স্থান কেন ত্রিমাত্রিক তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পাওয়ার দাবী

1
781

মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই ত্রিমাত্রিক, তথা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এই তিনটি মাত্রা বিশিষ্ট। মহাবিশ্ব কেন ত্রিমাত্রিক এটি নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষেরা হয়তো তেমন একটা ভাবিত নই। তবে এই প্রশ্নটি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে রয়েছে।

কণা পদার্থ বিজ্ঞান এবং নট থিওরি (knot theory, গ্রন্থি তত্ত্ব)-র মিশেলে নতুন ধারনা ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্বকে শুধু বর্ণনাই করে না, বরং সেই সাথে কেন সৃষ্টির অনতিপরেই মহাবিশ্ব বিপুলাকার ধারনা করে সেই ব্যাপারেও ধারনা দেয়। মহাবিশ্বের ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা অর্থাৎ এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা নামের তিনটি ডিগ্রি অব ফ্রিডম (Degree of freedom) এতোই মৌলিক যে, তিনমাত্রার বাইরে মহাবিশ্বকে কল্পনা করাই কঠিন। যেমন: চতুর্মাত্রার একটি ‘হাইপারকিউব’ কল্পনা করার চেষ্টা করে দেখুন, আপনার মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।

আমরা অবশ্য তিনমাত্রার বাইরেও আরো নানাবিধ মাত্রার অস্তিত্ত্ব থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারি না। এমনও হতে পারে অন্যান্য মাত্রাগুলো এমন অনির্ণয়যোগ্য পরিমাপের মধ্যে কুঁকড়ে আছে যে আমরা এখনো তা পর্যবেক্ষণ করি নি। বিভিন্ন তাত্ত্বিক মডেল যেমন স্ট্রিং থিওরি এধরনের বহুমাত্রিক মহাবিশ্বকে বৈধতা দেয় এবং নয় কিংবা তদূর্দ্ধ মাত্রার একটি মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা দেয়।

তবে তিনের অধিক মাত্রার হদিস যেহেতু এখনো আমরা পাইনি এবং এগুলো যেহেতু কাগজে কলমে হিসেবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাই আমরা কেবল দৃশ্যমান মহাবিশ্বের তিনটি মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারি যার মাধ্যমে গঠিত হয়েছে গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি প্রভৃতি।

পদার্থবিদদের একটি দল তিন সংখ্যাটির এই যাদুকরী উপস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি নতুন মডেলের সম্মুখীন হয়েছেন যার নাম তাঁরা দিয়েছেন গ্রন্থিময় স্ফীতি (knotty inflation)।

গবেষকগণ ফ্লাক্স টিউব নামে পদার্থবিদ্যার মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত একটি বিষয় হতে শুরু করেন, যা জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের সময় হতেই আলোচনায় রয়েছে। ১৯ শতকের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের তত্ত্বের মধ্যে এর শেকড় প্রোথিত। ফ্লাক্স টিউব হলো চৌম্বক বলরেখার মতো জিনিস যা নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে চৌম্বক ক্ষেত্রের ফলে উদ্ভুত কাল্পনিক বলরেখার সংখ্যা।

বৈদ্যুতিক চার্জের ধনাত্মক ও ঋনাত্মক অংশ, চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিম মেরু এসবের সাথে আমরা পরিচিত। কোয়ান্টাম জগতও তেমনি এধরণের বিষয় নিয়ে গঠিত ধরে নেওয়া যায়। কোয়ান্টাম স্কেলে ফ্লাক্স টিউবের ধারনা প্রয়োগ করে দেখানো যায় কেন কোয়ার্ক কণিকাগুলো বিশেষ বিশেষ ভাবেই সজ্জিত হয়ে ভারী স্থিতিশীল পারমাণবিক কণিকা, যেমন: প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি গঠন করে।

একটি চুম্বকের দুই মেরুকে আলাদা করার চেষ্টা করা হলে দুটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর চুম্বকের উদ্ভব ঘটে যাদের প্রত্যেকের দুটি করে মেরু থাকে। একই ভাবে গ্লুয়নে যুক্ত একজোড়া কোয়ার্ককে আলাদা করার চেষ্টা করা হলে এরা প্রথমে প্রসারিত হয়, কিন্তু এক পর্যায়ে আকস্মিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। গ্লুয়ন ক্ষেত্রের শক্তি তখন নতুন একজোড়া কোয়ার্ক ও এন্টি কোয়ার্ক তৈরি করে।

কখনো কখনো এই যুগল তাৎক্ষণিকভাবে কাছাকাছি চলে এসে একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তবে কখনো কখনো কোয়ার্ক দুটি প্রাথমিক যুগলের মতো অন্য কোয়ার্কের সাথে আলাদা স্থিতিশীল যুগল তৈরি করে। মহাবিশ্বের বয়স যখন কেবল কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড ছিলো তখন সমগ্র স্থান কোয়ার্কময় ছিলো। কাজেই ধারনা করা হয় সেই অবস্থায় ফ্লাক্স টিউবও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলো।

এই রকম পরিস্থিতি থেকেই বিজ্ঞানীরা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, থমাস কেফার্ট বলেন, “আমরা বহুল প্রচলিত ফ্লাক্স টিউবের ধারনা নিয়ে এগিয়ে গেছি এবং এটিকে বিকিরণের মাধ্যমে উচ্চশক্তি স্তরে নিয়ে গেছি।”

উচ্চশক্তি স্তরে ফ্লাক্স টিউব ভেঙ্গে কোয়ার্ক ও এন্টিকোয়ার্কে পরিণত হওয়া এবং অতঃপর এরা একীভুত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে শক্তি বিকিরিত করাই সবচেয়ে স্বাভাবিক পরিণতি। তবে বিজ্ঞানীরা অদ্ভুত ব্যতিক্রম লক্ষ্য করেন। এই টিউবগুলো একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় এবং সরলরেখা বরারবরই কেবল বিস্তৃত নয়। ফ্লাক্স টিউব সরলরৈখিক বিন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং নানা আঙ্গিকে এদের ব্যাপৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উৎপন্ন কোয়ার্ক এবং এন্টিকোয়ার্কগুলো একীভুত না হয়ে গ্রন্থির মত আবদ্ধ থেকে যায়।

এই গ্রন্থিগুলোর সবচেয়ে ভালো কনফিগারেশনটি কী? এরা তিন মাত্রার মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল থাকে। এর চেয়ে বেশী মাত্রা তৈরি হলে তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে শর্টকাট পথ তৈরি করে ফেলে এবং একীভুত হয়ে কোয়ার্কগুলো ধ্বংস হয়ে যায়।

মহাবিশ্ব যেহেতু যথেষ্ট পরিমান সম্প্রসারিত হয়েছে যাতে কোয়ার্কগুলো পরস্পরের সান্নিধ্যে গ্রন্থি তৈরি করতে পারে, এর শূন্য স্থান উল্লেখযোগ্য পরিমানে ফ্লাক্স টিউবের এই জটের মাধ্যমে পূর্ণ হওযার সুযোগ পেয়েছে। গবেষকগণ ফ্লাক্স টিউবের এই জালকের শক্তি পরিমাপ করে দেখেছেন এবং এই শক্তি একটি স্ফীতি তৈরির জন্য যথেষ্ট পরিমানে পাওয়া গেছে।

আমাদের মহাবিশ্ব প্রত্যেকটি দিয়ে প্রায় একই রকম। এই অবস্থা দেখে কসমোলজিস্টগণ ধারনা করেন অতীতে প্রাথমিক সময়ে মহাবিশ্ব একটি তাৎক্ষণিক স্ফীতির মধ্য দিয়ে গেছে যখন এটি একটি প্রোটন আকারের অবস্থা হতে এক লাফে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে একটি আঙ্গুরের আকারে পরিণত হয়। কেফার্ট এ প্রসঙ্গে বলেন, “ফ্লাক্স টিউবের ধারনা শুধু এই স্ফীতির ব্যাখ্যাই দেয় না বরং কেন এই স্ফীতি হঠাৎ থমকে যায় সেটিও ব্যাখ্যা করে। মহাবিশ্ব যখন সম্প্রসারিত হতে শুরু করল তখন ফ্লাক্স টিউবের নেটওয়ার্ক দুর্বল হতে লাগল এবং ক্রমান্বয়ে ভেঙ্গে পড়ল। এর ফলে স্ফীতি সৃষ্টিকারী শক্তির উৎস উন্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে গেল।”

স্থিতিশীল ত্রিমাত্রিক গ্রন্থিগুলো ব্যতীত অন্যান্য মাত্রার ডিগ্রি অব ফ্রিডম এই সময় বিলীন হয়ে যায়। গবেষকগণ ইতিমধ্যে গবেষণাগারে এই ধরনের কোয়ার্কের প্লাজমা এবং এদের একত্রে বেঁধে রাখার আঠার মতো কণিকা গ্লুয়ন সৃষ্টি করেছেন।

তবে যেমনটি ঘটে আসছে, এই মডেলটি এখন পর্যন্ত খুব সুন্দর ও যুক্তিযুক্ত হলেও হয়তো সেদিন দূরে নয় যেদিন মহাবিশ্বের আরো প্যাঁচানো ইতিহাস পাওয়া যাবে।

[Science Alert অবলম্বনে, অনুলিখন: ইমতিয়াজ আহমেদ, বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদক]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. টেলিভিশনঃ তখন ও এখন
২. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
3. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

 

1 মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.