বিজ্ঞানীরা পদার্থের সম্পূর্ণ নতুন একটি দশা নিশ্চিত করেছেন

0
452

বেশ কয়েক মাস ধরেই জল্পনা কল্পনা চলছিলো গবেষকরা হয়তো টাইম ক্রিস্টাল বা সময় স্ফটিক তৈরী করতে পেরেছেন। টাইম ক্রিস্টাল এক অদ্ভুত স্ফটিক যার একটি পারমাণবিক গঠন রয়েছে যা শুধু সময়ের ব্যবধানে পুনরাবৃত্তি হয় না সাথে সাথে অল্প সময়ের মধ্যে কোনরূপ শক্তির ক্ষয় ছাড়াই ক্রমাগত দোদুল্যমান হতে থাকে।

অবশেষে গবেষকগণ এই উদ্ভট স্ফটিক কিভাবে তৈরী করতে হয় এবং কিভাবে তা পরিমাপ করা যায় তার বিস্তারিত প্রাকাশ করেছেন। টাইম ক্রিস্টালের প্রতিচিত্রের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীদের দুটি দল দাবি করেছেন তারা গবেষণাগারে টাইম ক্রিস্টাল তৈরী করেছেন যা পদার্থের একটি সম্পূর্ণ নতুন দশার অস্তিত্বের কথা নিশ্চিত করে।

আবিষ্কারের বিষয়টি শুনতে অনেকটা বিমূর্ত মনে হতে পারে তবে পদার্থবিজ্ঞানে এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন যুগের অগ্রদূত হবে। বিগত দশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা একটি পদার্থ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন যাকে স্থিতাবস্থায় কোন ধাতুর ন্যায় সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। কিন্তু এটাও ধারণা করা হয় যে, মহাবিশ্বে অনেক ধরনের অদ্ভুত পদার্থ রয়েছে যা স্থিতিশীল নয় এবং টাইম ক্রিস্টালসহ সেসব আমাদের নজরেও আসেনা।

তবে আসল ব্যাপার হচ্ছে চারপাশের এই অ-স্থিতিস্থাপক বিষয় সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলাফল হিসেবে আমরা পেয়েছি কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো নতুন প্রযুক্তি।

নোবেল বিজয়ী তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ফ্রাঙ্ক উইলজেক ২০১২ সালে প্রথম টাইম ক্রিস্টালের ধারণা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন টাইম ক্রিস্টালের যে কাঠামো রয়েছে তাতে এরা এদের সর্বনিম্ন গতিতে নড়াচড়া করতে পারে যা পরম শূন্য দশা  নামে পরিচিত।

সাধারণত যখন কোন উপাদান পরম শূন্য দশা পর্যায়ে থাকে তখন সেটা একটি ধারার শূন্য পর্যায় হিসেবেও ধরা হয়। এর মানে হচ্ছে এই নড়াচড়াটি তত্ত্বগতভাবে অসম্ভব হওয়ার কথা কারণ সেখানে তার শক্তি ক্ষরচ করার প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু উইলজেক ধারণা করেন টাইম ক্রিস্টালের ক্ষেত্রে হয়তো এটা ঘটেনা।

সাধারণ ক্রিস্টাল বা স্ফটিকের একটি পারমাণবিক গঠন থাকে যা একটি হীরার কার্বন জাফরির মতো কিছু সময়ের ব্যবধানে পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু একটি রুবি বা হীরার মতো তারা নিস্পন্দিত থাকে কারণ তারা শূন্য অবস্থায় স্থিতাবস্থায় থাকে। তবে টাইম ক্রিস্টালের যে কাঠামো রয়েছে তা শুধুমাত্র সময়ের ব্যবধানেই পুনরাবৃত্তি হয়না সাথে সাথে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি হয় এবং এই দোদুল্যমানের ঘটনা ক্রমাগত চলতেই থাকে।

আপনি একে একটি জেলির মতো কল্পনা করতে পারেন। যখন এক টুকরো জেলিকে আপনি টোকা দেবেন এটি বারবার মৃদু ঝাঁকি দিতে থাকবে। ঠিক একই ঘটনা টাইম ক্রিস্টালের ক্ষেত্রেও ঘটে তবে এখানে বড় পার্থক্যটি হচ্ছে এর গতি কোন শক্তির ক্ষয় ছাড়াই সৃষ্টি হচ্ছে।

একটি টাইম ক্রিস্টাল পরম শূন্য দশায় প্রকৃতিগতভাবেই ক্রমাগত কম্পমান জেলির মতো এবং এই বিষয়টিই একে একটি সম্পূর্ণ নতুন দশার অস্থিতিস্থাপক পদার্থ তৈরী করেছে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নরম্যান ইয়াও এবং তাঁর দল এই টাইম ক্রিস্টালের প্রতিচিত্রে বিস্তারিতভাবে এর বৈশিষ্ট্য পরিমাপ ও প্রস্তুত প্রণালী বর্ণনা করেছেন। ইয়াওর প্রতিচিত্রের উপর ভিত্তি করে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভাড থেকে দুটি স্বাধীন দল এই নির্দেশাবলী অনুসরণ করে তাদের নিজস্ব টাইম ক্রিস্টাল তৈরী করছেন।

মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি টাইম ক্রিস্টাল তৈরী করতে ১০ টি ইটারভিয়াম আয়নের একটি Conga সারি ব্যবহার করেছেন যার সবগুলোই ইলেকট্রন ঘূর্ণনে বিজড়িত ছিলো।

ছবি: ক্রিস মোনরো, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়

একটি টাইম ক্রিস্টালকে সচল করার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে আয়নগুলোকে স্থিতাবস্থা থেকে আলাদা করা এবং এই কাজ করার জন্য গবেষকগণ পার্যায়ক্রমে দুটি লেজার রশ্মি দিয়ে আঘাত করেন। প্রথম লেজারটি একটি চৌম্বকক্ষেত্র তৈরী করে এবং দ্বিতীয় লেজারটি পরমাণুর ঘূর্ণনকে আংশিক টোকা দিতে থাকে। কারণ সবগুলো পরমাণুর ঘূর্ণন একইসাথে স্থিরভাবে আবদ্ধ ছিলো। আর এই ঘূর্ণন টোকার পুনরাবৃত্তির কারণে তা ক্রিস্টালে পরিণত হতে থাকে।

সমগ্র কার্যক্রমটি যথেষ্ট স্বাভাবিকই ছিলো, তবে একটি টাইম ক্রিস্টাল হতে হলে উক্ত পদ্ধতিটিকে সময়ের প্রতিসাম্যে বিরতি ঘটাতে হতো। আর ইটারভিয়াম পরমাণুর Conga সারি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে গবেষকগণ এক অদ্ভুত কার্যক্রম লক্ষ্য করলেন। যে দুটি লেজার ইটারভিয়াম পরমাণুদের নিয়মিতভাবে ধাক্কা দিচ্ছিলো তা ঐ সময়েই ঘূর্ণনের পুণরাবৃত্তিকরণ করে যাচ্ছিলো যা সাধারণ পদ্ধতির ক্ষেত্রে ঘটেনা।

বিভিন্ন চৌম্বকীয় ক্ষেত্র এবং লেজার স্পন্দনের আওতায় টাইম ক্রিস্টাল দশা পরিবর্তন করতে পারে ঠিক যেমন একটি বরফের টুকরো গলতে থাকে।

হার্ভাড টাইম ক্রিস্টাল কিছুটা ভিন্ন ছিলো। গবেষকরা একে ঘন নাইট্রোজেনে আবদ্ধ একটি খালি হীরের মাঝে স্থাপন করেন এবং একই ফলাফল পেয়েছেন।

ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিল রিকেরম বলেন, “শুধুমাত্র একটি কৌতুহল কিংবা কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি নয় বরং দুটি ভিন্ন পদ্ধতিতে একই রকম ফলাফল অর্জন করাটাই টাইম ক্রিস্টালকে একটি নতুন দশার পদার্থ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।” [সায়েন্সএলার্ট- অবলম্বনে]

-শফিকুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.