একটা সময় মহাকাশ গবেষণায় বিজ্ঞানীদের হাতে ছিল শুধুই টেলিস্কোপ। গণিত আর তত্ত্বের হিসাব আর টেলিস্কোপিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই বিজ্ঞানীদের মহাকাশে লুকিয়ে থাকা সত্যাসত্য বের করে নিয়ে আসতে হত। যুগ পাল্টেছে। কম্পিউটারের যুগ শুরু হয়েছে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। কিন্তু সেময় কম্পিউটার মানেই শুধুই গণনার যন্ত্র মাত্র। নির্দিষ্ট কিছু কাজই এই যন্ত্র করতে পারত। তবু সেই অ্যানালগ যন্ত্রের সাহায্য নিয়েই মানুষ চাঁদে গেছে। বড় বড় বৈজ্ঞানিক কার্য সমাধান করেছে। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে কম্পিউটারে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন প্রযুক্তি দুনিয়ার দুই মহাপুরম্নষ স্টিভ জবস আর বিল গেটস। আজকের মহাকাশ গবেষণা থেকে কণা পদার্থবিজ্ঞান, সর্বত্র কম্পিউটারের জয়জয়কার।
আজকের টেলিস্কোপ নিছকই টেলিস্কোপ নয়। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে কম্পিউটার জুড়ে আছে। আজ টেলিস্কোপ চোখ রেখে মহাকাশ দেখার দরকার হয় না। মহাকাশের কোনো চিত্র দেখে টেলিস্কোপের সাথে যুক্ত কম্পিউটারই বলে দেয় দূর আকাশের ওই কোণে কী লুকিয়ে আছে, তার চরিত্র, গঠন ইত্যাদি নানা হিসাব। কম্পিউটারের সবচেয়ে বঢ় সুবিধা এর গণনা করার ক্ষমতা। একটা বড় জটিল গণনা করতে হয়তে মানুষের বছরকে বছর লেগে যাওয়ার কথা, সেরকম একটা হিসাব কম্পিউটার হয়তো কয়েক সেকেন্ডে করে দেবে। কম্পিউটারের আরেকটা বড় সুবিধা এর ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা। জ্যোতিষিদের মতো হাত গুণে বুজরুকি করে ভূত-ভবিষ্যত্ বলার অভ্যাস নেই কম্পিউটারের। তারচেয়ে বরং গাণিতিক হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে বৈজ্ঞানিক কোনো গবেষণার ফল কম্পিউটার আগেই বলে দিতে পারে। পরে পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে দেখা যাবে কম্পিউটার হিসাব-নিকাষ করে যে ফলাফল পেয়েছিল, আপনি পর্যবেক্ষণের পর সেই ফলাফলটিই পাবেন। ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জি আদৌ আছে কিনা সেটার জন্য একটা কম্পিউটারের গণণা শুরু হয়েছিল।
কম্পিউটারের মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণার শুরুটা হয়েছিল গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। মার্কিন কম্পিউটেশনাল পদার্থবিদ জন পাস্তা আর স্তানিলাউ উলাম এনরিকো ফার্মির সঙ্গে মিলে কম্পিউটার সিমুলেশন পদ্ধতি ব্যাবহার শুরু করেন। তারা একটি মহাকর্ষীয় সিস্টেম প্রথমবারের মতো কম্পিউটারের মাধ্যমে গণানা করে এর প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু মাউস-মনিটর ছাড়া সেযুগের কম্পিউটার বলতে গেলে ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো। তা দিয়ে আর কতুটুকু কাজ করা সম্ভব! তবুও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কম্পিউটারের ব্যবহারের দ্বার খুলে গিয়েছিল সেই ঘটনার মাধ্যমে। মহাকাশ গবেষণায় ব্যাপকহারে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। নাসার মাধ্যমে। তখন পৃথবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারটি ছিল নাসার গবেষণাগারেই।
সেসময় নাসায় দুই সহদোর গবেষক ছিলেন। অ্যালান টুমরে এবং ইউরি টুমরে। তাঁরা একটা অভূতপুর্ব কাজ করলেন। দুটি গ্যালাক্সির মধ্যে সংঘর্ষের ব্যাপারটি তাঁরা পর্যবেক্ষণ করতে চান কম্পিউটারের সাহায্যে। এজন্য গ্যালাক্সি দুটিকে দুটি ভরপিণ্ড হিসেবে দেখিয়ে তার সাংঘর্ষিক ফলফল কী হতে পারে তার একটা হিসাব কম্পিউটার থেকে বের করলেন। সেই ঘটনাটিই মহাজাগতিক কোনো ঘটনায় কম্পিউটার ব্যবহারের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দুটো আলাদা হিসাব বের করেছিলেন। একটা হিসাব তাঁরা করেছিলেন টেলিস্কোপের সাহায্যে। দুটি গ্যালাক্সি পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে কী কী ঘটনা ঘটে তা টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখে নোট রেখেছিলেন। আরেকটিতে টেলিস্কোপ বা মহাকাশের কোনো যোগ নেই। গ্যালাক্সি দুটির ভর, গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি তথ্য কম্পিউটারে ইনপুট করে সেদুটো সংঘর্ষ ঘটলে কী হবে তার একটা হিসাব কষেছিলেন কম্পিউটারের সাহায্যে। তাঁরা অবাক হয়ে লক্ষ করেন বাস্তব পর্যবেক্ষণ থেকে যেসব ফলাফল তারা পেয়েছেন, সেই একই ফলাফল পেয়েছেন কম্পিউটার সিমুলেশন থেকেই। সুতরাং কম্পিউটার সিমুলেশনের ব্যাপারটা মহাজাগতিক গবেষণায় এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
টুমরেরা দুই ভাই ১২০টা মডেল কণা নিয়েছিলেন। এগুলো নিছকই কণা নয়। এদের একেকটা কণার ভর এক শ কোটি সূর্যের ভরের সমান। এত বিপুল পরিমাণ ভরের ১২০ কণিকা দিয়েই আসলে দুই সহোদর দুটো গ্যালাক্সিকে তুলনা করে সিমুলেশন করেছিলেন। টুমরে ভাইদের সেই যুগন্তকারী কম্পিউটার গণানায় আজকের জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যায় নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। তাদের দেখানো পথে হেঁটেই বিজ্ঞানীরা মিলেনিয়াম সিমুলেশনের অনুপ্রেরণা পান।
মিলেনিয়াম সিমুলেশন করা হয় ২০০৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা আর জাপানের একদল গবেষক মিলে এই সিমুলেশনটা করেন। এবার আর শুধু দুটি গ্যালাক্সি নয়। গোটা মহাবিশ্বের একটা তুলনামূলক চিত্র তৈরি করতে চান বিজ্ঞানীরা। মিলেনিয়াম সিমুলেশনে মহাবিশ্বের বর্তমান বস্তু বণ্টনের বিষয়টা কেমন হবে বিজ্ঞানীরা জানতে চাইলেন। এর আগে আমরা আমরা দেখেছিলাম, মহাবিস্ফোরণের তিন লাখ আশি হাজার বছর পর মহাবিশ্ব থেকে প্রথম ফোটন অর্থাৎ আলোকরশ্মি মুক্ত হয়। অর্থাৎ প্রথম আলোর জন্ম হয়। সেই আলো বা বিকিরণই আবিষ্কার করেন অর্নো আর পেনজিয়াস গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। সেটাই কসমিক মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন। মিলেনিয়াম সিমুলেশনের সেই আলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
টুমরে ভাইয়েরা তাঁদের কম্পিউটার সিমুলেশনে মাত্র ১২০টা কণা ব্যবহার করেছিলেন। অন্যদিকে মিলেনিয়াম সিমুলেশনে ১ হাজার কোটি কণা ব্যবহার করা হয়। আর এই সিমুলেশনে ব্যবহার করা হয় অত্যান্ত শক্তিশালী এক সুপার কম্পিউটার। গ্যালাক্সির জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিয়ে অনেকগুলো তত্ত্ব বা মডেল আছে। অনেকগুলো মডেলের তথ্য ইনপুট করে এই সিমুলেশন করা হয়। এরপর সিমুলেশনের পর যে চিত্র আমরা পাই তা মহাবিশ্বের একটা মডেলকেই সমর্থন করে। সেটা হলো ল্যামডা সিডিএমএ। অর্থাৎ ল্যামডা কোল্ড ডার্ক ম্যাটার মডেল।
আগেই বলেছি কম্পিউটার সিমুলেশনে যেসব কণা ব্যবহার করা হয়েছে এগুলো কণাপদার্থবিজ্ঞানের মূল কণিকা নয়। এগুলো আসলে একেকটা এক শ কোটি সৌরভরের কল্পিত বস্তু। শুধু বস্তু না বলে একেকটাকে একেটা গ্যালাক্সিও বলা যেতে পারে। এই কণাগুলোকে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে সাজানো হয়। তারপর সিমুলেশনের নিয়মানুযায়ী মহাবিশ্বের একটা মডেল তৈরি করা হয় সেই কণাগুলো দিয়ে। তারপর প্রসারণশীল মহাবিশ্ব যে নিয়মে প্রসারিত হয়, সেই নিয়মটা বেঁধে দেওয়া হয় সিমুলেশন মডেলে। মহাবিশ্বের বক্রতা আর মহাজাগতিক ধ্রুবকের মানও ইনপুট করা হয় সেই সিস্টেমে। সঙ্গে দেওয়া হয় ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জিও। তার তার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় না। এলোমেলো ভাবে ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির বিভিন্ন মান দেওয়া হয়। সত্যি বলতে কী ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির পরিমাণ বের করে নিয়ে আসাই ছিল সেই সিমুলেশনের মূল উদ্দেশ্য। এরপর শুরু হয় ক্যালকুলেশন।
যে সুপার কম্পুিটারটি একাজে ব্যাবহার করা হয় তার প্রায় আট শ প্রসেসর আর দুই টেরাবাইট মেমরি এই ক্যালকুলেশনে অংশ নেয়। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় চার মিলিয়ন ডাটা প্রসেস করে সেগুলো। তারপর বেরোয় ফলাফল। সেই ফলাফল বলে মহাবিশ্বের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং বর্তমান অবস্থা আসলে ল্যামডা সিডিএম মডেল অনুসরণ করে চলছে। এই মডেল বলে, মহাবিশ্বের মাত্র চার শতাংশ দৃশ্যমান বস্তুকণা দিয়ে গড়ে উঠেছে। বাকি ৯৬ শতাংশের ২১ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার। আর বাকি ৭৫ শতাংশই ডার্ক এনার্জি।
১৯৬০-এর দশকে ভেরা রুবিন মহাবিশ্বের যে মডেলের কথা বলেছিলেন সেখানে দৃশ্যমান বস্তু আর ডার্ক ম্যাটারের যে পরিমাণের কথা বলেছিলেন, কম্পিউটার সিমুলেশন থেকেও সেই একই মান পাওয়া যাচ্ছে।
আমরা ল্যামডা সিডিএম বা ল্যামডা কোল্ড ডার্ক ম্যাটারের কথা বলেছি। তাহলে কি ডার্ক ম্যাটারের সাথে ঠান্ডা-গরমের কোনো সম্পর্ক আছে। সত্যি বলতে কি হট ‘ডার্ক ম্যাটার’ বলে একটা শব্দ প্রচলিত আছে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে। আসলে এখানে হট আর কোল্ডকে ঠান্ডা বা গরম বোঝায় না। ডার্ক ম্যাটারকে অতি ঘন এক রহস্যময় গুপ্ত পদার্থ বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। সেগুলো একসঙ্গে স্তুপের মতো গতিহীন বস্তুপিণ্ড বলে মনে করেন ডার্ক ম্যাটার গবেষকরা। এগুলো হলো কোল্ড ডার্ক ম্যাটার। আরেক ধরনের ডার্ক ম্যাটার আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। সেগুলো অত্যান্ত গতিশীল। যেমন, নিউট্রিনো। তাহলে কি নিউট্রিনো আসলেই ডার্ক ম্যাটার?
এই বইয়ের সব পর্ব
- গুপ্ত ভরশক্তির খোঁজে
- প্রাচীন মহাবিশ্ব
- আধুনিক মহাবিশ্ব
- মহাবিস্ফোরণ
- কী ঘটেছিল মহাবিস্ফোরণের পর?
- গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং
- জুইকি থেকে রুবিন
- যা চেয়েছি আর যা পেয়েছি
- ছায়াপথ স্তবক
- মূল কণিকাদের গল্প
- স্ট্যান্ডার্ড মডেল
- প্রতিসাম্যতা
- ডার্ক পার্টিকেলের খোঁজে
- মিলেনিয়াম সিমুলেশনে ডার্ক ম্যাটার
- নিউট্রিনো কি ডার্ক ম্যাটার?
- স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ত্রুটি সুপারসিমেট্রিতে সমাধান
- ডার্ক ম্যাটারের প্রার্থী কারা?
- কীভাবে শনাক্ত হবে ডার্ক পার্টিকেল?
- গামা রশ্মির সন্ধানে
- মহাবিশ্বের সম্প্রারণ ও ডার্ক এনার্জি
- সুপারনোভার জন্ম
- আদর্শ বাতির খোঁজে
- আদিম আলোয় বিশ্ব দেখা
- মহাকাশের মানচিত্রে গুপ্ত ভরশক্তি
- কুইন্টেসেন্স তত্ত্ব
- ডার্ক ফোটনের সন্ধানে
- উপসংহার