ব্ল্যাকহোলের অনুসন্ধানে এবার শুরু হল যাত্রা

0
357

অপার কৌতুহল ও রহস্যে ঘেরা আমাদের এই বিশ্বজগত। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহবর তেমনই এক বিস্ময়ের নাম। মহাকাশবিজ্ঞানীরা চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে। সৌরজগৎ এমনকি এর বাইরের গ্রহ ,উপগ্রহ,নক্ষত্র, ধূমকেতু ইত্যাদি সম্পর্কেও অনেক কিছু জানতে সক্ষম হয়েছে। তবে ব্ল্যাকহোল এখনও তাদের কাছে অজেয়ই রয়ে গেছে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, ব্ল্যাকহোলের দেখা বিজ্ঞানীরা এখনও পান নি। তাই ব্ল্যাকহোল বলতে আমরা তারকাখচিত আকাশের মাঝে লুকিয়ে থাকা যে বৃত্তাকার একটি কাল বিন্দুকে বুঝি, তা একটি কল্পনাপ্রসূত ধারণামাত্র।

বিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী আমাদের গ্যালাক্সিতে শতাধিক এমনকি কারো কারো মতে সহস্রাধিক ব্ল্যাকহোল রয়েছে। তবে তাদের অস্তিত্ব সনাক্ত করা খুবই কঠিন। সাধারণ টেলিস্কোপে ব্ল্যাকহোল দেখা যায় না। কারণ আলোকরশ্মি ব্ল্যাকহোল বেষ্টনকারী ঘটনাদিগন্ত বা ইভেন্ট হরাইজন অঞ্চল অতিক্রমের সাথে সাথে পুরোপুরি শোষিত হয়ে যায়। ফলে কোন ধরনের আলো প্রতিফলিত না হওয়ায় টেলিস্কোপে এর কোন প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় না। এছাড়াও ব্ল্যাকহোল সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নন। যার কারণে কোটি কোটি বছর পূর্বে সৃষ্ট এই রহস্যময়ী মহাজাগতিক বস্তুটি সাধারণ মানুষ ও মহাকাশবিদদের মাঝে এখন পর্যন্ত এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করে রেখেছে।

তবে ব্ল্যাকহোল সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়ত অতিশীঘ্রই মিলে যেতে পারে। গত বছর বিজ্ঞানীরা ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন। অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন এই টেলিস্কোপের সাহায্যে কৃষ্ণগহবরের ছবি তোলা সম্ভব হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেছিলেন।  এই বছরে তারা আরও একটি সুসংবাদ দিয়েছেন। তাদের বিবৃতি অনুসারে আগামী এপ্রিল মাসেই তারা এই টেলিস্কোপটি গবেষণায় ব্যাবহার করবেন।

মজার ব্যাপার হল ইভেন্ট হরাইজন কোন একক টেলিস্কোপ নয়। রেডিও সিগন্যাল গ্রহণক্ষম ৯টি টেলিস্কোপের সমন্বয়ে এটি গঠিত। এই টেলিস্কোপগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ( যুক্তরাষ্ট্র,স্পেন,চিলি,দক্ষিণ মেরু)  স্থাপন করা হয়েছে। তাই টেলিস্কোপটির সার্বিক আকার পৃথিবীর প্রায় সমান বলা যেতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থাকলেও টেলিস্কোপগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করবে ও প্রতিটি টেলিস্কোপে প্রাপ্ত ছবিগুলোকে জোড়া লাগিয়ে একটি উচ্চ রেজ্যুলেশনের ছবি প্রস্তুত করা যাবে। ব্যাতিচারজনিত তথ্য লাভের একটি বিশেষ পদ্ধতি ভিএলবিআই দ্বারা টেলিস্কোপের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এই কৌশল ব্যাবহার করে গ্রাহক টেলিস্কোপ গুলো মহাশুন্যের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে আগত রেডিও সিগন্যালগুলো সংগ্রহ করবে।

বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত এই টেলিস্কোপের সাহায্যে আকাশ পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা করেছেন।  ব্ল্যাকহোল যেহেতু সরাসরি দেখা সম্ভব নয়। তাই গবেষকরা টেলিস্কোপের সাহায্যে এর প্রান্ত বা ইভেন্ট হরাইজনের একটি স্থিরচিত্র তোলার চেষ্টা করবেন। এই ঘটনা দিগন্ত বা ইভেন্ট হরাইজনই মহাবিশ্ব থেকে ব্ল্যাকহোলকে পৃথক করে রেখেছে।

গবেষকরা প্রথমে আমাদের গ্যালাক্সির অতিকায় বৃহৎ ব্ল্যাকহোল স্যাগিটারিয়াস এ (এ স্টার নামেও পরিচিত) অনুসন্ধান শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন। এই ব্ল্যাকহোলটি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত। এর ভর ৪ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন= ১০ লক্ষ) সংখ্যক সূর্যের সমান। ঘটনা দিগন্তের ব্যাস ২০ মিলিয়ন কিলোমিটার ( ১২. মিলিয়ন মাইল)  পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব আনুমানিক ২৬ হাজার আলোকবর্ষ।

তবে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোল দেখতে না পেলেও এর অস্তিত্বের বেশ কিছু নিদর্শন পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন। উদাহরণস্বরূপ এ স্টারের কথা বলা যায়। এই ব্ল্যাকহোলটি নিয়ে গবেষনাকালে বিজ্ঞানীরা দেখেন, তার পারিপার্শ্বিক তারকা গুলোর কক্ষপথ একটি অদৃশ্য শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়। মহাশূন্যে অনুমিত অন্যান্য ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়াও মহাকাশের কোন একটি অঞ্চল থেকে আগত বিকিরণের পরিমাণ থেকেও বিজ্ঞানীরা এর উপস্থিতি সনাক্ত করতে সক্ষম হন।

ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ ব্ল্যাকহোলের রহস্যের জট খুলতে পারবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে তেমন কিছু ঘটে গেলে মহাজগত সম্পর্কে আমাদের ধারণা লাভে সেটি এক বিরাট মাইলফলক স্থাপন করবে। গবেষক দলের সদস্য হার্ভার্ড স্মিথসনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের সেপার্ড ডোয়েলেম্যান এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা যেমন অনুমান করছি হয়ত তার থেকে ভিন্ন কিছু ঘটতেও পারে। আমি আগেও বলেছি, আইনস্টাইনের বিপরীতে বাজি ধরা মোটেও ভালো কাজ হবে না।তবে প্রত্যাশিত ফলের চেয়ে অধিক ভিন্নতর কিছু ঘটলে আমাদেরকে মহাকর্ষ তত্ত্ব পুনর্মুল্যায়ন করতে হতে পারে। আমি চাইনা এমন কিছু হোক। তবে বাস্তবিক অর্থে যে কোন কিছুই ঘটতে পারে।“

তবে কি ব্ল্যাকহোল পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত তত্ত্ব ও সূত্রকে হারিয়ে দেবে?এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ২০১৭ সালের শেষভাগে অথবা ২০১৮ সালের প্রথমদিকেই ব্ল্যাকহোল স্যাগিটারিয়াস এ এর ইভেন্ট হরাইজনের পূর্ণাঙ্গ ছবি তোলা সম্ভব হবে। পরবর্তীতে গবেষণায় হয়ত জানা যাবে, কে বিজয়ী? ব্ল্যাকহোল নাকি পদার্থবিজ্ঞান?

ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ গবেষকদের কল্পিত ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজনের চিত্র

তথ্যসূত্রঃ
https://www.galaxymonitor.com/event-horizon-telescope-will-begin-detailed-observation-blackhole-april/
https://futurism.com/we-may-finally-get-a-picture-of-a-black-hole/

-নাসরুল্লাহ মাসুদ

 

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.