মস্তিষ্ক সবসময়ই জটিল ও রহস্যময়। খাচ্ছি, দেখছি, স্বাদ নিচ্ছি এতসব কিছুর সবইতো মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া নানা ক্রিয়াকলাপের ফল। মস্তিষ্ক যে স্বাদের অনুভূতি কিংবা দেখার অনুভূতি প্রদান করছে তা যে সবসময়ই সঠিক হয় তা কিন্তু না। যেমন লাল মরিচ খেলে ঝালের চোটে জিহ্বায় লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায়। ঐ ঝালের সময় ঠাণ্ডা পানি পান করলে কিছুটা আরাম লাগে। মনে হয় যেন ঝাল কমে গিয়েছে। আদতে এখানে ঝাল কমে যায়নি, মস্তিষ্ক ভুল করে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। উল্লেখ্য ঝাল কোনো স্বাদ নয়, একধরনের যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। এই প্রকাশের মাধ্যমে মস্তিষ্ক জানিয়ে দেয় এই বস্তু বেশি মাত্রায় গ্রহণ করলে শরীরের জন্য তা খারাপ ফলাফল বয়ে আনবে। ঐ মুহূর্তে গরম পানি পান করলে যন্ত্রণা আরো বেড়ে যায়। ঝালের সময় গরম পানিতে যন্ত্রণা বেড়ে যাওয়াটাও মস্তিষ্কের একটা ভুল সিদ্ধান্তের ফল।[1] সঠিক কিংবা ত্রুটিপূর্ণ ব্যাপারগুলো কেন ঘটছে কীভাবে ঘটছে এসব জানতে বিজ্ঞানীরা তৎপর। কিন্তু মস্তিষ্ক তার কাজের কারণ ও বৈশিষ্ট্য নিজে থেকে বলে দেয় না। বিজ্ঞানীরা মাথার ভেতরের খবর বের করতে সময় সময় নানা কৌশল অবলম্বন করেন। এই ধরনের একটা কৌশল হচ্ছে চোখকে ধোঁকায় ফেলা! দৃশ্যমান আলোকের নানা অবস্থার প্রেক্ষিতে মস্তিষ্ক একেক সময়ে একেক রকম সিদ্ধান্ত নেয়। চোখকে ধোঁকা দিয়ে মস্তিষ্কের আভ্যন্তরীণ কর্ম-প্রক্রিয়া সম্বন্ধে তথ্য লাভ করেন বিজ্ঞানীরা। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে মস্তিষ্কের কাজের ধরন-বৈশিষ্ট্য, ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। এরকমই চোখের প্রেক্ষিতে আলোকীয় ধোঁকা নিয়ে কিছু উদাহরণ দেখবো।
স্নায়ুবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটাই প্রকৃত সত্য যে, আমাদের চারপাশে যা অনুভব করছি তার সবই আমাদের কল্পনার কতগুলো সমন্বয় ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষ অধিকাংশ সময় সঠিক কল্পনাই করে থাকে। মস্তিষ্ক বাইরের জগত নিয়ে আলাদা আলাদা প্রেক্ষিতে আলাদা আলাদা বাস্তবতা তৈরি না করে বরং তাদের মাঝে একধরনের সমন্বয় তৈরি করে নেয়।[2] এটা মস্তিষ্কের এক স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। আর এই কাজটা করার সময় মাঝে মাঝে ভুল হয়ে থাকে।
শারীরিক উদ্দীপনার মাধ্যমে বাস্তব জীবনের সকল অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কে প্রবাহিত হয়। কিন্তু চোখ, কান ও অন্যান্য সংবেদনশীল অঙ্গ হতে যে স্নায়ুবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলো প্রক্রিয়াজাত হয় একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবাস্তব স্বপ্ন, বিভ্রম (delusions) ও স্মৃতি ভুলে যাবার ব্যাপারগুলো সম্পন্ন হয়। মানে বলা যায় স্নায়ুতন্ত্রের দৃষ্টিতে বাস্তব জগত আর কাল্পনিক জগত আদতে একই জগত। সবকিছুই নিউরনে নিউরনে ঘটে যাওয়া কতগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল। এই পর্যায়ে দার্শনিক সক্রেটিসের কাছ থেকে সামান্য বিদ্যে অর্জন করি। “আমি শুধুমাত্র একটা জিনিসই জানি আর সেটা হচ্ছে আমি কিছুই জানি না।”
মস্তিষ্ক কীভাবে বাস্তবতার অনুভূতি তৈরি করে তা জানতে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা সবচে গুরুত্বপূর্ণ যে উপায়টি ব্যবহার করে তা হচ্ছে চোখের মাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি করা। অবশ্যই সেগুলো নানা ধরনের চিত্র। চোখে বিভ্রান্তি তৈরি করার কাজটি বিজ্ঞানীরা ছাড়াও ঐতিহাসিকভাবে অনেক আগে থেকেই চিত্রশিল্পী ও জাদুকরেরা করে আসছে। কীভাবে সমতল কাগজে আঁকা দ্বিমাত্রিক চিত্র দর্শকের চোখে ত্রিমাত্রিক রূপে প্রতীয়মান হয় কিংবা তুলির আঁচরে কতগুলো রেখার সমন্বয়ে তৈরি করা চিত্র কীভাবে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় এই কৌশল নিয়ে তারা কাজ করতো।
চোখের বিভ্রান্তিকে যদি আমরা সংজ্ঞায়িত করতে চাই তাহলে তাকে একটি বস্তুর বা ঘটনার ভৌত বাস্তবতা ও মানসিক উপলব্ধির মাঝে পার্থক্যকারী হিসেবে ধরতে হবে। অথবা বলা যেতে পারে চোখের বিভ্রান্তি হচ্ছে ভৌত বাস্তবতা ও মানসিক উপলব্ধির মিশ্রণ। আমরা যখন কোনো দৃষ্টি সংক্রান্ত বিভ্রান্তির অভিজ্ঞতা লাভ করি তখন সম্ভবত স্বাভাবিকের বাইরে এমন কিছু দেখি যা সেখানে নেই। কিংবা এমন সেখানে যা যা আছে তার সবগুলো দেখতে সক্ষম হই না। একটা আলোকীয় সিস্টেম বিবেচনা করা যাক। ধরা যাক সেই সিস্টেম হচ্ছে একটা চিত্রকর্ম। সিস্টেমে বাইরে থেকে কোনো রঙ যুক্ত হলে কিংবা রঙিন কাঁচের ভেতর দিয়ে চিত্রটিকে দেখলে সেটি কোনোভাবেই আগের সিস্টেমের মতো থাকবে না। চোখের বিভ্রান্তির বেলাতেও এমনটাই ঘটে। তবে চিত্রকর্ম আর এর মাঝে পার্থক্য হচ্ছে চিত্রকর্মে সত্যি সত্যি কিছু
যুক্ত হচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছে কিন্তু চোখের বিভ্রান্তির বেলায় একটা চিত্র অপরিবর্তনীয় থাকা সত্ত্বেও মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না কিংবা অতিরিক্ত কিছু কল্পনা করে নিচ্ছি। বাস্তবতা ও কল্পনার মাঝে সমন্বয় না থাকার কারণেই এমন ত্রুটিগুলো হয়ে থাকে।
আমরা কী ‘দেখি’ তার উপর রঙ, রঙের উজ্জ্বলতা, ছায়া, চোখের নড়াচড়া সহ অন্যান্য কারণের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। উজ্জ্বলতা, ছায়া, পরিপার্শ্ব ইত্যাদির সামান্য চতুরতার ফলে খুব সহজেই ‘যা দেখছি’ তার এদিক সেদিক করে ফেলা যায়। এবারে এরকমই কয়েকটি ছবি নিয়ে আলোচনা করব।
১. উজ্জ্বলতার বিভ্রম
বিভ্রমের এই ছবিটি তৈরি করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির দৃষ্টিবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড এইচ অ্যাডেলসন। এখানে A ও B নামে দুটি বর্গ আছে। দেখতে ভিন্ন দেখালেও তাদের রঙ আসলে একই। কথাটা বিশ্বাস না হলে বর্গ দুটি কাচি দিয়ে কেটে নিয়ে একত্র করে দেখি। কাটতে মায়া লাগলে A এবং B ব্যতীত বাকি সবকটা বর্গকে অন্য কাগজের টুকরো দিয়ে ঢেকে দিলে দেখা যাবে তাদের রঙ একই।
তারপরও সন্দেহ থাকলে ডানের চিত্রে দুটি বর্গকে মিলিয়ে দেখানো হয়েছে। চোখকে প্রতারণায় ফেলার এই ঘটনাটি ঘটে থাকে কারণ আমাদের মস্তিষ্ক কোনো বস্তুর সত্যিকার রঙ সরাসরি গ্রহণ না করে ঐ বস্তুর আশেপাশের বস্তুগুলোর রঙের সাথে তুলনা করে দেখে। এই চিত্রটির বেলাতেও তাই হয়েছে। দুটি বর্গই ধূসর রঙের হওয়া সত্ত্বেও আশেপাশের বর্গগুলোর রঙের প্রভাবে তাদের ভিন্ন ভিন্ন দেখাচ্ছে। B বর্গটি তার চারপাশে সিলিন্ডারের ছায়া সম্বলিত কালো বর্গ দিয়ে বেষ্টিত হওয়াতে কালো রঙের প্রভাবে তাকে অধিকতর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এই ধূসর ঘরটিই যদি চারপাশে সাদা বর্গ দিয়ে বেষ্টিত থাকতো তাহলে তাকে এতটা উজ্জ্বল দেখাতো না। একটু বেশি কালো দেখাতো। ফলাফল, একটার সাথে আরেকটার তুলনা করতে গিয়ে মস্তিষ্ক প্রতিনিয়তই ভুল করে যাচ্ছে।
এই ধরনের আরেকটি উদাহরণ। রাতের বেলায় বাতির আলোতে কোনো একটা বই পড়ছি। বাতির আলোতে বইয়ের পৃষ্ঠার সাদা অংশ যে পরিমাণ আলো প্রতিফলিত করে, তার চেয়ে দিনের বেলায় সূর্যের আলোতে থাকা পৃষ্ঠার কালো লেখাগুলো বেশি আলো প্রতিফলিত করে। কিন্তু তারপরেও আমরা দিনে ও রাতে অক্ষরগুলোকে কালো ও ফাঁকা অংশগুলোকে সাদা দেখে আসছি। কী পরিমাণ আলো প্রতিফলিত করছে, ঐ আলো আমাদের চোখে সত্যিকার অর্থে কোন ধরনের বর্ণের সৃষ্টি করতো তা যেন থোরাই কেয়ার করে। অক্ষরগুলো তার চারপাশে কী দিয়ে বেষ্টিত তাদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেই দিব্যি সিদ্ধান্ত নিয়ে চলছে আমাদের মস্তিষ্ক। হোক সেটা দিন বা রাত, অক্ষরের রঙের চাইতে ফাঁকা অংশের রঙ বেশি সাদা। আশপাশ সাদা হলে মস্তিষ্ক এটিকে তুলনামূলকভাবে বেশি কালো বলে মনে করে নিবে। আমাদের মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়া অনেক জায়গাতেই এরকম।
২. গতির বিভ্রান্তি
কতগুলো স্থির চিত্রের কৌশলপূর্ণ সমাবেশ আমাদের মস্তিষ্কে গতিশীলতার বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। প্রতিটা গোলাকার ক্ষেত্রের গতি আরো বেড়ে যায় যদি দৃষ্টি পরপর একটি ক্ষেত্র থেকে আরেকটি ক্ষেত্রে নেয়া হয় কিংবা ছবিটির চারপাশে দৃষ্টির চক্কর দেয়া হয়। দেখলে গতিশীল বলে মনে হওয়া এই ভ্রান্তির চিত্রটি তৈরি করেন জাপানের রিতসুমাইকান বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আকিওশি কিতাওকা। জাপানের সংস্কৃতির মিশেলে তার ভাষ্যে- ঘূর্ণনের সময় ‘সর্প’ দৃষ্টিগোচরীভূত হয়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ছবিতে কিছুই ঘুরছে না। তবে একটা জিনিস প্রতিনিয়ত নড়াচড়া করছে, সেটা হচ্ছে যে দেখছে তার চোখ!
চোখ প্রতিনিয়ত নড়াচড়া করছে বলেই স্থির ছবিকে চলমান দেখাচ্ছে। বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা। এখানের যেকোনো একটা ‘সর্প’ বা বৃত্তের কেন্দ্রের কালো বিন্দুর দিকে মনোযোগ দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। স্থির মনোযোগে তাকালে দেখা যাবে বৃত্তের ঘূর্ণন অনেক ধীর হয়ে গেছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ঘূর্ণন এমনকি থেমেই যাবে। চোখের মনোযোগকে একটা বিন্দুতে আটকে রাখলে চোখের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে মস্তিষ্ক গতিশীল বিভ্রান্তিমূলক অনুভূতি গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। ভ্রান্তির অনুপস্থিতিতে ঘূর্ণন থেমে যায়। দৃষ্টিবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন বিভ্রান্তির ঘূর্ণন মস্তিষ্কের যে অংশকে উদ্দীপিত করে সত্যিকার ঘূর্ণনের সময়ও মস্তিষ্কের ঐ অংশই উদ্দীপিত হয়। মস্তিষ্ক অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বাস্তবতা আর ভ্রান্তির কাছে ধরা খেয়ে গিয়েছে! একই এলাকায় উদ্দীপিত হচ্ছে, আলাদা করতে পারছে না কোনটা আসল কোনটা নকল।
পালটে যাওয়া রঙ
এই অসাধারণ বর্ণ-বিভ্রান্তিটি তৈরি করেছেন ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাও লটো ও ডেল পারভেস। মস্তিষ্ক যে ভিন্ন ভিন্ন রঙের উপস্থিতিতে একই জিনিষকে সমন্বয়ের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখে, এটা তার আরেকটা জলজ্যান্ত প্রমাণ। নিচে একটা রঙবেরঙের কিউব আছে। কিউবের উপরের পৃষ্ঠে মাঝের ঘরে বাদামী বর্গটি আর দর্শকের সামনের দিকের মাঝের অংশে কমলা বর্গটি একই রঙের। সামনের দিকের বর্গটি কমলা রঙের দেখাচ্ছে কারণ তার আশেপাশে উজ্জ্বল বর্গের অনুপস্থিতি। পাশাপাশি এর উপর ছায়া পড়ে আছে। উপরের বর্গে এমন ছায়া নেই, অনুজ্জ্বল বর্গের পরিমাণও কম। যার কারণে সামনের দিকের মাঝের বর্গটিকে উপরের দিকের মাঝের বর্গটির তুলনায় বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এই উজ্জ্বলতার কারণেই একে বাদামী না দেখে কমলা বলে ভুল করছে মনের চোখ।
আকৃতির বিকৃতি
বিভ্রান্তির এই অংশটি ক্যাফে ওয়াল ইল্যুশন নামে পরিচিত। মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড গ্রেগরি এটি প্রথম উদ্ভাবন করেন। ইংল্যান্ডে গ্রেগরির ল্যাবরেটরির সামনে ছিল একটি রেস্টুরেন্টের দোকান। রেস্টুরেন্টের সামনের দেয়ালটা ছিল সবুজ ও সাদা রঙে টাইলস করা। সজ্জাটা ছিল সাদা-সবুজ-সাদা-সবুজ-সাদা-সবুজ এরকম। ল্যাবের এক সদস্য স্টিভ সিম্পসন একদিন খেয়াল করেন দেয়ালের সবুজ ও সাদা লাইনগুলোকে হেলানো দেখাচ্ছে, যদিও তারা সোজাই ছিল। গ্রেগরি এই জিনিসটার মনোবৈজ্ঞানিক অর্থ অনুধাবন করতে পারেন।
বিজ্ঞানীরা এই সবুজ-সাদা দেয়ালের একটা সরলীকৃত অবস্থা তৈরি করেন কালো-সাদা ভার্সনের মাধ্যমে। উদ্দেশ্য, একটি বস্তু কীভাবে তার আকৃতি ও সজ্জার বৈচিত্রতার কারণে দর্শকের চোখে সত্যিকার ভৌত আকৃতির বাইরে ভিন্ন আকৃতির বিভ্রান্তি তৈরি করে তা জানা। সোজা লাইনকে বাকা দেখার এই বিভ্রমটি তখনই কাজ করে যখন ‘টাইলস’ বা ক্ষেত্রগুলোর চারদিকে ধূসর রঙের ‘বর্ডার’ উপস্থিতি থাকে। পাশাপাশি চিত্রগুলো এমনভাবে সাজাতে হবে যেন একটা ক্ষেত্রের চারদিকেই ভিন্ন রঙের ক্ষেত্র থাকে। ক্ষেত্রগুলোকে একটু কায়দা করে সোজা লাইনে না সাজিয়ে একটু এদিক সেদিক করে সাজালেই হয়ে যাবে এমন প্যাটার্ন। নিচের চিত্রে একটা সাদা ক্ষেত্রের চারদিকেই আংশিক ভা সম্পূর্ণভাবে কালো ক্ষেত্র আছে।
উজ্জ্বল (সাদা) ও অন্ধকার (কালো) রঙের অনুভূতির জন্য মস্তিষ্কের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল কাজ করে। সজ্জার মাঝে ধূসর রঙের যে একটা লাইন বা বর্ডার আছে সেখানে লাগে গণ্ডগোলটা। যেখানে ‘সাদা-কালো’র সমাবেশ ঐখানে লাইনটিকে কিছুটা স্ফীত বলে মনে হয়। আর যেখানে ‘সাদা-সাদা’ কিংবা ‘কালো-কালো’র সমাবেশ সেখানে ধূসর লাইনটিকে কিছুটা সংকোচিত বলে মনে হয়। একটা সারিতে এক লাইনে ক্রমান্বয়িক স্ফীত ও সংকোচনের অনুভূতির কারণে মস্তিষ্ক পুরো সারিটিকেই বাঁকা বা ঢালু বলে ভুল করে।[3]
এই সহজ কিন্তু অসাধারণ ভ্রান্তিকে প্রদর্শনের জন্য বিশাল বড় এক স্থাপনার সামনের অংশ এমন সাদাকালো প্যাটার্নে করে ফেলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে।[4] ২০০৬ সালে সম্পন্ন এই স্থাপনা অস্ট্রেলিয়ান কাস্টমস সার্ভিসের জন্য ব্যবহার করা হয়।[5]
বৃত্তাকার গতীয় বিভ্রান্তির স্রষ্টা অধ্যাপক কিতাওকা’র তৈরি আরেকটি আলোকীয় বিভ্রান্তি। একটি দাবার ঘরের মতো মেঝে/দেয়ালের মাঝের অংশটিকে বৃত্তাকারে কিছু কাজ করা হয়েছে। তাতেই মনে হচ্ছে মাঝের অংশটি যেন উপরের দিকে স্ফীত হয়ে আছে। আরও মনে হচ্ছে একদম কেন্দ্রের ক্ষেত্রটি সবচে বড় আর বাইরের দিকের ক্ষেত্রগুলো ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে গিয়েছে। এখানে কিছুই ছোট হয়ে যায়নি, কিছুই উপরের দিকে ওঠে আসেনি। প্রত্যেকটি বর্গই পরস্পর সমান। পরিধির দিকেরটা যে আকৃতির কেন্দ্রের দিকেরটা একই আকৃতির। শুধু বর্গের ভেতরে সাদা কিংবা কালো রঙের ছোট ছোট বর্গ বিশেষ সজ্জায় সাজানোর ফলে এমন দেখাচ্ছে। ছোট বর্গগুলোর কৌশলপূর্ণ অবস্থানের কারণে মস্তিষ্ক এই ছবিতে সঠিক তথ্যটা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আগে উল্লেখ করা ক্যাফে ওয়ালের বেলায় মস্তিষ্ক যেমন ভুল করেছিল থাকে এখানেও একই রকম ভুল করছে।
এই ত্রুটিগুলো মূলত একটাই। বাস্তবতাকে চিনতে ভুল করছে। আরও একটু এগিয়ে বললে বলতে হবে বাস্তবতা কী? আমরা যাই দেখছি, অনুভব করছি তার সবই মস্তিষ্কের ভেতর ঘটা কতগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফসল। এর ফলে স্বপ্নে হাতের কাছে, চোখের সামনে কোনো বস্তু না থাকলেও তার অনুভূতি গ্রহণ করতে পারি। ‘ম্যাট্রিক্স’ চলচ্চিত্রে যেমন বিস্তৃত এক পরাবাস্তবতার জগত দেখানো হয়েছে। জাগ্রত অবস্থার বিক্রিয়া আর ঘুমন্ত অবস্থার বিক্রিয়ার মাঝে পার্থক্য কী? একটা টেবিলকে ছুঁয়ে দেখলাম। কিছু একটা অনুভব করলাম। কিন্তু আসলেই কী আমরা টেবিলটাকে ছুতে পেরেছি? পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে কোনোদিনই আমরা টেবিল কিংবা অন্য কোনো কিছু স্পর্শ করতে পারি না।[6] হাতের চামড়া আর টেবিলের পৃষ্ঠের মাঝে একটা ফাঁকা স্তর থেকে যায়। যত সূক্ষ্মই হোক ফাঁকা থাকেই। একটা কাঁচ আরেকটা কাঁচের উপর যত শক্তি দিয়েই লাগানো হোক না কেন তাদের মাঝে অতিসূক্ষ্ম একটা ফাঁকা থেকেই যায়।[7] যা দেখছি, ছুইছি তার সবই আসলে বিভ্রান্তি। কাব্যিক ভাষায় বলা যায় এই মহাবিশ্বের সবই আসলে মায়া!
[1] বাস্তবতার গঠন প্রক্রিয়াঃ স্পর্শ বলে কিছু নেই, দীপেন ভট্টাচার্য, জিরো টু ইনফিনিটি, জুলাই ২০১৪
[1] জিরো টু ইনফিনিটি প্রশ্নোত্তর
[2] Susana Martinez-Conde and Stephen L. Macknik ,The Neuroscience of Illusion, Scientific American Mind, September 2013
[3] Susana Martinez-Conde and Stephen L. Macknik ,The Neuroscience of Illusion, Scientific American Mind, September 2013
[4] Barile, Margherita and Weisstein, Eric W. “Café Wall Illusion.” From MathWorld, http://mathworld.wolfram.com/CafeWallIllusion.html
[5] পূর্বোক্ত
[6] বাস্তবতার গঠন প্রক্রিয়াঃ স্পর্শ বলে কিছু নেই, দীপেন ভট্টাচার্য, জিরো টু ইনফিনিটি, জুলাই ২০১৪
[7] কোয়ান্টাম মেকানিক্স, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মওলা ব্রাদার্স, ISBN 9847015600860
⚫ সিরাজাম মুনির শ্রাবণ
বিভাগীয় সম্পাদক, জিরো টু ইনফিনিটি