একটি একক দোলকের কথা চিন্তা করুন চিত্র-১ এর মতো। একে যদি প্রতিবার তার সাম্যাবস্থা থেকে এক দিকে খানিকটা টেনে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে প্রবিবারই সে একটি নির্দিষ্ট পথে দুলতে থাকবে। কিন্তু যদি নিচের ছবিটির মতো দুটি দোলককে একসাথে একটির নিচে আরেকটি যুক্ত করে দ্বৈত দোলক তৈরি করা হয় এবং একদিকে কিছুটা টেনে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে কখনোই দুইবারের গতিপথ (trajectory) একরকম হবে না, বরং প্রতিবারই গতিপথ পুরোপুরি ভিন্ন হবে এবং গতিপথ হবে সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত [১]। কাজেই একক দোলকের গতিপথ যদিও সহজে হিসেব করে বের করে দেওয়া যায় দ্বৈত দোলক বা ডাবল পেন্ডুলামের গতিপথ এভাবে হিসেব করা খুবই মুষ্কিল। আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন একই দোলকের গঠনে যেহেতু পার্থক্য নেই তাই প্রতিবারের দোলনের জন্য এদের উপর পদার্থ বিজ্ঞানের সূ্ত্রও একইভাবে প্রযুক্ত হওয়ার কথা এবং একই ধরণের গতিপথ পাওয়ার কথা। হ্যাঁ, পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র নিশ্চয়ই একই ভাবে প্রযুক্ত হবে কিন্তু এধরনের একটি দ্বৈত দোলকের গতিপথ অতিমাত্রায় এর প্রাথমিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে এবং এর সাথে অনেকগুলো ভ্যারিয়েবল যুক্ত থাকে। মানুষের পক্ষে যেহেতু প্রতিবার খুব সূক্ষভাবে একই অবস্থান থেকে একটি দ্বৈত দোলককে টেনে ছেড়ে দেওয়া মুষ্কিল ফলে সামান্যতম প্রাথমিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণেই দ্বৈত দোলকের গতিপথ পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত (বিক্ষিপ্ত শব্দটি অবশ্য এখানে যথাযথ নয়, বরং অনির্নেয় বলাই শ্রেয়, পরবর্তীতে আমরা দেখব কেন) হয়ে যায়। এই ধরনের পরিস্থিতি যা প্রাথমিক অবস্থার সূক্ষতার উপর অতিমাত্রায় সংবেদনশীল গণিতে তার জন্য একটি তত্ত্ব রয়েছে, যাকে বলা হয় chaos theory (বাংলায় বলা যেতে পারে বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব বা নৈরাজ্য তত্ত্ব!) [২]।
Chaos theory টার্মটি যদিও আপাত বিশৃঙ্খল দেখতে বিভিন্ন ঘটনা বা পরস্থিতি থেকে এসেছে কিন্তু এর উদ্দেশ্য বা আলোচ্য বিষয় হলো নানাবিধ বিশৃঙ্খল ঘটনা বা বিক্ষিপ্ত উপাত্তের অন্তর্নিহিত শৃঙ্খলা বা পাটার্নটি খুঁজে বের করা। যদিও ঊনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই choatic সমীকরণ সম্বন্ধে গণিতবিদদের ধারনা ছিলো তথাপি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের উপস্থাপক MIT এর আবহাওয়াবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জ (Edward Lorenz)। ১৯৬০ সালে তিনি আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি একটি কম্পিউটার সেটআপ করে তাতে আবহাওয়া সংক্রান্ত ১২ টি সমীকরণ ব্যবহার করে তাত্ত্বিকভাবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নির্ধারণের একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেন। তারপর এতে আবহাওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন গণনা সিমুলেট (simulate) করা শুরু করেন। ১৯৬১ সালের কোনো একদিন তিনি এমনই একটি সিমুলেশন করছিলেন। সময় বাঁচানোর জন্য তিনি তাঁর আগের সিমুলেশন থেকে প্রাপ্ত গ্রাফের একটি মাঝামাঝি বিন্দু থেকে সিমুলেশন শুরু করলেন এবং দেখলেন ঘন্টাখানেকের মধ্যে গ্রাফের গতিপথ আগের গতিপথ হতে পুরোপুরি বদলে গেছে, এবং একটির সাথে আরেকটির কোনো মিলই নেই। তিনি এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলেন কম্পিউটার দশমিকের পর ছয়ঘর পর্যন্ত গণনা করে, কিন্তু কাগজ বাঁচানোর জন্য তিনঘর পর্যন্ত প্রিন্ট করে রাখে। তিনি যখন পুনরায় মাঝখান থেকে সিমুলেশন শুরু করেছিলেন তখন ছয়ঘরের বদলে কাগজ থেকে সেই তিনঘর পর্যন্ত সংখ্যাই সিমুলেশন দিয়েছিলেন এবং এতে যেই সামান্য ব্যবধান তৈরি হয় তাতেই অল্প সময়ের মধ্যে গণনা পুরোপুরি বদলে যায়।
সেই সময় ব্যবহারিক গবেষণার ক্ষেত্রে Chaos theory সম্বন্ধে কারো কোনো ধারনা ছিলো না, এবং প্রচলিত সব ধারনা অনুযায়ীই দুটি গ্রাফ খুবই কাছাকাছি হওয়ার কথা ছিলো। এবং একজন গবেষক তিনটি সিগনিফিক্যান্ট ফিগার (significant figure) পর্যন্ত তাঁর গণনার যথার্থতা পেলেই নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন। কারো কল্পনাতেই ছিলো না চতুর্থ বা পঞ্চম ঘরের কোনো অংকে পার্থক্যের কারণে কোনো পরীক্ষার ফলাফল আমূল বদলে যেতে পারে। কিন্তু লরেন্জের পরীক্ষা থেকে বোঝা গেলো এই ধারনা ভুল এবং তথ্যে এই ধরনের একটি পরিবর্তন পরীক্ষাগত ত্রুটি, বা ব্যকগ্রা্উন্ড নয়েজ বা মানুষে মানুষে যে পার্থক্য তার কারণেই সহজে তৈরি হয়ে যেতে পারে এবং ফলাফল পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। যেই উদাহরণটির মাধ্যমে এই লেখাটি শুরু করেছিলাম সেটি নিয়েই চিন্তা করা যাক। দ্বৈত পেন্ডুলামটিকে আমরা শুরুতে ঠিক কোন অবস্থান থেকে ছাড়ছি তার উপর নির্ভর করে এর গতিপথ অল্পসময়ের মধ্যে পুরোপুরি বদলে যাবে এবং অনুমানের বা গণনার অযোগ্য হয়ে পাড়বে। আমরা হাত দিয়ে কাজটি করে কখনোই দুটি দোলনের গতিপথ একই রাখতে পারব না।
এই পরীক্ষার ফলাফল থেকে প্রাপ্ত ধারনাটি অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থায় সামান্য পরিবর্তনে ফলাফল আমূল পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি পরবর্তীতে butterfly effect বা প্রজাপতি প্রভাব নামে প্রচলিত হয়ে যায়। এটি একটি মেটাফোর, লরেন্জ নিজেই এই প্রচলনের জন্য দায়ী। ১৯৭২ সালে তিনি একটি আলোচনায় মজা করে বলেছিলেন কিছু কিছু ঘটনা তার প্রারম্ভিক পরিস্থিতির উপর এতোই স্পর্শাকতর যে খুব সামান্য পরিবর্তনে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তিনি বলেছিলেন “হয়তোবা ব্রাজিলের একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোর প্রভাবে কয়েক সাপ্তাহ পর টেক্সাসে টর্নেডো তৈরি হয়ে যেতে পারে। একই বছর তাঁর সেই লেকচারটি প্রকাশিতও হয় ” Does the Flap of a Butterfly’s wing in Brazil Set Off a Tornado in Texas? [৩] (ব্রাজিলের একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোয় টেক্সাসে কি টর্নেডো হয়?)” শিরোনামে। যদিও একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোতে টেক্সাসে টর্নেডো হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে এধরনের অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, যা পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
যাই হোক। আপাততঃ Chaos এর গাণিতিক দিকটি নিয়ে আরেকটু এগোনো যাক। Chaos theory এর সংজ্ঞা দেওয়ার সময় আমরা বলেছি এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশৃঙ্খলার মধ্য হতে শৃঙ্খলা খুঁজে বের করা যেন এগুলোকে তত্ত্বে ফেলে দেওয়া যায়। এর জন্য আমরা একটি গতীয় ব্যবস্থা (dynamic system) নিয়ে শুরু করতে পারি। সময়ের সাথে কোনো বিন্দুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটলে আমরা তাকে একটি গতীয় ব্যবস্থা বলতে পারি। একটি সরল বা একক দোলক এধরনের একটি গতীয় ব্যবস্থা। এই দোলকের প্রান্তবিন্দুটি সময়ের সাথে একটি বৃত্তাকার পথে একদিক থেকে আরেকদিকে ক্রমাগত যেতে থাকে। এই গতীয় ব্যবস্থাটিকে আমরা স্পন্দনের সমীকরণ দিয়ে সহজেই প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু একটি জটিল দোলকের গতিপথ এমন সুনির্দিষ্ট নয়। যদিও এটিকেও বিভিন্ন গতীয় সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে কিন্তু লরেঞ্জের সিমুলেশনের মতোই এই ক্ষেত্রে গতীয় সমীকরণের প্রারম্ভিক মানের সামান্যতম হেরফের হলেই তার গতিপথ আমূল বদলে যাবে কেননা এটি একটি Chaotic system।
তবে chaotic system এরও সবকিছু পুরোপুরি chaotic নয়। অনেক chaotic system আছে যাতে গতীয় ব্যবস্থার বিন্দুটি সময়ের সাথে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু বা একগুচ্ছ বিন্দুর কাছাকাছি অবস্থান করার প্রবণতা দেখায়। যদি বাস্তব ক্ষেত্রে এর উদাহরণ দিতে হয় তাহলে পরিবেশের তাপমাত্রার কথা বলা যেতে পারে। জুন মাসের ১২ তারিখে ঢাকা শহরের কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানের তাপমাত্রা আমরা একমাস আগে থেকে হিসেব করে বলে দিতে পারব না, কেননা এটি একটি chaotic ব্যাবস্থা, কিন্তু এটি বলতে পারব যে এই তাপমাত্রা হিমহিম -১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যাবে না, বা গনগনে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও হয়ে যাবে না। আমরা এটুকু বলতে পারব যে এই তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (আনুমানিকভাবে ধরে নিলাম) মধ্যে থাকার প্রবণতা দেখাবে। এইখানে তাপমাত্রা একটি chaotic গতীয় ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও এর মান কিছু নির্দিষ্ট বিন্দুর আশেপাশে ঘুরঘুর করবে। এই বিন্দুগুলো হলো ২৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি । একটি গতীয় ব্যবস্থা যে বিন্দুগুলোর আশেপাশে ঘুরঘুর করার প্রবণতা দেখায় গণিতে সেগুলোকে বলা হয় আকর্ষক বা attractor [৪][৫]. গতীয় ব্যবস্থা যদি একটি বিন্দুর কাছাকাছি থাকার প্রবণতা দেখায় তাহলে সেই আকর্ষককে বলা হয় বিন্দু আকর্ষক। আর যদি একগুচ্ছ বিন্দুর কাছাকাছি থাকার প্রবণতা দেখায় তাহলে গুচ্ছের ধরণ অনুযায়ী সেগুলোকে বক্র (যদি বিন্দুগুচ্ছে একটি বক্র রেখা নির্দেশ করে) আকর্ষক, বৃত্ত আকর্ষক (যদি বিন্দুগুচ্ছ একটি বৃত্ত নির্দেশ করে) বা অন্যান্য নামে নামকরণ করা হয়। Chaotic ব্যবস্থার সাথে আকর্ষকের এই সম্পর্ক খুঁজে বের করার বিষয়টিকে Chaos তত্ত্বের অন্যতম সাফল্য হিসেবে ধরা হয়। নিচের চিত্রে বিন্দু ও বৃত্তাকার আকর্ষক দেখানো হলো। প্রথমটিতে সিস্টেমের গতিময় বিন্দুটি একটি বিন্দু অভিমুখে গমনের চেষ্টা করছে আর দ্বিতীয় চিত্রে একটি বৃত্তের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছে।
তবে এডওয়ার্ড লরেঞ্জ একটু অদ্ভুৎ ধরনের আকর্ষক খুঁজে পান। তিনি একটি সরল আবহাওয়া ব্যবস্থার মডেল তৈরি করেন কয়েকটি সমীকরণ ব্যবহার করে। যেমন: একটি টর্নেডো প্রাথমিক ভাবে তিনটি বিষয় তাপমাত্রা, আদ্রতা, বায়ু প্রবাহ এই তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে এটি যদি আমরা ধরে নিই সরলতার অযুহাতে এবং এবং সময়ের সাথে এদের পরিবর্তন হিসেবে করার চিন্তা করি তাহলে তিনটি প্যারামিটারের জন্য আমার x, y, z অক্ষ কল্পনা করে নিতে পারে যারা সময় t এর সাপেক্ষে পরিবর্তিত হবে। এভাবে লরেঞ্জ নিচের ডিফারেনশিয়াল সমীকরণগুচ্ছ পান।
এই ধরনের ব্যবস্থায় আকর্ষক থাকলে তা কেমন হতে পারে? আমরা পরিচলন স্রোত সম্বন্ধে জানি। একটি চুলায় পাত্রে যদি পানি নিয়ে তাপ দেওয়া হয় তাহলে নিচের উত্তপ্ত পানি উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং উপরের অপেক্ষাকৃত শীতল পানি নিচের দিকে নামতে থাকে। এভাবে একটি পরিচলন স্রোত তৈরি হয়। পানির কোন অণুটি ঠিক কোন পথে চলবে তা বোঝা না গেলেও এই যে একটি লুপ অনুযায়ী তার গমনের প্রবণতা থাকবে এটাকে আমরা আকর্ষক হিসেবে চিন্তা করতে পারি। প্রকৃতিতে বায়ুপ্রবাহ, কিংবা মেঘের আকৃতি প্রভৃতি এই আকর্ষকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। চিত্রের মেঘের গঠন দ্রষ্টব্য।
লরেঞ্জ যে সমীকরণ গুচ্ছ তৈরি করেছেন সেগুলোও একটি গতীয় ব্যাবস্থার অংশ এবং এগুলোকে যদি আমরা x, y, z এর নির্দিষ্ট মান ধরে (সবগুলোকে ১.০০০ ধরে নেওয়া হলো) সময়ের সাথে ত্রিমাত্রিকভাবে স্থাপন করার চেষ্টা করি তাহলে নিচের গ্রাফটি পাব।
এই গ্রাফটিকে y অক্ষবরাবর দেখলে একটি প্রজাপতির মতোই দেখায় কাকতালীয় ভাবে, তাই গ্রাফটিকে অনেকসময় লরেঞ্জের প্রজাপতি বা Lorenz’s butterfly বলা হয়, যদিও প্রথমোক্ত প্রজাপতির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই [৬]। এই গ্রাফের একটা মজার বিষয় আছে। আমরা আগের বিভিন্ন গতীয় ব্যবস্থায় যেমন আকর্ষক পেয়েছি এই ব্যবস্থায়ও তেমনি আকর্ষক আছে তবে একটি নয় দুটি (প্রজাপতির দুটি পাখায় দুটি বিন্দু আকর্ষক)। এই ব্যবস্থায় একটি বিন্দু গতীয় অবস্থায় চলতে চলতে হঠাৎ হঠাৎ আকর্ষক পরিবর্তন করে এবং ঠিক কোন সময় আকর্ষক পরিবর্তন করবে তা বলা দুষ্কর। এইধরনের অদ্ভুত আকর্ষক ব্যবস্থাকে সত্যিই অদ্ভুত আকর্ষক বা strange attractor বলা হয় [৭]। এই ধরনের ব্যবস্থায় আমরা বলতে পারবনা একটি সিস্টেম আদি অবস্থা থেকে সামান্য পরিবর্তন করে দিলে সেটি ঠিক কোন সময় কোন আকর্ষকের প্রতি আকৃষ্ট হবে। আমরা যদি x, y এবং z এর মান সামন্য পরিবর্তন করে দিই তাহলেই আকর্ষকের পরিবর্তনের সময় পুরোপুরি বদলে যাবে। প্রথম কয়েকটি লুপ হয়তো ঠিক থাকবে বা অনুমানযোগ্য হবে কিন্তু তারপরই বিপর্যয় শুরু হবে এবং এটি পুরোপুরি একটি বিশৃঙ্খল গতীয় ব্যবস্থায় পরিণত হবে। এটি একটি সরল ব্যবস্থা, বাস্তবে কোন স্থানের আবহাওয়া কেবলমাত্র তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে না বরং এর সাথে অনেকগুলো ভ্যারিয়েবল যুক্ত থাকে। আমরা যদি এই ভ্যারিয়েবলগুলোর সবগুলো ঠিকঠাক মতো বসাতে পারি তাহলেও হয়তোবা প্রথম কয়েকটি লুপ পর্যন্ত সেটি মোটামুটি অনুমানের কাছাকাছি মান প্রদান করবে কিন্তু তারপরই বিশৃঙ্খলা শুরু হবে। আমরা ভ্যারিয়েবলগুলো যত নিখুঁতভাবে হিসেব করব ততোই হয়তোবা সময়ের সাথে অনুমিত ফলাফল মিলবে বেশী কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে বিপর্যয় এড়ানো যাবে না। বরং আমরা যদি আবহাওয়ার ফলাফল ১০গুণ বেশী নিখুঁত করি তাহলে ১০ গুণ বেশি সময়ের জন্য পূর্বাভাস পাওয়া যাবে না বরং অনুমান সামান্য সময়ের জন্যই বেশী যথার্থ হবে। এসব কারণেই ৫/৬ দিনের বেশী আগে কোনো স্থানের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া যায় না।
আমাদের আধুনিক জীবনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত অনেক কিছুই chaotic আচরন করে। এটা অর্থনীতির সাথেও সম্পর্কিত। এই কারণেই বোধহয় আমরা অনেক সময় দাতা দেশের সামান্য অনুদানের প্রতি মুখ চেয়ে থাকি যা হয়তো নিজেদের অর্থায়নেও করতে পারি। এই ক্ষেত্রে ঝুঁকি না নেওয়ার চেষ্টা করা হয় কারণ সামান্য অর্থনৈতিক সংকট থেকে বিপুল বিপর্যয় তৈরি হয়ে যেতে পারে। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে যেসব অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়েছে তা ছোটখাট বিষয় থেকেই সূত্রপাত হয়েছে। যখন প্রচলিত VCR ব্যবস্থার ভিডিও টেপ এর পাশাপাশি Sony Betamax রেকর্ডিং সিস্টেম চালু করল তখন অর্থনীতিবিদগণ ভেবেছিলেন শিঘ্রই বাজারে দুই ফরম্যাটের ভিডিওর প্রচলন সমান হয়ে যাবে কিন্তু তবু বিটাম্যাক্স ব্যার্থ হয়ে গিয়েছিলো কারণ প্রচলিত VHS টেপে খুব সামান্য পরিমান বেশী সময় রেকর্ড করা যায় এবং তাতে ফিচারফিল্মগুলো এঁটে যায়। এই সামান্য পার্থক্য অননুমেয় পরিস্থিতি তৈরি করেছিলো [৮]।
তিন বস্তু সমস্যা (three-body problem) chaotic system এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। দুটি মহাজাগতিক বস্তু যখন একটি অপরটির সাপেক্ষে প্রদক্ষিণ করে তখন তারা একটি সাম্যাবস্থায় থাকে তাই তারা স্থিতিশীল থেকে ঘুরতে পারে। কিন্তু যদি একটি গ্রহের তিনটি উপগ্রহ থাকে এবং তাদের গতি বিভিন্ন ধরনের হয় তাহলে একটি বস্তুর উপর অন্যগুলোর প্রভাবে তাদের একটি সাম্যাবস্থায় পৌঁছানো কষ্টকর হওয়ার কথা এবং সিস্টেম কোনো এক সময় বিপর্যয়ে পড়ার কথা। কিন্তু তারপরও আমরা একাধিক উপগ্রহ বিশিষ্ট গ্রহগুলোর সিস্টেমকে স্থিতিশীল পাই। এর কারণ হচ্ছে উপগ্রহগুলো যখন গ্রহকে আবর্তন করে ঘুরতে থাকে তখন তাদের পর্যায়টি পুরোপুরি সুষম হয় না বরং কিছুটা chaotic হয়। ফলে এই উপগ্রহটির পাশ দিয়ে যখন অন্য উপগ্রহ অতিক্রম করে তখন তার প্রভাব এই chaotic গতির কারণে ক্রমশঃ বাতিল হয়ে যায়। অথাৎ chaos ই বরং এই ব্যবস্থায় order বা শৃঙ্খলা তৈরি করছে [৯]!
পৃথিবীর আবহাওয়ার দিকেই তাকানো যাক। শুরুতেই আবহাওয়ার বিষয়বস্তুগুলো পুরোপুরি chaotic বলে এসেছি। কিন্তু আবহাওয়া এতো বেশী ভ্যারিয়েবলের উপর নির্ভরশীল যে এবং এরা এমনই chaotic আচরণ করে যে একটি উপর আরেকটির প্রভাব প্রবল হতে পারে না, তাই আমাদের পৃথিবী হঠাৎ করে প্রাণ ধারনের অনুপযোগী হয়ে যায় না বরং ভ্যারিয়েবলগুলোর মান সীমিত পাল্লার মধ্যে থাকে। এই কারণে ব্রাজিলে বিচরণকারী কোনো প্রজাপতি পাখা ঝাপটালে তার প্রভাবে কয়েক সাপ্তাহ পর টেক্সাসে টর্নেডো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়। প্রারম্ভিক ছোটখাট কোনো ঘটনার প্রভাব হয় প্রলয়ঙ্কারী। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন সার্বিয়ার নাগরিক গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রান্জ ফার্দিনান্দ এবং তাঁর স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করেন। এই ঘটনার ফলাফল স্বরূপ পরবর্তীতে আরো কিছু ঘটনা ঘটে যার পরিণতিতে মাসখানেক পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, যেই যুদ্ধে এক কোটি ষাট লাখ সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় এবং ২ কোটি মানুষ আহত হয় [১০, ১১]। ১৯১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই একজন ব্রিটিশ সৈন্য হেনরি টেনডি (Henry Tendy) একজন আহত জার্মান সৈন্যের মুখোমুখি হন এবং নিজের জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। সেই জার্মান সৈন্যের নাম ছিলো এডলফ হিটলার [১২], বাকী ইতিহাস উল্লেখ করাই বাহুল্য! রোসা পার্ক (Rosa Parks) ছিলেন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিক অধিকার আন্দোলনকর্মী। ১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি অ্যালাবামায় একজন বাস চালকের নির্দেশ অনুযায়ী একজন শ্বেতাঙ্গকে নিজের আসন ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর দেখা-দেখি আরো দুজন নারী Irene Morgan এবং Sarah Louise Keys তাঁকে অনুসরণ করেন এবং Montgomery Improvement Association গড়ে তোলেন। এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয় অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় এবং অপরিচিত একজন ব্যক্তি ডেক্সটার এভিনিউ ব্যাপ্টিস্ট চার্চের মিনিস্টার মার্টিন লুথার কিং-কে। তার পরবর্তী ঘটনা এবং ইতিহাস সবাই মোটামুটি অবগত [১৩]। ১৯৯১ সালে টিমবার্নাস লী ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওযেব প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথম ওয়েব পেইজ পাবলিশ করেন [১৪]। এই পেইজে নির্দেশনা ছিলো কিভাবে প্রাথমিক ওয়েব ব্যবহারীরা নিজেদের ওয়েব পেইজ নির্মান করবে যা সমগ্র বিশ্বের কাছে দৃশ্যমান হবে। সেটি শুরুতে মোটেও প্রচলিত কিছু ছিলো না। লী ওয়াল্ড ওয়াইড ওয়েব থেকে একটি পয়সাও উপার্জন করতে পারেন নি। বর্তমানে ওয়াল্ড ওয়াইড ওয়েব ছাড়া আমরা একটি মূহুর্তও চিন্তা করতে পারি না। এধরনের ঘটনা হাজার হাজার বর্ণনা করা যেতে পারে।
তবে শুরুতে যেমন বলা হয়েছে, chaos system গুলোকে যদিও আগে থেকে গণনা করে বের করা দুঃসাধ্য কিন্তু তবু এগুলো বিক্ষিপ্ত নয়। কেননা, এই সিস্টেমগুলো deterministic system. অর্থাৎ এই সিস্টেমগুলো সুনির্দিষ্ট! সুনির্দিষ্ট কেন? কারণ এই সিস্টেমগুলোকে সুনির্দিষ্ট সমীকরণ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। এই সিস্টেমগুলো প্রাথমিক পরিস্থিতির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল তারমানে এই নয় যে এরা নিজেদের ইচ্ছামতো চলে। আমরা যদি প্রাথমিক পরিস্থিতি বা প্যারামিটারগুলোকে সুক্ষভাবে প্রতিবার সুনির্দিষ্টভাবে প্রযুক্ত করে দিতে পারি তাহলে প্রতিবারই একই গতিপথই পাওয়া যাবে। Deterministic system এর বিপরীত প্রক্রিয়া গুলো হচ্ছে probabilistic system. এই সিস্টেমগুলো সম্ভাব্যতার উপর নির্ভর করে। শ্রডিঞ্জারের বিড়ালের সিস্টেমটি একটি probabilistic system. একটি তেজস্ক্রিয় পরমাণু থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটবে কিনা তা কোয়ান্টাম বিক্ষিপ্ততার আলোকে চিন্তা করতে হবে, সেটি সম্ভাব্যতার আলোকে ঘটবে এবং আমরা আগে থেকে কোনোভাবেই বলে দিতে পারব না এটি বিকিরণ করবে কি করবে না, তাই এটি একটি probabilistic system। তবে মজার বিষয় হলো Deterministic system কে প্রোবাবলিস্টিক সিস্টেম এবং probablistic system কে deterministic system হিসেবে ধরে নেওয়া যায় অনেক সময়। যেমন: একটি মুদ্রা নিক্ষেপ করলে হেড ও টেল ওঠার সম্ভাবনা আমরা ৫০-৫০ ধরে নিতে পারি সম্ভাব্যতা অনুযায়ী, কিন্তু এটি আসলে deterministic system. আমরা যদি প্রতিবার ঠিক একইভাবে মুদ্রা নিক্ষেপ করতে পারি তাহলে এর একই পিঠই আমরা সর্বদা পাব। এমন যন্ত্র উদ্ভাবিত হয়েছে যা প্রতিবার মুদ্রা নিক্ষেপে একই ফলাফল তৈরি করতে পারে। এই সিস্টেম chaotic এবং তাই deterministic তবুও probabilistic প্রয়োজনে আমরা ব্যবহার করি (টস ইত্যাদি করার জন্য)। অপর দিকে আমি যদি এক মোল তেজস্ক্রিয় পরমাণু নিয়ে একটি প্রক্রিয়া শুরু করতে চাই তাহলে কোন পরমানুটি কখন তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটাবে তা না জানলেও সার্বিকভাবে আমরা জানি যে শতকরা কতগুলো পরমাণু বিকিরণ ঘটাবে। যেহেতু এক মোল একটি বিপুল সংখ্যক পরিমান (১.৬২ X ১০^২৩ টি পরমাণু বা ১৬২ লিখে তার পরে ২১ টি শূন্য লিখলে যেই সংখ্যা হবে সেই সংখ্যা) তাই সর্বদাই আমরা একমোল থেকে সুনির্দিষ্ট সংখ্যক বিকিরণ পাব (সম্ভাব্যতা অনুযায়ী) এবং এটিকে আমরা deterministic প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারব।
তথ্যসূত্র:
[১] http://scienceworld.wolfram.com/physics/DoublePendulum.html
[২] Kellert, Stephen H. (1993). In the Wake of Chaos: Unpredictable Order in Dynamical Systems. University of Chicago Press. p. 32. ISBN 0-226-42976-8.
[৩] http://eaps4.mit.edu/research/Lorenz/Butterfly_1972.pdf
[৪] http://mathworld.wolfram.com/Attractor.html
[৫] https://en.wikipedia.org/wiki/Attractor
[৬] https://en.wikipedia.org/wiki/Lorenz_system
[৭] http://www.stsci.edu/~lbradley/seminar/attractors.html
[৮] http://www.theguardian.com/technology/2015/nov/10/betamax-dead-long-live-vhs-sony-end-prodution
[৯] http://www.nature.com/scitable/blog/student-voices/nietzsches_butterfly_an_introduction_to
[১০] http://www.telegraph.co.uk/history/world-war-one/inside-first-world-war/part-one/10273752/gavrilo-princip.html
[১১] https://en.wikipedia.org/wiki/Gavrilo_Princip
[১২] http://www.bbc.com/news/uk-england-28593256
[১৩] http://americanhistory.mrdonn.org/RosaParks.html
[১৪] https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_the_World_Wide_Web
-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[ফেসবুক প্রোফাইল]
[…] যায় না। অনেকটা বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব বা কেওস থিওরির মতো। কেওস থিওরিতে ‘বাটারফ্লাই […]