কৃষ্ণগহ্বর-১৫ : নক্ষত্রের জন্ম মৃত্যু

2
746

অন্ধকার আর নির্জনতাকে বড্ড ভালোবাসতেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। আকাশের কাছে গভীর আকুতিভরা কণ্ঠে বলেছিলেন–
‘এখন পবিত্র অন্ধকার;
হে আকাশ, হে কাল শিল্পী, তুমি আর সূর্য জাগিয়ো না;…’
জীবনানন্দের কথা কি শুনবে আকাশ? সূর্য কি সত্যিই আর জাগবে না?
মহাবিশ্বে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মহাজাগতিক মেঘ। হাইড্রোজেনের মেঘ। সেসব মেঘ মহাকর্ষ বলের আকর্ষণের প্রথমে জড়ো হতে শুরু হয়। যত কাছাকাছি হয় হাইড্রোজেনের মেঘ, মহাকর্ষ বলের প্রভাব আরো বাড়ে। ফলে দ্রুত সংকুচিত হতে শুরু করে হাইড্রোজেন মেঘ। ফলে গ্যাসের চাপও বাড়ে। সেই চাপ কাজ করে মহাকর্ষ বলের বিপরীত দিকে।

এই অবস্থায় মহাকর্ষ বলের কারণে গ্যাসের সংকোচন আর গ্যাসের বিপরীতমুখী গ্যাসের চাপে স্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারত নক্ষত্র। কিন্তু সেটা হয় না। হতে দেয় না সবল নিউক্লীয় বল। মহাকর্ষ বাড়তে থাকে হাইড্রোজনের ঘনত্ব। খুব কাছাকাছি চলে আসে হাইড্রোজেনের পরমাণুগুলো। সঙ্গে বাড়ে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলির গতিও−ধাক্কা খায় একে অপরের সাথে। সেই ধাক্কায় জন্ম হয় তাপের। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরমাণুর ধাক্কায় জন্মানো তাপের পরিমাণ কম নয়। তাই হু হু করে বাড়তে থাকে হাইড্রোজেন মেঘের তাপমাত্রা। একসময় তাপমাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যখন ঘটে সবল নিউক্লীয় বল সক্রিয় করার মতো যথেষ্ঠ শক্তি পেয়ে যায়। আগেই বলেছি, নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন। আর তাদেরকে একসাথে ধরে রাখে সবল নিউক্লীয় বল। কিন্তু হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসে থাকে শুধুই প্রোটন। এই প্রোটন আর প্রোটনে বৈদ্যুত কিভাবে ধনাত্মক। তাই এরা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। কিন্তু বৈদ্যুতিক বল থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী সবল নিউক্লীয় বল। হাইড্রোজেনের পরমাণুর যদি সংঘর্ষ ঘটিয়ে পরস্পরের প্রচণ্ড তাপ উৎপন্ন করে। সেটা একসময় ১ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। তখন সেই শক্তিতে সক্রিয় হয় সবল নিউক্লীয় বল। আগেই বলেছি সবল নিউক্লীয় বলের সীমা খুব কম। এই সীমার মধ্যে যদি দুটো হাইড্রোজন নিউক্লিয়াস এসে পড়ে তাহলে তাদের বৈদ্যুতিক আকর্ষণকে রুখে দিতে পারে সবল নিউক্লীয় বল। তখন দুটো নিউক্লিয়াসের ভেতর নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া হবে। নিউক্লিয়ার ফিউশন। ফিউশন বিক্রিয়ায় দুটো ছোট নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে অপেক্ষাকৃতে বড় ও ভারী নিউক্লিয়াস তৈরি হয়ে। প্রচণ্ড এই বিক্রিয়ার জন্য শক্তির জোগান দেয়। ফিউশনে দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু যুক্ত হয়ে একটা ডিউটেরিয়াম তৈরি করে।

নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া

 

ডিউটেরিয়াম হলো হাইড্রোজেনের একটি আইসোটপ। হাইড্রোজেনের আরো একটি আইসোটপ আছে। সেটার নাম ট্রিট্রিয়াম। ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াসে একটা প্রোটনের সাথে একটা নিউট্রন থাকে। আর ট্রিটিয়াম নিউক্লিয়াসে থাকে দুটো নিউট্রন আর একটা প্রোটন।
মহাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হয়ে থাকা এসব মেঘে প্রথম পর্যায়ের ফিউশনের পর প্রচুর ডিউটেরিয়াম তৈরি হয়। অর্থাৎ দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস যোগ হয়ে একটা নিউট্রনবিশিষ্ট হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস তৈরি করে। আর তৈরি হয় একটা করে পজিট্রন আর একটা করে ইলেকট্রন নিউট্রিনো। পজিট্রন আর নিউট্রিনো বেরিয়ে যায় নিউক্লিয়াস ছেড়ে। সবল নিউকক্লীয় বলের প্রভাবে তৈরি একটি নিউট্রন আর একটি প্রোটন বাধা পড়ে তৈরি হয় ডিউটেরিয়াম নিউক্লিয়াস।
সাধারণ হাইড্রোজেনের পরমাণুর সাথে তখন সেই মেঘের ভেতর ঘুরে বেড়ায় অংসখ্য ডিউটেরিয়াম। তুলনামূলক ভারী পরমাণুর মেঘে পরিণত হয় সেই হাইড্রোজেন মেঘ। তাদের ভেতর ধাক্কাধাক্কি-ছোটাছুটি চলতেই থাকে। তাপমাত্রাও বাড়ে সমানে। সাথে সাথে নিউক্লিয়ার ফিউশনের হারও বাড়ে। সাধারণ হাইড্রোজেন-হাইড্রোজেন ফিউশন যেমন চলে, একই সাথে চলে ডিউটেরিয়ামের সাথে সাধারণ হাইড্রোজেনের ফিউশন।
এতে উিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াসের সাথে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে দুটি প্রোটন আর একটি নিউট্রনওয়ালা হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। সেই সাথে উৎপন্ন হয় কিছু শক্তি। সেই শক্তি নিউক্লিয়াস ছেড়ে বেরিয়ে আসে আলোক শক্তি হিসেবে। দুই রকমের হাইড্রোজেন মিলেমিশে তৈরি করে বনে যায় হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে। এভাবেই চলে হাইড্রোজেনের হিলিয়াম গড়ার খেলা। একটা সময় হাইড্রোজেন মেঘ আর আর মেঘ থাকে না। তীব্র মহাকর্ষীয় টানে সেটা একটা গোলকের চেহারা পায়।
নিউক্লিয়ার ফিউশনে যতটুকু তাপশক্তি দরকার হয়, তার পুরোটাই কিন্তু কাজে লাগে না। কিছু তাপশক্তি হিলিয়াম তৈরির পরও অবশিষ্ট রয়ে যায়। হাইড্রোজেন পরমাণুর সংঘর্ষ আর ফিউশন থেকে তৈরি হওয়া তাপশক্তি আরো উত্তপ্ত করে তোলে গোলকটাকে। অগ্নিগোলক, নাকি নরককুণ্ড! সেটাই তখন হয়ে ওঠে তাপ আলোক শক্তির বিরাট আধার। বলার অপেক্ষা রাখে না, উত্তপ্ত সেই অগ্নিগোলকই একেকটা নক্ষত্র। বড়-মাঝারি-ছোট কত রকম নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে মহাকাশে। আমাদের সূর্যও একটা নক্ষত্র।
একটা নক্ষত্র কতকাল জ্বলবে, তা নির্ভর করে নক্ষত্রের ভেতরকার হাইড্রোজেনের মোট পরিমাণের ওপর। শুধু হাইড্রোজেনই নক্ষত্রের জন্মকালের সঙ্গী। যে নক্ষত্রের ভেতর হাইড্রোজেন যত বেশি, তার ভরও তত বেশি। নক্ষত্রের ভরের ওপর নির্ভর করে সে কতকাল জ্বলবে। বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছেন, কোনো নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের তিন গুণ হয়, তাহলে সেই নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের হাইড্রোজেন মাত্র দুই কোটি বছরেই ফুরিয়ে যাবে।
কারণ ভর বেশি হলে মহাকর্ষীয় শক্তিও বেড়ে যায়। ফলে কেন্দ্রীয় অঞ্চলের হাইড্রোজেনের ওপর আরো বেশিমাত্রায় চাপ পড়ে। তাই হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসগুলো দ্রুত পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই অনুপাতে তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পায় প্রচণ্ডভাবে। সে কারণে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের দহন চলে খুবই দ্রুততালে। ফলে দ্রুত ভেতরের হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে আসে। বাড়তে থাকে হিলিয়াম পরমাণুর সংখ্যা। কিন্তু সূর্যের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটা দ্রুত নয়। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, সূর্যের জš§কালে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন এর ভেতর জড়ো হয়েছিল, স্বাভাবিকভাবে সেটা নিঃশেষ হতে এক হাজার কোটি বছর সময় লাগবে। তারপর? এখন সূর্যের বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। মোট আয়ুর মধ্যগগনে। তার মানে আরো ৫০০ কোটি বছর হাতে আছে সূর্যের।
সূর্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে চলছে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। হাইড্রোজেন পুড়ছে। তৈরি হচ্ছে হিলিয়াম। একদিন সূর্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের হাইড্রোজেন প্রায় ফুরিয়ে আসবে। একসময় নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া করার মতো হাইড্রোজেন তেমন থাকবে না। বাড়বে হিলিয়ামের ঘনত্ব। সেসব হিলিয়াম মহাকর্ষীয় টানে পরস্পরের কাছে আসতে চাইবে। তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হবে, তৈরি হবে বিপুল পরিমাণ তাপ।
কিন্তু সেই তাপ কাজে লাগিয়ে হিলিয়ামের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটবে খুব কম। বিশাল পরিমাণ তাপশক্তি তাই জমা হবে সূর্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে। কেন্দ্রীয় অঞ্চলের কেন্দ্রে থাকে অবশিষ্ট হাইড্রোজেন আর বাইরে হিলিয়ামের স্তর। প্রচণ্ড সংকোচনের দরুন কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ফলে সেটা অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেই উত্তাপের প্রভাবে কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বহিরাবরণটা প্রসারিত হতে থাকে। প্রসারণের কারণে কমতে থাকবে তাপমাত্রাও। আবার ইচ্ছা করলেই সূর্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চলটা তো আর দেখতে পাই না। দেখতে পাই বাইরের পৃষ্ঠটা। যেহেতু তাপমাত্রা অনেকটাই খুইয়ে ফেলেছে, তাই এর উজ্জ্বলতা হয়ে গেছে অনেকটাই ফিকে। তাই সূর্যটাকে আর উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো দেখাবে না। দেখাবে টকটকে লাল একটা গোলকের মতো।
কামারের হাপরের তলায় থাকা একটা উত্তপ্ত লোহার কথা ভাবা যাক। লোহা যখন খুব গরম থাকে তখন এক রকম দেখায়, তাপমাত্রা কমলে তার চেহারা আবার আরেক রকম। কম তাপমাত্রার লোহাকে টকটকে লাল রঙের দেখায়। বাইরের পৃষ্ঠ সম্প্রসারণের পরে সূর্যকেও এমনই লাল দেখাবে। লাল রঙের এই অতিকায় সূর্যটাকে তখন বলা উচিত রেড জায়ান্ট বা লোহিত দানব বা লাল দানব বা রক্তিম দৈত্য। এখন সূর্যের বাইরের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫৮০০ কেলভিন। লোহিত দানবে পরিণত হলে এই তাপমাত্রা কমে দাঁড়াবে ৩০০০ কেলভিনে। ব্যাসার্ধ বেড়ে হবে এখনকার ব্যাসার্ধের ১০০ গুণ। ওই অবস্থায় সূর্য গ্রাস করবে বুধ গ্রহকে।
কিন্তু খেলা এখানেই শেষ নয়। লোহিত দানবে পরিণত হওয়া সূর্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের হিলিয়াম নিউক্লিয়াস মহাকর্ষীয় টানে সংকুচিত হতে থাকবে। তাদের ভেতরও সংঘর্ষ হবে, তৈরি হবে তাপ। সেই তাপশক্তি হিলিয়ামের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটাবে। আবার প্রাণ ফিরে পাবে সূর্যের লোহিত দানব। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া এবং তা থেকে তৈরি হওয়া তাপশক্তি বাড়িয়ে দেবে লাল দানবের তাপমাত্রা ও উজ্জ্বলতা। লোহিত দানবের কেন্দ্রীয় তাপমাত্রা উঠে যাবে ১০ কোটি ডিগ্রি কেলভিনে।
সব কিছুরই একটা শেষ থাকে। লোহিত দানবের ভেতরে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াও চিরকাল চলতে থাকবে না। হিলিয়াম নিউক্লিয়াস এ প্রক্রিয়ায় কার্বন নিউক্লিয়াস জন্ম দেবে। সেই কার্বন নিউক্লিয়াস কমিয়ে দেবে লোহিত দানবের তাপমাত্রা। কারণ যতই তাপশক্তি থাক। তাই এতক্ষণ তাপশক্তি আর মহাকর্ষ শক্তির যে লড়াই দেখেছি, সেটাতে জয়ী হবে মহাকর্ষ। কিন্তু তবু শেষ হাসি সে হাসতে পারবে না। তখন আসবে নতুন বাধা। লোহিত দানবে পরিণত হওয়া সূর্যের কেন্দ্রে জমা হবে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মুক্ত ইলেকট্রন। তার চারপাশে হিলিয়ামের আবরণী। ভেতরে আবার কার্বনও আছে। কিন্তু ইলেকট্রন পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। আর আছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বাধা।
পাউলির অপবর্জন নীতি বলে, একই সাথে দুটো ইলেকট্রন কখনো একই অবস্থায় থাকতে পারবে না। সেই বিকর্ষণ শক্তিও তো কম নয়। ইলেকট্রনগুলো পারস্পরিক বিকর্ষণের কারণে কেন্দ্র ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইবে। কিন্তু তা হতে দেবে না মহাকর্ষীয় বল। গোটা সূর্যের হিলিয়াম পরস্পরকে আকর্ষণ করে চুপসে যেতে চাইবে। এ জন্য বাড়বে সূর্যের লোহিত দানবের ঘনত্ব। প্রবল একটা কেন্দ্রমুখী আকর্ষণ বল তৈরি হবে। কেন্দ্রবিন্দুর দিকে চুপসে যেতে চাইবে গোটা সূর্যের দেহ।
কিন্তু পুরোপুরি চুপসে যেতে পারবে না ইলেকট্রনের বিকর্ষণজনিত বহির্মুখী চাপের কারণে। ফলে দুই চাপের একটা মরিয়া লড়াই জমবে মরে যাওয়া সূর্যের কেন্দ্রের দিকে। তার ফলে হিলিয়ামের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া হবে বিক্ষিপ্তভাবে। তাতে হয়তো লোহিত দানবের ভেতরের তাপমাত্রা বাড়বে, বাড়বে উজ্জ্বলতাও। কিন্তু সেই তাপ আর উজ্জ্বলতা লোহিত দানবের বিশাল আবরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তবে মাঝে লোহিত দানবের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটবে। সেই বিস্ফোরণের শক্তি ব্যয় হয়ে যাবে মহাকর্ষীয় টানের বিপক্ষে লড়তে লড়তেই। শেষ পর্যন্ত হিলিয়াম নিউক্লিয়াসগুলো ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বনে পরিণত হয়।
তারপর কি কার্বনের নিউক্লিয়াসেরও ফিউশন হওয়া সম্ভব? সম্ভব যদি পর্যাপ্ত তাপমাত্রার জন্ম দিতে পারে। সে জন্য খুব বেশি ভরের নক্ষত্র হলে সম্ভব হতো। তাহলে প্রবল মহাকর্ষীয় বলের কার্বন পরমাণুর মধ্যে সংঘর্ষ হতো খুব বেশি মাত্রায়। তাপও হতো তত বেশি। কিন্তু সূর্যের অত ভরও নেই, কার্বন পরমাণুর ফিউশনের জন্য সে পর্যাপ্ত মহাকর্ষ বলের জোগান দিতে পারবে না। তাই কেন্দ্রীয় অঞ্চলের কার্বনের ফিউশন হবে না। কেন্দ্রের চারপাশে থাকবে হিলিয়ামের আবরণ। সেই আবরণী স্তরে ফিউশন হতে অসুবিধা নেই। এই ফিউশন থেকেও তাপ জন্ম নেবে। উজ্জ্বলতা বাড়বে হিলিয়াম আবরণীর। সেই সঙ্গে আবরণী ফুলেফেঁপে আরোও বড় হবে। আরোও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে সূর্যের রক্তিম দানব।
একসময় আবরণীর হিলিয়াম সব ফুরিয়ে যায়। কার্বন নিউক্লিয়াসের ছড়াছড়ি তখন। তাপমাত্রাও তখন অনেক কমে আসে। তখন কার্বন নিউক্লিয়াসগুলো মুক্ত ইলেকট্রন ধরে নিয়ে কার্বন পরমাণু তৈরি করে। এ সময় আলোর ফোটন কণা বিকিরিত হয়। সেই ফোটন আবার লোহিত দানবের বাইরের আবরণে শোষিত হয়। ফলে আবরণীর তাপমাত্রা বাড়ে এবং প্রসারিত হয়। প্রসারণের কারণে আবার কমতে থাকে আবরণীর তাপমাত্রা। তখন আবার সংকুচিত হয় আবরণী। বারবার এভাবে সংকোচন-প্রসারণ চলে। একসময় আবরণী স্তরটির ভারসাম্য আর থাকবে না। সেটা তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে সূর্য থেকে। উন্মুক্ত হয়ে যাবে সূর্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চল।
এই অবস্থায় সূর্য চুপসে যাওয়ার কথা। কিন্তু পুরোপুরি সেটা হতে দেবে না কেন্দ্রের সেই ইলেকট্রন পিণ্ড। মৃতপ্রায় সূর্যের ব্যাস তখন দাঁড়াবে মাত্র ২০ হাজার কিলোমিটারে। আমাদের পৃথিবীর ব্যাসার্ধের দ্বিগুণের কম! সূর্যের উজ্জ্বলতা দাঁড়াবে এখানকার উজ্জ্বলতার ১০০ গুণ কম। মহাকাশে ধুঁকতে থাকা একটা শ্বেত বামনে পরিণত হবে সূর্য। টিম টিম করে জ্বলা সেই সূর্যের কথা ভাবতে কেমন লাগে! দোর্দণ্ড প্রতাপ নেই। কাছের গ্রহগুলোকে লোহিত দানব অবস্থায় গিলে ফেলেছে।
কোথাও প্রাণের স্পন্দন নেই। স্পন্দন নেই সৌরজগৎ সিস্টেমেই। ধীরে ধীরে হিমশীতল মহাশূন্য শ্বেত বামনরূপী সূর্যের তাপমাত্রা শুষে নিচ্ছে। ধীরে ধীরে সেটা সাদা থেকে হলুদ তারপর আরোও ক্ষীণ রঙের গোলকে পরিণত হচ্ছে। তারপর একদিন সব শেষ। নিভে যাবে শেষ আলোকছটাও। একটা কালো গোলকে পরিণত হয়ে সূর্যের শবদেহ ভেসে রবে অন্ধকার মহাশূন্যের অতলে।
কিন্তু এটা যদি সূর্য না হয়ে অত্যন্ত ভারী নক্ষত্র হতো? তাহলে আর শ্বেত বামনে পরিণত হতে পারত না। সেটা তখন চন্দ্রশেখর লিমিট অতিক্রম করে গেছে। তখন মহাকর্ষীয় সংকোচন ঠেকানোর উপায় থাকবে না নক্ষত্রের ভেতরে। ভেতরের ইলেকট্রনের চাপ তখন মহাকর্ষীয় সংকোচন রোখার মতো যথেষ্ঠ নয়। তখন হুড়মুড় করে কেন্দ্রের আকষণে ছুটতে থাকবে নক্ষত্রের পরমাণুগুলি। আবার পরস্পরের ধাক্কা। তার ফলে বেড়ে যাবে তাপমাত্রা। কেন্দ্রের তাপমাত্রা তখন উঠে যাবে ৬০ কোটি ডিগ্রিতে। এই অবস্থায় আবার শুরু হবে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। কেন্দ্রের দিকে নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে কার্বন পরমাণু তৈরি হবে ম্যাগনেশিয়ামে। এভাবে ধীরে ধীরে লোহা আর নিকেলের নিউক্লিয়াস জমা হবে কেন্দ্রের দিকে। এতে কেন্দ্রের দিকে তাপমাত্রা কমতে থাকবে দ্রুত। কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া আর হবে বলে ক্রমেই জমাট বাঁধতে থাকবে নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অঞ্চল। সেখান মহাকর্ষীয় প্রভাবও বাড়বে। সেই প্রভাবকে ঠেকিয়ে থাকবে না, জমাট ইলেকট্রনের চাপেরও। এতে একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটবে। কেন্দ্রের লোহা আর নিকেলের নিউক্লিয়াসগুলো আস্ত থাকবে না।
প্রচণ্ড সংকোচনের কারণে একটা নিউক্লিয়াস আরেকটা নিউক্লিয়াসের খুব খুব কাছে চালে চলে আসবে। আবার প্রচণ্ড মহাকর্ষীয় চাপে ইলেকট্রনগুলিও পোটনের খুব কাছে চলে আসতে পারবে। তখন মৌলের নিউক্লিয়াস বলে আর কিছুই থাকবে না। বরং আলাদা আলাদা প্রোটন, নিউট্রন আর ইলেকট্রনগুলি পরস্পরের খুব কাছে এসে পড়বে। প্রচণ্ড চাপ আর শক্তিতে প্রোটন আর ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে জন্ম দেবে নতুন নতুন নিউট্রনের। সাথে জন্ম নেমে নিউট্রিনো
অন্যদিকে নক্ষত্রের বাইরের দিকের অঞ্চলে তখনো হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চলবে। বাইরের অঞ্চল আর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। তখন একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটবে সেই নক্ষত্রের। সেই বিস্ফোরণের তীব্রতা এতই বেশি কিছুক্ষণের জন্য একটামাত্র নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা গোটা গ্যালাক্সির সমান হবে। এই ধরনের বিস্ফোরণকে জ্যোতির্বিদ্যার ভাষায় বলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ। তারপর…?

চলবে….

আগের সব পর্ব :                                                                                                                                                                                                                                            কৃষ্ণগহ্বর-১৪ : চন্দ্রশেখর লিমিটের জন্মকথা

কৃষ্ণগহ্বর-১৩ : স্থানকালের বক্রতা যেখানে অসীম

কৃষ্ণগহ্বর-১২ : বলবাহী কণা, মৌলিক বল আর এদের আত্মীয়তার গল্প

কৃষ্ণগহ্বর-১১ : প্রতি কণার জগতে
কৃষ্ণগহ্বর-১০: কোয়ার্ক, নিউট্রিনো আর অন্যান্য কণিকা
কৃষ্ণগহ্বর-৯ : মূল কণিকাদের কথা 
কৃষ্ণগহ্বর-৮ : পরমাণুর কথা
কৃষ্ণগহ্বর-৭ : মহাকর্ষের কথা শোনে আলোও
কৃষ্ণগহ্বর-৬ : আপেক্ষিকতা ও আধুনিক মহাকর্ষ
কৃষ্ণগহ্বর-৫ : আলোর কচড়া
কৃষ্ণগহ্বর-৪ : নিউটনের কামান আর পৃথিবীর মুক্তিবেগ
কৃষ্ণগহ্বর-৩ : নিউটনের মহাকর্ষে
কৃষ্ণগহ্বর-২ : মহাকর্ষের পটভূমি
কৃষ্ণগহ্বর-১ : ফিরে দেখা ইতিহাস

2 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.