নক্ষত্রের ইতিকথা

0
840

প্রায় ১৩.৪ বিলিয়ন বছর পূর্বে অসীম ঘনত্বের অতিক্ষুদ্র কোন বস্তু কণা হতে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটে। আবির্ভাবের পর প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর যাবত মহাবিশ্ব ছিল অন্ধকারে চাদরে ঢাকা। এরপর একসময় মহাবৈশ্বিক আলোকবর্তিকা রুপে আগমন ঘটল নক্ষত্রদের। সকল অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে তারা মহাবিশ্বকে উদ্ভাসিত করল আলোর জোয়ারে। রাতের আকাশে মিটিমিটি আলোর ঝলকানি রুপে আমরা যেসব তারা দেখতে পাই তা মহাবৈশ্বিক আলোক শয্যার একটি অতি নগণ্য অংশ মাত্র। খালি চোখে আমরা সাধারণত ২ থেকে ৩ হাজারের মতন তারা দেখতে পাই।

প্রতিটি নক্ষত্রের প্রথম এবং প্রাথমিক গাঠনিক উপাদান হল হাইড্রোজেন গ্যাস। এই হাইড্রোজেন গ্যাসই তাদের সকল শক্তির উৎস। আমাদের জন্ম যেমন মাতৃ গর্ভে তেমনি নক্ষত্রদের জন্ম হয় হাইড্রোজেন গ্যাসের বিশাল মেঘের মাঝে। এদের আমরা বলি “নীহারিকা” (nebula)। এই নীহারিকাগুলোর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য এদের মহাজাগতিক সৌন্দর্যের একটি অন্যতম অংশে পরিণত করেছে।

বিশাল মেঘের নেবুলা

নক্ষত্র সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে হাজার  হাজার টন হাইড্রোজেন গ্যাস ঘনীভূত হয়ে নক্ষত্রের কোর বা কেন্দ্র সৃষ্টি করতে থাকে। এই ঘনীভবনের ফলে কেন্দ্রের চাপ এবং তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং একসময় কোরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান বলয়ের সৃষ্টি হয় যা “প্রোটো স্টেলার ক্লাউড” নামে পরিচিত। একটি প্রোটো স্টেলার ক্লাউড আয়তনে আমাদের সৌর জগতকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। মহাকর্ষ বলের প্রভাবেপ্রতিনিয়ত আরও অধিক পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাস কেন্দ্রীভূত হতে থাকে এবং কেন্দ্রের তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি করতে থাকে। একসময় তাপমাত্রা এতোটাই বৃদ্ধি পায় যে কেন্দ্র হতে উত্তপ্ত গাসের শক্তিশালী জেট নির্গত হয়ে তা কয়েক আলোক বর্ষ ব্যাপী ছড়িয়ে পরে।

প্রায় ১ মিলিয়ন বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং এক সময় কোরের তাপমাত্রা প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডিগ্রীতে পৌঁছে যায়। আর তখনই নক্ষত্রের কেন্দ্র “নিউক্লিয়ার ফিউশন” নামক নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোজেনকে  হিলিয়ামে পরিণত করে শক্তি উৎপন্ন করা শুরু করে এবং নক্ষত্রটি প্রজ্বলিত হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে শিশু নক্ষত্রটিকে ঘিরে প্রোটো স্টেলার ক্লাউড ও জেটের বিলুপ্তি ঘটে। আর এভাবেই একটি নক্ষত্রের জন্ম হয়। এটি হয়তো আগামী সহস্র কোটি বছর ধরে মহাবিশ্বকে আলোকিত করে যাবে।

এই যাবৎ আলোচনায় আমরা নক্ষত্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা পেলাম, এখন প্রশ্ন হল একটি নক্ষত্র কি সারা জীবন একই ভাবে আলো বিকিরণ করে যাবে? না, মহাবিশ্বের কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সবকিছুর মতই এই নক্ষত্রেরও মৃত্যু আছে। একটি নক্ষেত্রের কিভাবে জিবনবসান ঘটবে তা নির্ভর করে তার অভ্যন্তরে জমাকৃত হাইড্রোজেনের পরিমান অর্থাৎ তার ভরের উপর। কম ভরের নক্ষত্ররা সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আলো বিকিরণ করে থাকে। এদের আয়ুকাল গড়ে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন বছর যা মহাবিশ্বের বয়স অপেক্ষা বেশি। কিন্তু এরাও চিরস্থায়ী নয়, একসময় এদের অভ্যন্তরের মজুদকৃত জ্বালানী ফুঁড়িয়ে যাবে এবং এরা পরিণত হবে “হোয়াইট ডুয়ার্ফে” (White dwarf)। আবার মধ্যম আকারের নক্ষত্ররা যাদের ভর সৌর ভরের অর্ধেক হতে দেড় গুণের মধ্যে তারা হোয়াইট ডুয়ার্ফে (White dwarf) পরিণত হওয়ার পূর্বে রেড জায়েন্টে (Red giant) পরিণত হয়। অপেক্ষাকৃত ভারী এইসব নক্ষত্র এদের অভ্যন্তরের হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যাওয়ার পরও হিলিয়ামে  নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটিয়ে শক্তি উৎপন্ন করা শুরু করে। আর এরই ফলে নক্ষত্রটি ফুলে ফুপে বিশাল দানবাকৃতি ধারণ করে। তখন এদের বিশাল লাল দানবের মত দেখায়। তাইতো এদের নাম করন করা হয়েছে “রেড জায়েন্ট”।

আজ থেকে ৫০০ কোটি বছর পর সূর্য যখন তার সমস্ত হাইড্রোজেন শেষ করে ফেলবে,  তখন ধীরে ধীরে এটি পরিবর্তিত হতে থাকবে।  বুধ, শুক্র, ও পৃথিবীকে গ্রাস করে মঙ্গল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আমাদের চিরচেনা সূর্য রেড জায়েন্টে (Red giant) পরিণত হবে। হয়তো তখন আমাদের সৌর জগতটা দেখতে উপরের ছবির মতন হবে। কিন্তু একসময় রেড জায়েন্টের অভ্যন্তরের হিলিয়ামও শেষ হয়ে যায় আর তখন তা হোয়াইট ডুয়ার্ফে (White dwarf) পরিণত হয়। যেসব নক্ষত্রের ভর আরও বেশি অর্থাৎ সৌর ভরের দেড় গুনেরও বেশি তাদের জীবনবসান ঘটে আরও নাটকীয় ভাবে।

এদের অভ্যন্তরের সব হিলিয়াম শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এরা থামে না বরং নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে আরও ভারী ভারী মৌলগুলো সৃষ্টি করতে থাকে।  এইভাবে চলতে চলতে একসময় নক্ষত্রটি এর কেন্দ্রে লোহা উৎপন্ন করতে শুরু করে আর তখনই এটি তার অন্তিম পরিণতির দিক ধাবিত হয়। যখনই নক্ষত্রের কেন্দ্রে লোহা উৎপন্ন হওয়া শুরু হয় এর কোরটি আনস্টেবল হয়ে যায় এবং মুহূর্তের মধ্যে সুপারনোভা নামক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে এর উপাদানসমূহ আলোর কাছাকাছি বেগে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। এই বিস্ফোরণ বহু আলোকবর্ষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে এবং এইসময় নক্ষত্রটির উজ্জ্বলতা পুরো গ্যালাক্সি থেকেও বেশি হয়। এই বিস্ফোরণের ফলেই উদ্ভব ঘটে নিউট্রন স্টার আর ব্ল্যাক হোলের। এই সুপারনোভা বিস্ফোরণ কতটা শক্তিশালী তা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝানো যেতে পারে। পৃথিবী থেকে প্রায় শত আলোকবর্ষ দূরের কোন সুপারনোভা বিস্ফোরণও পৃথিবীর চেহারা চিরতরে পালটে দিতে পারে।

প্রচণ্ড শক্তিশালী এই সুপারনোভা একদিকে যেমন চরম ধ্বংসাত্মক অপরদিকে এরা প্রাণের সঞ্চারকও বটে। আমাদের শরীরের প্রতিটা কার্বন, আমাদের নিশ্বাসের সাথে গ্রহণকৃত প্রতিটা অক্সিজেন, পৃথিবীর প্রতিটা সমুদ্র সৈকতের প্রতিটা সিলিকন, গোল্ড মাইনের প্রতিটা গোল্ড পরমাণু এই সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্ট। আমারা আমাদের চারপাশে ভারী মৌল সমূহের যে প্রাচুর্য দেখতে পাই তা এই সুপারনোভা বিস্ফোরণের জন্য। একভাবে দেখলে সুপারনোভা অনেকটা সদ্য জন্ম নেওয়া একটি মানব শিশুর মতন যা চিৎকারের মাঝে জীবনের আগমনী বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। আজ আমরা আমাদের মহাবিশ্বকে যে রূপে দেখতে পাই তার পুরটাই এই নক্ষত্রদের জন্য। এই অসীম মহাবিশ্বের যেখানেই আমরা চোখ রাখি না কেন অজস্র তারার মেলা দেখতে পাই। আজ থেকে কোটি কোটি বছর পূর্বে যেমন আমাদের মহাবিশ্বের দৃশ্যপট এমন ছিল না তেমনি আজ থেকে হাজার হাজার কোটি বছর পরও মহাবিশ্ব ঠিক এমনটা থাকবে না। মহাবিশ্বে নিত্য পরিবর্তনশীল। বহু কোটি বছরের আবর্তনে মহাবিশ্বের সব নক্ষত্রদের মৃত্যু ঘটবে, যে নক্ষত্ররা একসময় অন্ধকার মহাবিশ্বে আলোর স্পন্দন নিয়ে এসেছিল সেই নক্ষত্ররাই আবার মহাবিশ্বকে অন্ধকারের চাদরে মুড়ে দিবে।

-সাফিউল হোসেন (স্নিগ্ধ)
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.