দৈনন্দিন জীবনেও জড়িয়ে আছে আপেক্ষিকতা

0
982

বিখ্যাত বৃটিশ পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন ১৯০০ সালে অতি দম্ভের সাথে ঘোষণা করেন,পদার্থবিজ্ঞানে আর নতুন কিছুই আবিষ্কারের সুযোগ নেই। পুরনো তত্ত্ব গুলোর উপর গবেষণা করা ও তার উৎকর্ষ সাধনই হবে আগামী দিনের পদার্থবিদদের কাজ। কিন্তু তার এই ধারণা বেশিদিন টেকে নি। এরই মাঝে বিখ্যাত পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের উত্থান ঘটে।তিনিই ১৯০৫ সালে বিংশ শতাব্দীতে পদার্থবিজ্ঞানের  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ও যুগান্তকারী তত্ত্ব প্রদান করেন। একে ইংরেজিতে বলে থিওরি অব রিলেটিভিটি। বাংলাতে যার অর্থ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। এই তত্ত্বটি স্থান ও কাল ভেদে বস্তুর ধর্ম ও আচরণ ব্যাখ্যা করে। এছাড়াও কৃষ্ণগহবর,সুপারনোভা,মহাকর্ষের প্রভাবে আলোর বেঁকে যাওয়ারও ধারণা পাওয়া যায় এই তত্ত্ব থেকে।  তত্ত্বটি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বেশ সহজ। তিনি ধারণা দেন,পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র সর্বত্র সমান। এছাড়াও তিনি ৩টি গুরুত্বপূর্ন অনুসিদ্ধান্ত উপস্থাপন করেন। প্রথমত, পরম প্রসঙ্গবস্তু বলতে কিছু নেই। আমরা সবসময় একটি বস্তুকে প্রসঙ্গবস্তু কল্পনা করে তার সাপেক্ষে অন্য কোন বস্তুর বেগ,ভরবেগ পরিমাপ করি। প্রসঙ্গবস্তুর যে কোন পরিবর্তনে অপর বস্তুটির আপেক্ষিক ধর্মেরও পরিবর্তন ঘটে। তাই পরম গতি ও পরম স্থিতির অস্তিত্ব প্রকৃত অর্থে নেই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, আলোর বেগ সবসময় সবজায়গায় সমান। এটি স্থির বা গতিশীল যে কোন বস্তুর সাপেক্ষে ধ্রুব থাকে। তৃতীয়ত, আলোর চেয়ে বেশি গতিতে মহাবিশ্বের কোন কিছু যেতে পারে না ।

আইনস্টাইনের এই অবিস্মরণীয় তত্ত্বটির ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। যেমন: যেহেতু আলোর বেগ সবসময় সমান। এর ফলে পৃথিবীর সাপেক্ষে অনেক বেশি মাত্রায় গতিশীল মহাশূন্যযানে অবস্থানকারী মহাকাশচারীর ঘড়ির কাটা, পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষের ঘড়ির চেয়ে ধীরে চলবে । তাই পৃথিবীর তুলনায় মহাকাশচারীর কাছে সময়টা অনেক ধীরে কাটবে। একেই বলে কাল দীর্ঘায়ন।এটাই টাইম ট্রাভেলের মূল ব্যাখ্যা। এছাড়াও প্রসঙ্গবস্তুর সাপেক্ষে কোন বস্তুর গতিবেগ ও দুরত্ব বাড়তে থাকলে  তার দৈর্ঘ কমে যায় বলে মনে হয়। আমাদের মাথার উপর দিয়ে যখন উড়োজাহাজ উড়ে যায়,তখন আমরা এই ঘটনাটি দেখতে পাই। এক্ষেত্রে আমরা প্রসঙ্গবস্তু আর আমাদের সাপেক্ষে উড়োজাহাজ থাকে গতিশীল ।এটি আমাদের থেকে যত দূরে চলে যায়,আমাদের কাছে সেটি তত ছোট মনে হয়। একেই বলে দৈর্ঘ সংকোচন ।আইনস্টাইনই প্রমাণ করেছেন, ভরকে শক্তিতে বা শক্তিকে ভরে রুপান্তর করা সম্ভব। তবে আপেক্ষিকতার তত্ত্বে ভরকে দুইভাবে প্রকাশ করা হয়। একটি হচ্ছে নিশ্চল ভর (স্থির অবস্থায় বস্তুতে সঞ্চিত ভর), অপরটি হচ্ছে গতিশীল ভর (প্রসঙ্গবস্তুর সাপেক্ষে গতিশীল অবস্থায় অনুভূত ভর )। কোন বস্তু যদি পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে আলোর বেগে চলে,তাত্ত্বিকভাবে তার গতিশীল ভর অসীম হবে। কিন্তু কোন বস্তুর ভর কখনও অসীম হয় না। তাই কোন বস্তুই আলোর বেগকে অতিক্রম করতে পারবে না।

তবে আপেক্ষিকতা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হলেও ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয়ের সাথে এটি জড়িয়ে আছে। এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এর উপস্থিতি বিদ্যমান। আমরা হয়ত তা উপলব্ধি করতে পারি না। আজ এই বিষয়েই আমরা জানব।

TV
আমাদের ব্যবহৃত সেই টিভি

কিছু বছর আগেও বাসাবাড়ির টেলিভিশন তৈরিতে ক্যাথোড রশ্মির টিউব ব্যবহত হত। এই টিউব টেলিভিশনের ভেতরে থাকা একটি বড় চুম্বকের উপরে বিদ্যমান ফসফরাসের পর্দার উপর দ্রুতবেগে ইলেকট্রন নিক্ষেপ করে। পর্দায় আপতিত হওয়ার পর প্রতিটি ইলেকট্রন উজ্জ্বল ও বর্ণময় প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। পর্দায় ছবি তৈরিতে ইলেকট্রনগুলোকে আলোর গতিবেগের প্রায় ৩০ শতাংশ বেগে নিক্ষেপ করতে হয়। এক্ষে্ত্রে আপেক্ষিকতার প্রভাবও লক্ষণীয়। এমনকি টেলিভিশন নির্মাতারাও এই বিষয়টকে মাথায় রেখেই চুম্বকের আকৃতি নির্ধারণ করতেন।

আমরা জানি পারদ ধাতু হলেও কক্ষতাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে। এর পেছনেও আপেক্ষিকতার অবদান রয়েছে। তত্ত্ব অনুসারে, বস্তুর গতি যত বাড়বে, ভরও তত বাড়বে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আধানের উপর ইলেকট্রনসমূহের গতি নির্ভর করে। নিউক্লিয়াসের আধান বেশি হলে ইলেকট্রনের প্রতি তার আকর্ষণও বেশি হবে। তখন নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ রোধে ইলেকট্রনকে স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুত গতিতে ঘুরতে হয়। ফলে তার ভরও বেড়ে যায়। এই দ্রুতগতি ও ভরবৃদ্ধির কারণে ইলেকট্রনসমূহ নিউক্লিয়াসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকে। ফলে পরমাণুগুলোর মাঝে দূর্বল প্রকৃতির বল বিদ্যমান থাকে। তাই পারদের গলনাংক কম ও স্বাভাবিক অবস্থায় তা তরল থাকে। এছাড়াও ভারী মৌলিক পদার্থ যেমন স্বর্ণের রাসায়নিক নিস্ক্রিয়তা (অন্য কোন পদার্থের সাথে বিক্রিয়ায় অনীহা), এর উজ্জ্বলতা ও সহজে ক্ষয় না হওয়ার কারণ এই তত্ত্ব থেকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।

তরল ধাতু পারদ
তরল ধাতু পারদ

চুম্বকত্বও আপেক্ষিকতা মেনে চলে। যদি আমরা একটি তারের কুন্ডলীকে একটি চুম্বকক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাই,তাহলে তারের মাঝে তড়িৎ উৎপন্ন হয়। কারণ তারে বিদ্যমান চার্জের কণাগুলো পরিবর্তনশীল চুম্বকক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়। যা কণাগুলোকে চলাচলে বাধ্য করে ও এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এখন ধরা যাক,তারের কুন্ডলীটি স্থির কিন্তু চুম্বকটি চলমান। এক্ষেত্রে তারে উপস্থিত আধানের কণাগুলো (প্রোটন ও ইলেকট্রন) স্থির থাকে। তাই স্বাভাবিক দৃষ্টিতে চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা এটি প্রভাবিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। কারণ ফ্যারাডের সূত্রানুসারে, গতিশীল চৌম্বকক্ষেত্র তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম। তাই এটাই প্রতিয়মান হয় যে, পরম বা বিশুদ্ধ প্রসঙ্গকাঠামোর অস্তিত্ব প্রকৃতিতে নেই। আর ফ্যারাডের এই সূত্রের উপর ভিত্তি করেই ট্রান্সফর্মার, বৈদ্যুতিক জেনারেটর তৈরি করা হয়। তাই আমরা যে বিদ্যুত ব্যবহার করি, তা মূলত এই আপেক্ষিকতারই ফল।

জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমেও আপেক্ষিকতার প্রভাব সুস্পষ্ট। এই সিস্টেমে মূলত স্যাটেলাইটের সাহায্যে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের বা বস্তুর অবস্থান নিশ্চিত করা হয়। স্যাটেলাইট অবশ্য আলোর গতিতে পৃথিবীকে আবর্তন করে না। তবে তাদের ঘূর্ণন গতি অনেক বেশি। তাই স্যাটেলাইট প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ যখন পৃথিবীতে পাঠায়, তখন অভিকর্ষজনিত কারণে স্টেশনগুলোতে সঙ্কেতের ত্বরণ অত্যাধিক বেড়ে যায়। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক সঙ্কেত চিহ্ণিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।তাই নির্ভূল সঙ্কেত পাওয়ার জন্য,স্যাটেলাইটগুলোতে যে ঘড়ি ব্যবহার করা হয় তাতে সময়কে ন্যানোসেকেন্ডে রাখা হয়। যেহেতু প্রতিটি স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে প্রায় ১২,৬০০ মাইল (২০,৩০০কি.মি.) উঁচুতে থাকে এবং ঘন্টায়  ৬০০০ মাইল(১০০০০কি.মি) বেগে ঘুরতে থাকে,তাই এক্ষেত্রে এর কাল দীর্ঘায়ন ঘটে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, এই কাল দীর্ঘায়নের মান ৪ মাইক্রোসেকেন্ড। তবে অভিকর্ষের প্রভাবে এর মান বেড়ে দাঁড়ায় ৭ মাইক্রোসেকেন্ড বা ৭০০০ ন্যানোসেকেন্ড।

এই পরিবর্তন চোখে পড়ার মত। আপেক্ষিকতার এই প্রভাব যদি বিবেচনা করা না হয়, তাহলে একটি রেস্টুরেন্টের দুরত্ব আপনার বাড়ি থেকে আধা মাইল হলে, একদিন পরই জিপিএসে এর দুরত্ব দেখাবে ৫ মাইল। তাই এক্ষেত্রে কাল দীর্ঘায়নের প্রভাব মোটেও অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়।

 তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আপেক্ষিকতা তাত্ত্বিক বা কল্পনার কোন বিষয় নয়। আমাদের বাস্তব জীবনেরও পরতে পরতে লুকিয়ে আছে আপেক্ষিকতা।

-নাসরুল্লাহ্ মাসুদ

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.