গ্রাফিনের সাহায্যে তৈরি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র বাতি

0
382

গ্রাফিন, কার্বনের এক প্রকার রূপভেদ যা অনেকের কাছেই পছন্দীয় এর গুণাবলীর জন্য। ইস্পাতের চেয়ে শক্তিশালী আর তামার চেয়ে বেশি পরিবাহী এই বস্তুটি। বর্তমানের সিলিকন নির্ভর প্রযুক্তি যে ভবিষ্যতে গ্রাফিন নির্ভর হতে যাচ্ছে এটা যেন না বললেও চলে। গ্রাফিনের বিস্ময়ের তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছে তার আলোক তৈরি করার ক্ষমতা। গবেষকরা আলোক নিঃসরক গ্রাফিন ট্রানজিস্টর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ফিলামেন্ট বাল্বগুলো যেরকম কাজ করে এগুলোও সেরকমই কাজ করে।

অত্যন্ত ক্ষুদ্র স্কেলে কাজ করা গ্রাফিন তন্তু দিয়ে তৈরি করা বাতি বা লাইট বাল্বই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র বাল্ব। এই গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জেমস হন তার এক বিবৃতিতে এমনটাই বলেন “আমরা অপরিহার্যভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে পাতলা ও সরু বাল্ব উৎপন্ন করেছি।” জেমস হন নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।

প্রকৌশলী ও পদার্থবিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই এমন এমন একটা কিছু খুঁজছিলেন যা আলো নিঃসরণ করবে এবং যার আকৃতি হবে অনেক ক্ষুদ্র। এই ধরনের ক্ষুদ্র আলোক নিঃসরকদের খুব সহজেই ইলেকট্রনিক চিপের মাঝে স্থাপন করা যাবে। এই ধরনের নিঃসরকদের বলা হবে ‘ফোটনিক সার্কিট (Photonic circuit)’। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সহ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনেক ন্যানো যন্ত্রপাতির বেলায় এই ধরনের ‘বাল্ব’ খুব কাজে আসবে।

কিন্তু এই ধরনের ক্ষুদ্র বাল্ব নির্মাণে কিছু সমস্যার দেখা দেয়। প্রথমত এত ক্ষুদ্র আকৃতির বাল্ব নির্মাণ করা খুব চ্যালেঞ্জিং দ্বিতীয়ত তাপমাত্রা সমস্যা। প্রকৌশল বিদ্যায় কোনো বস্তু হতে তখনই আলোক নিঃসৃত হয় যখন বস্তুটি প্রচণ্ড পরিমাণ উত্তপ্ত হয়। ক্ষুদ্র বস্তুতে এত উত্তাপ প্রদান করলে বস্তুটি গলে যাবে যা বড় ধরনের সমস্যা।

গ্রাফিন যেহেতু ইস্পাতের চেয়ে শক্তিশালী, তামার চেয়ে বেশি পরিবাহী ও তাপ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন তাই গ্রাফিন এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে। সেই লক্ষে বিজ্ঞানীরা কাজে নেমে পড়লেন এবং সফলও হলেন। তারা জানান গ্রাফিনের এই জিনিসটি উদ্ভাবনের ফলে খুব ক্ষুদ্র স্কেলে অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রা নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার প্রতিবন্ধকতা দূর হবে।

আলোক উৎপাদন

যখন তড়িৎ প্রবাহ ইলেকট্রিক বাল্বের ফিলামেন্টের মাঝে দিয়ে যায় তখন ফিলামেন্টটি খুব উত্তপ্ত হয় এবং জ্বলে উঠে। ফিলামেন্টগুলো সাধারণত উচ্চ পরিবাহী ট্যাংস্টেনের হয়ে থাকে। ইলেকট্রন যখন এর মধ্য দিয়ে চলাচল করে তখন ট্যাংস্টেনের পরমাণুর ইলেকট্রনকে তাদের কক্ষপথ হতে বিচ্যুত হয়ে যেতে শক্তি প্রদান করে (কোয়ান্টাম লম্ফ)। পরে ইলেকট্রনগুলো যখন নিজের কক্ষপথে ফিরে যায় তখন বাড়তি অর্জন করা শক্তিকে ফোটন হিসেবে নির্গত করে, যা আলোক শক্তি হিসেবে আমরা দেখতে পাই। ঐ সময় ফিলামেন্টের তাপমাত্রা ৩ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে উন্নীত হয়! এই উচ্চ তাপমাত্রার জন্যই লাইট বাল্বের অভ্যন্তর বায়ুশূন্য করে রাখা হয় কিংবা নিষ্ক্রিয় গ্যাস ভরে রাখা হয়। সাধারণ বায়ুতে ট্যাংস্টেন এত পরিমাণ তাপমাত্রায় উন্নীত হলে বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে জ্বলে ওঠবে, ফলে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, বাল্ব আর ‘বাল্ব’ থাকবে না।

Picture2

এজন্যই ক্ষুদ্র স্কেলে উচ্চ তাপমাত্রা নিয়ে কাজ করা একটু কষ্টসাধ্য। শক্তিশালী ও অধিক তাপ সহনশীল গ্রাফিকে কোনো একভাবে আলোক উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা গেলে ক্ষুদ্র স্কেলের এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর হবে। এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজে নেমেছিলেন বিজ্ঞানীরা। সফলও হয়েছেন। বাস্তব জীবনেও প্রচুর উপকার বয়ে আনতে পারে এই উদ্ভাবন। যেমন নিত্যদিনের ব্যবহার করা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ক্ষুদ্র চিপ ব্যবহার করতে হয়। এটি এই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে সমস্ত মানবজাতির উপকারে আসবে। বিজ্ঞানীদের এই প্রচেষ্টা হয়তো ক্ষুদ্র স্কেলের গবেষণা তথা ন্যানো প্রযুক্তিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।

সিরাজাম মুনির

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.