বিজ্ঞানপ্রেমী যেকোন মানুষ বিশেষ করে যারা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের হাল-চালের খোঁজ রাখেন, তাদের কাছে বোধ হয় সার্ন(CERN) নামের প্রতিষ্ঠানটি অপরিচিত নয়। ইউরোপিয়ান এই নিউক্লিয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিকে নিত্য চলে বিশাল দক্ষযজ্ঞ, মূল উদ্দেশ্য পার্টিকেল ডিটেক্টিং। এক কথায় তাত্ত্বিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মৌলিক এবং অতিপারমাণবিক কণিকার অস্তিত্বের বাস্তবতা আবিষ্কার ও সনাক্ত করা এবং আবিষ্কৃত সেসব কণিকাকে উচ্চতর গবেষণায় কাজে লাগানোই সার্নের কাজ।
এসব কাজে সার্নের LHC তে যে ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয় তার পরিমাপের পাল্লা ধারণাতীত নিখুঁত। বিশাল আকৃতির, হাজার হাজার টনের এই ডিটেক্টরে থাকে মিলিয়ন সংখ্যক অতি উন্নত প্রযুক্তির ডিটেক্টিং এলিমেন্ট এবং এই প্রযুক্তি, সাজ-সরঞ্জামের উপর নির্ভর করেই চলে হাজার খানেক বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীর নিরলস সাধনা এবং আন্তর্জাতিক মানের অসংখ্য গবেষণা কাজ।
যা হোক, আজ এ লেখায় সার্নের অত্যাধুনিক সেসব পার্টিকেল ডিটেক্টরের জটিল ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাখ্যায় যাব না। সেটা আশা করি লেখায় শিরোনাম দেখেই বুঝতে পেরেছেন। তাহাড়া পার্টিকেল ডিটেক্টিং মানেই যে জটিল কোন প্রযুক্তি বা ইঞ্জিনিয়ারিং তা কিন্তু নয়। এমন অনেক সাধারণ ডিজাইনের ডিটেক্টর আছে যা আপনি খুব সহজেই বাসায় তৈরি করে চালাতে পারবেন!
সেই রকম একটা ডিটেক্টরের নাম হল Continuously Sensitive Diffusion Cloud Chamber। নামটা কাঠখোট্টা শোনালেও এর আইডিয়াটা বেশ সহজ। এটার আইডিয়া প্রথম আসে ১৯৩৮ সালে UC Berkeley তে (ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে)। এই ধরনের ডিটেক্টরে অ্যালকোহল বাষ্প দিয়ে ‘cloud’ তৈরি করা হয়, যা এর ভেতর দিয়ে চলমান পার্টিকেলের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।
মহাজাগতিক রশ্মি (Cosmic ray) এমন সব পার্টিকেল যা প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্তে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ছুটে আসছে। এগুলো যখন বায়ুমণ্ডলে আঘাত করে, তখন তা আরো কম ভারী পার্টিকেল হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এদের বেশিরভাগই ভূমিতে ঝরে পড়ে আমাদের চোখের অগোচরে।
কিন্তু যখন এই মহাজাগতিক রশ্মি কোন মেঘের (cloud) ভেতর দিয়ে গতিশীল হয়, তখন ছাপ ফেলে যায় পার্টিকেলের অদ্ভুতুড়ে চিহ্নের, যা খালি চোখেই দেখা যাবে।
এই ক্লাউড চেম্বার তৈরি করা বেশ সহজ এবং কিছু সাধারণ সরঞ্জাম-উপাদান থাকলে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে আপনি এটা বানাতে পারবেনঃ
প্রয়োজনীয় সরঞ্জামঃ
- ফেল্ট (Felt, এক ধরনের পশমি বা উলের কাপড়)।
- একটা পরিষ্কার প্লাস্টিক বা কাচ পাত্র (যেমনঃ চারকোণা মাছের অ্যাকুরিয়াম)। একটা প্লাস্টিক বা মেটালের ঢাকনা থাকতে হবে।
- আইসো-প্রোপাইল অ্যালকোহল, বা তার বেশি (এটা ফার্মেসী, সায়েন্টিফিক স্টোর, কোন কেমিক্যাল সরবরাহকারী কোম্পানী থেকে কিনতে পারেন বা আপনার স্কুল-কলেজের কেমিস্ট্রি ল্যাবেও পেয়ে যেতে পারেন। এটা ব্যবহারের সময় সতর্ক থাকতে হবে এবং নিরাপদ চশমা ব্যবহার করতে হবে)।
- শুকনো বরফ বা ড্রাই আইস (এটি হল ঘনীভূত বা কঠিন কার্বন ডাই অক্সাইড। মাছের বাজারে, মুদির দোকানে বা ভ্রাম্যমান আইস্ক্রিম বিক্রেতা এটা প্রায় ব্যবহার করে। তাছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সংগীত বা নাটকের মঞ্চে ধোয়াশা তৈরির কাজে এর ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। এটা ধরতে অবশ্যই পুরু-নিরাপদ হাত মোজা ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকলে সেটা দিয়েই আপনি কিন্তু খুব সহজে ড্রাই আইস তৈরি করে নিতে পারেন)।
- টর্চলাইট।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপঃ
- কাপড়টাকে এমন ভাবে কেটে নিন যেন পাত্রের ভিতরে নিচের অংশে ঠিকভাবে বসে যায়। এটাকে আঠা দিয়ে পাত্রের সাথে আটকিয়ে দিন।
- ফেল্টের কাপড়কে এবার আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল দিয়ে সম্পৃক্ত করুন; মানে যতক্ষণ শুষে নিতে পারে ততক্ষণ ভিজিয়ে জবজবে করুন, কিন্তু কাপড়ের উপর ভেসে থাকা অতিরিক্ত অ্যালকোহলটুকু বের করে দিন।
- একটা ট্রে বা পাত্রের উপর ড্রাই আইস নিন। এবার কাচ পাত্রের ঢাকনাটিকে উল্টিয়ে ড্রাই আইসের উপর রাখুন।
- কাচের পাত্রটিকে উল্টিয়ে দিন অর্থাৎ ফেল্ট লাগানো নিচের পাশ যাবে উপরে এবং পাত্রের খোলা মুখ থাকবে নিচে, এবার এ অবস্থায় এটাকে ড্রাই আইসের উপর রাখা ঢাকনার উপর বসিয়ে দিন।
- ১০ মিনিটের মত অপেক্ষা করুন, এরপর ঘরের আলো নিভিয়ে দিন এবং কাচ পাত্রের ভিতর টর্চের আলো ফেলুন।
কী ঘটছে ক্লাউড চেম্বারের ভিতর ?
ফেল্টের কাপড় যে অ্যালকোহল শোষণ করেছে তা কক্ষতাপমাত্রায় তরল অবস্থায় আছে এবং এটা ধীরে ধীরে বাষ্প হয়ে বাতাসের সাথে মিশছে। কিন্তু যখন এই বাষ্পীভূত অ্যালকোহল নিচে ড্রাই আইসের দিকে আসে, তখন তা ঘনীভূত হয় এবং আবার তরলে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়।
পাত্রের নিচের দিকের বাতাস এখন অতিপৃক্ত। যার মানে হল এটা এখন তার শিশিরাংকের ঠিক নিচে। শরতের সকালে পানির কণা যেমন ঘাসের পাতায় পাতায় লেগে থাকে, তেমন অ্যালকোহল বাষ্পও সুযোগ পেলে যে কোন কিছুর উপর মেঘের মত ফোটায় ফোটায় লেগে থাকবে।
বয়ে চলছে পার্টিকেল আর পার্টিকেল !
যখন কোন পার্টিকেল ক্লাউড চেম্বারের ভিতর দিয়ে যায়, তখন এটা চেম্বারের ভেতরকার বাতাসের অণুগুলোতে প্রচন্ড বেগে ধাক্কা মারে এবং এই ধাক্কা পরমাণুগুলোর বেশ কিছু ইলেক্ট্রনকে মুক্ত করে দেয়। ফলে বাতাসের পরমাণু পরিণত হয় চার্জিত আয়নে। তখন বাতাসে থাকা অ্যালকোহল বাষ্প এই আয়নের দিকে আকর্ষিত হয় এবং এদের সাথে যুক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোটার আকার নেয়।
ফলস্বরূপ এসব পার্টিকেল চেম্বারের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় রেখে যায় চিহ্ন বা ছাপ। এসব চিহ্ন হচ্ছে বয়ে চলা পার্টিকেলের গতিপথের নিদর্শন। বলতে পারেন এগুলো হল পার্টিকেলের পদচিহ্ন, দেখতে অনেকটা বিমানের contrail এর মত।
এসব চিহ্ন থেকে আপনি কী বলতে পারেন ?
ক্লাউড চেম্বারের ভিতর দিয়ে হরেক রকম পার্টিকেল বয়ে যেতে পারে। এগুলো আপনার পক্ষে চোখে দেখা সম্ভব না, কিন্তু অবাক করা সত্যিটা হল আপনি এদেরকে না দেখেও চিনতে পারবেন এবং এদের পার্থক্য বুঝতে পারবেন! কিন্তু কিভাবে? আরে, পার্টিকেল দেখতে পাচ্ছেন না তাতে কী? চেম্বারে তাদের রেখে যাওয়া চিহ্ন তো দেখতে পাচ্ছেন। আর এসব চিহ্নই আপনাকে সবকিছু বলে দিবে!
খাটো, মোটা চিহ্নঃ
না, এটা কোন মহাজাগতিক রশ্মি নয়। তাই বলে এগুলো দেখে হতাশ হবেন না। এগুলোও কম চমকপ্রদ নয়। যখন আপনি এই খাটো, মোটা চিহ্ন দেখছেন, তখন আপনি আসলে বাতাসের রেডন অণু থেকে নির্গত আলফা পার্টিকেল (ইলেক্ট্রনবিহীন হিলিয়াম পরমাণু) দেখছেন। অনেকের হয়তো খটকা লাগতে পারে- রেডন তো প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় মৌল! এটা আবার বাতাসে থাকে না কি ? হ্যাঁ, এটা বাতাসে আছে। কিন্তু এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্বাভাবিক বাতাসে এর পরিমাণ এতটাই নগন্য () যে এর তেজস্ক্রিয়তা চিনাবাদামের (Peanut butter) চেয়ে কম। যা হোক, রেডন থেকে বিকিরিত এই আলফা পার্টিকেল বেশ ভারী এবং কম-শক্তি সম্পন্ন; তাই এরা খোটা এবং মোটা চিহ্ন ফেলে যায়।
লম্বা, সোজা চিহ্নঃ
অভিনন্দন! আপনি মিওন () পেয়েছেন! মিওন কিন্তু ইলেক্ট্রনের জ্ঞাতিভাই (উভয়ই লেপটন শ্রেণির), তবে এরা ইলেক্ট্রনের চেয়ে প্রায় গুণ ভারী। কসমিক রশ্মি পৃথিবীতে আসার পথে যখন বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে বাতাসের অণুর সাথে ধাক্কা খায়, তখন এই মিওন তৈরি হয় এবং এবং প্রতি মুহূর্তে এটা হচ্ছে। বেশ ভারী হওয়ায় এই মিওন বাতাসের বাধা অগ্রাহ্য করে প্রচন্ড গতিতে ভূপৃষ্ঠে ছুটে আসে। তাই এদের ফেলা চিহ্নগুলো হয় স্পষ্ট, লম্বা এবং সোজা।
আঁকাবাঁকা, কোঁকড়া চিহ্নঃ
যদি আপনার চিহ্নগুলো অচেনা শহরে পথভ্রষ্ট কোন ভ্রমণকারীর গতিপথের মত অনির্দিষ্ট, আঁকাবাঁকা দেখায়, তাহলে বুঝবেন আপনি তাকিয়ে আছেন ইলেক্ট্রন () বা পজিট্রনের (, এটা ইলেক্ট্রনের প্রতি-কণা) দিকে। এরা সৃষ্টি হয় যখন বায়ুমণ্ডলীয় কণার সাথে কসমিক রশ্মির সংঘর্ষ হয়। ইলেক্ট্রন এবং পজিট্রন খুবই হালকা পার্টিকেল; প্রোটনের চেয়েও প্রায় ভাগ হালকা! তাই বাতাসের অণু-পরমাণুর সাথে ধাক্কা খেয়ে এদের গতিপথ বারবার বদলে যেতে থাকে, ফলস্বরূপ চেম্বারের ভিতর এদের সৃষ্ট চিহ্নগুলো হয় আঁকাবাঁকা, অনির্দিষ্ট এবং কোঁকড়ানো।
শাখাবিভক্ত চিহ্নঃ
যদি এমন চিড়ে যাওয়া, বিভাজিত, শাখাওয়ালা চিহ্ন পান, তাহলে অভিনন্দন! এই চিহ্নের অর্থ হল আপনি স্বচোক্ষে পার্টিকেল ক্ষয়(Decay) হতে দেখছেন। অনেক পার্টিকেল থাকে খুব অস্থিতিশীল এবং এগুলো ক্ষয়ে গিয়ে অধিকতর স্থিতিশীল পার্টিকেলে পরিণত হয়। পর্যবেক্ষণের সময় আপনি যদি তাৎক্ষণিক এমন কোন শাখা চিহ্ন দেখেন, বুঝবেন কণা-পদার্থবিদ্যার মাধুর্য একেবারে সামনা-সামনি নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য লাভ করলেন।
সম্পূর্ণ প্রকল্পটির ভিডিও দেখতে পারেন এই লিঙ্কেঃ
কত রকম মৈলিক এবং সাব-এটমিক পার্টিকেল যে আপনার অগোচরে প্রতিনিয়ত আপনার ঘরের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে, এ প্রকল্পটির মাধ্যমে সেটা প্রথমবার আপনার অনুভবে আসবে। আপনার চারপাশের এই পরিচিত জগতও হয়ে উঠবে রহস্যময় কৌতুহলে ঠাসা। আপনার কৌতূহলী মন হয়ে উঠবে রোমাঞ্চিত, পুলকিত এবং বাড়িয়ে দিবে বিজ্ঞানের প্রতি আপনার আগ্রহ এবং ভালবাসা।
পদার্থবিদ্যা-প্রেমী যে কোন ব্যক্তির কাছে এর চেয়ে বড় আনন্দের প্রাপ্তি আর কি হতে পারে!
-মুবতাসিম ফুয়াদ
শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিজ্ঞানব্লগে লেখাটির লিঙ্কঃ http://bigganblog.org/2017/06/তৈরি-করুন-পার্টিকেল-ডিটে/