১৯০৫ সালে। এর মধ্যে পদার্থবিদ্যার জগৎটাই ওলটপালট হয়ে গেছে। আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করে ভিত নড়বড়ে করে দিলেন চিরায়ত পদার্থবিদ্যার। এরপর ১০ বছর কেটে গেল। আইনস্টাইন তখন বিজ্ঞান জগতের সুপারস্টার। নিউটনের গতিবিদ্যা আমূলে বদলে দিয়েছেন। কিন্তু বাকি রয়ে গেছে মহাকর্ষ তত্ত্ব। নিউটন বলেছিলেন, মহাকর্ষ হলো দুটো বস্তুর মধ্যে আকর্ষণের ফল। আমরা যে পৃথিবীর ওপর হাঁটছি, ঘুরছি-ফিরছি পৃথিবীর বুক থেকে অনন্ত মহাশূন্যে পড়ে যাচ্ছি না, সেটা মহাকর্ষের কারণেই।
গাছের আপেল মাটিতে কেন পড়ে?
কেন কোনো কিছু ওপরে ছুড়ে মারলে তা আবার নিচে ফিরে আসে, মাটিতে আছাড় খায়?
এসবের পেছনে একটাই বল কাজ করছে। মহাকর্ষ বল। ১৯১৫ সালে নিউটনের এই তত্ত্বে আবার কুঠারাঘাত করলেন আইনস্টাইন। বললেন, মহাকর্ষ মোটেও দুটি বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বল নয়। মহাকর্ষ হলো স্থানকালের বক্রতা।
আমরা তিন নং অধ্যায়ে দেখেছিলাম একটা কামানের গোলার গতিবেগ যখন খুব বেশি হয়, সেটা পুরো পৃথিবীকেই একবার চক্কর যদি দিয়ে আসতে পারে, তাহলে সেই গোলা আর মাটিতে নামবে না। আইনস্টাইন তার বিশেষ আপেক্ষিকতায় বলেছিলেন, কোনো বস্তুর বেগ আলোর বেগের সমান হতে পারে না। তার মানে আলোই মহাবিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল বস্তু।
তা-ই যদি হয়, তাহলে একে যদি পৃথিবীর চারপাশে কামানের গোলার মতো ঘোরাতে শক্তি বাড়িয়ে একে আরো গতিশীল করার দরকার হবে না। এমনিতেই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার কথা। মুশকিল হলো কামানের গোলার ভর ছিল, আলোর ফোটন কণা ভরহীন। তাই নিউটনের মহাকর্ষ দ্বারা সে আকর্ষিত হবে না।
কিন্তু আইনস্টাইন দেখিয়েছেন, ভারী বস্তু তার চারপাশের স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। সেই বাঁকা পথে চলতে গিয়ে আলোকেও বেঁকে যেতে হয়। অর্থাৎ মহাকর্ষ ক্ষেত্র আলোর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর যে ভর, তার ক্ষমতা নেই আলোকে অসীম মাত্রায় বাঁকিয়ে দিতে পারবে না। অসীম মাত্রায় বাঁকাতে না পারলে আলোই বা পৃথিবীর চারপাশে ঘুরবে কেন।
আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, বস্তুর ভর যদি খুব বেশি হয়, তার মহাকর্ষ ক্ষেত্র যদি স্থানকালকে বাঁকিয়ে দিতে পারে সেই বস্তুর পাশ দিয়ে আলো আর ফিরে আসবে না। বস্তুটির চারপাশে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর আটকে যাবে। আর এই আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিতার তত্ত্বের সমাধান থেকেই বেরিয়ে আসে।
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অত্যন্ত জটিল। নির্দিষ্ট কোনো সমাধান ছিল না এর। ছিল অনেকগুলো জটিল সমীকরণের সমাহার ছিল। সেসব সমীকরণ সমাধান করে একটা আসন্ন মানে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন অনেক বিজ্ঞানী। তবে সবার আগে সমাধানটা করেন জার্মান পদার্থবিদ কার্ল সোয়ার্জশিল্ড। সেটা ল্যাপ্লাসের সমীকরণের দেখা পান। আইনস্টাইনের সমীকরণ সমাধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে, মহাকাশে এমন কিছু বস্তু থাকে, যেটা জন মিশেলের সেই কৃষ্ণতারার মতো।
আইনস্টাইনের মতো কার্ল শোয়ার্জশিল্ডও ছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী। তবে বড্ড অভাগা। যশ-খ্যাতি তো কপালে জোটেইনি। গবেষণাটাও ঠিকঠাক মতো করে যেতে পারেননি। শোয়ার্জশিল্ডের জন্ম ১৮৭৩ সালে জামার্নির বইয়ের শহর ফ্রাঙ্কফুটে। মূলত মহাকাশবিজ্ঞানী। কিন্তু চেনে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্যই। আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণের সমাধানই তাঁর জীবনের সেরা কাজ।
১৮৯৬ সালে তিনি জার্মানির লুডভিক ম্যাকমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। পিএইচডির বিষয় ছিল হেনরি পয়েনকেয়ারের তত্ত্ব। অনেকেই মনে করেন আইনস্টাইনের মতো হেনরি পয়েনকারও সাধারণ আপেক্ষিতা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তিনিই এই চিন্তা প্রথম করেন। পয়েনকারের তত্ত্ব নিয়ে যার আগ্রহ, সেটাই যার পিএইচডির বিষয়, তিনি আইনস্টাইনের ক্ষেত্রতত্ত্বে আকৃষ্ট হবেন সেটাই স্বাভাবিক। তাই শোয়ার্জশিল্ড কোমর বেঁধে লেগে পড়েন ক্ষেত্রতত্ত্ব সমাধানে। তাই বলে ভাববেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করতে গিয়ে কিংবা বাড়িতে আরাম কেদারায় বসে তিনি আইনস্টাইনের ক্ষেত্র তত্ত্ব সমাধান করেছিলেন। পুরো গবেষণাটাই তিনি করেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দুক আর কামানের পেছনে বসে!
ভাবতে অবাক লাগে যে হাতের ছোঁয়ায় উঠে আসে নান্দনিক সৌন্দর্য, সেই নান্দনিকতার ছোঁয়ায় গতি প্রায় প্রযুক্তি, যে প্রযুক্তি মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়ে ওঠে, সেই হাতেই কি না মারণাস্ত্র ঝলসে ওঠে! শুধু শোয়ার্জশিল্ড নয়, একই কথা সতি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দুই প্রবাদ পুরুষ লুই দ্য ব্রগলি আর ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের ক্ষেত্রেও। প্রথমজন ফরাসি আর দ্বিতীয়জন জার্মান।
একই সময় রণক্ষেত্রে ছিলেন দুই বিজ্ঞানী। পরস্পরের বিরুদ্ধে। ফ্রান্স-জার্মানির তখন তুমুল লড়াই। যুদ্ধক্ষেত্রে যদি দেখা হতো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দুই পুরোধার, একই সাথে দুজন দুজনকে যদি গুলি ছুড়তেন? হয়তো ভবলীলা সাঙ্গ হতো দুই বিজ্ঞানীরই, কী হতো তাহলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের, আজকের বিজ্ঞানের?
হাইজেনবার্গ-ব্রগলির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল যুদ্ধ ময়দানে কিন্তু পয়েনকেয়ার, আইনস্টাইনের সাথে শোয়ার্জশিল্ডের যুদ্ধ করার সম্ভাবনা ছিল না মোটেও। তিনজনই যে জার্মান!
যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে চলল শোয়ার্জশিল্ডের গবেষণা। আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণগুলোতে গণিতের নতুন শাখা টেন্সর বিশ্লেষণ ব্যবহার করা হয়েছে, ব্যবহার করা হয়েছে কার্ল গাউস আর বার্নার্ড রিম্যানের ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি। সব মিলিয়ে ক্ষেত্র সমীকরণ জটিল আকার ধারণ করে। এসব জটিল সমীকরণের নির্দিষ্ট কোনো এক সমীকরণের সমাধানও ছিল না। শোয়ার্জশিল্ড চেষ্টা করলেন একটা আসন্ন মান বের করে সমাধানে আসতে। আর সেই সমাধান থেকেই যে ডার্কস্টারের বিষয়টা চলে আসে সে কথা আগেই বলেছি। এমন একটা আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক মহলে হৈচৈ ফেলে দেবে, সেটাই স্বাভাবিক।
আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণ সমাধান করতে গিয়ে শোয়ার্জশিল্ড একটা আসলে একটা ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধের দেখা পেয়ে গিয়েছিলেন। সেই ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধ সব নক্ষত্র এমনকি গ্রহ-উপগ্রহের তাত্ত্বিকভাবে অস্তিত্ব থাকে। শোয়ার্জশিল্ড বলেছিলেন, একটা নক্ষত্র বা ভারী বস্তুর ভর ঠিক রেখে যদি তার আয়তন যদি ক্রমেই কমানো হয়, কমতে থাকবে নক্ষত্রের ব্যাসার্ধও।
ব্যাসার্ধ কমতে কমতে এমন এক অবস্থায় আসবে, যখন বস্তুটি তার চারপাশের স্থানকালকে অসীম মাত্রায় দুমড়ে দেবে। আমরা আগের অধ্যায়ে এমন কিছু দেখেছিলাম। তবে একটু অন্যভাবে। সেখানে আমাদের চেষ্টা ছিল, স্থানকালের অসীম বক্রতা কী সেটা বোঝানো। তাই আমরা সূর্যের বাড়িয়ে, মহাকর্ষীয় প্রভাব বাড়িয়ে স্থানকালের বক্রতা অসীম করেছিলাম। কিন্তু শোয়ার্জশিল্ড ভর ঠিক রাখলেন, কিন্তু কমালেন ব্যাসার্ধ।
ব্যাসার্ধ কমে এমন এক ব্যাসার্ধে পৌঁছে যাবে, যখন বস্তুটি তার চারপাশের স্থানকালকে দুমড়ে-মুচড়ে দেবে অসীম মাত্রায়। শোয়ার্জল্ডি এই ব্যাসার্ধেও নাম দিলেন ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধ। পরে তাঁর নামানুসারেই ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধের নাম হয়ে যায় শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ।
কালক্রমে সেই ব্যাসার্ধই হয়ে ওঠে কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা-দিগন্ত। তখনই বেরিয়ে আসে ২০০ বছর আগের মিচেল-ল্যাপলাসের সেই পুরনো ডার্কস্টারের সমীকরণ। রোমাঞ্চিত হন শোয়ার্জশিল্ড। বুঝতে পারেন, নিজের অজান্তেই বড় একটা ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছেন। শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধেও গাণিতিক সমীকরণটা একটাবার দেখে নেওয়া যাক–
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র থেকে মুক্তিবেগের সমীকরণ বের করা যায়। কোনো বস্তুর ভর M , ব্যাসার্ধ r হলে এবং মহাকর্ষীয় ধ্রুবক G হলে মুক্তিবেগ,
এই সমীকরণ থেকেই স্পষ্ট, কোনো বস্তুর ভর ঠিক রেখে ব্যাসার্ধ কমালে একসময় ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধে পৌঁছে যায়। ক্রান্তীয় বাসার্ধে পৌঁছানোর সাথে সাথে আলোর বেগের সমান হয়ে যায় বস্তুটির মুক্তিবেগ। তাই নিউটনীয় সূত্র মতে আলোর পক্ষেও সম্ভব নয় সেই মহাকর্ষ ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসা।
এখানে (২) নং সমীকরণ থেকে যে ব্যাসার্ধ দেখানো হয়েছে সেটা নিউটনীয় সমীকরণ থেকে আসা। যদিও নিউটন কিংবা ল্যাপলাসের সময় আলোর বেগের মান জানা ছিল না। জানা ছিল না আলোর বেগ ধ্রুবক। (২) সমীকরণে কিন্তু আলোর বেগকে ধ্রুবকই দেখানো হয়েছে। তাই বলা যেতে পারে, শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধেও এই সমীকরণটি নিউটন আর আইনস্টাইনের সমীকরণে এক অপূর্ব সমন্বয়।
আরো একটা সমস্যা এই সমীকরণের আছে। এই সমীকরণ অনুযায়ী যেকোনো বস্তুর ব্যাসার্ধ কমিয়ে তার ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
তার মানে, যেকোনো বস্তুর ব্যাসার্ধ কমিয়ে তার মুক্তিবেগ আলোর বেগের সমান করা যায়। শোয়ার্জশিল্ড এই সমীকরণ বলে কোনোভাবে যদি সূর্যের ব্যাসার্ধ কমিয়ে ২.৯৫ কিলোমিটারে নেওয়া যায় তাহলে সূর্যও ডার্কস্টারা বা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে। অর্থাৎ সূর্যের সোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ ২.৯৫ কিলোমিটার।
এমনকি পৃথিবীরও একটা শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ আছে। সেটা হলো মাত্র ০.৮৭ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ বিশাল ভরের পৃথিবীকে যদি ০.৮৭ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের একটা গোলকে পরিণত করা যায়, সেও তখন কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে।
শুধু পৃথিবী নয়। মহাবিশ্বের সব বড় বড় ভরের বস্তুও জন্য একটা শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলে, সূর্য কোনো দিনও কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে না। পৃথিবী তো হবেই না।
তাহলে কি শোয়ার্জশিল্ড সমীকরণ ভুল?
না, ভুল নয়, তবে সীমাবদ্ধতা আছে। ভুল নয়, এ জন্য সূর্যের চেয়ে তিনগুণ ভরের নক্ষত্র শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ অর্জন করতে পারে। সত্যি সত্যিই সেগুলো তখন কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে।
এ ধরনের একটা নক্ষত্রের নির্দিষ্ট মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সীমা থাকে। সেই সীমার বাইরের কোনো বস্তুকে সেই বস্তু আকর্ষণ করতে পারে না। আবার সেই সীমার ভেতরে কোনো বস্তু ঢুকে পড়লে প্রবল বেগে সেটা নক্ষত্রটি গ্রাস করে নেবে। নক্ষত্রটির সেই ব্যাসার্ধকে পরে শোয়ার্জচাইল্ড ব্যাসার্ধ বলে নামকরণ করা হয়। আর শোয়ার্জশিল্ড সেই সীমার বাইরের প্রান্তরেখার নাম দিলেন ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত।
মিচেল-ল্যাপলাসের ডার্কস্টারের তৈরি করা সমীকরণই আবার পেয়েছিলেনে শোয়ার্জশিল্ড। কিন্তু সেই ডার্কস্টারের সাথে শোয়ার্জশিল্ড ডার্কস্টারের বিস্তর ফারাক। কারণ মিচেল-ল্যাপলাসের ডার্কস্টারের ধারণাটা করা হয়েছিল আলোকে কণা ধরে এবং সম্ভবত এর ‘ভর আছে’ ধরে নিয়েই। তা ছাড়া সেই যুগে স্থানকালের বক্রতার ধারণাই ছিল না। মহাকর্ষ বল ছিল বস্তুদের মধ্যে ক্রিয়াশীল এক ধরনের আকর্ষণ মাত্র। সেই ডার্কস্টারের শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের মতো ব্যাসার্ধ ছিল।
সেই ব্যাসার্ধ সীমার বাইরে যাওয়ার সাধ্য আলোর ছিল না। সেই তত্ত্বের হিসাব অনুযায়ী আলোর চেয়ে ভারী বস্তু বা নক্ষত্রের মুক্তিবেগ বেশি হবে। একটা বস্তুকে ওপরে ছুড়ে মারলে সেটা যেমন পৃথিবীতে ফিরে আসে, কারণ বস্তুটির বেগে পৃথিবীর মুক্তিবেগের চেয়ে কম, তাই সেটা ওপরে উঠে কিছুদূর যাবার পর আবার মহাকর্ষীয় টানে মাটিতে ফিরে আসবে।
ল্যাপলাস-মিচেলের ডার্কস্টারেও আলো এমন আচরণ করবে, আলো তার নিজের শক্তিতে ওপরে দিকে ওঠার চেষ্টা করবে। নির্দিষ্ট একটা উচ্চতায় এসে আবার নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় আকর্ষণে নিচে নেমে যাবে। নির্দিষ্ট সেই উচ্চতা বরাবর নক্ষত্রটির চারপাশে বৃত্ত আঁকলে নক্ষত্রের কেন্দ্র থেকে সেই উচ্চতা পর্যন্ত একটা ব্যাসার্ধ পাওয়া যাবে, সেই ব্যাসার্ধই আসলে শোয়ার্জশিল্ডের ব্যাসার্ধের সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু ভরহীন আলোর কণা এই সূত্র মানবে কেন!
আবার এই তত্ত্বের হিসাব অনুযায়ী, আপনি যদি ডার্কস্টারের ঘটনা দিগন্তের রেখায় গেলে হয়তো আলোকরশ্মিকে দেখাও যেতে পারে। কারণ সেই ব্যাসার্ধসীমাটা নক্ষত্র থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। কিন্তু শোর্জয়াশিল্ডের ভাবনাটা একটু অন্য রকম ছিল। তার ডার্কস্টার থেকে এভাবে স্থানকালকে বাঁকিয়ে একটা ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধ তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু এই ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধ হলে মূল বস্তুটারই ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধ। বস্তুর বাইরে এর কোনো অস্তিত্ব ছিল বলে শোয়ার্জশিল্ডের হিসাব থেকে পাওয়া যায়নি। তাই শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ রেখায় কেউ দাঁড়াতেই পারবে না। আর ভেতরে ঢোকা তো দূর অস্ত।
শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধে তাহলে কী ঘটে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই জন্ম হয় সিঙ্গুলারিটির। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় পরম বিন্দু বা অদ্বৈত বিন্দু। কেউ কেউ আবার একে বলেন অনন্যতা। আমরা সিঙ্গুলারিটিই বলব এই বইয়ে।
এই সিঙ্গুলারিলিটি শব্দটা অনেক পরে চালু হয়। তবু সেই যুগে এমন একটা স্থানকালের কথা বিজ্ঞানীদের মাথায় এসেছিল, যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত সূত্রগুলো ভেঙে পড়ে।
নতুন ডার্কস্টার তত্ত্ব দাঁড়াল ঠিকই। সমস্যা হলো এর ভেতরের খবর নিয়ে। অর্থাৎ শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের ভেতরে খবর পাওয়া যাবে কী করে। যেখান থেকে আলোও রেহাই পায় না। সেখানকার খবর জানার কোনো উপায় আছে?
উপায় বলতে পারেননি শোয়ার্জশিল্ড। বলার উপায়ও ছিল না। কারণ আইনস্টাইনের ক্ষেত্রতত্ত্বের সমাধান তিনি বের করেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রেই। সেই যুদ্ধ থেকে আর ফেরেননি শোয়ার্জশিল্ড। সেখানেই ১৯১৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয় দুরারোগ্য এক ব্যাধিতে। সেখান থেকেই ক্ষেত্রতত্ত্বের সমাধানটা চলে আসে আইনস্টাইনের হাতে। প্রুশিয়ান একাডেমিতে এক বিজ্ঞান সম্মেলনের আয়োজন করা হয় সে বছর। সেখানে তাঁর হয়ে সেই ক্ষেত্রতত্ত্বের সমাধানটি পাঠ করেন আইনস্টাইন।
শোয়ার্জশিল্ডের পেপার তাঁর হয়ে আইনস্টাইনের পাঠ করার মধ্যে একটা বিশেষ গুরুত্ব লুকিয়ে আছে। আইনস্টাইন মেনে নিয়েছিলেন সেই সমাধান। অনেক বিজ্ঞানীই অবশ্য প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু বেশি দিন চলেনি সে গুঞ্জন। কারণ সবাই ভেবেছিল শোয়ার্জশিল্ডের এই ডার্কস্টার শুধুই তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব। বাস্তবে কোনো নক্ষত্রের এমন দশা হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু শোয়ার্জশিল্ডের সমাধানটার বিশেষ গুরুত্ব ছিল।
চলবে….