ভাষার বৈচিত্র্য কেন আছে তা নিয়ে ইহুদী পুরাণে একটি কাহিনী আছে। ঐ কাহিনী অনুসারে অনেক অনেক আগে পৃথিবীর সকল মানুষেরা একটি মাত্র ভাষায় কথা বলতো। কারো কথা কারো বুঝতে কোনো অসুবিধা হতো না। একভাষী মানুষেরা সবাই মিলে বাবেল শহরে বিশাল এক অট্টালিকা তৈরি করার জন্য একত্র হলো। অট্টালিকা বা মিনার (tower) এতই উঁচু হবে যে এটি আকাশে গিয়ে ঠেকবে। এটি ব্যবহার করে মর্ত্যের মানুষ নিজের ইচ্ছামতো স্বর্গে যেতে পারবে।
দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের পরিকল্পনা স্রষ্টার চোখে পড়ে যায়। মর্ত্যের মরণশীল সাধারণ মানুষ দেবতাদের রাজ্যে আরোহণ করবে এই ব্যাপারটা একদমই ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার মতো। স্রষ্টা মর্ত্যের মানুষের দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি দিয়ে দেখলেন সবাই সবার কথা বুঝতে পারে, যার কারণে তাদের মাঝে পারস্পরিক ঐক্য খুব দৃঢ়। ভাবলেন, যদি এদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে দেয়া যায় তাহলে তাদের কাজের অগ্রগতি একদমই মিইয়ে যাবে, ফলে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা আর আলোর মুখ দেখবে না। তাই তাদের কাজকে দমানোর জন্য স্রষ্টা তাদের ভাষার মধ্যে বিশৃঙ্খলা এনে দিলেন। ফলে একজনের কথা আরেকজন বুঝতে পারে না। এক অঞ্চল বা উপজাতির মানুষের ভাষা আরেক অঞ্চল বা উপজাতির মানুষের কাছে আবোল-তাবোল বকবক বলে প্রতিভাত হতে লাগল। এমতাবস্থায় অট্টালিকা তৈরি মাঠে মারা গেল এবং জন্ম হলো অনেকগুলো ভাষার বিশাল এক বৈচিত্র্য। অর্থাৎ আজকের যুগের ভাষার এত বৈচিত্র্যের জন্য দায়ী বাবেলের সেই অট্টালিকা (The Tower of Babel)।
যদিও বাবেল শহরের অট্টালিকার লোককাহিনী একদমই সত্য নয় তারপরেও এই কাহিনী পৃথিবীতে ভাষার বৈচিত্র্য সম্পর্কে আগ্রহের জন্ম দেয়। পৃথিবীতে কেন এত এত ভাষার সৃষ্টি হয়েছে?
কোনো একটা প্রজাতি যেমন অল্প কিছু প্রজাতি ব্যতীত অন্য সকল প্রজাতি থেকে আলাদা এবং অল্প কিছু প্রজাতির সাথে মিল থাকাতে তারা একই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত তেমনই ভাষার ক্ষেত্রেও এই কথাটি প্রযোজ্য। প্রাণীদের মতো ভাষারও অনেক শাখা-প্রশাখা এবং গোত্র-পরিবার আছে। স্পেনিশ, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ, ফ্রেঞ্চ সহ অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষাগুলো এবং রোমাঞ্ছ, গ্যালিসিয়ান কাতালান উপভাষাগুলোতে অনেক মিল আছে। এই ভাষাগুলোকে একত্রে ‘রোমান্স’ (Romance) ভাষাগোষ্ঠী বলা হয়। এখানে রোমান্স শব্দটির সাথে প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কিত ইংরেজি শব্দ রোমান্সকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। ভাষার ক্ষেত্রে রোমান্স শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে। ল্যাটিনে এর মানে দাঁড়ায়, রোম অঞ্চলের ভাষা- The language of Roam।
কথা প্রসঙ্গে ভালোবাসা শব্দটি যেহেতু এসেই গিয়েছে তাই এই শব্দটি নিয়ে সামনের দিকে এগোই। দেশ ও এলাকাভেদে ভালোবাসা প্রকাশ করতে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়। শব্দ ভিন্ন কিন্তু মনের অনুভূতি এক। ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য Ti amo, Amote, T’aimi কিংবা Je t’aime এর যেকোনো একটা প্রকাশ করলেই হয়ে যাবে। ল্যাটিন বংশের ভাষায় এগুলো ব্যবহৃত হয়। একদম ঠিক ঠিক ল্যাটিনে ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাইলে বলতে হবে Ti amo। ল্যাটিন ভাষায় ভালোবাসা আর স্প্যানিশ ভাষায় ভালোবাসা একই রকম শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
আফ্রিকা মহাদেশের দেশ কেনিয়া, তানজানিয়া অথবা উগান্ডাতে কারো কাছে নিজের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে চাইলে সাহিলি ভাষায় নাকুপেন্ডা (Nakupenda) শব্দটি উচ্চারণ করতে হবে। এর চেয়ে আরো দক্ষিণের দেশগুলোতে গেলে, যেমন মোজাম্বিক, জাম্বিয়া বা মালাউইতে চিনইয়ানজা ভাষায় দিমাকুকোন্ডা (Ndimakukonda) বলতে হবে। আফ্রিকা মহাদেশের আরেকটি ভাষা বান্তুর মাধ্যমে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করা হয় দিনোকুডা (Ndinokuda) কিংবা দিয়াকুথান্ডা (Ndiyakuthanda)। আবার এটিকে জুলু ভাষাতে প্রকাশ করতে হলে বলতে হবে গিয়াকুথান্ডা (Ngiyakuthanda)। শবদ্গুলোর উচ্চারণে অনেক মিল আছে। বুঝাই যায় এরা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আফ্রিকার এই ভাষাগুলো একে অপরের সাথে আত্মীয়ের সম্পর্কে সম্পর্কিত হলেও অন্য ভাষাবংশ যেমন রোমান্স থেকে একদমই স্বতন্ত্র। এরা আবার জার্মানীয় ভাষাবংশ থেকে স্বতন্ত্র। জার্মানীয় ভাষাবংশে আছে ডয়েশ, ডাচ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভাষাগুলো। আমরা প্রাণীর শ্রেণীবিন্যাসে যেমন দেখেছিলাম প্রজাতিগুলো আলাদা আলাদা তেমনই ভাষাগুলোও আলাদা আলাদা। প্রজাতিগুলো যেমন একটি গোত্র গঠন করে তেমনই ভাষাগুলোও একত্রে মিলে ভাষাগোষ্ঠী গঠন করে। অর্থাৎ একটা ভাষা থেকে পরিবর্তন বা রূপান্তরের মাধ্যমে একাধিক ভাষার জন্ম হয়।
কীভাবে একটি ভাষা থেকে কাছাকাছি সম্পর্কযুক্ত একাধিক ভাষা বা ভাষাগোষ্ঠীর জন্ম হয় সেটা অনুধাবন করা খুব কঠিন কিছু নয়। একটা ছোটখাটো পরীক্ষা করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমে বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় তাদের কথা বলার ধরন পর্যবেক্ষণ করি। তারপর দাদা-নানার বয়সী কারো কথা কথা বলার ধরণ পর্যবেক্ষণ করি। তারপর বন্ধুদের কথা বলা আর বয়স্কদের কথা বলার মাঝে কোনো পার্থক্য আছে কিনা তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে অবশ্যই কম-বেশি পার্থক্য পাওয়া যাবে। যেমন আজকের অতি-আধুনিক যুগে তরুণরা চমৎকার অর্থে ‘জোস’, ‘ফাটাফাটি’, ‘অস্থির’ ‘চরম’ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আমার (শ্রাবণ) দাদা বা নানার আমলের কেউই এই শব্দগুলোর মাঝে কোনোটিকেই চমৎকার অর্থে ব্যবহার করেনি। টাইম মেশিনে করে তাদের কাছে গিয়ে এই শব্দগুলো বললে তারা অন্য অর্থ বুঝবে। জোস বললে তারা বুঝবে ফলের জুস বা শরবত জাতীয় কিছু, ফাটাফাটি বললে ভেঙে ফেটে চৌচির অবস্থা হয়ে গেছে এমন কিছুকে বুঝবে, অস্থির বললে ভূমিকম্পের কাপাকাপির মতো কোনোকিছুকে বুঝবে!
তবে দুই কালের দুই প্রজন্মের ভাষার মাঝে অল্প-স্বল্প পার্থক্য থাকলেও তাদের ভাষা বুঝতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। উভয় প্রজন্মের সবার কথাই সবাই বুঝবে। কারণ তাদের মাঝে পার্থক্য মাত্র দুই প্রজন্ম। যদি দাদা-নানার চেয়ে ২৫/৩০ প্রজন্ম আগের লোকেদের কথা বলার ধরনের সাথে বন্ধুদের কথা বলার ধরণ তুলনা করে দেখি তাহলে কিন্তু উভয়ের ভাষার মাঝে অনেক পরিবর্তন দেখা যাবে। যদি কেউ ইংরেজিভাষী হয়ে থাকে তাহলে তার ২৫ প্রজন্ম আগের কারো ভাষা কেমন হতে পারে তার নমুনা তুলে ধরছি। মধ্যযুগীয় কবি জিওফ্রে শাসার এর জীবন নিয়ে লিখিত হয়েছিল এই কবিতাটি।
He was a lord ful fat and in good poynt;
His eyen stepe, and rollynge in his heed,
That stemed as a forneys of a leed;
His bootes souple, his hors in greet estaat.
Now certeinly he was a fair prelaat;
He was nat pale as a forpyned goost.
A fat swan loved he best of any roost.
His palfrey was as broun as is a berye.
কবিতাতে খেয়াল করলে দেখা যাবে বানানের অনেক ত্রুটি আছে এখানে। আজকের যুগে আমরা বানানের যে যে দিকগুলোকে ভুল বলে জানি তখনকার যুগে সেটার কোনো ধারণাই ছিল না। মাত্র একশো বছরও হয়নি বাংলা ভাষার বানানরীতি চালু হয়েছে। একশো বছরের আগে যারা লেখালেখি করেছে তাদের ধারণাও ছিল না বানানের মতো একটা জিনিসেরও নিয়ম থাকতে পারে! তারপরেও এই কবিতাটি পড়ে মোটামুটি বোঝা যায়। কিন্তু এটি যদি লিখিত আকারে না থেকে উচ্চারণের মাধ্যমে কেউ শুনে তাহলে এর মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাবে না। ঘাগু ইংরেজরাও বুঝতে সমস্যা হয়ে যাবে।
বাংলাভাষী মানুষদের প্রেক্ষিতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার নিজস্ব কিছু উদাহরণও সংযুক্ত করা উচিৎ। তাহলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। আমরা এই বেলায় তিনটি কবিতা পর্যবেক্ষণ করবো। একটি আধুনিক যুগের, একটি মধ্যযুগের এবং একটি প্রাচীন যুগের।
১.
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।।
যত চাও তত লও তরণী-’পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহ করুণা করে।।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী। ।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সোনার তরী)
২.
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;—
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;—
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে—
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে॥
(মাইকেল মধুসূদন দত্ত, চতুর্দশপদী কবিতাবলী)
৩.
উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।
ণিঅ ঘরনি ণামে সহজ সুন্দারী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।
(চর্যাপদ)
তিনটি কবিতার প্রথমটি তুলনামূলকভাবে আধুনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। অন্য দুটি কবিতার চেয়ে এটি পড়ে বোঝা গিয়েছে সহজে। দ্বিতীয়টি রবীন্দ্রনাথের আগের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের। তিনি ১৮৬০ সালে এটি লিখেন। তৃতীয়টি বাংলা ভাষায় এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীনতম সাহিত্য নিদর্শন চর্যাপদের একটি শ্লোক। চর্যাপদের পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বলে ধারণা করা হয়। এটি পড়তে গিয়ে দুয়েকটা দাঁত ভেঙে গেলে অবাক হবার কিছু নেই।
খেয়াল করলে খুব সহজেই দেখা যাবে সময়ের সাথে সাথে ভাষার কত পরিবর্তন হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতাটা সহজেই বোঝা যায়, মধুসূদনেরটা অল্প স্বল্প বোঝা যায় এবং চর্যাপদেরটা একদমই বোঝা যায় না। বাংলা ভাষা সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া এর মানে খুব কম মানুষই বুঝবে। আমরা এখানে রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক বলছি কিন্তু অতি সাম্প্রতিককালের কবিদের কবিতার সাথে তুলনা করলে রবীন্দ্রনাথের কবিতাও অনেক সেকেলে। সাম্প্রতিককালের কবিদের কবিতা আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা তুলনা করে দেখলে ভাষাগত অনেক পার্থক্য দেখা যাবে। অল্প অল্প করে এক প্রজন্মের ভাষা থেকে আরেক প্রজন্মের ভাষায় অনেক অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। এখানে তার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখলাম।
এরকমভাবে সময়ের সাথে সাথে ভাষার মাঝে পার্থক্য যদি খুব বেশি হয়ে যায় তাহলে তাদেরকে আলাদা ভাষা বলে গণ্য করতে হবে। যেমন ইতালিয়ান ভাষা থেকে পরিবর্তনের মাধ্যমে স্প্যানিশ ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো এলাকার ভাষাই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরিবর্তিত হয়। এই ব্যাপারটিকে ভাষার প্রবাহ বা সঞ্চরণ বলতে পারি। এক ভাষা আরেক ভাষায় সঞ্চরিত হয়। এই ব্যাপারটাকেই বাংলা ব্যাকরণ বইতে বলা হয়ে থাকে ‘ভাষা বহমান নদীর মতো, ভাঙ্গা-গড়া আর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভাষা অগ্রগতি লাভ করে’।
এখন ভাষার বিবর্তনের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যেমন ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রচলিত আছে তেমনই বিভিন্ন স্থানে এক ভাষাও প্রচলিত আছে। যেমন ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মানুষের ভাষা ইংরেজি। এরকম ভিন্নস্থানের একভাষীর মানুষদের মাঝে কোনো যোগাযোগ নেই। ধরলাম সেই সময়ের কথা যখন টেলিফোন টেলিগ্রাফ চিঠির প্রচলন ছিল না। এরকম পরিস্থিতিতেও কিন্তু ভাষা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হবে। এখন যেসকল স্থানে ভাষা এক তাদের সবাই কি একইভাবে পরিবর্তিত হবে? না। অবশ্যই না। আলাদা আলাদা অঞ্চলে ভাষা আলাদা আলাদাভাবে পরিবর্তিত হবে। এই পরিবর্তন শুধু শব্দের মাঝেই হবে না, শব্দের পাশাপাশি উচ্চারণের ধরণেও হবে। উচ্চারণের ধরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ভারতীয় কোনো লোক যদি ইংরেজিতে কথা বলে এবং একজন আমেরিকান লোক যদি ইংরেজিতে কথা বলে তাহলে তাদের উচ্চারণের ধরণে অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে। ইংরেজি শব্দে কোনো পার্থক্য না থাকলেও শুধু উচ্চারণের ধরণের কারণে তাদের কথায় অনেক ভিন্নতা দেখা যাবে। এই ব্যাপারটাকে বলা হয় টান বা একসেন্ট (accent)। একটা উদাহরণ দেই different শব্দটি ভারতবর্ষের অনেকে ‘ডিফারেন্ট’ বলে, অন্যদিকে একজন আমেরিকান উচ্চারণ করে ‘ডিফ্রেন্ট’ বলে। আমেরিকান ইংরেজি, ইংল্যান্ডের ইংরেজি, অস্ট্রেলিয়ার ইংরেজি সকলের মাঝেই একসেন্ট বা টানগত পার্থক্য আছে। আমাদের একদম গ্রামবাংলার উদাহরণই দেই না কেন? ভিন্ন কোনো জেলা থেকে কেউ আসলে তার কথাবার্তা শুনে স্থানীয়রা প্রায় সময়ই বলে ‘পোলা/মাইয়াডা কেমন ঠেলা দিয়া কথা কয়’। এই ‘ঠেলা’ই হচ্ছে একসেন্ট। এরকমভাবে একটু করে কোনো ভাষা থেকে যদি একটি শাখা বের হয়, অর্থাৎ তাদের মাঝে পার্থক্য আছে কিন্তু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা একদমই বিচ্ছন্ন হয়ে যায়নি তাহলে শাখা ভাষাটিকে আমরা বলবো উপভাষা।
উপভাষা হলেও মানুষ তা বুঝতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খেয়াল করি, কুষ্টিয়া অঞ্চলের ভাষা কিংবা নাগরিক ভাষা থেকে নোয়াখালী বা চট্টগ্রামের ভাষা একদমই আলদা। এদের ভাষা আলাদা হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই তাদের ভাষা বুঝতে পারে। হয়তো কিছু কিছু বাক্যে বুঝতে সমস্যা হয়, কিন্তু তারপরেও কথা-বার্তা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে তা বোঝা যায়। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে এরা উপভাষা। পরবর্তীতে যদি চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর ভাষা এতটাই পরিবর্তিত হয়ে যায় যে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষেরা এই ভাষার কিছুই বুঝতে পারে না তাহলে এই উপভাষাগুলো স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে গণ্য হবে। কারণ এটি মূল ভাষা থেকে একদমই বিচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র বই থেকে বাংলা ভাষায় কয়েকটি উপভাষার নমুনা তুলে ধরছি।
সাধু ভাষা : একজন লোকের দুইটা ছেলে ছিল।
কলকাতা- নদীয়া : অ্যাকজন লোকের দুটো ছেলে ছিল
খুলসা-যশোর : অ্যাকজন মানসির দুটো ছাওয়াল ছিলো।
মানভূম: একজন লোকের দুটো বেটা ছিল।
মেদিনীপুর: এক লোক্কার দুট্ট পো থাইল।
মালদহ: য়্যাক ঝোন ম্যানশের দুটো ব্যাটা আছ্লো।
বগুড়া : য়্যাক ঝনের দুই ব্যাটা ছৈল আছিল।
রংপুর: একজন ম্যানশের দুইকনা ব্যাটা আছিলো।
ঢাকা: একজন মানসের দুইডা পোলা আছিলো।
ময়মনসিংহ: য়্যাক জনের দুই পুৎ আছিল্।
সিলেট: এক মানুশুর দুই পোয়া আছিল।
চট্রগ্রাম: এগুয়া মানসের দুয়া পোয়া আছিল্।
নোয়াখালী: একজনের দুই হুত আছিল।
বাংলাদেলের উপভাষাসমূহের রুপতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য অধিক। যেমন – সর্বনামের আমি’র উপভাষা -রুপ উত্তরবঙ্গে ‘ মোর’ নোয়াখালিতে ‘আঁর’। আমাদের উত্তরবঙ্গে ‘হামার’ ময়মনসিংহে ‘আমার ‘কুমিল্লায় ‘মোগো’, ইত্যাদি।
আজকের ডাচ ভাষা জার্মান ভাষার উপভাষা ছিল। পরবর্তীতে এর অনেক পরিবর্তন হয় ফলে এটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়। ফ্রেঞ্ঝ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ ও পর্তুগীজ ভাষাগুলোর সবকটিই স্বতন্ত্রভাবে ল্যাটিন ভাষা থেকে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। প্রাণিবৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে আমরা যেমন কাল্পনিকভাবে জীবন-বৃক্ষ আঁকা যায় তেমনই ভাষার বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও বৃক্ষ আঁকা যায়। নিচের ছবিটির মতো করে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীকেকে আত্মীয়তার সম্পর্কে বেধে একটা চমৎকার গাছ কল্পনা করা যায়, ডারউইন প্রজাতির বিবর্তনের জন্য ঠিক এমনই একটি গাছ কল্পনা করেছিলেন।
ঠিক ভাষার মতোই প্রজাতিরাও সময় স্থান ও দুরত্বের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। প্রাণীর মাঝে স্থান কাল ভেদে কেন এমন পরিবর্তন ঘটে? ‘কেন’ পরিবর্তন ঘটে সেটি দেখার আগে ‘কীভাবে’ ঘটে সেটি দেখে নেয়া প্রয়োজন। প্রজাতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের চালক হিসেবে কাজ করে DNA। যখন কোনো প্রজাতির নারী সদস্য ও পুরুষ সদস্য সন্তান উৎপাদনের জন্য যৌন প্রজননে অংশ নেয় তখন তাদের আলাদা আলাদা DNA পরস্পর মিলিত হয়। নবজন্ম লাভ করা সন্তানের মাঝে মা ও বাবা উভয়ের DNA-ই আছে। অর্থাৎ দুটি ভিন্ন সদস্য থেকে একটি নতুন সদস্য তৈরি হয়েছে এবং এটি শতভাগ বাবার মতোও হয়নি শতভাগ মায়ের মতোও হয়নি। উভয়ের মতো হয়েছে, মানে তার মাঝে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ভাষার পরিবর্তনের মতো।
আলাদা আলাদাভাবে প্রাণী বিন্যস্ত করার প্রসঙ্গে আরেকটা ব্যাপার চলে আসে। দুটি প্রাণীর মাঝে কীভাবে আমরা নির্ধারণ করি এরা উভয়ে একই প্রজাতির নাকি আলাদা আলাদা প্রজাতির? যে সকল প্রাণীরা যৌন জননের মাধ্যমে নিজেদের বংশবিস্তার করে তাদের বেলায় সংজ্ঞাটা সহজে দেয়া যায়। প্রাণী দুটি যদি যৌন জননের মাধ্যমে নিজেদের মতো আরো এক বা একাধিক প্রাণী উৎপন্ন করতে পারে তাহলে তারা একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে তাদের মাঝে যদি যৌন প্রজনন সম্ভব না হয় কিংবা সম্ভব হলেও এর ফলে যদি তাদের তাদের মতো কোনো প্রাণীর জন্ম না হয় তাহলে তারা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সদস্য।
যখন এক এলাকার প্রজাতি ভ্রমণ করে অনেক দূরের অন্য এলাকার প্রজাতির সাথে মিলে বংশবিস্তার করে তখন নতুন বংশে অনেক বৈচিত্র্য তৈরি হয়। যেমন ধবধবে সাদা চামড়ার কোনো আমেরিকান যদি কুচকুচে কালো কোনো আফ্রিকানকে বিয়ে করে তাহলে তাদের সন্তানের DNA ব্যাপক ভিন্নতা সম্পন্ন হবে। এই ব্যাপারটাকে বলা হয় জিন প্রবাহ বা জিন সঞ্চরণ (gene flow)।
ইতালিয়ান ও ফ্রেঞ্ঝ ভাষা পরস্পর সঞ্চরিত হওয়াকে দুটি আলাদা এলাকায় প্রজাতির DNA পরস্পর দূরে যাওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। ভাষার মতো দুই এলাকার একই প্রজাতির সদস্যের মাঝে DNA’র সাদৃশ্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কমতে কমতে একসময় যদি এমন অবস্থায় আসে যে দুই এলাকার প্রাণীরা পরস্পরের সাথে মিলে যৌন প্রজননে অংশগ্রহণ করলে তাদের থেকে কোনো সন্তানের জন্ম হয় না তাহলে বলতে হবে তারা আর একই রকম প্রজাতিতে নেই। পার্থক্যের মাত্রা বেশি হবার কারণে তারা এখন আলাদা প্রজাতি। ঘোড়া ও গাধার DNA তে অনেক মিল আছে। যার কারণে তাদের যৌন জননের ফলে সন্তানের জন্ম হয়। কিন্ত তাদের মিল খুব বেশি নয়, যার কারণে তাদের দ্বারা এমন কোনো প্রাণী তৈরি হয় না যে আবার সন্তান উৎপাদনে সক্ষম। অর্থাৎ জিনগতভাবে ঘোড়া ও গাধা ভিন্ন প্রজাতি ও সম-প্রজাতির মাঝের কোনো একটা অবস্থানে অবস্থান করছে। ঘোড়া ও গাধার এমন ঘটনা ভাষার বেলায় অনেকটা উপ-ভাষার মতো। এরা পরস্পরের কাছাকাছি, কিন্তু এত কাছাকাছি না যে তাদের দ্বারা স্বয়ংসম্পূর্ণ সন্তান উৎপাদিত হবে।
প্রাণী বিবর্তন ও ভাষা বিবর্তনের মাঝে কিছু পার্থক্যও আছে। গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্থক্য হচ্ছে এক ভাষা অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করতে পারে। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে অন্য ভাষার শব্দ মূল ভাষার স্থায়ী সম্পদ হয়ে যায়। দুটি ভাষার মাঝে অনেক শব্দের বিনিময় হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইংরেজি ভাষায় shampoo শব্দটি এসেছে হিন্দি ভাষা থেকে, iceberg শব্দটি এসেছে নরওয়েজিয়ান ভাষা থেকে, bungalow শব্দটি এসেছে বাংলা ভাষা থেকে। খুব সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে একাধিক প্রজাতির প্রাণী কখনোই DNA আদান প্রদান করে না। ব্যাকটেরিয়ার কথা আলাদা, বিশেষ ক্ষেত্রে এরা DNA (জিন) আদান প্রদান করে। কিন্তু তারা কেন করে কিংবা এই প্রক্রিয়ার বিস্তারিত সম্বন্ধে আলোচনা করতে হলে বেলা বয়ে যাবে।
সিরাজাম মুনির শ্রাবণ
বিভাগীয় সম্পাদক, জিরো টু ইনফিনিটি