১৯১১ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড একট পরীক্ষা চালান। বিখ্যাত স্বর্ণপাত পরীক্ষা। পাতটা খুবই পাতলা। ২০টি পরমাণুর ব্যাসের সমান। অর্ধস্বচ্ছ পাত বললেও চলে ওটাকে। স্বর্ণপাতের চারপাশে রাখলেন জিঙ্ক সালফাইড পর্দার একটি বেষ্টনি। এই পর্দা আলোক সংবেদী।
পর্দার একদিকে সামান্য একটা গলিপথ রাখা হলো। সেই গলিপথের সামনে রাখা হলো একটা সীসার ব্লক। ব্লকটার ভেতরে রাখা হলো একটা আলফাকণার উৎস। ব্লকে একটা সুড়ঙ্গপথ আছে। সেই পথ দিয়ে ছুটন্ত আলফাকণা বেরিয়ে আসে। তারপর আলফাকণার স্রোত (বিম) ঢুকে পড়ে জিঙ্ক সালফাইড পর্দার গলিপথ দিয়ে। এরপর আলফাকণার বিম গিয়ে পড়ে স্বর্ণপাতের ওপর।
আলফা কণা যদি স্বর্ণপাত ভেদ করে চলে যায়, তাহলে সেটা গিয়ে পড়বে জিঙ্ক সালফাইডের বেষ্টনির ওপর। পর্দাটা আলোক সংবেদি। তাই আলফা কণা পর্দার ওপর যেখানে আঘাত করবে সেখানে একটা আলোক বিন্দুর ঝলক দেখা যাবে।
স্বর্ণপাতের ওপর একঝাঁক ছুটন্ত আলফাকণা দিয়ে আঘাত করালেন রাদাফোর্ড। দেখলেন, বেশিরভাগ কণা স্বর্ণপাত ভেদ করে চলে যাচ্ছে। কণাগুলো এক পথে যায়নি। কিছু কণা স্বর্ণপাত ভেদ করে একেবারে সোজা গিয়ে পড়েছে জিঙ্ক সালফালইড পর্দার ওপর। কিছু আবার একটু দিক পবির্তন করে অর্থাৎ ভিন্ন পথে ভিন্ন কোণে গিয়ে পর্দার ওপর পড়েছে। অল্প কিছু কণা স্বর্ণপাত ভেদই করতে পারেনি। বিভিন্ন কোণে প্রতিফলিত হয়ে পর্দার ওপর পড়েছে। ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক আর আলফা কণার চার্জ ধনাত্মক। তাহলে ইলেকট্রন আলফা কণাকে আকর্ষণ করে কী আটকে রাখতে পারত না?
এই পরীক্ষার আগ পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়নি। তাই রাদাফোর্ড জানতেন না আলফা কণা আসলে হিলিয়ামের নিউক্লিয়ায়াস।
ততদিনে ইলেকট্রন আবিষ্কার হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা জেনে গেছেন, ইলেকট্রন ঋণাত্মক চার্জ যুক্ত। ধনাত্মকচার্জের আলাফাকণাকে আকর্ষণ করার ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রন। তাহলে আলফাকণাগুলো আটকে যাবার কথা স্বর্ণপাতের ভেতর! আটকে যেত, যদি ইলেকট্রনের ভর আলফা কণার কাছাকাছি হতো। ইলেকট্রন আর আলফা কণার ভরের তফাৎ আকাশ-পাতাল। ইলেকট্রনের সাধ্য নেই প্রবল ভরেবেগে চলা ভারী আলফা কণাকে আকর্ষণ করে আটকে রাখে।
সে না হয় হলো, খটকা তো আরও থেকে যাচ্ছে। সবগুলো আলফাকণাই কেন স্বর্ণপাত ভেদ করে সোজাসুজি গিয়ে পর্দায় আঘাত করল না, তাদের পথ কেনইবা বেঁকে গেল? আবার কিছু কণা প্রতিফলিত হয়ে ফিরেই বা এলো না কেন? নিশ্চয়ই স্বর্ণপাতে এমনকিছু আছে যেগুলো আলফাকণার গতিপথকে প্রভাবিত করেছে। কোনো বস্তুতেই পরমাণুর বাইরে কিছু থাকার কথা নয়। পরমাণু মানেই ইলেকট্রন। সেই ইলেকট্রন যদি আলফা কণার ওপর প্রভাব না ফেলতে পারে, তাহলে কে ফেলল?
[এই লেখাটি কৃষ্ণগহ্বর ঃ এক মহাজাগতি রহস্যের ঊপাখ্যান বইয়ের অংশবিশেষ। বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশ করবে অন্বেষা প্রকাশন]
এই পরীক্ষা থেকে রাদারফোর্ড নিশ্চিত হলেন, পরমাণু নিরেট নয়। নিরেট হলে আলফা কণা স্বর্ণপাত ভেদ করে চলে যেতে পারত না। ইলেকট্রন কি পারত না আলফা কণাকে বাঁধা দিতে?
রাদারফোর্ড নিশ্চিত হন, সকল পরমাণুতেই একটা ঘন জমাট বস্তু আছে। সেই বস্তুটা বেশ ভারি, এবং আলফাকণার গতিপথের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সেটা ঋণাত্মক চার্জের হলে হবে না। সেটার চার্জ ধনাত্মক। আর ধনাত্মক বলেই বলেই সেটা আফলা কণাকে বিকর্ষণ করে। তাই কোল ঘেষে যাওয়া আলফা কণার গতিপথ বেঁকে যায়।
বেঁকেই বা যায় কেন?
সেই ভারি বস্তুটা যদি ধনাত্মক এবং সেটা নিরেট বস্তু হয়, তাহলে আলফা কণা তাতে বাধা পেয়ে ফিরে আসার কথা। পাত ভেদ করে গেল কীভাবে? তাহলে কি পরমাণুর ভেতররে শুধু ধনাত্মক ভারি বস্তুটি আর ইলেকট্রন ছাড়াও ফাঁকা জায়গা আছে?
রাদারফোর্ড সেটাই নিশ্চিত হলেন। বললেন, পরমাণুর গঠন কিছুটা সৌরজগতের মতো। এর কেন্দ্রে রয়েছে অত্যন্ত ঘন ও ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের বাইরে রয়েছে বিরাট ফাঁকা অঞ্চল। কতটা ফাঁকা, সেটা বোঝাতে দারুণ এক উদহারণ দিলেন রাদারফোর্ড।
তিনি বললেন, পরামাণু হলো বিশাল এক মন্দিরের মতো। তাঁর ভেতরে যদি একটা মাছি থাকে তাহলে সেটাই হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াস। তারমাণে পরমাণুর ভেতর বেশিরভাগ জায়গায়ই ফাঁকা।
রাদারফোর্ড হিসাব করে দেখালেন, নিউক্লিয়াসের আয়তন পরমাণুর মোট আয়তনের ১০ লক্ষ ভাগের একভাগ। রাদার্ফোড পরমাণু আর নিউক্লিয়াসের ব্যসার্ধ্য নির্ণয় করতেও সক্ষম হলেন।
পরমাণুর ব্যাস পেলেন ১০^-১০ মিটার আর নিউক্লিয়াসের ব্যাস ১০^-১৪ মিটার। তাঁর হিসাব অনুযায়ী, আয়তনে যত নগণ্যই হোক পরমাণুর প্রায় সবটুকু ভর দখল করে থাকে নিউক্লিয়াস। ইলেকট্রনের ভর এত নগণ্য, পরমাণুর মোট ভরের তুলনায় সেটা কিছুই নয়।
রাদারফোর্ড আরো বললেন, ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনের গতি-প্রকৃতি অনেকটা আমাদের সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা গ্রহগুলোর মতো।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলকে সোলার সিস্টেম অ্যাটম মডেলও বলে। পার্থক্য হলো, সূর্য ও তার গ্রহগুলোর মধ্যে মহকর্ষ বল ক্রিয়া করে আর নিউক্লিয়াস আর ইলেকট্রনগুলোর মধ্যে ক্রিয়া করে তড়িচ্চুম্বকীয় বল। নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক চার্জের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে রাদারফোর্ড ১৯১৯ সালে প্রোটন নামে এক ধরনের কণার অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। এই কণা ধনাত্মক চার্জযুক্ত।
ইলেক্্রটন আর প্রোটন আবিষ্কারের পর একটা সমস্যা দেখা দিল কণা পদার্থবিজ্ঞানে। কৌনিক ভরবেগ আর চার্জ সংরক্ষণশীলতার নীতিতে গোলামামাল হচ্ছিল। তখন রাদারফোর্ড চার্জবিহীন কিন্তু প্রোটনের সমান ভারী একটা কণার প্রস্তাব করেন।
রাদারফোর্ডেও সূত্রের রেশ ধরে বিখ্যাত পদার্থবিদ পিয়েরে কুরি ও মাদাম কুরির মেয়ে আইরিন কুরি আর তাঁর স্বামী জুলিও কুরি একটা পরীক্ষা চালান। সেই পরীক্ষা থেকেই নিউট্রন কণার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেত। কিন্তু কুরি দম্পতি ঠিকঠাকভাবে পরীক্ষার ফলাফলটাকে ব্যবহার করতে পারেনি। তাই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি নিউট্রনের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা। একই পরীক্ষা আবার করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস চ্যাডউইক। ১৯৩২ সালে তিনি সক্ষম হন নিউট্রনের হদিস দিতে। এজন্য ১৯৩৫ সালে তাঁকে নোবেল দেওয়া হয়।
এর সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন, ইলেটট্রন, প্রোটান ও নিউট্রনÑএই তিনটি মূলকণা দিয়েই পৃথিবীর সব মৌলিক পদার্থ তৈরি। আবার যৌগিক পদার্থগুলোও তো মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। মৌলিক আর যৌগিক পদার্থ দিয়েই তৈরি গোটা মহাবিশ্ব। তাহলে গোটা মহাবিশ্বের তিনটি মূল উপদান দাঁড়ালÑইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন।
বিজ্ঞান কখোনোই একটা জায়গায় থেমে থাকে না। শুধু সামনেই এগিয়ে চলে। তাই যুক্তি, তর্ক, প্রমাণ দিয়ে দাঁড় করানো তত্ত্ব ভবিষ্যতে হয়তো ভুল প্রমাণিত পারে। সেটা যদি হয়, সেই তত্ত্বেও যিনি আবিষ্কারকও তিনিও খুশিমনে সেটা মেনে নেন। নতুন তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়েই তিনি ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেন তাঁর গবেষণা। এখানেই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য। ঠিক এমনই ঘটনা ঘটল মূল কণিকাকাদেও ক্ষেত্রেও।
বিজ্ঞানীরা সবাই প্রায় মেনে নিয়ে নিয়েছেন মহাবিশ্বেও তিনটি মূল কণিকাকে। তারমানে, ইলেকট্রন, প্রোটন, আর নিউট্রন যে অন্য কোনো কণা দিয়ে তৈরি নয়, একথা যখন বিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করেছেন, তখনই হাজির নতুন এক সমস্যা।
সমস্যাটার জন্ম নিউক্লিায়সের ভেতর। আগেই প্রমাণ হয়েছে প্রোটন ধনাত্মক চার্জ যুক্ত আর নিউট্রন ঋণাত্মক চার্জযুক্ত কণা। তাই এরা একে অপরকে আকর্ষণ করার কথা নয়।
তাহলে নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রন পরস্পরের সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে কীভাবে?
এদের যে ভর তাতে মহাকর্ষ বল দিয়েও, এত শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হবার কোনো সুযোগ নেই এদের। একই চার্জযুক্ত দুটি কণা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। হাইড্রোজেন পরমাণুতেই কেবল একটি প্রোটন থাকে। বাকি সব পরমাণুতেই একাধিক প্রোটন থাকে। নিউক্লিয়াসের ভেতর সেসব প্রোটন গাদাগাদি করে থাকে কীভাবে, একটার ধনাত্মক চার্জ আরেকটার ধনাত্মক চার্জকে বিকর্ষণ করবে না? তাই যদি হয়, প্রোটনগুলো নিউক্লিয়াসে আটকে না থেকে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার কথা। তাহলে…?
একটা সমস্যা বটে। সাথে যোগ হলো আরেকটি অদ্ভুত সমস্যা। একটা নিউক্লিয়াসের ভর এর ভেতরের প্রোটন ও নিউট্রনগুলোর আলাদা আলাদা ভরের যোগফলের সমান হওয়ার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখলেন বস্তবে তা হয় না। নিউক্লিয়াসের ভর প্রোটন ও নিউট্রনগুলোর আলাদা আলাদা ভরের যোগফলের সমান নয়। বেশ খানিকটা কম। তাহলে বাকি ভরটুকু গেলো কোথায়?
এই সমস্যার সমাধান হলো আইনস্টাইনের ভরশক্তির সমীকরণ থেকে। নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে নিউক্লিয়নগুলো আলাদা করতে হলে বিপুল পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। এবার এই ব্যপারটাকে উল্টোদিক থেকে হিসাব করলে দাঁড়ায়, নিউক্লিয়নগুলো নিজেদের ভেতর যখন বন্ধন তৈরি করে তখন তারা ওই একই পরিমাণ শক্তি ছেড়ে দেয়।
এই শক্তি নিউক্লিয়নগুলো কোথায় পায়? এই শক্তি উৎপাদন করার জন্য নিউক্লিয়নগুলো তাদের সামগ্রীক ভর কিছুটা কমিয়ে ফেলে। তাই নিউক্লিয়াসে ভর ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি ভরটুকু আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ ঊ=সপক্ষ্ম অনুসারে বিপুল পরিমাণ শক্তিতে পরিণত হয়। সেই শক্তি দিয়েই নিউক্লিায়াসে ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন আর চার্জনিরপেক্ষ নিউট্রন পরস্পরের সাথে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে।
আবার সুগঠিত নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে গেলে তাই সেই পরিমাণ শক্তি বাইরে থেকে প্রয়োগ করতে হয়। তখন নিউক্লিয়নগুলো সেই শক্তি গ্রহণ করে তাদের হারানো ভর ফিরে পায় এবং তাদের নিউক্লিয় বন্ধন ভেঙে যায়।
যেহেতু নিউক্লিয়াসের ভর ঘাটতির সমস্যা সমাধান হয়ে গেল, তাই বিজ্ঞানীরা ধরে নিলেন ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনএই তিনটি মৌলিক কণা দিয়েই আমাদের দৃশ্যমান জগৎ তৈরি। কিন্তু তাঁদের সেই ধারণা টিকল না বেশিদিন।
আগের সব পর্ব :কৃষ্ণগহ্বর-৭ : মহাকর্ষের কথা শোনে আলোও
কৃষ্ণগহ্বর-৬ : আপেক্ষিকতা ও আধুনিক মহাকর্ষ
কৃষ্ণগহ্বর-৪ : নিউটনের কামান আর পৃথিবীর মুক্তিবেগ
কৃষ্ণগহ্বর-৩ : নিউটনের মহাকর্ষে
-আব্দুল গাফফার রনি সহসম্পাদক, মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা [লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]