১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোর মধ্যে মৌলিক সংখ্যা কতটি? উত্তরটা সহজ। ৪টি।
১ থেকে ১০০ এর মধ্যে? যাদের জানা আছে তারা হয়তো বলবে সংখ্যাটা ২৫।
১ থেকে ১০০০ এর মধ্যে কতটি মৌলিক সংখ্যা আছে? এবার কয়েক শ্রেণির উত্তরদাতা পাওয়া যাবে! যারা কঠোর পরিশ্রমী তারা হয়তো বলবে ‘একটু হিসাব করে দেখতে হবে’। আবার যারা আমার মতো দিনে ১৬ ঘন্টা নিদ্রাযাপন করে তারা হয়তো ভ্রুঁ কুচকে বলবে ‘এতদূর আবার হিসাব করা যায় নকি? (!)’। তবে উপরের দুই শ্রেণীর সবার মনেই একটা প্রশ্ন কিন্তু নিশ্চিত ঘুরপাক খাচ্ছে। এই লেখাটা কি সংখ্যাতত্ত্বের উপর, নাকি মহান বিজ্ঞানী গাউসের জীবনী নিয়ে? তাদেরকে আশ্বস্ত করছি। লেখাটা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ কার্ল ফ্রেডরিক গাউসকে নিয়েই। তাই আর কথা না বড়িয়ে গণিতের এই রাজপুত্র সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। তার সাথে না হয় কঠোর পরিশ্রমী আর অলসদের কাজটাও খানিকটা সহজ করে দেয়া যাবে।
গাউসের জীবনের দিকে তাকালে একটু অবাক হতে হবে। ইউরোপের বড় বড় বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, গণিতবিদদের মতো তিনি সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে উঠে আসেন নি। তাঁর বাবা ছিলেন একজন শ্রমিক, প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত। এরকম দরিদ্র পরিবার থেকেও যে গাউস এত বড় মাপের বিজ্ঞানী হয়েছিলেন তার পিছনে তাঁর মায়ের অবদান ছিল অবস্মিরণীয়। তাঁর মা জীবনের ৯৭ বছরের একেবারে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন।
১৭৭৭ সালের ৩০ শে এপ্রিল জার্মানীর ব্রাউন্সউইক শহরে তার জন্ম হয়। শৈশবে তাঁর গাণিতিক প্রতিভা নিয়ে বেশ কিছু মজার গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে তিনি কথা বলা শুরু করার আগেই অঙ্ক করতে পারতেন। ছোটবেলায় তাঁর শিক্ষক গাউসকে ব্যস্ত রাখার জন্য ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো যোগ করতে বলেছিলেন। তিনি ঝটপট উত্তর দিয়েছিলেন ৫০৫০। তিনি আসলে ১+১০০, ২+৯৯, ৩+৯৮….. এভাবে জোড়া বানিয়ে ১-১০০ পর্যন্ত মোট ৫৫টি জোড়ার সংখ্যা গুণ করে পেয়েছিলেন ১০১×৫৫=৫০৫০।
গণিতকে এত সুন্দরভাবে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার নজির তার আগে কেউ স্থাপন করেন নি। কিন্তু একটু বড় হয়েই তিনি আবিষ্কার করলেন তাঁর আশেপাশে গাণিতিক প্রতিভা বোঝার মতো কোনো মানুষ নেই। গণিত ও গণিতের সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলার কোনো লোক নেই! আসলে গাউস এতটাই অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন যে তাঁর ক্লাসে যাই পড়ানো হত তিনি তা আগে থেকেই জানতেন। এমনকি ১৮০১ সালে তিনি যখন বীজগণিতের মূল চারটি থিওরেম প্রমাণ করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন, বলা হয়ে থাকে তখন তাঁর ডক্টরেট করার শিক্ষক জোহান ফ্রেডরিক ফাফ এর চেয়েও তিনি বেশি জানতেন।
যা হোক, ১১ বছর বয়সে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শেষ করে হাইস্কুলে (জার্মানীতে যেটার নাম জিমন্যাসিয়াম) যোগ দেন। ১৪ বছর বয়সে তার অসামান্য প্রতিভার কারণে ব্রাউন্সউইক শহরের ডিউকের নজর কাড়েন এবং পড়াশুনার জন্য বৃত্তি পেয়ে যান। ১৭৯২ সালে তিনি ব্রাউনসউইকের কার্নোলিয়াম কলেজে ভর্তি হন। বলাই বাহুল্য সফলতার সাথে তিনি তার কলেজ জীবন শেষ করেন। কলেজ শেষে তিনি ভর্তি হন গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজে বইপত্র-জার্নাল পর্যাপ্ত ছিল না। কিন্তু গটিনজেনে ভর্তি হওয়ার পর সেগুলো তার নাগালের মধ্যে চলে এল। তিনি ক্ষুধার্ত জ্ঞান অন্বেষণকারীর মতো সেগুলো গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন! এবং প্রায়ই অবাক হয়ে আষ্কিার করতেন এর বেশ কিছু জিনিস তিনি নিজেও প্রমাণ করেছেন।
কলেজে থাকার সময়ই তিনি প্রাইম নাম্বার সম্পর্কিত তার বিখ্যাত সূত্রটি প্রদান করেছিলেন! যেটি শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর পর প্রমাণ করা সম্ভব হয়। সূত্রটি ছিল এরকমঃ
যেখানে, n হচ্ছে যত পর্যন্ত মৌলিক সংখ্যা নির্ণয় করতে হবে আর হচ্ছে হ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোর মধ্যে যতটি মৌলিক সংখ্যা পাওয়া যাবে। এবার হয়ত অনেকে ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করতে পার হ এর মান ১০০ বসালে পাওয়া যায়। কিন্তু সংখ্যাটা তো ২৫ আসার কথা। তাদের জন্য বলছি মৌলিক সংখ্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করার সূত্র এখনও আবিষ্কৃত হয় নি। তবে গাউসের সূত্রের একটা সৌন্দর্য্য হচ্ছে n এর মান যত বেশি হয় এর মান তত সঠিক হয়। তোমরা বড় মান নিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পার। আর উত্তর মেলানো জন্য ইন্টারনেট তো আছেই।
শুধু প্রাইম নাম্বারের থিওরি নয়। তিনি প্রায় দুই হাজার বছরের অসাধ্য সমস্যা- রুলার ও কম্পাস দিয়ে সমসতেরোভূজ এঁকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। গণিতের ক্ষেত্রে যে এটা কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল তা আমাদের অজানা নয়। তিনি ত্রিভুজ সংখ্যার একটি সুন্দর গাণিতিক প্রকাশ করেছিলেন-
অর্থাৎ, যেকোন স্বাভাবিক সংখ্যাকে ত্রিভূজ সংখ্যার সমষ্টি আকারে প্রকাশ করতে তিনটির বেশি ত্রিভুজ কখনই প্রয়োজন হবে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ৩৫ সংখ্যাটাকে প্রকাশ করতে তিনটি ত্রিভুজ সংখ্যা ১, ৬ ও ২৮ এর প্রয়োজন পড়ে। অর্থাৎ ৩৫=২৮+৬+১
যাহোক, ১৭৯৮ স্নাতক শেষ না করেই গটিনজেন ছেড়ে দেন এবং নিজ শহরে ফিরে এসে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তার গবেষণাপত্রের সংখ্যা ছিল ১৫৫টি! যেগুলো সত্যিকার অর্থেই সংখ্যাতত্ত্বের ভিত গড়ে দিয়েছিল। ১৮০১ সালে পাটগিণিতের উপর তাঁর বিখ্যাত বই Disquisitiones Arithmeticae প্রকাশিত হয়। যেটাকে এখন পর্যন্ত পাটগিণিতের সর্বশেষ্ঠ বই হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এরই মধ্যে হারিয়ে যাওয়া গ্রহাণু সেরেসের অবস্থান ও কক্ষপথ নির্ভুলভাবে হিসাব করে জ্যোর্তিবিদ হিসেবেও নিজের প্রতিভার প্রমাণ দেন। ১৮০৯ সালে জ্যোতির্বিদ্যার উপর তার একটি বইও প্রকাশ পায়। যার নাম Theoria Motus Corporum Coelestium।
মজার ব্যাপার হচ্ছে গণিত শিক্ষায় তৎকালীন ছাত্রদের অনুৎসাহ দেখে তিনি (গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে) গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিতে রাজি হননি। বরং জ্যোতির্বিদ্যাকেই বেশি উৎসাহব্যঞ্জক মনে করেছিলেন। কথিত আছে তিনি গবেষণা নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে যখন তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিয়ে তার স্ত্রী মৃত্যু শয্যায়, তখন তাঁকে স্ত্রীর খবর দেয়া হলে তিনি বলেন,
“Ask her to wait a moment, I am almost done!!!’’
গাউস তাঁর এক জীবনে বিজ্ঞানের অনেক শাখায় অবদান রেখেছেন। র্জামানি এই মহান গণিতবিদের স্মরণে ১০ মার্কের (জার্মান টাকা) নোটে গাউসের ছবি ব্যবহার করে। ১৮৫৫ সালে ২৩ শে ফেব্রুয়ারি এই মহান গণিতবিদের মৃত্যু হয়। সংখ্যাতত্ত্ব ও গণিতকে যিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন, সংখ্যাতত্ত্বের অপার সৌন্দর্য যাকে মুগ্ধ করতো, ব্রাউনসউইক শহরের এক শ্রমিক পরিবার থেকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হয়ে ওঠা মানুষটির ৭৮ বছরের জীবনাবসান ঘটে। জার্মানরি হ্যানোভারে এই মহান গণিতবিদকে সমাহিত করা হয়। গণিত ও সংখ্যা তত্ত্বের প্রতি তার ভালবাসা খুঁজে পাওয়া যায় তার প্রিয় উক্তিতে-
“Mathematics is the queen of science
And number theory is the queen of Mathematics”
আসলে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। সংখ্যাতত্ত্বের উপর তার দক্ষতা ও মৌলিক উপপাদ্য প্রমাণের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে গণিতের মুকুটহীন রাজপুত্র বা Prince of mathematics নামে ডাকা হয়।
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া
অনলাইন ব্লগ
নিউরনে আবারো অনুরণন
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: শাহরিয়ার আহমেদ রাব্বী (ছেলেটা গাউসের মতোই মেধাবী কিন্তু আমার মতোই অলস)
তাসীন নুর রাহিম
ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, রংপুর