মহাশূন্য গবেষণার ধারনা আমূল বদলে দিতে আসছে EmDrive!

0
688

গত শতাব্দী থেকেই মানুষ মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড় করছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই ঘটনা কবে ঘটবে সেই সম্বন্ধে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কালক্ষেপন হতে হতে নাসা এখন পরিকল্পনা করছে ২০৩৫ সাল নাগাদ মঙ্গলে মানুষ প্রেরণের। মঙ্গলে মানুষ প্রেরণের সবচেয়ে বড় বাধা আসলে কোথায়? উত্তর হচ্ছে জ্বালানী। রকেট যখন উৎক্ষেপন করা হয় তখন সাথে করে এর বিপুল ভরের জ্বালানীও বহন করতে হয়। যা আবার একই সাথে জ্বালানীর চাহিদাও বিপুল পরিমানে বাড়িয়ে দেয়। মঙ্গলে মানুষ পাঠাতে হলে তাকে ফিরিয়েও আনতে হবে এবং ফেরত আসার জ্বালানীটুকু বহন করে নিয়ে যেতে হবে, কিংবা মঙ্গলের বুকে উৎপাদন করতে হবে। এই আনা-নেওয়ার কিংবা উৎপাদনের সহজসাধ্য প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে না বলেই মূলতঃ মঙ্গলে মানুষ পাঠাতে দেরী হচ্ছে।

তবে সম্প্রতি এক বিষ্ময়কর প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে এবং তা নিয়ে বিজ্ঞানীমহল ধোঁয়াসায় রয়েছেন। এই প্রযুক্তির নাম EmDrive বা Electromagnetic propulsion drive। এই প্রযুক্তিতে কোনো ধরনের জ্বালানী ছাড়াই বিদ্যুতের মাধ্যমে ধাক্বা সৃষ্টি করা যায় যার সুবিধা বহুবিধ। প্রথমতঃ যেহেতু জ্বালানীবহন করতে হয় না তাই এটি যথেষ্ট পরিমানে হালকাভাবে তৈরি করা যায় এবং শক্তিখরচ কমে আসে। দ্বিতীয়তঃ এটির মাধ্যমে বিপুল পরিমান গতি তৈরি করা যায় যার ফলে মাত্র ৭০ দিনের মধ্যে মঙ্গলে পৌঁছানো যেতে পারে।

২০০৩ তিন সালে রজার শয়ার (Roger Shawyer) যখন প্রথমবারের মতো এর প্রদর্শন করেন তখন বিজ্ঞানীমহলে হাস্যরসের সৃষ্টি হয় এবং শয়ারকে বিদ্রুপ করা হয়। কারণ, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এটি ভরবেগের সংরক্ষণসূত্র ভঙ্গ করছে। ভরবেগের-সংরক্ষণসূত্রগুলো বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন সূত্রগুলোর একটি। যখন কোনো পরীক্ষায় ভরবেগের বা অন্যধরনের সুপ্রতিষ্ঠিত সংরক্ষণ সূত্রগুলো লঙ্ঘিত হতে দেখা যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয় যে সেখানো কোনোধরনের ভুল হয়েছে। তাই শয়ারের পরীক্ষাটিকে সবাই ভুল হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। এটি নিয়ে শয়্যারকে প্রচুর সমালোচনার মুখোমুখিও হতে হয়েছে।
em-drive-head-640x353

শয়্যার তাঁর ইঞ্জিনের কার্যপদ্ধতির ব্যাখ্যা হিসেবে বলেন এর অভ্যন্তরে একটি আবদ্ধ প্রকোষ্ঠে মাইক্রোওয়েভের বাউন্সের মাধ্যমে এই ইঞ্জিনের ধাক্বা প্রযুক্ত হয়, যার ফলে এর ইঞ্জিনটি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মাইক্রোওয়েভ তৈরি হয় বিদ্যুৎশক্তির মাধ্যমে যা সৌরপ্যানেল বসিয়ে মহাশূন্যে খুব সহজেই এবং স্থায়ীভাবে যোগাড় করা যেতে পারে, যার মানে হলো এই ধাক্কা উৎপাদক ব্যবস্থা আজীবন একই ভাবে কাজ করে যেতে পারবে যদি এর কোনো যন্ত্রাংশ বিকল না হয়ে যায়। এর জন্য আলাদা কোনো জ্বালানী এর সাথে যুক্ত করে দিতে হয় না। প্রাথমিক ভাবে এই ব্যাখ্যা প্রচুর সমালোচনার মুখোমুখি হয় কেননা নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী কোনো আবদ্ধ প্রকোষ্ঠ কোনো সার্বিক ধাক্কা উৎপাদন করতে পারে না। তবে শয়্যার আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী মাইক্রোওয়েভের মডুলেশনজনিত বেগের একদিকে কিছুটা বাড়তি হওয়ার মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও তাঁর ব্যাখ্যায় কেউ সন্তুষ্ট হন নি এবং এখন পর্যন্ত এটি প্রতিষ্ঠিত করা যায় নি।

emdrive2

শয়্যারের উদ্ভাবিত EmDrive এর আপাত কার্যপদ্ধতি

তাহলে সত্যিই কি এই ইঞ্জিন কাজ করে? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ! ২০০৯ নয় সালে একদল চীনা বিজ্ঞানী এই যন্ত্র পুনর্নিমানের মাধ্যমে এর কার্যকারীতা নিশ্চিত করেন। তাঁরা তাদের নিজের তৈরি সংস্করণের মাধ্যমে ৭২০ মিলিনিউটন বল উৎপাদন করেন, যদিও এরপরও এই বিষয়টি সত্যিকারভাবে কেউ বিশ্বাস করেন নি। তবে নাসার একদল বিজ্ঞানী এটি পুনরায় পরীক্ষা করে দেখার উদ্যোগ নেন এবং বিস্ময়করভাবে তাঁরা ফলাফল আশাব্যঞ্জক বলে ঘোষনা দেন। ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই ক্লিভল্যান্ডে অনুষ্ঠিত পঞ্চবিংশ যৌথ উৎক্ষেপন সম্মেলনে তাঁরা তাদের ফলাফল পেশ করেন। EmDrive এর পেছনে কাজ করা গবেষকরা এখনো যদিও জানেন না কেন এটি কাজ করে, কিন্তু প্রকৃত বিষয় হচ্ছে এটি কাজ করে। এটিকে ব্যাখ্যা করতে হলে সম্ভবতঃ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের খুবই আধুনিক কোনো তত্ত্বের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করতে হবে।

যদিও কার্যপদ্ধতি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না তবে এই ইঞ্জিনের আবেদন খুব সহজেই অনুমেয়। এটি বাস্তবায়িত হলে আমাদের মহাশূন্য গবেষনা রাতারাতি আমূল বদলে যাবে। হয়তোবা সৌরজগতের দূর-দূরান্তে মানুষ্যবাহী নভোযান পাঠানো যাবে। তাই নাসা এর গবেষনায় বেশ জোর দিচ্ছে। সম্প্রতি নাসা নতুন করে আরো নিখুঁত, আরো সুচারু ভাবে এধরনের ইঞ্জিন নির্মান পরীক্ষা করছে এবং ফলাফলও আরো ভালো পেয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো ফলাফলই peer review এর মধ্য দিয়ে যায় নি তাই একটা সন্দেহ বৈজ্ঞানিক মহলে এখন পর্যন্ত থেকেই যাচ্ছে।

তবে এর মধ্যে নাসার Eagleworks Lab এর প্রধান গবেষকদের অন্যতম পল ম্যাচ বিগত কয়েকমাসের মধ্যে তাঁর পরীক্ষার প্রথম হালনাগাদ তথ্য জনসম্মুখে উন্মুক্ত করেন। তিনি বলেন যে, বিজ্ঞানীমহলে সন্দেহ করা হয়েছে আগের পরীক্ষাগুলোর এমন কিছু ত্রুটি তাঁরা তাদের বর্তমান পরীক্ষায় দূর করেছেন এবং তারপরেও এই যন্ত্রটি বেশ ভালোভাবেই কাজ করছে। এর আগে কেউ কেউ সন্দেহ করেছিলেন যে এই যন্ত্র পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে লরেঞ্জ বল উৎপাদন করার মাধ্যমে কাজ করছে, কিন্তু নতুন গবেষনায় সেই ধারনাও অমূলক প্রমানীত হয়। তবে পল ম্যাচ তাঁর গবেষনার কোনো ছবি বা পরীক্ষার বিস্তারিত পদ্ধতি দেখাতে পারেন নি, কেননা তাঁর দল একটি গবেষনাপত্র প্রকাশের চেষ্টা করছে। এটি প্রকাশের পরে হয়তোবা এই গবেষণার বিস্তারিত জানা যাবে।

এটি সত্যিই মহাশূন্য গবেষনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে কিনা তা জানতে হলে আগে নিশ্চিত হতে হবে যে, এটি কোনো ধরনের নির্মান ত্রুটির কারণে কাজ করছে না।

বিজ্ঞানপত্রিকা ডেস্ক

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.