়তে হতে পারে (যেমন ক্যাথোডের পাতলা ধাতব পাত ভেদ করে যেতে পারে এ থেকে ধারণা করে নেওয়া হয়েছিল যে, তাদের পক্ষে কণা দ্বারা গঠিত হওয়া সম্ভব নয়)।
কাজেই ইলেক্ট্রন বস্তু থেকে বিচ্যূত হয়েছে তার মানেই এই নাও হতে পারে যে তারা বস্তুতে শুরু থেকেই বিদ্যমান। আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বে দেখিয়েছিলেন যে. ভর হচ্ছে শক্তির এক ধরনের রূপ। ভরকে শক্তিতে এবং শক্তিকে ভরে রূপান্তর করা সম্ভব। আলো শক্তি ধারণ করে। কাজেই এমনও হতে পারে যে, আলোক শক্তি ধাতুকে আঘাত করে বিশেষ পরিস্থিতিতে খুব ক্ষুদ্র ভর, একটি ইলেক্ট্রনে পরিণত হয় যা ধাতুর মাধ্যমে প্রাপ্ত কিছু ঋণাত্মক চার্জও ধারণ করতে পারে? যদি এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে ইলেক্ট্রন কখনোই ধাতুর অংশ ছিলো না।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব অবশ্য শুধু এটিই বিবৃত করে না যে, ভর এবং শক্তি পরস্পর রূপান্তরযোগ্য। বরং এটি একটি সরল সমীকরণের মাধ্যমে দেখায় কতটুকু ভরের রূপান্তরে কতটুকু শক্তি পাওয়া যায় যা বিপরীত রূপান্তরের জন্যও সত্য। এখান থেকে পাওয়া যায়, এমনকি একটি অতি ক্ষুদ্র ভরের রূপান্তরের মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া সম্ভব এবং বিপরীতভাবে, খুব ক্ষুদ্র পরিমাণ ভর উৎপাদনের জন্যেও বিপুল পরিমাণ শক্তি দরকার।
ইলেক্ট্রন নিশ্চিৎভাবেই ভর হিসেবে খুবই ক্ষুদ্র কিন্তু তারপরেও ইলেক্ট্রনের সমপরিমাণ ভর, শক্তির রূপান্তর মাধ্যমে অর্জন করার জন্য যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন তা অতিবেগুনী রশ্মির আলো থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই, আলোক তড়িৎক্রিয়া শক্তি থেকে ইলেক্ট্রনের রূপান্তর ফলাফল হতে পারে না; এটি অবশ্যই ধাতব পরমাণু থেকে ইলেক্ট্রন বিচ্যূত হওয়ার ফল যেই ইলেক্ট্রন ইতিমধ্যেই বিদ্যমান আছে। শক্তি থেকে নতুনভাবে ইলেক্ট্রন উৎপন্ন করার চেয়ে ইলেক্ট্রন রূপান্তর করতে অনেক কম শক্তি প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে তাই দেখা গেলো যে, সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যাটিই বাস্তবিক (এবং এটি সুখকরও বটে যা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে ঘটে থাকে)।
অবশ্যই এই সম্ভাবনা এখনো উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, পরমাণু থেকে যা নিঃসৃত হয় তা ইলেক্ট্রন নয়। হতে পারে তারা অন্য কোনো কণিকা যা ঋনাত্মক চার্জ বহন করে। তবে থমসন ১৮৯৯ সালে তড়িৎ এবং চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করে দেখিয়েছিলেন যে, নিঃসৃত কণিকাগুলোর ভর এবং চার্জ ইলেক্ট্রনের ভর এবং চার্জের সমান। যেহেতু এই দুটি ধর্মই মিলে যায় তাই আলোক তড়িৎ ক্রিয়ারত কণিকাগুলো যে ইলেক্ট্রন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং অদ্যাবধি এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার মতো কিছুই ঘটে নি।
[বইয়ের সূচীপত্র তথা প্রকাশিত সবগুলো আর্টিকেলের জন্য এখানে দেখুন। বিজ্ঞান পত্রিকায় সম্পূর্ণ বইটিই পড়া যাবে, তবে মুদ্রিত সংস্করণটি সংগ্রহ করতে চাইলে যোগাযোগ করুন: ছায়াবিথী প্রকাশনী, ফোন: ০১৯১৫৯৩৯৬৬৮]
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]