রক্তস্বল্পতা দূর করে লোহার মাছ!

0
615

ছয় বছর আগে কানাডার বিজ্ঞান গ্র্যাজুয়েট ক্রিস্টোফার চার্লস যখন কম্বোডিয়াতে ভ্রমণে আসেন তখন দেখতে পান এখানকার মানুষদের মাঝে রক্তস্বল্পতা বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। ড. চার্লস খেয়াল করে দেখেন কান্দাল প্রদেশে যে ছেলেমেয়েরা হবার কথা ছিল উজ্জ্বল ও বুদ্ধিদীপ্ত তারা আদতে হচ্ছে দুর্বল ও বিলম্বিত মানসিক বিকাশের অধিকারী। মহিলাদের মাঝে বিরাজ করছে মাথাব্যথা ও অতিরিক্ত ক্লান্তি। এর ফলে তারা স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে অক্ষম হয়ে যাচ্ছে। অল্প কাজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।

তার উপর গর্ভবতী মহিলারাও সন্তান জন্ম দেবার আগে এবং সন্তান জন্ম দেবার পরে জটিল রোগে ভুগছে। এতে করে জন্মের সাথে সাথেই একটা অপূর্ণতা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে নবজাতকেরা। জন-স্বাস্থ্যের একদমই বাজে অবস্থা। আর এদের অধিকাংশই হচ্ছে রক্তস্বল্পতার কারণে।

রক্তস্বল্পতা সারাবিশ্বেই পরিচিত একটি রোগ। বিশেষত গর্ভবতী মহিলা, কিশোরী বালিকা এবং যুবতী মেয়েরা এই পুষ্টি সমস্যায় ভোগে। কম্বোডিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৫০% মহিলা এই সমস্যায় আক্রান্ত। আর এই সমস্যার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে লোহা (Iron)। দেহে লৌহের স্বল্পতা হলে রক্তের স্বল্পতা দেখা দেয়।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য সুন্দর একটি উপায় হতে পারে আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণ করা কিংবা আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা। এতে দেহে আয়রনের পরিমাণ বাড়বে এবং সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এই এলাকায় এই সমাধান ঠিকঠাকমতো কাজ করে না। সেখানে আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের স্বল্পতা তথা খাদ্যের স্বল্পতা বিরাজমান। আর ট্যাবলেটগুলো সহজলভ্য নয়। যা পাওয়া যায় তা আবার উচ্চ দামের। কোনো জিনিস সহজলভ্য না হলে তার দাম বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তার উপর যাদের পক্ষে ট্যাবলেট সংগ্রহ করার সমর্থ আছে তারা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে এই ট্যাবলেট গ্রহণ করতে চায় না।

সবদিক থেকে এমন নেতিবাচক অবস্থা দেখে ড. চার্লস চিন্তিত হয়ে গেলেন এবং এর জন্য সমাধান খুঁজতে লাগলেন। বিজ্ঞানীদের করা পূর্ববর্তী একটি গবেষণা থেকে তিনি চমৎকার একটি আইডিয়া পেয়ে যান। পূর্ববর্তী ঐ গবেষণায় গবেষকগণ দেখিয়েছিলেন, যেসকল মানুষ লোহার বা ঢালাইয়ের তৈরি পাত্রে তরকারী রান্না করে খায় তারা আয়রনের স্বল্পতায় ভোগে কম। অর্থাৎ লোহা বা ঢালাই থেকে কিছু পরিমাণ লৌহ কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অন্ত্রে যায় এবং দেহে লৌহের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।

এই গবেষণা থেকে উৎসাহিত হয়ে ড. চার্লস ঐ এলাকার মানুষের জন্য তরকারীর পাত্রে লোহার টুকরো দিয়ে দিলেন। লোহার টুকরোগুলোকে আরো একটু বাস্তবতা দেবার জন্য এদের মাছের আকৃতিতে তৈরি করলেন। এটি ব্যবহার করার জন্য গ্রামবাসীদের উৎসাহিত করলেন এবং বছর খানেক পরে দেখা গেল যারা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তাদের মাঝে রক্তস্বল্পতা নেই।

লোহার মাছ।
লোহার মাছ।

লোহার টুকরো যেকোনো আকৃতিরই হতে পারতো। তবে মাছের আকৃতি দেবার কারণ হচ্ছে কম্বোডিয়ান সংস্কৃতিতে মাছ হচ্ছে সৌভাগ্যের প্রতীক।

এটি ব্যবহার করার পদ্ধতিও সহজ। পানির সাথে বা স্যুপের সাথে এটি দিয়ে ১০ মিনিট উত্তপ্ত করে নিতে হবে। এতে করে তরলে আয়রনের পরিমাণ বাড়ে। তারপর ঐ তরলে কিছু লেবু বা লেবুর রস মিশিয়ে নিতে হবে। লেবুর রস মিশিয়ে নেবার কারণ লেবুর রসের উপাদান লৌহকে রাসায়নিকভাবে শোষণ করে নিবে। এবং খেলে শোষিত অবস্থায় দেহে যাবে।

3

ড. চার্লস বলেন যদি কেউ প্রতিদিন নিয়ম মেনে এই লোহার মাছ ব্যবহার করে তাহলে এটি দেহের ৭৫ ভাগ আয়রনের অভাব পূরণ করবে। এটির কার্যকরীতা যাচাইয়ের জন্য কম্বোডিয়ার কয়েকটি গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়। এতে দেখা যায় ১২ মাসের মাঝেই গ্রামের অর্ধেক পরিমাণ মানুষ আর লৌহের স্বল্পতায় ভুগছে না। European Journal of Public Health জার্নালে এই গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়। সবদিক থেকে ইতিবাচক হলে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে। [তথ্যসূত্রঃ বিবিসি]

-সিরাজাম মুনির শ্রাবণ

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.