সকল মৌলই তার নিজস্ব অবস্থান থেকে বিশেষ বা স্পেশাল। প্রত্যেক মৌলেরই কোনো না কোনো এক দিক থেকে বিশেষত্ব আছে। এদের মাঝে কার্বন মৌলটির বিশেষত্ব এতটাই বেশি যে, একে সতর্কতার সাথে অন্যান্য মৌল থেকে আলাদা করে রাখতে হবে।
কার্বন তার বৈচিত্র্যময়তার মাধ্যমে রসায়নে আলাদা একটি ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছে। ‘জৈব রসায়ন’ বা Organic Chemistry নামে রসায়ন বিজ্ঞানের পৃথক একটি শাখা আছে যার সবটাই মূলত কার্বনকেন্দ্রিক। সমস্ত রসায়ন বিজ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়- জৈব রসায়ন ও অজৈব রসায়ন। শুধুমাত্র একটি মৌল, কার্বন দিয়ে গড়ে ওঠা রসায়নকে বলে জৈব রসায়ন আর বাকি সমস্ত কিছু নিয়ে তৈরি রসায়ন হলো অজৈব রসায়ন। দুটিকে তুলনা করলে দেখা যায় মাত্র একটি মৌলের বিপরীতে আছে অন্যান্য সমস্ত মৌল। এটি থেকেই বোঝা যায় মৌল হিসেবে কার্বন কতটা বিশিষ্ট। তো কার্বনে কী এমন আছে যা তাকে এত বিশিষ্ট করে তুলেছে?
কার্বনের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে, কার্বনের একটি পরমাণু অন্য অনেকগুলো কার্বন পরমাণুর সাথে মিলে শৃঙ্খল বা চেইন তৈরি করতে পারে। অন্যান্য মৌলগুলো কার্বনের মতো এমন বৈচিত্র্যময়ভাবে চেইন তৈরি করতে পারে না। যেমন রাসায়নিক যৌগ অকটেন ৮ টি কার্বন পরমাণুর চেইন নিয়ে গঠিত। অকটেন হচ্ছে একধরনের পেট্রোলিয়াম বা জ্বালানী জাতীয় তরল পদার্থ। অকটেনে কার্বন পরমাণুর সাথে পাশাপাশিভাবে সংযুক্ত আছে হাইড্রোজেন পরমাণু। আগের চিত্রটি লক্ষ্যণীয়। কালো রঙের গোলক বা চাকতিগুলো কার্বন পরমাণু আর ধূসর রঙের গোলকগুলো হাইড্রোজেন পরমাণু নির্দেশ করছে। একে রাসায়নিকভাবে লিখলে দড়ায়-
কার্বনের আরেকটি চমকপ্রদ দিক হচ্ছে এটি যেকোনো দৈর্ঘ্যের চেইন তৈরি করতে পারে। অকটেনে তো মাত্র ৮ টি কার্বন পরমাণু ছিল, এটি এমনকি কয়েকশো পরিমাণ কার্বনের চেইন নিয়েও যৌগ তৈরি করতে পারে। মাঝে মাঝে এই চেইন এক বা একাধিক চক্রের সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ন্যাপথালিনের কথা, ন্যাপথালিনের মার্বেল বা স্ফটিক তেলাপোকা দূর করতে ব্যবহৃত হয়। কাপড়-চোপড় সংরক্ষণ করে রাখার সময় কাপড়ের ফাঁকে ফাঁকে ন্যাপথালিনের গুটিকা দিয়ে দিলে তা কাপড়কে পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। ন্যাপথালিন যৌগও কার্বন পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। কার্বনের পাশাপাশি হাইড্রোজেনও আছে। ন্যাপথালিনের কার্বনের চেইন দুটি চক্রের সৃষ্টি করে।
রসায়নবিদরা গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে কার্বনের চেইন তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। শুধুমাত্র সাধারণ সরল চেইনই নয়, অনেক জটিল ও চমৎকার চেইনও আছে তাতে। এর মধ্যে অবিশ্বাস্য একটি যৌগ হচ্ছে বাকিবল বা বাকিটিউব। বাকি শব্দটি এসেছে মার্কিন স্থপতি বাকমিনস্টার ফুলার-এর নাম থেকে। তিনি এমন একটি গম্বুজ জাতীয় বক্রস্থানিক স্থাপত্যের নকশা করেছিলেন যা ছিল স্থাপত্যবিদ্যার এক বিস্ময়। ল্যাবরেটরিতে রসায়নবিদদের তৈরি করা কার্বনের জটিল যৌগটি ছিল বাকমিনস্টার ফুলারের তৈরি করা বক্রস্থানিক গম্বুজের গঠনশৈলীর মতো। এজন্য কার্বনের এই যৌগটিকে বাকিবল বা বাকিটিউব বলা হয়। যৌগটির রাসায়নিক সংকেত C60। মাঝে মাঝে যৌগটিকে ঐ স্থপতির নামের শেষের অংশ অনুসারে ‘ফুলারিন’ বলেও ডাকা হয়।
বাকিবল বা C60 যৌগটির মধ্যে কার্বনের সংযোগ কীভাবে থাকে তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে নীচের ছবিটি দেখলে। বিজ্ঞানীরা বাকিবল বা ফুলারিন তৈরি করেছেন কৃত্রিমভাবে। তার উপর অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বিজ্ঞানীরা মহাকাশে দূরবর্তী নক্ষত্রের এলাকাতেও বাকিবলের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন।
কার্বনের রসায়ন প্রায় অসীম সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন যৌগের সম্ভাবনা প্রদান করে। এসব যৌগের সবগুলোই আকৃতি ও গঠনের দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন। এতসব সম্ভাব্য যৌগের মাঝে মাত্র কয়েক হাজার যৌগ নিয়েই সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ গঠিত। অর্থাৎ প্রায় অসীম সংখ্যক যৌগের সম্ভাব্যতা থাকলেও প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহে এসব যৌগের মাত্র কয়েক হাজার পরিমাণ পাওয়া যায়। চিত্রে বৃহৎ এই যৌগটির নাম মায়োগ্লোবিন। আমাদের পেশিতে মিলিয়ন মিলিয়ন পরিমাণে আছে এই যৌগটির উপস্থিতি। ছবিতে যৌগটির পরমাণুগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে দেখানো যায়নি, শুধুমাত্র জয়েন্ট বা পরমাণুর বন্ধনস্থল দেখানো হয়েছে।
এটিও কার্বনবিশিষ্ট যৌগ। মায়োগ্লোবিনের সবগুলো পরমাণুই অবশ্য কার্বন নয়, কিন্তু কার্বন পরমাণুই অন্য সকল পরমাণুগুলোকে নির্দিষ্ট সজ্জায় সজ্জিত করে ধরে রেখেছে। এখানে কার্বন হচ্ছে মায়োগ্লোবিনের কংকাল।
জীবন্ত প্রাণের প্রায় সবকিছুই কার্বন বিশিষ্ট যৌগের সমন্বয়ে তৈরি। যত ধরনের প্রাণী ও প্রাণীজাত পদার্থ এবং উদ্ভিদ ও উদ্ভিজ্জাত পদার্থ আমরা আমদের চারপাশে দেখতে পাই তার সবই কার্বনের বৈচিত্র্যময়তার ফল। কার্বনের কারণেই প্রাণের অস্তিত্ববান হওয়া সম্ভব হয়েছে। শুধু মায়োগ্লোবিনই নয়, এর মতো আরো হাজার হাজার জটিল যৌগ আছে যা প্রাণের অস্তিত্ববান হবার জন্য ভূমিকা রাখছে। যখন ভাবি পৃথিবীতে এতসব বৈচিত্র্যময় প্রাণের গঠনে আছে জটিল ধরনের হাজার হাজার যৌগ, এবং সেসব যৌগের কারিগর হিসেবে আছে সাধারণ কার্বন পরমাণু তখন খুবই অবাক হতে হয়। প্রকৃতির এত এত জটিলতার মাঝেও কত সারল্য বিরাজ করছে!
তথ্যসূত্র
- The Magic of Reality, by Richard Dawkins, Free Press, New York, 2011
- উচ্চ মাধ্যমিক রসায়ন (২য় পত্র), হাজারী ও নাগ, হাসান বুক হাউজ, ২০১১
- The Grand Design, Stephen Hawking & Leonard Mlodinow
-সিরাজাম মুনির শ্রাবণ
সহ-সম্পাদক, বিজ্ঞান ব্লগ