বাদামী ঘোড়া কি রাতে কালো দেখায়? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী পিছু ধাওয়া করেছিলেন বাজিকরদের। গিয়েছিলেন রেসের ময়দানে, বাইজির আস্তানায়। কালো ঘোড়া, বাজি আর বিজ্ঞান শেষমেষ অমৃতের মৃত্যু রহস্যের বড় ক্লু হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানীরাও একেকজন সত্যান্বেষী। ব্যোমকেশ কিংবা কীরিটি রায়ের চেয়ে ঢের জটিল রহস্য হাজির হয় তাঁদের সামনে। বিজ্ঞান ও আর গণিতের ক্লু ধরে ধরে সেসব রহস্যের সমাধান করেন তাঁরা। গোয়েন্দা বিজ্ঞানীদের খোঁজ মেলে কাতারে কাতারে। কিন্তু কেমন হয়, যদি শোনেন বিজ্ঞানীরা নিজেই একেকজন তুখোড় বাজিকর, কারো কারো বাজির নেশা আবার ফ্যানাটিক পর্যায়ের!
অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি, ‘পাউলির অববর্জন নীতি’র কারণে যিনি বিখ্যাত। এই পাউলিই সর্বপ্রথম নিউট্রন কণার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ভবিদ্বাণীর পেছনে রয়েছে আরেক মজার ঘটনা। ১৯২৯ সাল। ড্যানিস বিজ্ঞানী নীলস বোরের তখন জগতজোড়া খ্যাতি। পরমাণু মডেলের কারণে। বোর একটা পরামর্শ চেয়ে চিঠি লিখলেন পাউলিকে। বোর পাউলির চেয়ে ১৫ বছরের বড়, ততদিনে নোবেল প্রাইজও পেয়ে গেছেন। তবুও ২৯ বছর বয়সী জুনিয়র বিজ্ঞানীর কাছে পরামর্শ কেন? কারণ, পাউলি স্পষ্টবক্তা হিসেবে বিখ্যাত। কোনও বিজ্ঞানীর তত্ত্ব ঠিক মনে না করলে, সরাসরি বলে ফেলতেন তাঁর বক্তব্য। পাউলি বোরের ধারণার সাথে একমত হতে পারেননি। জবাবে লিখেছিলেন, ‘বিকিরণ বিষয়ে আপনার ধারণা মোটেও সন্তোষজনক নয়। আপাতত আপনার ধারণা ঘুমিয়ে থাকুক আর নক্ষত্ররা আলো দিক শান্তিতে…!’
ভর-শক্তির নিত্যতা সূত্র আছে। সেই সূত্রে বলে, মহাবিশ্বের ভর-শক্তির পরিমাণ সবসময় এক। নতুন করে ভর-শক্তির জন্ম দেওয়া যাবে না আবার মোট ভর-শক্তির কমও হবে না। শুধু ভর আর শক্তিকে এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় রূপান্তর করা যাবে। কিছু মৌলিক পদার্থ তিন ধরনের রশ্মি বিকিরণ করে: আলফা, বিটা ও গামা। ফলে ভাঙন ধরে এদের নিউক্লিয়াসে। ভাঙনের পর সেই নিউক্লিয়াস অন্য পরমাণুর নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। আলফা ও গামা রশ্মি ক্ষয়ে কোনও সমস্যা দেখা যায় না। কিন্তু গোল বাঁধে বিটা রশ্মি বিকিরণের সময়। যেসব পরমাণু বিটা রশ্মি বিকিরণ করে, মনে হলো, তারা ভর-শক্তির নিত্যতা লঙ্ঘন করছে। ট্রিটিয়ামের কথাই ধরা যাক। ট্রিটিয়াম হলো একটা প্রোটন ও দুটো নিউট্রন যুক্ত হাইড্রোজেনের আইসোটোপ। ট্রিটিয়াম বিটা রশ্মি নিঃসরণ করে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। ফলে কিছুটা কমে যায় ট্রিটিয়ামের ভর-শক্তি। অন্যদিকে কিছুটা ভর-শক্তি নিয়ে পরমাণু থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে ইলেকট্রন বা বিটা রশ্মি। ট্রিটিয়ামের হারানো ভরশক্তি আর নিউক্লিয়াস থেকে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া ইলেকট্রনের ভরশক্তির সমান হওয়া উচিৎ। কিন্তু হিসাব কষে দেখা গেল, বিটা রশ্মির ইলেক্ট্রনের ভরশক্তি কিছুটা কম। তাহলে বাকি ভরশক্তি গেল কোথায়?
বিজ্ঞানীরা অনেক মাথা খাটিয়েও এর সমাধান বের করতে পারেনি। তখন বোর প্রস্তাব করলেন, ভর-শক্তির নিত্যতা সূত্র কাজ করছে না এখানে। তাঁর যুক্তি পরমাণুর ভেতরে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের অনেক সূত্রই খাঁটে না, তাই হয়তো ভর-শক্তির নিত্যতা সূত্রও এখানে খাটবে না। এই প্রস্তাবটাই বোর জানিয়েছিলেন পাউলিকে লেখা চিঠিতে।
পাউলি ভর-শক্তির নিত্যতাকে বাদ দিতে চাইলেন না। কারণ, আলফা ও গামা রশ্মি বিকিরণের ভর-শক্তির নিত্যতা বজায় থাকে। বোরের কথা মানলে সেখান থেকেও ভর-শক্তির নিত্যতা সুত্র বাদ দিতে হয়। আর সেটা করতে গেলে পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক বিষয়ই ওলট-পালট হয়ে যাবে। পাউলি একটু অন্যভাবে ভাবতে শুরু করলেন। ভাবলেন, হারানো ভরটুকু নিশ্চয়ই অন্য কোনও অদৃশ্য কণায় পরিণত হয়। সেই কণাটার চার্জ নেই। চার্জবিহীন কণা অন্য বস্তুর সাথে মিথষ্ক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সম্ভবনা খুব কম। এজন্য একে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। চার্জযুক্ত ইলেকট্রন, প্রোটন ততদিনে পাওয়া গেছে কিন্তু নিউট্রন তখনও আবিষ্কার হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা এটা নিশ্চিত ছিলেন বিটা ক্ষয়টা হয় নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে এবং সেটার জন্য প্রোটন দায়ী নয়। অন্য কোনও উৎস থেকে সেটা আসছে। পাউলি অঙ্ক কষে তাঁর তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
পাউলি তখন ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়নে জর্জরিত। স্ত্রীর সাথে সংসার ভেঙে গেছে। স্ত্রী বিয়ে করেছেন আরেক রসায়ন বিজ্ঞানীর সাথে। মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত। গ্যালন গ্যালন মদ গিলেছেন। আবার মনোবিদের কাছে চিকিৎসা চলছে। অবসাদ ভুলতে নাচগান আর পার্টিতে হৈ হুল্লোড় করে বেড়াতেন।
১৯৩১ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ জেমস চ্যাডউইক পরামাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতরকার তৃতীয় কণাটি আবিষ্কার করলেন। অনেকে ভাবলেন এই নতুন কণাটাই বোধহয় পাউলির ধারণা করা নিউট্রিনো। কিন্তু পাউলির হিসাবের থেকে এই কণাটার ভর অনেক বেশি, প্রায় প্রোটনের সমান। শিগগিরই জানা গেলে সদ্য আবিষ্কৃত নিউট্রন থেকেই মূলত বিটা রশ্মির ক্ষয় হয়। ফলে জš§ হয় একটা ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর। সাথে একটা প্রোটনের জš§ হয়। ওটা রয়ে যায় নিউক্লিয়াসের ভেতরে। ফলে ট্রিটিয়ামের নিউক্লিয়াস পরিণত হয় হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে।
সে বছরই ইতালিতে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের আয়োজোন করলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি। পাউলি গেলেন সেখানে। তবে সম্মেলনে যোগ দিতে নয়, ফার্মির সাথে নতুন কণাটির বিষয়ে আলোচনা করতে। পাউলির কথার গুরুত্ব বুঝলেন ফার্মি। তবে নতুন কণাটির নাম ‘নিউট্রিনো’ সেটা পাউলিই রাখলেন, এর অর্থ ‘ছোট নিউট্রন’। ওই বছরই ফার্মি নিউট্রিনো নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করলেন। বিটা ক্ষয়ের সমস্যা সমাধানে নতুন এক ধরনের বলের প্রস্তাব করলেন ফার্মি । ‘দুর্বল নিউক্লিয়’ বল। ফার্মি বললেন, এই দুর্বল বলের কারণে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ভাঙন ধরছে। নিউক্লিয়াসের একটি নিউট্রন ভেঙে একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন তৈরি হচ্ছে। আর তৈরি হচ্ছে সেই রহস্যময় কণা নিউট্রিনো। অবশ্য এক্ষেত্রে কণাটি নিউট্রিনো নয়, অ্যান্টি-নিউট্রিনো। অর্থাৎ পাউলি যেটাকে নিউট্রিনো মনে করতেন সেটা আসলে অ্যান্টি-নিউট্রিনো।
কিন্তু এই কণা পাওয়া যাবে কীভাবে। কোনও বাধাই এর কাছে বাধা নয়। যে কণা স্বাচ্ছন্দে সবকিছু ভেদ করে চলে যেতে পারে, সে আছে না নেই তার প্রমাণইবা কীভাবে হবে? অনেকেই চেষ্টা করলেন পাউলি-ফার্মির তত্ত্ব ধরে এগুতে। কেউই নিউট্রিনো কণার হদিস দিতে পারলেন না। দুই জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হ্যানস বেথে ও রুডলফ পিয়ের্লেস হিসেব করে দেখান, প্রতি এক হাজার আলোকবর্ষ পুরু কোনও বস্তু ভেদ করার সময় একটি প্রতি-নিউট্রিনোর সাথে প্রোটনের সাথে সংঘর্ষ ঘটতে পারে। আলোকবর্ষ হলো একবছরে আলো যতটুকু যাই সেই পরিমাণ দূরত্ব! বেথে আর পিয়ার্লেসের হিসাব শুনে পাউলি ঠাট্টা করে ধরে বসলেন বাজি। নিউট্রনো অথবা প্রতি-নিউট্রনো যিনি আবিষ্কার করবেন তাঁকে এক কেস শ্যাম্পেনের বোতল উপহার দেবেন পাউলি।
১৯৪০ সাল। মার্কিন পারমাণবিক গবেষণাগারে করেন ফ্রেডেরিক রেইনস। তাঁর মাথায় এলো নিউট্রিনো ধরার আইডিয়া। একদিন তিনি আইডিয়ার কথা জানালেন বন্ধু ক্লাইড কাওয়ানকে। ১৯৫৬ সালে রেইনস ও কাওয়ান ঘোষণা দিলেন তাঁরা অ্যান্টি-নিউট্রিনোর সন্ধান পেয়েছেন। পাউলি তখন আনন্দে আত্মহারা। ২৬ বছর পর তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর প্রমাণ মিলেছে! সে রাতেই বন্ধুদের নিয়ে এক কেস শ্যাম্পেন সাবাড় করলেন পাউলি।
কিপ থর্ন সত্যিকারের বাজিকর। তার সাথে আরেক পাণ্ডব স্টিফেন হকিং। এই দুই পাণ্ডব মিলে একটা বাজি ধরলেন। প্রসঙ্গ ব্ল্যাকহোল। সেটা ১৯৭৫ সালে। সিগনাস এক্স-১ নামে একটা ভারি বস্তু আছে মহাকাশে। সেটি কী ব্ল্যাকহোল? এটাই নিয়েই বিতর্ক! প্রশ্নটার একটা তাৎপর্যও আছে। তখনও কৃষ্ণগহ্বরে অস্তিত্ব অতটা শক্ত ভিতের ওপর ওপর দাঁড়ায়নি। তাই কৃষ্ণগহ্বর প্রমাণ করা গেলে ব্ল্যাকহোল বিরোধিদের কণ্ঠ মিইয়ে যাবে। থর্ন বললেন সিগনাস এক্স-১ সত্যিকারের একটা ব্ল্যাকহোল। কিন্তু হকিং বলেলেন, ওটা ব্ল্যাকহোল নয়। হকিং ব্ল্যাকহোল নিয়ে ততদিনে অনেক কাজ করেছেন। যদি সিগনাস এক্স-১ ব্ল্যাকহোল হয়, তাহলে হকিংয়েরই গবেষণার জিত। যদি না হয়, তাহলে তার ব্ল্যাকহোল গবেষণাই হুমকির মুখে পড়তে পারে। তখন সান্ত্বনা হিসেবে বাজি জেতার তৃপ্তি তো থাকবে!
বাজির পণটাও ছিল অদ্ভুত। যদি হকিং হারেন তাহলে তিনি তিনি থর্নকে একবছরের জন্য একটি পর্নো ম্যাগাজিনের গ্রাহক করিয়ে দেবেন নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে। আর যদি জেতেন হকিং, তাহলে হকিংয়ের নামে চার বছর আসবে কমেডি ম্যাগাজিন প্রাইভেট আই। খরচা থর্নের। বছর দশেক পর প্রমাণ হয়, সিগনাস এক্স-১ সত্যিই ব্ল্যাকহোল। হার স্বীকার করেন হকিং। একবছর ধরে থর্নের বাড়িতে নিয়মিত পৌঁছায় নির্ধারিত ওই পর্নো ম্যাগাজিনটি। কিন্তু এই পত্রিকা দেখে কি খুশি হয়েছেলিনে থর্নের স্ত্রী? হবার কথা নয়। জানা যায়, স্বামীর ওপরে ভীষণ খেপেছিলেন ভদ্রমহিলা। হয়তো শাপ-শাপন্তও করতেন হকিংকেও।
থর্নের যেমন বাজির নেশা, সমান নেশা হকিংয়েরও। এবার দুজন এক হয়ে বাজি ধরলেন। ক্যালটেকের বিজ্ঞানী জন প্রেসিকলের বিপক্ষে। হকিংয়ের একটা তত্ত্ব নিয়ে বাজিটা। সত্তর দশকে হকিং বলেছিলেন, ব্ল্যাকহোল যদি কিছু গিলে নেয়, সেটার কোনো তথ্য আর অবশিষ্ট থাকে না। ধরা যাক, বিরটা একটা পাথর গিলে নিল ব্ল্যাকহোল, কিংবা আস্ত একটা গ্রহ। ঘটনার দিকে কেউ নজর রাখেনি। তাই গিলে ফেলার পর জনা সম্ভব নয়, ব্ল্যাকহোল কী হজম করল, কিংবা আদৌ কিছু খেয়েছে কিনা।
প্রেসিকলের ধারণা, ব্ল্যাকহোল চুপচাপ একটা বস্তু গিলে ফেলবে, তার কোনো খবর মহাবিশ্বে থাকবে না, এটা অসম্ভব। সুতরাং ধরো বাজি। যে পক্ষ জিতবে তাঁরা পাবে ঢাউস একটা এনসাইক্লোপিডিয়া। সাত বছর পরে গিয়ে হার মানেন হকিং। বাজির পণ হিসেবে প্রেসিকলকে দেন সাত কেজি ওজনের এক বেসবল এনোসাইক্লোপিডিয়া। হার মেনেছেন হকিং, থর্ন কিন্তু তার নিজের বিশ্বাসে অনড়। তাই হার স্বীকার করেননি তিনি। তিনি এখনো মনে করেন, ব্ল্যাক নীরব ঘাতব। কী খেল না খেল তার তথ্য মহাবিশ্বকে দেয় না। হকিং-থর্নের সেই ধারণাই কিন্তু দিন দিন হালে পানি পাচ্ছে। হকিং বাজিতে হার না মানলেই বোধহয় ভালো করতেন।
১৯১৫ সালে প্রকাশ হয় আইস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা। সেই তত্ত্ব থেকেই বেরিয়ে আসে মহাকর্ষ তরঙ্গের ভষিদ্বাণী। কিন্তু ভবিষদ্বাণী প্রমাণ হতে লেগে গেছে পাক্কা একশো বছর। তাঁর আগে ঘটে গেছে কত ধুন্দুমার কাণ্ড। নাথান রোজেনকে সাথে নিয়ে স্বয়ং আইনস্টাইন এই তরঙ্গ বাতিল করতে উঠেপড়ে লাগেন, জোসেফ ওয়েরারের জোচ্চুরি ঝড় তোলে, রিচার্ড ফাইনম্যান এই তরঙ্গ শণাক্তের এক কাল্পনিক যন্ত্রে নকশা করেন। শেষমেষ মার্কিন বিজ্ঞানী রেইনার ওয়েইসই করেন কাজের কাজ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শণাক্তের জন্য আলোর ব্যাতিচার ধর্ম কাজে লাগানোর কথা ভাবেন। সেজন্য বানাতে হবে বিশাল এক ইন্টারফেরোমিটার। সেই যন্ত্রের দুটো ফাঁপা বাহু থাকবে। বাহু দুটো থাকবে পরস্পরের সমকোণে। মহাকর্ষ তরঙ্গ প্রবাহিত হলে একটা বাহুর দৈর্ঘ্য বেড়ে যাবে। তখন সেই বাহুর সমকোণে থাকা বাহুটির দৈর্ঘ্য যাবে কমে। পরমুহূর্তে যে ঢেউ আসবে সেটা প্রথম বাহুটির দৈর্ঘ্য কমিয়ে দেবে এবং দ্বিতীয় বাহুটি প্রসারিত হবে।
একমাত্র আলোই মহাকর্ষ তরঙ্গের প্রভাবমুক্ত। আলোকে থামানো যায় না। আলোর বেগও শূন্য মাধ্যমে একটুও কমবেশি হয় না। নলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করা হবে লেজার আলো। মহাকর্ষ তরঙ্গের প্রভাবে। ইন্টারফেরোমিটারের দৈর্ঘ্যরে সংকোচনে বাড়বে, কমবে আলোর গতিপথের দূরত্ব। ফলে দুই বাহ থেকে আসা লেজার আলোর ব্যাতিচার নকশা তৈরি হবে যন্ত্রটির বিশেষ পর্দায়। তা থেকেই নিশ্চিত হবে মহাকর্ষ তরঙ্গের উপস্থিতি।
১৯৬২ সালে ওয়েইস ইন্টাফেরোমিটার যন্ত্রের ওপর একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তখন অনেকেই বিশ্বাস করতেন না আলোর ব্যাতিচার ধর্ম ব্যবহার করে মহাকর্ষ তরঙ্গ শণাক্ত করা যেতে পারে। এই দলে ছিলেন ক্যালটেকের গবেষক কিপ থর্নও। ইন্টারফেরোমিটার যন্ত্রের জন্য তৈরির জন্য টাকা দরকার। ওয়েইস সরকারের বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করছেন। সরকারই বা একজন বিজ্ঞানীর স্বপ্নের পেছনে শুধু শুধু অর্থ ঢালবে কেন? যাচাই-বাছাই করেই না আসল সোনা চিনতে হয়। সরকারের প্রস্তাব, নাসার এক বৈজ্ঞানিক প্যানেলকে বোঝাতে হবে পুরো বিষয়টা। ১৯৭৫ সালের কথা। কিপ থর্নও উঠেপড়ে লেগেছেন মহাকর্ষ তরঙ্গ শণাক্তের কাজে। সেই মুহূর্তে ওয়েইসের ডাক পড়ল ওয়াশিংটনে। নাসার প্যানেলে বক্তৃতা দিতে হবে তার যন্ত্রের কার্যকারিতা তুলে ধরে। ওয়েইস থর্নকে আমন্ত্রণ জানালেন সেই অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের আগের রাতটা কাটালেন দুজন ওয়াশিংটনের এক হোটেলে একই কক্ষে। সেই রাতেই ওয়েইস থর্নকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, আলোর ব্যাতিচার ধর্মকে ব্যবহার করেই মহাকর্ষ তরঙ্গ শণাক্ত করা সম্ভব। এরপর রোখ চেপে যায় থর্নের। থর্ন, ওয়েইস, আরেক বিজ্ঞানী ডোনল্ড ড্রেভরকে নিয়ে নকশা করেন মহাকর্ষ তরঙ্গ শিকারী লাইগো যন্ত্রের।
নকশা তো হলো। সেটা তৈরি করতে লাগবে ২৭২ কোটি ডলার। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (এনএসএফ)-এর কাছে অনুদান চাইলেন। এর বিরোধিতা করলেন অনেক জোতির্বিজ্ঞানী। মহাকর্ষ তরঙ্গ শণাক্তের ব্যাপারে তাঁরা সন্দিহান। ওয়েবারের ব্যর্থতা তাদের আত্মবিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে করেছে। আরো একটা ব্যাপার আছে। এনএসএফ যদি এতটাকা একটা প্রকল্পের পেছনে ব্যয় করে ফেলে অন্য প্রকল্পে টাকার ঘাটতি পড়ার আশঙ্কা আছে।
দমলেন না তিন বিজ্ঞানী। লড়াই চালিয়ে গেলেন। ১৯৮১ সালে থর্ন ধরলেন বাজি। প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরোমিয়া অস্ট্রাইকার। থর্ন বলেছিলেন ২০০০ সালের আগেই তাঁরা মহাকর্ষ তরঙ্গ শণাক্ত করতে পারবে। সেটা যে পারেননি, সেটা এখন সবাই জানে। তাই বাজিতে হারতে হয়েছিল থর্নকে। কিন্তু হেরেও কি অসুখি হয়েছিলেন থর্ন। ২০১৬ সালে যখন মহাকর্ষ তরঙ্গ শণাক্তের ঘোষণা এলো, এটাই এখন পর্যন্ত এই শতাব্দির সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক সাফল্য। সুত্র: ফিজিক ওয়ার্ল্ড
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]