আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র: বিজ্ঞানী হতে সফল উদ্যোক্তা

3
522

একটা সময় অনেকেই মনে করতেন বাঙালির মস্ত দোষ হচ্ছে তাদের আলস্য আর এইজন্যেই নাকি তাদের দ্বারা ব্যবসা বাণিজ্যের মত মহা কর্মযজ্ঞ কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু এই কথাকে ভুল প্রমাণিত করে আজকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে বাঙালি নতুন প্রজন্ম নিজেদের মেধা কর্মদক্ষতা দ্বারা একটি উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছে। বাঙালির এই কর্মযজ্ঞে সাফল্যের পথিকৃৎ হিসেবে যাকে আমরা স্মরণ করতে পারি তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি একজন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী হিসেবে ও যে মানুষটি একজন কর্মবীর হিসেবে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলি গ্রামে তাঁর জন্ম হয় ১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট। বাবা হরিশ্চন্দ্র রায় ছিলেন স্থানীয় জমিদার। মা ছিলেন ভুবনমোহিনী দেবী। সকলে তাকে ডাকত “ফুলু” বলে। প্রফুল্লচন্দ্রের বাবা ছিলেন যেমন প্রাচ্য শিক্ষায় শিক্ষিত ঠিক তেমনি পাশ্চাত্যের সমৃদ্ধ কৃষ্টির অনুরাগী। এজন্যে ছোটবেলায় ঘরেই যখন প্রফুল্লচন্দ্রের জ্ঞানচর্চার হাতেখড়ি হয় জমিদার ও তথাকথিত উচ্চ হিন্দু বংশের সন্তান হওয়া সত্বেও কখনো কোনরূপ গোঁড়ামি তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। বাবার কাছ থেকে শেখা স্বাভাবিক শিক্ষাগত ঔদার্যই তাঁকে পরবর্তীতে প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক ও প্রণিধানযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।পাশাপাশি নিজের গ্রামেই বাবার একটা নিজস্ব লাইব্রেরি থাকার কারণে সেই লাইব্রেরির বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তার জ্ঞানপিপাসা বাড়িয়ে দিয়েছিল ভীষণ ভাবে।

স্থানীয় পড়াশুনোর পাট শেষ হবার পর তাকে ভর্তি করা হল কলকাতার হেয়ার স্কুলে। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য খুব একটা ভাল না থাকায় এর দু বছর পরেই তিনি রক্ত আমাশয়ে আক্রান্ত হলেন। এই সময়ে তাঁর পড়াশুনোর কিছুদিন বিরতি থাকায় তিনি এরপর ভর্তি হলেন কেশবচন্দ্র সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এলবার্ট স্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বিদ্যাসাগর কলেজ(তৎকালীন মেট্রোপলিটন কলেজ) থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এফ এ পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন।

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি এরপর “গিলক্রিস্ট স্কলারশিপ” নিয়ে বিলেতে পাড়ি জমান। বিলেতে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে পড়াশুনায় যথেষ্ট পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেন। বিলেতে থাকাকালীন সময়েই তিনি “সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা” শীর্ষক একটি রাজনৈতিক গবেষণামূলক বই লেখেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের রাজনৈতিক জ্ঞান ও যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। ছয় বছর পর তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “ডক্টর অফ সায়েন্স” উপাধি অর্জন করেন। (তার আগে আর মাত্র একজন বাঙালি এই উপাধি অর্জন করতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন সরোজিনী নাইড়ুর বাবা ডাঃ অঘোর নাথ চট্টোপাধ্যায়।) বিলেতে থাকাকালীন সময়ে তাঁর জ্ঞানসাধনা সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন-

“আমি যখন এডিনবরাতে পড়তাম “India & British Rule” নামে একটি বই লিখেছিলাম। ফলে লর্ড বায়রনের মত “Awoke one fine morning and found myself famous” এইরকম ভাবে রাজনীতির চর্চা করেছি, নানা প্রকার বই লেখার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি রসায়ন শাস্ত্র অধ্যয়ন ও গবেষণার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি।”

দেশে ফিরেই তিনি শুরু করেন তাঁর কর্মযজ্ঞ। প্রথমেই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপকের পদে যোগ দিলেন। এখান থেকেই তিনি তাঁর গবেষণা চালাতে থাকেন। তাঁর প্রথম গবেষণার ফল বের হয় জার্নাল অফ এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলে। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল মারক্যুরাস নাইট্রাইট। নাইট্রাইট যৌগসমূহ খুব বেশি স্থায়ী হয়না। এইজন্যে তিনি ওইসময় প্রেসিডেন্সি কলেজে বসে সামান্য কিছু যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সহজেই অপেক্ষাকৃত স্থায়ী নাইট্রাইট তৈরির উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন যেটি ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের কাছে বিস্ময়ের কারণ ছিল। এই কাজের স্মরণে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে প্রশংসা করেছিলেন এই বলে-

” বিসম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালি দিয়েছে বিয়া,
বাঙালির নব্য রসায়ন শুধু গরমিলে মিলাইয়া।”

১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত এই কয়েক বছরেই ধাতব নাইট্রাইট এর উপরে তার গবেষণা বিভিন্ন কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ছাড়া পারদ-সংক্রান্ত ১১টি মিশ্র ধাতব যৌগ আবিষ্কার করে তিনি রসায়নজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এ ছাড়া তিনি সম্পূর্ণ নতুন উপায়ে গবাদি পশুর হাড় পুড়িয়ে তাতে সালফিউরিক এসিড যোগ করে তিনি সুপার ফসফেট অব লাইম তৈরি করেন। ভৌত রসায়নের বিভিন্ন বিষয়ে তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার ফলাফল আমরা দেখতে পাই তার গবেষণাপত্রের মান এবং তার সংখ্যায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকাকালীন সময়ে দেশি বিদেশি নাম করা জার্নালে তার সর্বমোট গবেষনাপত্র ১০১ টি।

একজন গবেষক হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্র যেরকম অসম্ভব মেধার পরিচয় দিয়েছেন ঠিক সেরকমভাবেই শিক্ষক হিসেবেও স্থায়ী আসন গ্রহণ করেছেন তাঁর ছাত্রদের হৃদয়ে। নিজের ছাত্রদের তিনি পুত্রবৎ স্নেহ করতেন এবং খুব আনন্দঘন ভাবে সকল জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলিকে তিনি ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করতেন। শিক্ষক হিসেবে নিজের ভূমিকা সম্বন্ধে তিনি নিজের আত্মরচিতে বলেছেন-

“প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার ২৭ বছর অধ্যাপনা জীবনে আমি সচেতনভাবে প্রধানত: নিচের ক্লাসেই পড়াতাম। কুমোর যেমন কাদার ডেলাকে তার পচ্ছন্দমত আকার দিতে পারে হাই স্কুল থেকে সদ্য কলেজে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের তেমনি সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়। আমি কখনও কোন নির্বাচিত পাঠ্যবই অনুসরণ করে পাঠদান দিতাম না ”

তিনি কেবল মাত্র তার নিজের যশ খ্যাতি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেননি। পাশাপাশি তৈরি করেছেন এক দল দক্ষ ছাত্র ও সহকারী গবেষকদের যারা তার কাজে যুগপৎ সাহায্য করেছেন এবং পরবর্তীতেও নিজেদেরকে স্বাধীন ও প্রকৃষ্ট গবেষক রূপে গড়ে তুলেছেন। নীলরতন ধর, রসিকলাল দত্ত, পঞ্চানন নিয়োগী, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নামজাদা বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের দ্বারাই উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত ডিগ্রির দিকে না তাকিয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন একজন ছাত্রের গবেষণার প্রবৃত্তি ও উৎসাহের উপর। তাঁর একজন ছাত্রকে সাথে নিয়ে তিনি এমাইন নাইট্রেট আবিষ্কার করেছিলেন। অথচ শ্রীযুক্ত রক্ষিত নামের এই সহকারীটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তার গবেষণার সুপ্ত প্রতিভা প্রফুল্লচন্দ্র ঠিকই অনুভব করতে পেরে তাকে পরবর্তী গবেষণার সুযোগ দিয়ে বিজ্ঞানচর্চায় ভূমিকা রাখেন আর এইখানেই ছিল একজন শিক্ষক হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্রের সার্থকতা।

১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি অবসর নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, যতদিন তিনি অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ততদিন তিনি এক কপর্দক বেতন নেননি। এই অর্থ সঞ্চিত থাকত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি সব সময় তাঁর ছাত্রদের নিজের অলংকার হিসেবে বিবেচনা করতেন। জাগতিক কোন কিছুর প্রতি তাঁর কোন লোভ ছিল না কখনওই।

শুধুমাত্র গবেষণার কাজে তিনি নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখেন নি। জ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে তাঁর অর্জিত সকল অভিজ্ঞতাকে তিনি শক্তিরূপে নিয়োগ করেছিলেন দেশের কাজে। যেখানেই দারিদ্র্য, বন্যা, মহামারি,দুর্যোগ সেখানেই তিনি তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করেছেন। সমগ্র বিশ্বই ছিল তাঁর সংসার। তাই তিনি বৈরাগ্যের মধ্যেই নিজের কর্মযজ্ঞের দ্বারা নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন।

তখন ছিল ইংরেজ শাসনামল। শাসকের অধীনস্ত হয়ে কখনও তিনি কোন অন্যায় সহ্য করেননি। এর স্বরূপ আমরা দেখতে পাই ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাশ কৃত বঞ্চনাকর রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ১৯১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি কলকাতা টাউন হলে চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ সভা হয় সেখানে প্রফুল্লচন্দ্র ও যোগদান করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন-

“আমি বৈজ্ঞানিক, গবেষণাগারেই আমার কাজ, কিন্ত এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও দেশের আহবানে সাড়া দিতে হয়।। আমি অনিষ্টকর এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ করিতেছি।”

এছাড়া আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র মহাত্মা গান্ধীর একান্ত অনুরাগী ছিলেন। দেশজ পণ্য ব্যবহারের জন্য যে আন্দোলন তখন বৈপ্লবিক আকার ধারণ করে সেই আন্দোলনে প্রফুল্লচন্দ্র ও একাত্মতা ঘোষণা করেন। ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর খাতায় তাঁকে “বিজ্ঞানীর বেশে বিপ্লবী” নামে ডাকা হত। ১৯৩০ সালে লবণ আইন অমান্যের স্থান হিসেবে তিনি নিজের গ্রাম রাড়ুলিকে নির্বাচিত করেন।

পাশ্চাত্যের অনেক আগে থেকেই প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগ থেকেই বিভিন্ন মুনি ঋষির হাত ধরে বিজ্ঞান চর্চা সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। প্রফুল্লচন্দ্রকে এই বিষয়টি আকৃষ্ট করে প্রবলভাবে আর তাই তিনি সেই বৈদিক যুগ থেকে চলে আসা হিন্দু রসায়নের ক্রমবিবর্তনকে লিপিবদ্ধ করবার উদ্যোগ নেন। ১৯০৪ এবং ১৯১৯ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় তার রচিত ” আ হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি” বা ” হিন্দু রসায়নের ইতিহাস”। এটি তাঁর অসামান্য কীর্তি। সেই সময় তিনি বিভিন্ন পুঁথিপত্রের উপর বিস্তর গবেষণা করে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। পুরো ভারতবর্ষ, নেপাল ও লন্ডনের অনেক জায়গা ঘুরে তিনি এই গ্রন্থ লেখবার দুষ্প্রাপ্য ও প্রয়োজনীয় পাণ্ডুলিপি ও পুঁথি সংগ্রহ করেন। এই বইটির উপর একটি আলোচনা মূলক প্রবন্ধে গবেষকগণ মন্তব্য করেন,

“In this book he showed from an unbiased scientific standpoint, how much the knowledge of acids, alkali, metals, and alloys proceeded in different epochs of Indian history. He showed that, the science of metallurgy and of medicine had advanced significantly in ancient India; when Europe was practicing alchemy, India was not far behind.”

এই বইটির প্রশংসা করে তৎকালীন প্রখ্যাত রসায়নবিদ মারসেলিন বার্থেলো স্বয়ং চিঠি লেখেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে। সেইসময়ে বিশেষতঃ পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের কাছে ভারতীয় উপমহাদেশের বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানচর্চায় সমৃদ্ধির কথা জানানোর জন্যে বার্থেলো প্রফুল্লচন্দ্রকে ধন্যবাদ জানান।

এতক্ষণ যে প্রফুল্লচন্দ্রের কথা বললাম তিনি একজন গবেষক, বিজ্ঞানের ইতিহাসবেত্তা, ছাত্রদের কাছে অতি প্রিয় শিক্ষক এবং দেশপ্রেমিক। কিন্তু প্রফুল্লচন্দ্র একজন গুণী শিল্পোদ্যোক্তাও ছিলেন। তিনি অসাধারণ বাণিজ্যিক দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। মাত্র আটশ টাকা মূলধনে আপার সার্কুলার রোডের একটা ছোট্ট ঘরে প্রফুল্লচন্দ্র গড়ে তুললেন তার স্বপ্নের বেঙ্গল কেমিক্যালস এন্ড ফার্মাসিটিউক্যালস ওয়ার্কস। প্রচণ্ড ধৈর্য আর নিষ্ঠার সাথে অক্লান্ত পরিশ্রমে যে প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুললেন -যার মূলধন ছিল মাত্র ৮০০ টাকা সেই পরিমাণ আজকে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় আট কোটি টাকার কাছাকাছি। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি ছিলেন অসম্ভব ন্যায়নিষ্ঠ এবং সততাই ছিল তাঁর সাফল্যের মূলমন্ত্র। আজকে অনেক ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তাদের (বিশেষত তরুণ উদ্যোক্তাদের) পুঁজি-মূলধন নিয়ে আক্ষেপ করতে শোনা যায়। এই হতাশায় প্রফুল্লচন্দ্রের আদর্শ আমাদের সামনে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে।

প্রফুল্লচন্দ্র অধ্যাপনা থেকে ৭৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের অধ্যয়ন ও জ্ঞানচর্চা করে গেছেন। জ্ঞানচর্চাকেই তিনি তাঁর জীবনের সাধনা ও একমাত্র ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। এইজন্যে তিনি কখনো বিয়ে করেন নি।

মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। অধ্যাপক থাকার সময় ডক্টর কুদরত ই খোদা এম এস সিতে প্রথম স্থান অধিকার করলে অনেকে তাকে প্রথম স্থান না দেওয়ার জন্যে প্রফুল্লচন্দ্রকে সুপারিশ করলে তিনি এর ঘোর বিরোধিতা করেন এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি জাতিভেদ প্রথায়েও বিশ্বাসী ছিলেন না। প্রাচীন ভারতে হিন্দু রসায়ন চর্চা তথা বিজ্ঞান সাধনার এত সমৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও জ্ঞান বিজ্ঞানে ভারতীয় উপমহাদেশের পিছিয়ে পড়ার পেছনে তিনি জাতিভেদ প্রথাকেই দায়ী করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে দেখিয়েছিলেন যাদের কাছে বিজ্ঞানের হাতে কলমে ফল পাওয়ার তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাদেরকে যখন জ্ঞান চর্চা থেকে বিরত রাখা হয় তখন থেকেই আস্তে আস্তে বিজ্ঞানের বিস্তারের দুয়ার ও সংকীর্ণ হতে থাকে। জীবন যাপনে তিনি ছিলেন একদম সাদামাটা। এক পয়সার বেশি সকালের নাশতার পেছনে ব্যয় করলে রেগে যেতেন। জামাকাপড় ও খুবই সাধারণ মানের পরতেন। অনেক মানুষ এত বড় অধ্যাপকের পোশাক দেখে অবাক হয়ে যেতেন। নিজে চরকা কেটে পোশাক তৈরি করেছেন নিজের জন্যে। তার অর্থের একটা বড় অংশ চলে যেত বিভিন্ন কলেজ, মানবকল্যান সংস্থা, দরিদ্র তহবিল, বিজ্ঞান সংগঠন প্রভৃতির প্রতি। সেই সময় বাংলায় স্থাপিত এরকম কোন শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে তার অনুদান ছিল না। ১৯০৩ সালে তিনি দক্ষিণবঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন আর কে বি কে হরিশ চন্দ্র ইনষ্টিটিউট (বর্তমানে কলেজিয়েট স্কুল)। নিজের গ্রামে তার দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়  যশোর-খুলনার প্রথম বালিকা বিদ্যালয় “ভুবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয়।” বাগেরহাট পিসি কলেজ তারই কীর্তি। সাতক্ষীরা চম্পাপুল স্কুলও পি সি রায়ের অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত। খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ, বরিশালে অশ্বিণী কুমার ইনষ্টিটিউশন, যাদবপুর হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল সহ প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে তিনি আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পি সি রায় ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা দান করে ছিলেন। একাধারে একজন শিল্পাদ্যোক্তা, সমাজ সংস্কারক,দার্শনিক, কবি, শিক্ষানুরাগী, বিপ্লবী দেশপ্রেমিক, অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে

” আমি বৈজ্ঞানিকের দলে বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী সমাজে ব্যবসায়ী, গ্রাম সেবকদের সাথে গ্রাম সেবক আর অর্থনীতিবিদদের মহলে অর্থনীতিজ্ঞ।”

১৯৪৪ সালের ১৬ ই জুন ৮৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের পুরো জীবনটি এক অনির্বচনীয় প্রেরণার উৎস। তাঁর প্রতি আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধা অর্থপূর্ণ হবে তখনই যখন আমরা তার জীবন দর্শনকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে যাব।বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে তিনি একজন সত্যিকার জ্ঞানতপস্বীর দৃষ্টান্ত।

সহায়িকা

১। আত্মচরিত- আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়
২। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র – শ্রী ফণীন্দ্রনাথ বসু
৩। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের জীবনবেদ- নন্দলাল মাইতি
৪। পাইকগাছা ও কয়রা থানার স্মরনীয় ও বরণীয় যারা- সম্পাদনা-শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু
৫। P. C. Ray, “Life and experiences of a Bengali chemist,” 2 vols. Calcutta: Chuckervertty, Chatterjee & Co. 1932 and 1935

-অতনু চক্রবর্তী
অণুজীব বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী,
বুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিন কোরিয়া

3 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.