১৮৬৫ সাল। নিউটনের পরে এবং আইনস্টাইন এর আগে সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী বলা হয়ে থাকে, সেই স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটালেন। যেটাকে এই বিজ্ঞান জগতে ম্যাক্সওয়েলের বিপ্লব বলা হয়। তিনি তিনি বিদ্যুৎ ও চুম্বকের তত্ত্বগুলির সমন্বয় ঘটালেন। শূন্যস্থানে শক্তি ক্ষেত্রের অবতারণা করলেন। অবশ্য এর জন্য তিনি মাইকেল ফ্যারাডের কাছে ঋণী। মাইকেল ফ্যারাডে প্রথম দেখিয়েছিলেন, বিদ্যুৎ তরঙ্গ শূন্যস্থানে বল ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। ফ্যারাডের সেই ক্ষেত্র তত্ত্বকে আরো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল।
ম্যাক্সওয়েলই প্রথম বলেন, আলো, বিদ্যুত্ আর চুম্বক একই বলের তিনটি আলাদা রূপ। তিনি বলেন এই বল পরিবাহিত হয় বিদুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ আকারে। আসলে বিদ্যুত্চুম্বক তরঙ্গের উেসর আশপাশে একটা শক্তি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে রাখে। সেই ক্ষেত্রের উপর ঢেউ তুলে এগিয়ে চলে বিদুত্চুম্বকীয় তরঙ্গ। আসলে সেই বলড়্গেত্রটি হল স্থান এবং কাল।
আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিতায় স্থান-কালের ক্ষেত্র ধারণা নিয়েছিলেন ম্যাক্সওয়েলের বিদুত্চুম্বকীয় ক্ষেত্র তত্ত্ব থেকে। ম্যাক্সওয়েল দেখান স্থান-কালের ওপর বিদ্যুত্চুম্বকীয় শক্তি এক ধরনের আন্দোলন তোলে। আন্দোলনই দুটো চুম্বকক্ষেত্রকে একই স্থানে থেকে আর একই স্থানে বয়ে নিয়ে যায়।
পরে আইনস্টাইনের যখন তার আপেক্ষিকতায় ক্ষেত্রতত্ত্ব প্রয়োগ করলেন তখন তখন অদৃশ্য স্থান-কাল বিজ্ঞানীদের নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলল। আর সেই ভাবনায় আর এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটালেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ।
কোয়ান্টাম মেকানিকস দাঁড়িয়ে আছে অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ওপর, গতে শতাব্দীর কুড়ির দশকে যেটা দাঁড় করিয়েছিলেন জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। সেই তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেই বেরিয়ে আসে আরেকটা তত্ত্ব-কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। এই তত্ত্ব বলে, শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। তার ভেতর লুকিয়ে আছে শক্তি। সেই শক্তির যোগান দেয় ভার্চুয়াল কণারা।
শূন্যস্থানে আসলে সবসময় এই কণা-প্রতি-কণার সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলা চলছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতি মুহূর্তে সব জায়গায় কণা আর প্রতি-কণার জোড়া তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তারা খুব ক্ষণস্থায়ী। জন্মের সাথে সাথেই এরা পরস্পরের সাথে সংর্ঘষ ঘটিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শক্তি। সেই শক্তিই পরক্ষণে আবার একজোড়া কণা-প্রতিকণা তৈরি করে। এভাবেই প্রকৃতিতে চলছে ভার্চুয়াল কণাদের ভাঙাগড়ার খেলা।
১৯২০ এর দশক। ডেনিস বিজ্ঞানী নীলস বোরের নেতৃত্বে যখন পতপত করে উড়ছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জয়পতাকা। দুনিয়াজুড়ে তরুণ বিজ্ঞানীরা ঝুঁকে পড়েছেন সেদিকে। বছর পঁচিশ বয়সের ব্রিটিশ তরুণ পল ডিরাক। সেই ডিরাকও ছিলেন নিলস বোরের ছাত্র। ১৯২৮ সাল। ততদিন এই বিজ্ঞানী এরউইন শ্রোডিঙ্গার প্রকাশ করেছেন তাঁর বিখ্যাত তরঙ্গ সমীকরণ। কিন্তু শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণে একটা সমস্যা ছিল। এই সমীকরণ গতিশীল ইলেকট্রন কণিকাদের আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু সেটা কম গতির ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে বেশ ভালো কাজ দেয়। উচ্চগতির ইলেকট্রনদের আচরণের ব্যাখ্যা ঠিকমতো ব্যখ্যা করতে পারে না।
পল ডিরাক এর একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করলেন। শ্রোডিঙ্গারের সমীকর শুধুই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বলবিদ্যার সম্পত্তি। আপেড়্গিক তত্ত্বের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। পল ডিরাক সেই সমীকরণে আপেড়্গিকতার আমদানি করলেন। আপেড়্গিকতার অন্যসব সমীকরণগুলো সাথে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তফাতটা চোখে পড়ার মতো। কিন্তু E=mc2 সমীকরণ কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যবহার করতে গিয়ে অতটা ঝামেলায় পড়তে হয় না। পল ডিরাক তাই আপেক্ষিকতার ভর-শক্তি সমীকরণকেই আগে বেছে নিলেন কোয়ান্টামের সাথে আপেড়্গিতার মেলবন্ধন ঘটাতে।
পল ডিরাকের ঋণাত্মক মানের প্রতি একটু বাড়তি দুর্বলতা ছিল। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমীকরণে ঋণাত্মক মান এর স্থান ছিল না। পল ডিরাক প্রথমেই এই সমীকরণে ঋণাত্মক রাশি যোগ করলেন। তখন বদলে যাওয়া সমীকরণটা দাঁড়াল, E=±mc2 সে যুগের বিজ্ঞানীরা শক্তির ঋণাত্মক মানকে অবাস্তব মনে করতেন। অবাস্তব বাস্তবতার জগতে ঠাঁই দিতে তারা রাজি ছিলেন না। সুতরাং শক্তি ঋণাত্মক মান নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাননি কখনো। কিন্তু পল ডিরাকের এটা দরকার ছিল। তিনি তাই ভর-শক্তির সমীকরণে ঋণাত্মক মান রেখে দিলেন। আর এটা করতে গিয়েই গোল বাঁধল। ভর ও শক্তির ঋণাত্মক মান ঋণাত্মক কণিকার আভাস দিল। যেহেতু ডিরাক ইলেকট্রনের আচরণ আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছিলেন, তাই নতুন এই সমীকরণ ঋণাত্মক ইলেকট্রনের ভবিষত্বাণী করল। হিসাব মতে সেই ইলেকট্রনের ভর হবে বাসত্মব ইলেক্ট্রনের সমান। কিন্তু চার্জ হবে ইলেকট্রনের বিপরীত। অর্থাৎ ধনত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন। পরে সেই বিপরীত ইলেকট্রনের নাম হলো পজিট্রন।
ডিরাক তো তত্ত্ব দিয়েই খালাস। বিপরীত কণিকার অসিত্মত্বের প্রমাণ কিভাবে আসবে?
ডিরাক দায়সারা গোছের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, বিশেষ ঋণাত্মক বিদ্যুত্চুম্বকীয় ক্ষেত্রেই এই বিপরীত ইলেকট্রন পাওয়া যেতে পারে। সাধারণ অবস্থায় ইলেকট্রন আমাদের চিরচেনা বিদ্যুচ্চুম্বকীয় ড়্গেত্রের ভেতর চলে তার মান ধনাত্মক। কিন্তু বিপরীত ইলেকট্রনগুলো চলাচল করবে ঋণাত্মক বিদ্যুচ্চুম্বকীয় ড়্গেত্রে।
ডিরাক তখন নতুন এক কথা শোনালেন। বললেন, ইলেকট্রন যে শক্তিসত্মরগুলোতে থাকে পরমাণুর ভেতর বা বিদ্যুচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রে, সেগুলো দুই ধরনের হয়। একটা ধনাত্মক আরেকটা ঋণাত্মক শক্তিসত্মর। সাধারণ ইলেক্রটনগুলো ধনাত্মক শক্তিসত্মরে থাকে, আর ঋণাত্মক শক্তিসত্মরে থাকে বিপরীত ইলেকট্রনগুলো। তিনি আরো বললেন, মহাবিশ্বের সব ঋনাত্মক শক্তিসত্মর কোনো এক কারণে আগেই পূর্ণ হয়ে গেছে। তাই বিপরীত ইলেকট্রনের থাকবার কোনো জায়গা নেই। এজন্য বিপরীত ইলেকট্রন অর্থাত্ পজিট্রন আমরা বাসত্মব জগতে দেখতে পাই না। তারমানে এই নয়, সেগুলো পাওয়া অসম্ভব। ডিরাক বললেন, যদি বিশেষ সেই ঋণাত্মক শক্তিসত্মর আমরা তৈরি করতে পারি তবে পজিট্রনের দেখা পাওয়া সম্ভব। অনেকেই তার কথা বিশ্বাস করলেন না।
তবে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। ১৯৩২ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল অ্যান্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করলেন। তখন এই বিপরীত কণা বা প্রতিকণা আর শুধু তত্ত্বেই সীমাবদ্ধ রইল না। তখন অন্য বিজ্ঞানীরা বললেন শুধু ইলেকট্রনের কেন, অন্য কণাদেরও বিপরীত কণা থাকা উচিত। সেটাও প্রমাণ করতে বেশিদিন সময় লাগল না। ১৯৫৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিজ্ঞানী প্রতিপ্রোটন এবং ১৯৫৬ সালে প্রতিনিউট্রন আবিষ্কার হল।
১৯৫১ সালে মার্কিন জুলিয়ান সুইংগার প্রমাণ করলেন শূন্য স্থানের ভেতরেই যদি প্রবল তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি করা যায় তাহলে কণাগুলো আর ভার্চুয়াল থাকে না। সেগুলো বাস্তব কণায় পরিণত হয়।
এই যে শূন্যস্থানের শক্তির কথা বলা হচ্ছে, এ শক্তিকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন ইনফ্লেশন তত্ত্বের নায়কেরা। শুরম্নটা করেছেলিনের নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যপক এডওয়ার্ড ট্রিয়ন। ১৯৭০ সালে একটা বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। সেই সম্মেলনে কোনো একজন বিজ্ঞানী কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে কথা বলছিলেন। তন্ময় হয়ে সেই বক্তৃতা শুনছিলেন ট্রিয়ন। তারপর হঠাত্ তার মাথায় আসে এক যুগান্তকারী ভাবনা। তিনি বলেন, ‘আমাদের মহাবিশ্বটা হয়তো স্রেফ ভ্যাকুয়াম ফ্ল্যাকচুয়েশনের ফসল।’ সেদিন তাঁর কথা কেউ আমলে নেয়নি। বরং হাসির রোল ওঠে সভাকক্ষ জুড়ে।
কিন্তু দমে গেলেন না ট্রিয়ন। তিনি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে শুরম্ন করলেন। তারপর দুই বছর খেটেখুটে প্রবন্ধ দাড় করালেন। ১৯৭৩ সালে তিনি সেটা পাঠালেন বিখ্যাত নেচার পত্রিকায়, চিঠিপত্র বিভাগে ছাপার জন্য। কিন্তু নেচারের সম্পাদক লেখাটার গুরুত্ব বুঝলেন। সেটা ছাপালেন ফিচারের আকারে।
ট্রিয়নের সেই ধারণা এক সময় সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যায় কাজে লাগান ইনফ্লেশন তত্ত্বের তিন জনক ডেমোস কাজনাস, অ্যালান গুথ ও আন্দ্রে লিন্ডে। তাঁরা দেখাতে সক্ষম হন, শূন্যস্থান থেকেই মহাবিশ্বের জন্ম। আর সেই মহাবিশ্বই পরে ইনফ্লেশন বা স্ফীত হয়ে ধীরে ধীরে পরিণত মহাবিশ্বে আত্মপ্রকাশ করেছে।
শূন্যতার শক্তির সমস্যাটা অন্য জায়গায়। বিজ্ঞানীদের কথা মেনে ধরেই নিলাম ভ্যাকুয়াম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল। তবু কি সব সমস্যার সমাধান হয়। প্রথম প্রশ্নটা হলো, আমাদের যে পদার্থবিজ্ঞানের নীতি সেটা আমাদের মহাবিশ্বের জন্য প্রযোজ্য। কারণ কোয়ান্টাম ক্ষেত্র বলুন, আর শূন্যতার শক্তি বলুন, এগুলো তো আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের নীতির মধ্যেই পড়ে। মহাবিস্ফোরণের আগে যে শূন্যতা সেটা কেমন? শূন্যস্থানের যে শক্তির কথা বলছি, তার জন্য দরকার হয় মহাবিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকে স্থান-কালের চাদর বা ড়্গেত্রের মধ্যে। কিন্তু এই স্থান-কালেল জন্ম মহাবিস্ফোরণের পর। তাই স্থানকালের যে কোয়ান্টাম শক্তি, সেটার জন্মও নিশ্চয় মহাবিস্ফোরণের পর।
শূন্যস্থানের শক্তির মাধ্যমে কণা তৈরির যে ব্যাপারটা, সেটা হতে গেলে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের দরকার হয়, স্থান কালের দরকার হয় আর দরকার হয় কোয়ান্টাম মেকানিকসের। কিন্তু এসব কিছুরই জন্ম মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। মহাবিস্ফোরণের আগে স্থানকাল থাকার কথা নয়, থাকার কথা নয় কোনো কোয়ান্টাম ক্ষেত্রেরও। সেখানে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানও অচল হওয়ার কথা। কিন্তু মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে এটাও তো সত্যি। মহাবিস্ফোরণের আগে যে পরম শূন্য ছিল, সেটা কি তবে শূন্য নয়? সেখানেও কি কাজ করেছিল পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র? তাই যদি হয়, সেখানেও কোয়ান্টাম ক্ষেত্র ছিল। সেই ক্ষেত্র কি আলাদা কোনো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিল? সেই মহাবিশ্বের কোনো বিন্দুতে বিগ ব্যাং ঘটে আমাদের একটি শাখা মহাবিশ্বের জন্ম। অর্থাৎ আমাদের এই মহাবিশ্বের কি আরেকটা মাতৃ মহাবিশ্ব আছে? সেই মহাবিশ্বের কি আমাদের মহাবিশ্বের মতো আরও কোনো সন্ত্মান আছে? হয়তো সেই সন্তানগুলোই আমাদের প্যারালাল ইউনিভার্স?
আরেকটা মজার প্রশ্ন এখানে করে ফেলতে পারি। আমাদের এই মহাবিশ্বের নিশ্চয়ই সীমা আছে। সীমা থাকলে এর প্রসারণও সম্ভব হত না। সেই সীমার বাইরে কী আছে। নিশ্চয়ই শূন্যতা আছে? সেই শূন্যতা নিশ্চয়ই আমাদের মহাবিশ্বের ভেতরে যে স্থানকালের শূন্যতা তার মতো নয়? সেই শূন্যতারই কোনো একটা বিন্দুতেই তো মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল আর জন্ম নিয়েছিল আমাদের মহাবিশ্ব।
যাইহোক, এ প্রশ্নের সঠিক সমাধান আমাদের বিজ্ঞানীদের হাতে আসেনি। কিন্তু বিজ্ঞানের যেভাবে উন্নতি ঘটছে হয়তো এসব উত্তর পেতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। ততদিন এটা অমীমাংসিতই রয়ে যাবে।
চলবে…
লেখকের বইগুলো ঘরে বসে কিনতে পারবেন রকমারি থেকে