ত্রিশ বছর ধরে সচল টেলিস্কোপগুলি। পৃথিবীর চার মহাদেশে আটটি। দানবের মতো আকার একেকটার। সবগুলি রেডিও টেলিস্কোপ। সাধারণ অপটিক্যাল টেলিস্কোপগুলি মহাকাশে ঘাপটি মেরে থাকা বস্তুগুলোকে ঠিকমতো শণাক্ত করতে পারে না। যেসব বস্তু সাধারণ আলোর বাইরে বেতার তরঙ্গ বিকিরণ করে, সেবব বেতার তরঙ্গের ভাষা বোঝার ক্ষমতা নেই অপটিক্যাল টেলিস্কোপের। মহাকাশের অলিগলি থেকে আসা সেসব বেতার তরঙ্গ শণাক্ত করার জন্য বসানো হয়েছে রেডিও টেলিস্কোগুলি। উচু উচু পাহাড়ের চূড়ায়। কারণ, ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা অনেক বেশি থেকে। আর্দ্র বাতাস শুষে নেয় বেশিরভাগ বেতার তরঙ্গ। সামান্য কিছু যা অবশিষ্ট থাকে, তা দিয়ে মহাজাগতিক বস্তুর স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোয়ানা, মেক্সিকো, চিলি, স্পেন আর অ্যান্টারটিকায় বসানো হয়েছে আটটি টেলিস্কোপ। এদের কখনো আকাশের একই দিকে একই সাথে তাক করা হয়নি। এবার সেটা কর হলো। করলেন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির (ম্যাচাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) গবেষকরা। উদ্দেশ্য ব্ল্যাকহোলোর ছবি তোলা। তাও যেনতেন ব্ল্যাকহোল নয়। আমাদের ছায়পথ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে যে বিশাল আকারের ব্ল্যাকহোল রয়েছে, যার নাম স্যাজিটেরিয়াস-এ-স্টারসেটারই সত্যিকারের আলোকচিত্র তোলার জন্যই এই মহাযজ্ঞ।
ব্ল্যাকহোলটির ভর আমাদের সূর্যের ভরের প্রায় ৫০০ গুণ। এত বড় একটা ব্ল্যাকহোল, অথচ আজ পর্যন্ত তার ছবি তোলা যায়নি। আসলে ছবি তোলা যায়নি মহাকাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোনো ব্ল্যাকহোলেরই। তাহলে অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগের দেয়ালে দেয়ালে ব্ল্যাকহোলের যেসব ছবি ঘুরে বেড়ায়, সেগুলো কি?
ওগুলো শীল্পির তুলিতে আঁকা। বিজ্ঞানীদের সরবরাহ করা ডেটা ব্যবহার করে, রং-তুলির নিপুন আঁচড়ে সেগুলো আঁকা হয়েছে অতি বাস্তব করে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কি শুধু শিল্পে মন ভরে? তারা চান একেবারে জলজ্যান্ত ছবি। এরজন্য তোড়জোড় চলছে অনেক দিন। এমআইটির গবেষকরা একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। প্রকল্পের নাম ইভেন্ট হরাইজন। এই প্রকল্পেই আটটি রেডিও টেলিস্কোপের সমন্বয় করা হয়েছে। প্রকল্পের নামের ভেতরেই লুকিয়ে আছে ব্ল্যাকহোলের মূল বৈশিষ্ট্য। ব্ল্যাকহোল খুব ক্ষুদ্র আকারের কিন্তু বিশাল ভরের। আমাদের সূর্যকে যদি কোনোভাবে ব্ল্যাকহোলে পরিণত করা যেত, তাহলে সেটার ব্যাসার্ধ হতো মাত্র সাড়ে পাঁচ মিলিমিটার! এটা আসলে ব্ল্যাকহোলটির মহার্ষীয় ক্ষেত্রের শেষ সীমা। এই সীমাকে বলে ইভেন্ট হরাইজন। ইভেন্ট হরাইজনের ভেতর যে বস্তুই চলে যাক সেটাকে গ্রাস করে নেয় ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষীয় মুক্তিবেগ আলোর বেগের চেয়েও অনেক অনেক বেশি। তাই ভেতর থেকে কোনো আলোক রশ্মিই বেরিয়ে আসতে পারে না। এ কারণে ব্ল্যাকহোর দেখা যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব এর ভেতরের খবর জানা। ব্ল্যাকহোল যদি দেখাই না যায়, ছবি তুলবে কী করে?
কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে শূন্যস্থান শূন্য নয়। সেখানে প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে কণা আর প্রতি কণার জোড়া। কিন্তু তারা খুব ক্ষণস্থায়ী। জšে§র সাথে সাথেই পরস্পরের সাথে সংর্ঘষ ঘটিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শক্তি। সেই শক্তিই পরক্ষণে আবার একজোড়া কণা-প্রতিকণা তৈরি করে। এভাবেই প্রকৃতিতে চলছে ভার্চুয়াল কণাদের ভাঙাগড়ার খেলা। ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্তের খুব কাছেই তৈরি হয় যেসব ভার্চুয়াল কণার জোড়া, সেগুলো পরস্পরকে ধ্বংস করার আগেই একটা পড়ে যায় ঘটনা দিগন্তের ভেতরে। অন্য কণাটা ঘটনা দিগন্তে নাও পড়তে পারে। ছুটে পালিয়ে আসতে পারে ঘটনা দিগন্ত থেকে অনেক দূরে। আসার সময় এই কণাটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে শক্তির যোগান পায়। সেই শক্তিই বিকিরণ (হকিং বিকিরণ) করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কণাটি। ঘটনা দিগন্তের বাইরে তখন তৈরি হয় বিকিরণ বলয়। সেই বিকরণ বলয় দেখেই হদিস মেলে কৃষ্ণগহ্বরের।
৭ থেকে ১১ এপ্রিল, পর পর পঁচ রাত আটটা টেলিস্কোপ একসাথে স্যাজিটেরিয়াস-এ-স্টার ব্ল্যাকহোলটির ছবি তুলেছে। কিন্তু ছবি আদৌ উঠেছে এখনই কিনা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। কারণ, ডাটা বিশ্লেষণ করতে সময় লাগবে। তাছাড়া অ্যান্টার্ন্টিকার আবহাওয়া বছরের এই সময়টাতে ভীষণ প্রতিকূল। বিমান পর্যন্ত যেতে পারে না। তাই সেখানকার পূর্ণ ডাটা পৌঁছাতে পারছে না এমআইটির বিজ্ঞানীদের হাতে। তবে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী ১০১৮ সালের মার্চ মাস নাগাদ প্রকাশ করতে পারবেন অতিভরের ব্ল্যাকহোলটির প্রথম ছবি।
-আব্দুল গাফফার রনি
বিজ্ঞান লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]