পাই (π) দিবসের আদলে টাউ (τ) দিবস পালিত

1
730

গত ২৮ জুন টাউ (τ) দিবস পালিত হয়েছে। টাউ একটি অমূলদ সংখ্যা ; বহুল প্রচলিত সংখ্যা পাইকে ২ দিয়ে গুণ করে টাউ পাওয়া যায়। পাইয়ের মান ৩.১৪… অনুযায়ী প্রতিবছর তৃতীয় মাস মার্চ ও ১৪ তারিখে পাই দিবস পালন করা হয়। একই ভাবে পাইয়ের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৬.২৮… অনুযায়ী জুনের ২৮ তারিখে টাউ দিবস পালন করা হয়।

গণিতের ইতিহাসে যে কয়টি রাশি সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত, সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে গুরুত্ববহ পাই সেগুলোর মধ্যে একেবারেই উপরের দিকে আছে। গণিতের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে পাই সম্ভবত কাজে লাগে না। অথচ পাইয়ের উৎপত্তি হয়েছিলো খুবই সাদামাটা ভাবে।

একটি বৃত্তের পরিধি এবং ব্যাসের অনুপাতকে পাই (π) বলা হয়। π একটি ধ্রূব সংখ্যা। অর্থাৎ যেকোন একটি বৃত্তের পরিধি এবং একই বৃত্তের ব্যাসের অনুপাতের মান সর্বদাই একই হবে।এর মান ৩.১৪১৫৯২৬….। হাজার বছর ধরেই π এর মান সঠিকভাবে নির্ণয়ের প্রচেষ্টা চলে আসছে। এই অনুপাতটি যে একটি ধ্রুব সংখ্যা সেটা খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় দুইহাজার বছর আগে থেকেই মানুষের ধারনায় ছিল। সেই সময় π এর মান দশমিকের পর দু্ই ঘর পর্যন্ত সঠিক ভাবে মানুষের জানা ছিলো যদিও সেই সময় দশমিক পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি, সেই সময়ের π এর মানকে আধুনিক দশমিকে প্রকাশ করলে দশমিকের পর দুই ঘর পর্যন্ত যথার্থতা পাওয়া যায়। π এর লিপিবদ্ধ মানের ব্যবহার প্রথম পাওয়া যায় প্রাচীন মিশর ও ব্যবিলনীয় সভ্যতায়। ব্যবিলন হতে প্রাপ্ত খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০০ -১৯০০ সালের একটি মৃৎখন্ডে π এর মান দেখানো হয়েছে ২৫/৮ বা ৩.১২৫০ যেটা π এর প্রকৃত মানের চেয়ে মাত্র ১% ছোট। কাগজে-কলমে π এর মান সঠিকভাবে বের করার একটি পদ্ধতি সবার প্রথম উদ্ভাবণ করেন আর্কিমিডিস। তিনি π এর মান নির্ণয় করেন 3.1410 যা π এর যথার্থ মান ৩.১৪১৫…. এর বেশ কাছাকাছি। এরপর ইতিহাসের পরিক্রমায় π এর মান নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সূত্র, সমীকরণ, ধারা প্রভৃতি প্রচলিত হয় এবং π এর মান সূক্ষাতিসুক্ষ ভাবে নির্ণয় হতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জন হেইনরিখ ল্যম্বার্ড কর্তৃক আবিষ্কৃত হয় যে π একটি অমূলদ সংখ্যা। অর্থাৎ π কে কোনোভাবেই দুটি পুর্ণসংখ্যার অনুপাত রূপে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এর আগে পর্যন্ত এটিকে শুধু দুটি পূর্ণ সংখ্যার অনুপাতরূপেই দেখা গেছে।যেমন 22/7, 333/106, 355/113, 52163/16604, এবং 103993/33102 ইত্যাদি।

কিন্তু এতসব ব্যাবহার সত্ত্বেও সম্প্রতি π এর ব্যাবহার কিছু গণিতবিদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই প্রশ্নের উৎপত্তি হচ্ছে বৃত্তের কেন্দ্রে উৎপন্ন কোণ থেকে। π এর মান অনুযায়ী একটি বৃত্তের কেন্দ্রে 2π রেডিয়ান কোণ উৎপন্ন হয়। তাঁরা বলছেন π এর সহগ হিসেবে 2 একটা বাহুল্য এবং এই বাহুল্য থাকা যুক্তি সংগত নয় এবং বিভিন্ন সমীকরণে এই সহগটির জন্য জটিল অবস্থা তৈরি হয় এবং আমরা যদি ধ্রুবক হিসেবে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত না নিয়ে পরিধি ও ব্যাসার্ধের অনুপাত নিই তাহলে খুব সহজেই এই সমস্যার সমাধান হয়। এই নতুন ধ্রুবকটির নাম দেওয়া হয়েছে টাউ (τ )। ধ্রুবকটির মান = 2π = ৬.২৮৩১৮৫৩……

π নিয়ে সন্দেহ এবং τ ম্যানিফেস্টো:
২০০১ সালে বব প্যালাইস নামক একজন গণিতবিদ একটি মতামতধর্মী জার্নাল আর্টিকেল লিখেন, যার শিরোনাম pi is wrong!( The Mathematical Intelligencer, Springer-Verlag New York, 23, 7-8 এখানে আর্টিকেলটি পাবেন )। π এর মান ভুল এটা তিনি বোঝাতে চাননি। বরং তিনি বলতে চেয়েছেন π ব্যাবহার করাটা ভুল। তিনি বলেন, বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত না নিয়ে যদি পরিধি ও ব্যাসার্ধের অনুপাত নেওয়া হয় তাহলে গানিতিক সমীকরণ এবং গণনাসমূহ আরো সহজ হয়ে যাবে। প্রথম যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন যে বৃত্তীয় একক অনুযায়ী একটি বৃত্তের কেন্দ্রে উৎপন্ন কোণের পরিমান 2π রেডিয়ান কিন্তু যদি আমরা যদি τ দিয়ে 2π কে প্রতিস্থাপিত করি তাহলে এর মান হবে τ রেডিয়ান। অতিরিক্ত 2 উপেক্ষা করতে পারায় গণিতের অনেক সমীকরণ আরো সরলাকৃতির হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। এই নতুন অনুপাতটির জন্য একটি প্রতীক প্রস্তাব করেন যেটি দেখতে π এর মতোই তবে π এর মাঝখানে আরেকটি পা দিয়ে লেখা হয় এভাবে:

তিনি একে নাম দেন one turn বা turn, যেহেতু একটি বৃত্তে একবার ঘুরে আসলে কেন্দ্রে এই পরিমান কোণ উৎপন্ন হয়।
বব প্যালাইসের দেওয়া প্রতীকটি অপ্রচলিত এবং কিছুটা অদ্ভুত হওয়ায় পরবর্তীতে ২০১০ মাইকেল হার্টল এর নাম τ প্রস্তাব করেন এবং একদল গণিতবিদ τ কর্তৃক অকৃষ্ট হয়ে এর ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন যা τ ম্যানিফেস্টো নামে প্রচার লাভ করে এবং τ এর মাহাত্ম প্রচারের লক্ষ্যে এটা নিয়ে একটা ওয়েবসাইট চালু করা হয়
এই ওয়েব সাইটে τ এর বিভিন্ন প্রয়োগ ব্যাখ্যা করা হয় এবং π এর বদলে τ এর প্রয়োগের যুক্তি-যুক্ততা তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখানো হয় যে প্রচুর গাণিতিক সমীকরণ আছে যেগুলোতে ২ π ব্যাবহার করা হয়। সেসব ক্ষেত্রে ২ π এর বদলে τ ব্যাবহার করা অনেক যুক্তিযুক্ত এবং এতে সমীকরণের সরলীকৃত রূপ পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে পোলার স্থানাঙ্ক ব্যাবস্থার কথা বলা যায়। আমরা যদি পোলার স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ স্থানাঙ্কটির মধ্যে ইন্টিগ্রাল করি তাহলে সেটা দেখানো যায় এভাবে।

যে সমীকরণের উর্দ্ধসীমায় দুটি πয়ের বদলে একটি τ ব্যাবহার করা যায়।
গাউসিয়ান ডিস্ট্রিবিউশনেও দুটি π আসে। যেমন:

ফুরিয়ার ট্রান্সফর্মে যেমন আসে,

এর বাইরেও আছে, কশির ইনটিগ্রাল সূত্র:

এককের n-তম রুটের সূত্র:

রাইম্যান জিটা ফাংশন:

এসবের বাইরেও আরো অনেক কিছু আছে যেসব নিয়ে τ পন্থীরা বেশ উত্তেজিত। τ এর প্রচলন চালু করার জন্য τ বাদীরা সারা পৃথিবীতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

τ বাদীরা যেমন বিভিন্ন সমীকরণ τ এর মাধ্যমে সরলীকরণ করে দেখিয়েছেন, π বাদীরাও তেমনি τ ব্যাবহার করে অনেক সমীকরণের জটিলাকৃতি দেখিয়েছেন। ফলে অতি সহসাই পাই এবং টাউয়ের দ্বন্দ্ব অবসানের সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না! তবে টাউ যদি জিতেও যায় তারপরেও এর প্রচলন কবে নাগাদ হতে পারে সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় কারণ সারা পৃথিবীর সকল পাইকে টাউ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যেনতেন কাজ নয়।
পাই না টাউ এটা নিয়ে অনলাইন মাধ্যম এবং ব্লগোস্ফিয়ার অনেকটা সরগরম। এই প্রশ্নে গণিতবিদগণ এখন দ্বিধা বিভক্ত। এই দ্বন্দ্ব প্রবল হয় ২০১০ এর ২৮ জুন থেকে যেদিন প্রথবারের মত টাউ পন্থীরা π দিবসের মতো করে τ দিবস ঘোষনা করে ব্যাপক অযোজনের মধ্য দিয়ে এটাকে উদযাপন করেছেন। π মান ৩.১৪১৬…. অনুযায়ী প্রতিবছর মার্চের ১৪ তারিখে π দিবস পালন করা হয়। এই ধারায় τ এর মান ৬.২৮৩২…. অনুযায়ী জুন মাসের ২৮ তারিখকে τ দিবস ঘোষনা করা হয়েছে এবং বড়বড় সংবাদ মাধ্যমগুলো এটা নিয়ে খবর পরিবেশন করেছে।
τ য়ের মাহাত্ম এবং এর ব্যাবহারের সুবিধা নিয়ে ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে বেশ কিছু ভিডিও । অনলাইনে চালানো হচ্ছে পাই এবং টাউ নিয়ে বিভিন্ন ডিবেট গ্রুপ। শেষ পর্যন্ত পাই এর বদলে টাউ প্রতিষ্ঠিত হয় কিনা সেটা কেবল সময়ই বলতে পারবে।

-ইমতিয়াজ আহমেদ
সম্পাদক, বিজ্ঞান পত্রিকা
[ফেসবুক প্রোফাইল]

 

1 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.