মহিমান্বিত নকশা (The Grand Design): পর্ব-৩

0
548

[বইটির সূচিপত্র তখা সব পর্বের লিংক দেখুন এখানে]

তৃতীয় অধ্যায়: বাস্তবতা কী? (What Is Reality)

কয়েক বছর আগে ইতালির মনজার পৌরপরিষদ গোলাকার পাত্রে গোল্ডফিশ রাখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই সিদ্ধান্ত যারা সমর্থন করেছিলো তাদের যুক্তি ছিলো যে গোলাকার পাত্রে গোল্ডফিশকে রাখা হলে সেটি বাস্তবতার এক ধরণের বিকৃতরূপ দেখে। কিন্তু আমরা কীভাবে জানি যে আমরা যে বাস্তবতা চাক্ষুষ করি সেটিই সত্য এবং অবিকৃত বাস্তবতা? এমন-ও তো হতে পারে যে আমরা নিজেরাই একটি বিশাল গোল্ডফিশের পাত্রের ভেতরে আছি এবং আমাদের দৃষ্টি বড়সড় কোনো লেন্সের কারণে বিকৃত হচ্ছে। গোল্ডফিশের চাক্ষুষ করা বাস্তবতা আমাদের বাস্তবতা থেকে ভিন্ন, কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত বলতে পারবো যে সেটি আমাদের চাইতে কম বাস্তব?

গোল্ডফিশের দৃষ্টি আমাদের মতো একই রকমের না হলে-ও গোল্ডফিশ চাইলে তাদের পাত্রের বাইরের বস্তুগুলোর জন্য গতিসূত্র তৈরি করতে পারবে। যেমন, আমরা যদি পর্যবেক্ষণ করি যে একটি বস্তু সরলপথে চলছে তবে পাত্রের কাচে সৃষ্ট বিকৃতির কারণে গোল্ডফিশ পাত্রের ভেতর থেকে বস্তুটিকে বক্রপথে চলতে দেখবে। তারপরেও, গোল্ডফিশ তাদের বক্র প্রসঙ্গকাঠামো (Frame of Reference) থেকেই বৈজ্ঞানিক সূত্র প্রতিপাদন করতে পারবে, যেগুলো কিনা বাস্তব হবে এবং পাত্রের বাইরের চলন্ত বস্তুসমূহের গতিপথ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সাহায্য করবে। অবশ্য তাদের সূত্রগুলো আমাদের প্রসঙ্গকাঠামোর সূত্র থেকে আরো জটিল হবে, কিন্তু সারল্য তো অভিরুচির বিষয়। যদি কোনো গোল্ডফিশ আসলেই এমন কোনো তত্ত্ব প্রতিপাদন করতে পারে যেটি পারিপার্শ্বিকতাকে ক্রটি ছাড়াই ব্যাখ্যা করতে পারে, তবে আমরা মানতে বাধ্য হবো যে গোল্ডফিশের দেখা জগত আমাদের জগতের মতোই সমান বাস্তব।

বাস্তবতার ভিন্ন ভিন্ন চিত্রের একটি বিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে ১৫০ সালের দিকে গ্রহনক্ষত্রের গতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টলেমির (আনুমানিক ৮৫-১৬৫) করা মডেলটি। টলেমি তার কাজ আরবি শিরোনামে অ্যালমাজেস্ত (Almagest) নামের একটি তের খণ্ডের গবেষণা-গ্রন্থে প্রকাশ করেছিলেন। বইটির শুরুতে তিনি যুক্তি দিতে চেয়েছিলেন কেনো তিনি মনে করতেন যে পৃথিবী গোলাকার, চিরস্থির, মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং মহাকাশের অন্যান্য গ্রহসমূহের চেয়ে অনেক ছোট। অ্যারিস্টারকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মডেলটি জানা থাকলে-ও কোনো এক অদ্ভুত কারণে অ্যারিস্টটলের সময় থেকে শিক্ষিত গ্রীকরা মনে করতো পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। টলেমির মডেলটিতে-ও পৃথিবী কেন্দ্রে স্থির দাঁড়িয়ে এবং অন্যান্য গ্রহসমূহ  চাকার ‘পরে চাকার মতো মন্দবৃত্তে (Epicycle) পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতো।

মডেলটির মূলধারণা স্বাভাবিক মনে হওয়ার কারণ হলো আমরা কখনো পায়ের নিচে পৃথিবী ঘুরছে এমনটি অনুভব করি না (ভূমিকম্প এবং বিশেষ ভারসাম্যহীনতার সময় বাদে)। পরবর্তীতে গ্রীকদের এই ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে ইউরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার ঘটে এবং অ্যারিস্টটল আর টলেমির ধারণাগুলো পশ্চিমা চিন্তাচেতনার ভিত্তিমূল হয়ে ওঠে। মহাজগত সম্পর্কে টলেমির ধারণাটি ক্যাথলিক চার্চ গ্রহণ করে এবং চৌদ্দ শত বছর ধরে তাদের আনুষ্ঠানিক মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে থাকে। কোপারনিকাস তার De revolutionibus orbium coelestium (On the Revolutions of the Celestial Spheres) গ্রন্থ ১৫৪৩ সালে প্রকাশের আগ পর্যন্ত মহাবিশ্বের আর কোনো বিকল্প মডেল প্রস্তাবিত হয় নি। ১৫৪৩ সালেই কোপারনিকাস মৃত্যুবরণ করেন (যদিও তিনি তার তত্ত্ব নিয়ে কয়েক যুগ ধরে কাজ করেছিলেন)।

প্রায় সতের শত বছর আগের অ্যারিস্টারকাসের মতো কোপারনিকাস-ও প্রস্তাব করেন যে সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং অন্যান্য গ্রহগুলো সেটিকে বৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করছে। যদিও ধারণাটি নতুন কিছু ছিলো না, তবুও পুনর্জাগরণের সময় এটি বাধার সম্মুখীন হয়। কোপারনিকাসের মডেলটি বাইবেলের মতের বিরুদ্ধে যায় এমন মনে হয়, যদিও বাইবেল কখনো সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করে নি যে গ্রহগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, যখন বাইবেল লেখা হয়েছিলো তখনকার মানুষ ভেবেছিলো যে পৃথিবী চ্যাপ্টা কোনো কিছু। কোপারনিকাসের মডেলটি পৃথিবী কেন্দ্রে স্থির কি না সেটি নিয়ে অসংযত বিতর্কের সূচনা করে, পরবর্তীতে কোপারনিকাসের ধারণাকে সমর্থন করায় এবং “পবিত্র গ্রন্থের বিবৃত মতবাদের বিরুদ্ধে গেলে-ও যে কেউ চাইলে অন্য মতবাদকে সমর্থন করতে পারেন” এইরূপ চিন্তা করায় গ্যালিলিওকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত গ্যালিলিওকে একঘরে করে ফেলা হয় এবং তাকে তার মতবাদ প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তখনো তিনি বিড়বিড় করে বলেছিলেন, “Eppur si muove,” “But still it moves” অর্থাৎ “কিন্তু এটি [পৃথিবী] এখনো ঘুরছে।” ১৯৯২ সালে রোমান ক্যাথলিক গির্জা অবশেষে স্বীকার করে যে গ্যালিলিওকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করা ভুল হয়েছিলো।

আসলে কোনটি বাস্তব, টলেমির নাকি কোপারনিকাসের মডেলটি? যদিও লোকজন বলবে যে কোপারনিকাস টলেমির মতবাদকে ভুল প্রমাণিত করেছে, কিন্তু এটি সত্যি নয়। আমাদের স্বাভাবিক দৃষ্টি বনাম গোল্ডফিশের দৃষ্টির মতো এই ক্ষেত্রেও যে কেউ যে কোনো একটিকে মহাবিশ্বের মডেল হিসেবে বেছে নিতে পারেন, আমাদের মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণগুলোও ইচ্ছে করলে পৃথিবী বা সূর্য যে কোনো একটিকে স্থির ধরে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে এটি মহাবিশ্বের প্রকৃতি নিয়ে দার্শনিকদের মাঝে বিতর্কের সৃষ্টি করলেও, কোপারনিকাসের মডেলটি ব্যবহার করার সবচে’ বড় সুবিধা হলো এর ফলে সূর্যকে স্থির ধরে নেয়া প্রসঙ্গকাঠামোয় গতিসূত্রগুলো অনেক সহজ হয়ে যায়।

ভিন্ন ধরনের বিকল্প বাস্তবতার দেখা মেলে ‘মাট্রিক্স’ (The Matrix) নামক বৈজ্ঞানিক কল্পচলচ্চিত্রে, যেটিতে দেখানো হয় যে নিজেদের শান্ত ও সন্তুষ্ট রাখার জন্য বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটারগুলোর বানানো একটি নকল অসদ বাস্তবতায় (Simulated Virtual Reality) মানবজাতি নিজেদের অজান্তেই বসবাস করছে এবং কম্পিউটারগুলো মানুষের শরীর থেকে জৈবতড়িৎ শক্তি (সেটি যা-ই হোক না কেনো) শুষে নেয়। হয়তো এমন হওয়াটা খুব বেশি দূরে নয়, কারণ আজকাল অনেক মানুষই ‘দ্বিতীয় জীবন’ (Second Life) নামক আন্তর্জালিক পাতার কাল্পনিক বাস্তবতায় বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করে। আর আমরা কীভাবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আমরা কম্পিউটার-সৃষ্ট কোনো গীতিনাট্যের চরিত্র নই? আমরা যদি বাস্তবিকই কোনো সংশ্লেষী কাল্পনিক জগতে বসবাস করতাম তবে ঘটনাবলি কোনো যুক্তি বা রীতিনীতি অনুযায়ী সংঘটিত হতো না। হয়তো বা আমাদের নিয়ন্ত্রণকারী কোনো ভিনগ্রহবাসীরা মজা করার জন্য ভাবলো যে দেখিতো কী হয় যদি পূর্ণিমার চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় কিংবা যারা খাদ্যসংযম করছেন তাদের মাঝে হঠাৎ কলার মাখনপিঠা খাওয়ার লোভ জাগিয়ে তোলা হয়। যদি এইরকম না করে ভিনগ্রহবাসীরা সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে তবে আমরা কোনোভাবেই বলতে পারবো না যে নকল অসদ বাস্তবতার পিছনে আরেকটি বাস্তবতা রয়েছে। এটি হয়তো বলা সহজ যে ভিনগ্রহবাসীদের জগতটা বাস্তব এবং আমাদেরটা কৃত্রিম, কিন্তু যদি আমাদের মতো নকল জগতের বাসিন্দারা তাদের জগতকে বাইর থেকে দেখতে না পারে, তবে তারা তাদের জগতকে বাস্তবই মনে করবে। এই চিন্তা ‘আমরা সবাই অন্য কারো স্বপ্নের অংশ’ এমন ধারণার আধুনিক সংস্করণ।

এই উদাহরণগুলো এই বইটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি উপসংহারে পৌঁছতে আমাদের সাহায্য করে: বাস্তবতার ধারণা কোনো চিত্র অথবা তত্ত্ব-নির্ভরতামুক্ত নয়। বরং আমরা মডেল-নির্ভর বাস্তবতা নামের ধারণাটি গ্রহণ করবো, যেটি মতে: ভৌত তত্ত্ব বা বিশ্বচিত্র হচ্ছে একটি মডেল (সাধারণত গাণিতিক মডেল) এবং একগুচ্ছ নিয়মাবলি যেগুলো মডেলটির বিভিন্ন অংশের সাথে পর্যবেক্ষণকে সংযুক্ত করে। এটি একটি নির্মাণকাঠামোর-ও যোগান দেয়।

প্লেটো ও পরবর্তী দার্শনিকেরা বহুবছর ধরে বাস্তবতা কীরকম সেটি নিয়ে বির্তক করেছেন। সনাতনী বিজ্ঞান বিশ্বাস করে যে একটি বহির্জগতের অস্তিত্ব আছে, যেটির ধর্ম বা গুণাবলি সুনির্দিষ্ট এবং যে কোনো পর্যবেক্ষকের নির্ভরতামুক্ত। সনাতনী বিজ্ঞান মোতাবেক, অনেক বস্তুর নির্দিষ্ট মান সম্পন্ন বিভিন্ন গুণাবলি যেমন গতি, ভর ইত্যাদি আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, একটি তত্ত্ব হলো ওই বস্তুগুলো এবং তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট পরিমাপ ও পর্যবেক্ষণকে বর্ণনা করার প্রচেষ্টা। পর্যবেক্ষক এবং তিনি যা পর্যবেক্ষণ করছেন- উভয়ই নৈর্ব্যক্তিক অস্তিত্বমান একটি জগতের অংশ, এবং তাদের মধ্যকার যে কোনো পার্থক্য অর্থপূর্ণ কিছু নয়। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, যদি আপনি দেখেন যে একদল জেব্রা পার্কিং গ্যারেজে একখণ্ড জায়গা দখল করার জন্য লড়াই করছে, তবে তারা আসলেই একখণ্ড জায়গা দখল করার জন্য লড়াই করছে। অন্য যে কোনো পর্যবেক্ষকও একই জিনিস লক্ষ্য করবে, এবং এমনকি কেউ পর্যবেক্ষণ না করলে-ও জেব্রাগুলো লড়াই করতে থাকবে। দর্শনশাস্ত্রে এই বিশ্বাসকে বাস্তববাদ (realism) বলা হয়।

যদিও বাস্তববাদ একটি আকর্ষণীয় দৃষ্টিভঙ্গি, কিন্তু আমরা পরে দেখবো যে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী এটি সমর্থন করা বেজায় কঠিন। যেমন, প্রকৃতির নিঁখুত ব্যাখ্যা দিতে পারা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন পর্যবেক্ষক পরিমাপ করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত একটি কণিকার নির্দিষ্ট কোনো অবস্থান বা গতি নেই। সুতারাং, আপনি যদি বলেন যে একটি পরিমাপ সুনির্দিষ্ট মান দিচ্ছে তবে তা ভুল, কারণ মানটি মূলত যে সময়ে পরিমাপ হয়েছে সেই সময়কার। তাছাড়া, অনেকক্ষেত্রে কিছু কিছু বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব থাকে না, বরং তারা একটি সমষ্টির অংশ হিসেবে বিরাজমান থাকে। যদি হলোগ্রাফিক বিধিটি (holographic principle) সঠিক প্রমাণিত হয় তবে আমরা এবং আমাদের এই চতুর্মাত্রিক জগত হয়তো একটি বৃহত্তর জগতের- পঞ্চ-মাত্রার স্থান-কালের ছায়া হবো মাত্র। সেক্ষেত্রে মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থা হবে ওই গোল্ডফিশটির মতোই।

জাঁদরেল বাস্তববাদীরা প্রায়শ যুক্তি দেখান যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর সাফল্য বাস্তবতার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব সফলভাবে একই ঘটনাকে ভিন্ন ধারণামূলক নির্মাণকাঠামোর উপর নির্ভর করে ব্যাখ্যা করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব- যেগুলোকে পূর্বে সফল বলে গণ্য করা হতো, সেগুলো পরবর্তীতে বাস্তবতা সম্পর্কিত সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা নির্ভর কিন্তু সফল অন্য তত্ত্ব দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

যারা বাস্তববাদকে গ্রহণ করেন নি তাদেরকে প্রথাগতভাবে প্রতি-বাস্তববাদী বলা হয়ে থাকে। প্রতি-বাস্তববাদীরা প্রায়োগিক জ্ঞান এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের মাঝে পার্থক্য করেন। তারা সাধারণত যুক্তি দেন যে, পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষানিরীক্ষাই হচ্ছে অর্থবহ, এবং তাত্ত্বিক জ্ঞান কেবল ভালো হাতিয়ার ছাড়া অন্য কিছু নয় এবং পর্যবেক্ষিত ঘটনা সম্পর্কে পরীক্ষানিরীক্ষার চেয়ে বাড়তি কোনো গভীর সত্য বহন করে না। কিছু প্রতি-বাস্তববাদীরা শুধু পর্যবেক্ষণযোগ্য ব্যাপারেই বিজ্ঞানের মনোযোগকে সীমিত করতে চায়। এই কারণেই, আমরা কখনোই পরমাণু দেখতে পারবো না- এই যুক্তিতে ঊনবিংশ শতাব্দিতে অনেকে পরমাণুবাদকে বাতিল গণ্য করেছিলেন। জর্জ বার্কেলে  (১৬৮৫-১৭৫৩) আরো চামচ এগিয়ে গিয়ে বললেন যে মন এবং মনজ ধারণাগুলো ছাড়া আসলে আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। যখন ইংরেজ লেখক এবং অভিধান সঙ্কলনবিদ ড. স্যামুয়েল জনসনের (১৭০৯-১৭৮৪) কাছে তার এক বন্ধু মন্তব্য করেছিলেন যে বার্কেলের দাবি হয়তো ভুল প্রমাণিত করা করা যাবে না, কথিত আছে, তখন ড. জনসন উঠে গিয়ে একটি বড় পাথরে সজোরে লাথি মেরে বললেন, “আমি তার ধারণার নিকুচি করি।” পাথরে লাথি মেরে ড. জনসন পায়ে যে ব্যথা অনুভব করেছিলেন সেটিও এক রকমের মনজ ধারণা, সুতারাং তিনি বার্কলের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করতে পারেন নি। অবশ্য তার কাণ্ডকারখানা দার্শনিক ডেভিড হিউমের  (১৭১১-১৭৭৬) দৃষ্টিভঙ্গিকে মনে করিয়ে দেয়: যদিও নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতায় বিশ্বাস করার জন্য আমাদের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই, তারপর-ও এটিকে সত্যি হিসেবে গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উপায়ও নেই।

মডেল-নির্ভর বাস্তবতা বাস্তববাদী এবং প্রতি-বাস্তববাদীদের মধ্যকার তর্কবিতর্ককে সংক্ষিপ্ত করেছে।

মডেল-নির্ভর বাস্তবতা মতে একটি মডেল বাস্তব কিনা সেটি জিজ্ঞাসা করা অর্থহীন, বরং দেখা দরকার সেটি পর্যবেক্ষণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না। যদি দুইটি ভিন্ন মডেলই পর্যবেক্ষণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, যেমন সেই গোল্ডফিশের এবং আমাদেরটার মতো, তাহলে আপনি বলতে পারবেন না যে একটির চেয়ে আরেকটি বেশি বাস্তব। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেটির প্রয়োগ সহজ এবং সুবিধাজনক সেটি ব্যবহার করলেই চলবে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি পাত্রের ভেতরে অবস্থান করে তবে গোল্ডফিশের মডেলটিই উপকারী, কিন্তু কোনো দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে পৃথিবীতে রাখা কোনো পাত্রের প্রসঙ্গ-কাঠামো অনুযায়ী বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করা বিচ্ছিরি কাজ হবে, কারণ পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময় ও নিজ অক্ষে ঘূর্ণনের সময় পাত্রটি-ও ঘুরবে।

সাধারণত বিজ্ঞানচর্চার জন্য আমরা বিভিন্ন মডেল বানাই, কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে-ও আমরা তাই করি। মডেল-নির্ভর বাস্তবতা কেবল বিজ্ঞানচর্চার জন্য নয়, প্রাত্যহিক জীবনে জগতের স্পষ্ট ধারণা পেতে বা বুঝতে গিয়ে আমরা সবাই সচেতন ও অবচেতনভাবে বিভিন্ন মানসিক মডেল তৈরি করি। জগত সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি (যেটি কিনা আমাদের স্নায়বিক প্রক্রিয়া এবং আমাদের চিন্তা ও যুক্তি প্রয়োগের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়) থেকে আমাদের-ভেতরের-পর্যবেক্ষককে বাদ দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। উপলব্ধি এবং পর্যবেক্ষণ আমাদের তত্ত্বগুলোর মূলভিত্তি- কিন্তু সেগুলো সরাসরি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয় না, বরং মস্তিষ্কের গঠন দ্বারা প্রভাবিত, অনেকটা লেন্সের কারণে দৃষ্টি প্রভাবিত হওয়ার মতন।

মডেল-নির্ভর বাস্তববাদের সাথে আমাদের প্রত্যক্ষকরণের মিল আছে। প্রত্যক্ষকরণে, মস্তিষ্ক চোখের স্নায়ুগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে সংকেত পেতে থাকে। এই সংকেতগুলো থেকে আপনি টেলিভিশনে যে ছবি দেখেন সেভাবে ছবি গঠিত হয় না। বরং, যেখানটায় অক্ষিস্নায়ু (optic nerve) রেটিনার সাথে সংযুক্ত হয়- সেখানটায় এটি অন্ধবিন্দু (blind spot) থাকে। আমাদের সমগ্র দৃষ্টিসীমার মাত্র ১ ডিগ্রি অংশ রেটিনার কেন্দ্রের যে অংশটি (হাতকে পুরোপুরি সামনে বাড়িয়ে ধরলে বৃদ্ধাঙ্গুলির প্রস্থের সমান বড়) ভালোভাবে দেখতে সক্ষম তার আওতাধীন। ফলে মস্তিস্কে যেসব অরূপান্তরিত সংকেত যায় সেগুলো কেবল একটি ছিদ্রযুক্ত অস্পষ্ট ছবি তৈরি করে। ভাগ্যিস, মানুষের মস্তিষ্ক উভয় চোখ থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কিছু অনুমান বা পূর্বধারণার উপর নির্ভর করে ছিদ্রগুলো পূরণ করে। তাছাড়া, মস্তিষ্ক রেটিনা থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের দ্বিমাত্রিক বিন্যাস থেকে ত্রিমাত্রিক জগতের চিত্র সৃষ্টি করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত একটি মানসিক চিত্র বা মডেল তৈরি করে।

মস্তিষ্ক এই মানসিক মডেল তৈরিতে এতোই পটু যে কেউ যদি চোখে উল্টো ছবি তৈরি করা চশমা পরে তারপরে-ও মস্তিষ্ক কিছুক্ষণ পরে সেটিকে পরিবর্তন করে ছবি সোজাভাবে তৈরি করে যেনো ব্যক্তি ঠিকমতো দেখতে পায়। আবার চশমা খুলে ফেলার পর উল্টোপাল্টা দেখতে শুরু করলে মস্তিষ্ক কিছুক্ষণ করে আবার নিজেকে মানিয়ে নেয় এবং ব্যবহারকারী পূর্বের মতো ভালোভাবে দেখতে পারে। এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে কেউ যদি বলে “আমি একটি চেয়ার দেখতেছি,” তবে তার মস্তিষ্ক ওই চেয়ার থেকে আসা বিক্ষিপ্ত আলো মিলিয়ে একটি মানসিক চিত্র বা মডেল তৈরি করছে, যেটি কিনা দেখতে একটি চেয়ারের মতো। যদি কোনো কারণে মডেলটি উল্টো ছবি তৈরি করে, তবে আশা করা যায় কেউ চেয়ারটিতে বসার আগেই মস্তিষ্ক দ্রুততার সাথে মডেলটি সোজা করে ফেলবে।

মডেল-নির্ভর বাস্তবতা অস্তিত্বের অর্থের (meaning of existence) মতো সমস্যার সমাধান দিতে কিংবা এড়াতে সক্ষম হয়। আমি কীভাবে নিশ্চিত করে বলতে পারি যে একটি টেবিলের অস্তিত্ব আছে, যদি আমি ঘর দেখতে বেরিয়ে যাওয়ার পর টেবিলটি আর না দেখতে পাই? যখন আমরা বলি যে ইলেকট্রন, কোয়ার্ক ইত্যাদি কণিকার অস্তিত্ব আছে, তখন আমরা আসলে কী বুঝাই? কেউ ইচ্ছে করলে এমন একটি মডেল তৈরি করতে পারেন যেটিতে আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলে টেবিলটি অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং আমি ফিরে আসার সাথে সাথে পূর্বের জায়গায় টেবিলটি ফিরে আসবে। কিন্তু এই রকম মডেল কিছু অস্বস্তি সৃষ্টি করে- সেই টেবিল-অদৃশ্য-হয়ে-যায় মডেলটি আমি ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরে ছাদ ধসে পড়ে টেবিল ভাঙার ব্যাপারটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে? আমি পরবর্তীতে ঘরে প্রবেশ করলে তো একটি ঠিকঠাক টেবিল দেখার কথা, কিন্তু আমি বাস্তবে দেখবো যে ছাদ ধসার ফলে একটি ভগ্ন টেবিল। বুঝতেই পারছেন, যে মডেলটিতে ঘর ত্যাগ করার পর-ও টেবিলটির অস্তিত্ব থাকে সেই মডেলটিই সরল এবং পর্যবেক্ষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আমরা খালি চোখে দেখতে না পেলে-ও অতিপারমাণবিক কণিকা, যেমন- ইলেকট্রন মডেল মেঘখোপে (cloud chamber) চিহ্ন তৈরি হওয়া কিংবা টেলিভিশন টিউবের উপরে আলো পতনে সৃষ্ট দাগ ইত্যাদি নানা পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। বলা হয়ে থাকে ১৮৯৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস পরীক্ষাগারে বৃটিশ পদার্থবিজ্ঞানি জে. জে. থম্পসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। তিনি বায়ুশূন্য কাচের নলের মধ্যে তড়িৎপ্রবাহের মাধ্যমে ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। গবেষণা থেকে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে এই রহস্যজনক রশ্মিগুলো এমন কোনো কণিকার কারণে সৃষ্টি যেগুলো পরমাণুর অদৃশ্য গাঠনিক উপাদান। থম্পসন কিন্তু ইলেকট্রন “দেখতে” পান নি, এমনকি তার অনুমান পরীক্ষার মাধ্যমে সরাসরি অথবা স্পষ্টভাবে প্রদর্শিত হয় নি। তারপর-ও ইলেকট্রনের মডেলটি বিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রকৌশল-বিদ্যার অবিচ্ছেদ্য অংশ, আজকাল সব পদার্থবিজ্ঞানিই ইলেকট্রনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন, যদি-ও আপনি খালি চোখে তা দেখতে পাবেন না।

আমরা কোয়ার্ককে দেখতে না পেলে-ও পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন এবং নিউট্রনের বৈশিষ্ট্যসমূহ ব্যাখ্যা করতে কোয়ার্ক মডেল অনেক ফলপ্রসু। যদিও বলা হয়ে থাকে প্রোটন এবং নিউট্রনের গাঠনিক উপাদান হলো কোয়ার্ক অথচ আমরা কখনোই একটিমাত্র কোয়ার্ককে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পাই না- কোয়ার্কগুলোর মধ্যকার বন্ধনবল তাদের বিচ্ছেদের সাথে সাথে বাড়তে থাকে এবং ফলশ্রুতিতে একটি বিচ্ছিন্ন, মুক্ত কোয়ার্কের অস্তিত্ব প্রকৃতিতে কখনোই দেখা যাবে না। বরঞ্চ, সর্বদা তিনটি কোয়ার্ক মিলে একটি দল গঠন করে (প্রোটন এবং নিউট্রন), অথবা একটি কোয়ার্ক ও একটি এন্টি-কোয়ার্কের যুগল (পাই মেসন) হিসেবে বিরাজমান থাকে, মনে হয় যেনো তাদেরকে একটি রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

যখন কোয়ার্ক মডেলের প্রস্তাব করা হয় তখন বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিলো কারণ আপনি যদি একটি কোয়ার্ককে আলাদা না করতেই পারেন কিংবা দেখতে না পারেন তবে সেটির অস্তিত্ব আছে এমনটি দাবি করে আসলে কী বোঝাচ্ছেন? অতিপারমাণবিক কণিকাগুলো  যে আরো অতিঅতিপারমাণবিক কণিকার বিভিন্ন সমন্বয়ে গঠিত- এমন ধারণা কণিকাসমূহের বৈশিষ্ট্যাবলির জন্য একটি সরল এবং আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা প্রদান করে। যদিও একটি কণিকা অন্য কণিকাকে কীভাবে বিচ্যুত করছে সে উপাত্ত ব্যবহার করে প্রথম কণিকাটির অস্তিত্ব প্রমাণ করার পদ্ধতি বিজ্ঞানিরা অনেক আগ থেকে জানতো, তারপর-ও কিছু কিছু বিজ্ঞানি পর্যবেক্ষণযোগ্য নয় বলে কোয়ার্কের অস্তিত্ব মানতে নারাজ ছিলেন। অথচ পরবর্তীতে কোয়ার্কের মডেল বিভিন্ন সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে থাকায় অন্যপক্ষের উচ্চবাচ্য মিইয়ে আসে। এটি ঠিক যে কোনো কিম্ভুতকিমাকার ভিনগ্রহবাসী যদি আমাদের মতো একই পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ করে তবে তাদের পক্ষে কোয়ার্ক মডেল ব্যবহার না করে-ও ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হবে। তা সত্ত্বেও, মডেল-নির্ভর বাস্তবতা মতে, যে মডেলে কীভাবে অতিপারমাণবিক কণিকাগুলো আচরণ করে তার ব্যাখ্যা আমাদের পর্যবেক্ষণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সে মডেলে কোয়ার্কের অস্তিত্ব আছে।

মডেল-নির্ভর বাস্তবতা আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তরালোচনার জন্য একটি নির্মাণকাঠামোর যোগান দেয়: যদি মহাবিশ্বের সৃষ্টি একটি সসীম সময় পূর্বে হয়ে থাকে তবে তার-ও আগে কী ঘটেছিলো? একজন খ্রিস্টান দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০) বলেছিলেন, ঈশ্বরের সৃষ্টি করা মহাবিশ্বের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সময়, এবং সৃষ্টির পূর্বে সময়ের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না, যেটি কিনা তার মতে খুব বেশি সময়কাল আগে নয়। যারা মনে করে জেনেসিসের বর্ণিত সমস্ত কিছুই সত্য তাদের জন্য অগাস্টিনের উত্তরটি একটি সম্ভাব্য মডেল হতে পারে, কিন্তু অন্য আরেকটি মডেল বা জীবাশ্ম ও অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ বলে যে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিলো দীর্ঘকাল আগে (নাকি কেউ একজন আমাদের বোকা বানানোর জন্য ওই সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো রেখে দিয়েছে?) অর্থ্যাৎ, সময়ের শুরু ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিস্ফোরণের (big bang) ফলে। যে মডেলটি আমাদের বর্তমান পর্যবেক্ষণ, এবং সেই সাথে ঐতিহাসিক ও ভূতাত্ত্বিক আলামতগুলোর অধিকাংশই ব্যাখ্যা করতে পারবে সেটিই সর্বোত্তম মডেল। দ্বিতীয় মডেলটি ফসিল, তেজস্ক্রিয়তার উপাত্ত, এবং আমরা যে অনেক মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি থেকে আসা আলো দেখতে পাই ইত্যাদি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, তাই দ্বিতীয় মডেল অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের মডেলটিই প্রথমটির চে’ বেশি ফলপ্রসু এবং প্রয়োজনীয়। তবুও, যে কোনো একটি মডেলকে অন্য আরেকটি থেকে বেশি বাস্তব বলা যাবে না।

কেউ কেউ আবার এমন একটি মডেলের প্রস্তাব করেন যেটিতে মহাবিস্ফোরণের আগে-ও সময়ের অস্তিত্ব ছিলো। তবে ব্যাপারটি এখনো স্পষ্ট নয় যে সময়ের এই পিছনে যেতে পারা আমাদের বর্তমান পর্যবেক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য সুবিধা বয়ে আনবে কি না, কারণ মনে হচ্ছে ঠিক মহাবিস্ফোরণের সময় (শূন্য সময়ে) মহাবিশ্বের বিবর্তনের সূত্রগুলো ভেঙে পড়ে। যদি আসলেই ভেঙে পড়ে, তবে মহাবিস্ফোরণের আগে-ও সময় গণনা করতে পারা মডেলের দরকারই নেই যেহেতু সেই সময়ের পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রভাব বর্তমান সময়ের উপর থাকবে না, সুতারাং আমরা স্বচ্ছন্দেই মহাবিস্ফোরণের মডেলটি গ্রহণ করে বলতে পারি: মহাবিস্ফোরণই মহাবিশ্বের সৃষ্টিসূচনা।

একটি ভালো মডেলের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে:

১. এটি সহজসরল বা চোস্ত (elegant)

২. এতে অবাধ বা সমন্বয়যোগ্য উপাদান কম থাকে

৩. সমস্ত পর্যবেক্ষণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও সেগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারে

৪. ভবিষ্যত পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে এমন সব বিস্তারিত ভবিষ্যদ্বাণী বা অনুমান করে যেগুলো না মিললে মডেলটি বাতিল গণ্য হবে

উদাহরণস্বরূপ, অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব মতে মহাবিশ্ব মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি- এই চারটি উপাদান দিয়ে গঠিত, এবং বস্তুগুলো তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য মিথস্ক্রিয়া করে। তত্ত্বটি চোস্ত ছিলো এবং সমন্বয়যোগ্য চলক বা উপাদান ছিলো না, কিন্তু অনেক ব্যাপারেই এটি সুনির্দিষ্ট অনুমান বা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি নি, পারলে-ও সেগুলো পর্যবেক্ষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো না। অন্যতম একটি অনুমান ছিলো যে ভারী বস্তুসমূহ দ্রত নিচে পড়বে, কারণ পতনই বস্তুগুলোর উদ্দেশ্য। গ্যালিলিওর আগ পর্যন্ত কেউ এর সত্যতা পরীক্ষা করার চিন্তা-ও করে নি। একটি গল্প প্রচলিত আছে যে তিনি পিসার হেলানো দালান থেকে নানা ওজনের বস্তু নিচে ফেলে পরীক্ষাটি করেছিলেন। গল্পটি গুজব হতে পারে, তবে আমরা জানি যে তিনি একটি ঢালু তলের ওপর দিয়ে নানা ওজনের বস্তুকে গড়িয়ে পড়তে দিয়েছিলেন, এবং সবগুলো একই হারে গতি লাভ করেছিলো, যা কিনা অ্যারিস্টটলের অনুমানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

এটি পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান যে উপরে বর্ণিত মানদণ্ডগুলো বিষয়কেন্দ্রিক (subjective)। যেমন, একটি তত্ত্ব কতটুকু সহজসরল কিংবা চোস্ত সেটি সহজে পরিমাপযোগ্য নয়, কিন্তু বিজ্ঞানিরা এই বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কারণ, তারা মনে করেন প্রকৃতির নিয়মগুলো এতোটাই নান্দনিক যে সেগুলোকে একটি সরল সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব। এটি তত্ত্বের সমন্বয়যোগ্য উপাদানের স্বল্পতার (দ্বিতীয় মানদণ্ডটি লক্ষ্য করুন, প্রথম ও দ্বিতীয় মানদণ্ডটি সম্পর্কযুক্ত) সাথে সংশ্লিষ্ট, তাই ভুজুংভাজুং দিয়ে গঠিত তত্ত্ব চোস্ত বা এলিগেন্ট নয়। আইনস্টাইনের মতো করে বলতে গেলে: “একটি তত্ত্ব যতোটা সম্ভব সহজসরল হওয়া উচিত, কিন্তু সরলতর নয়।” টলেমি গ্রহ-নক্ষত্রের গতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বৃত্তাকার কক্ষপথগুলোর সাথে মন্দবৃত্ত যোগ করেছিলেন। তার মডেলটিকে আরো সঠিকভাবে উপস্থাপন করা যেতো মন্দবৃত্তের উপরে মন্দবৃত্ত অথবা সমতলীয় মন্দবৃত্ত (even epicycles) যোগ করে। যদিও যোগ করা জটিলতা মডেলটিকে নির্ভুল করে তুলতো, কিন্তু শুধুমাত্র কিছু পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করার জন্য যখন একটি মডেলে জটিলতা ঢুকানো হয় তখন বিজ্ঞানিরা এতে সন্তুষ্ট হন না, দেখে মনে হয় যে সেটি কোনো তত্ত্ব নয়- বরং উপাত্তের একটি সুবিন্যস্ত তালিকা।

পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা দেখবো যে প্রকৃতির প্রাথমিক কণিকাগুলোর মিথস্ক্রিয়া বর্ণনা করতে পারা “প্রমিত মডেলকে” অনেক বিজ্ঞানিই এলিগেন্ট মনে করেন না। যদিও টলেমির মন্দবৃত্তের মডেলটির চেয়ে এই মডেলটি অনেক উৎকৃষ্ট। এটি প্রকৃতিতে পর্যবেক্ষণ করার আগেই অনেক নতুন কণিকার অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলো, এবং কয়েক দশক ধরে অগণিত পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল খুব সূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করতে পেরেছে। কিন্তু এই মডেলটিতে বিপুল সংখ্যক সমন্বয়যোগ্য ধ্রুবক বা চলক আছে যেগুলোর মান তত্ত্বটি নির্ধারণ করে না, বরং পর্যবেক্ষণের সাথে মেলানোর জন্য মান ঠিক করে বা বেছে নিতে হয়।

চতুর্থ পয়েন্টটির ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানিরা সব সময়েই মুগ্ধ হন যদি কোনো নতুন এবং চমকপ্রদ অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়। কিন্তু যদি কোনো মডেলে ক্রটি পাওয়া যায় তবে তারা দোষারোপ করেন যে পরীক্ষা ঠিকভাবে করা হয় নি। যদি দেখা যায় যে পরীক্ষা ঠিক মতোই করা হয়েছে তবে তারা জোড়াতালি দিয়ে বা পরিবর্তন করে মডেলটিকে যথাযথ করে তুলতে চেষ্টা করেন। যদিও পদার্থবিজ্ঞানিরা তাদের পছন্দের তত্ত্বকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে নাছোড়বান্দা, কিন্তু অধিক জোড়াতালির ফলে তত্ত্বটি এতোটাই পরিবর্তিত হয়ে যায় যে এটি কৃত্রিম বা ঝামেলাপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং ফলশ্রুতিতে এটি আর এলিগেন্ট থাকে না।

যদি নতুন পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো তত্ত্বে পরিবর্তনের কারণে এটি বারোক হয়ে ওঠে, তবে বুঝতে হবে যে একটি নতুন তত্ত্ব প্রস্তাবনার সময় হয়েছে। নতুন পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে না পারার কারণে কোনো পুরানো তত্ত্বের বাতিল হয়ে যাওয়ার ভালো উদাহরণ হলো স্থিতিশীল মহাবিশ্বের ধারণা। ১৯২০ সালের দিকে অধিকাংশ বিজ্ঞানিই মনে করতেন যে মহাবিশ্ব স্থিতিশীল বা আকারে পরিবর্তিত হচ্ছে না। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল পর্যবেক্ষণ-উপাত্ত প্রকাশ করে বললেন যে মহাবিশ্ব আকারে বর্ধিত হচ্ছে। একথা ঠিক যে হাবল সরাসরিভাবে মহাবিশ্বকে বাড়তে দেখেন নি, বরং তিনি দূর গ্যালাক্সিগুলো থেকে আসা আলো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আলো এক ধরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বহন করে, বর্ণালি; যদি ছায়াপথটি আমাদের অবস্থানের প্রেক্ষিতে দূরে সরে যেতে থাকে তবে ছায়াপথের বৈশিষ্ট্যাবলির উপর নির্ভর করে এই বর্ণালি একটি নির্দিষ্ট পরিমানে পরিবর্তিত হবে। ফলে বিভিন্ন ছায়াপথের বর্ণালি বিশ্লেষণ করে হাবল ছায়াপথগুলোর গতিবেগ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে যতোগুলো ছায়াপথ আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে, ঠিক ততোগুলোই আমাদের নিকটবর্তী হতে থাকবে। কিন্তু দেখা গেলো যে প্রায় সব ছায়াপথই আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এবং ছায়াপথগুলো যতো দূরবর্তী তারা ততো বেশি দ্রুত গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। হাবল সিদ্ধান্ত টানেন যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু অন্যরা তাদের স্থিতিশীল মহাবিশ্বের ধারণার প্রতি অনড় থেকে এই পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করলো। যেমন, ক্যালটেকের পদার্থবিজ্ঞানি ফ্রিট্‌জ জুইকি প্রস্তাব করলেন যে এখন পর্যন্ত অজানা কোনো কারণে যখন অতিদূরত্ব অতিক্রম করতে হয় তখন হয়তো আলো শক্তি হারায়। শক্তির এই হ্রাস পাওয়ার ফলে বর্ণালিতে পরিবর্তন হবে, এবং এটি হাবলের পর্যবেক্ষিত ঘটনার ব্যাখ্যায় অবদান রাখতে পারে। হাবলের পরবর্তী কয়েক দশক ধরে-ও অনেক বিজ্ঞানি সেই স্থিতিশীল মহাবিশ্বের মডেল অবলম্বন করেছেন, অথচ সবচেয়ে স্বাভাবিক মডেল ছিলো হাবলের মডেলটিই অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, এবং অবশেষে এটিই গৃহীত হয়েছে।

মহাবিশ্ব নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মগুলোর অনুসন্ধানে আমরা অনেক তত্ত্ব বা মডেল সূত্রবদ্ধ করেছি, যেমন অ্যারিস্টটলের চারটি উপাদান তত্ত্ব, টলেমির মডেল, মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব ইত্যাদি। প্রতিটি তত্ত্ব অথবা মডেলের সাথে সাথে বাস্তবতা এবং মহাবিশ্বের মৌলিক গাঠনিক উপাদান সম্পর্কে আমাদের ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। যেমন আলোক তত্ত্বের কথাই ধরুন না। নিউটন ভেবেছিলো যে আলো অতিক্ষুদ্র কণিকা দিয়ে গঠিত। এই তত্ত্ব দ্বারা আলোর সরলপথে চলা ব্যাখ্যা করা যায়, এবং নিউটন আলোর এই কণাতত্ত্ব ব্যবহার করেছিলেন কেনো আলো এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যেমন বায়ু থেকে পানিতে কিংবা বায়ু থেকে গ্লাসে যাওয়ার সময় বেঁকে যায় বা প্রতিসারিত হয় তা ব্যাখ্যা করতে।

কণাতত্ত্ব কিন্তু নিউটন নিজেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এমন একটি ঘটনা, নিউটনের বলয়, ব্যাখ্যা করতে পারতো না। প্রতিফলন ঘটে এমন একটি সমতল পাতের উপর একটি লেন্স রাখুন, এবার এটিকে একটি একরঙা আলো যেমন- সোডিয়াম আলো দিয়ে আলোকিত করুন। যদি উপর থেকে লক্ষ্য করেন তবে দেখবেন যে লেন্সটি যেখানটায় পৃষ্ঠভাগকে স্পর্শ করেছে সেখানটায় সুবিন্যস্তভাবে উজ্জ্বল ও কালো বলয় কেন্দ্রীভুত হয়েছে। এই ঘটনাকে আলোর কণাতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা বেজায় কঠিন, কিন্তু আলোর তরঙ্গতত্ত্ব দিয়ে সহজে ব্যাখ্যা করা যায়।

তরঙ্গতত্ত্ব মোতাবেক, উজ্জ্বল ও কালো বলয়গুলো ব্যতিচারের কারণে সৃষ্টি হয়। একটি তরঙ্গের (যেমন পানির ঢেউ) এক সারি তরঙ্গশীর্ষ (উঁচু অংশ) ও তরঙ্গপাদ (নিচু অংশ) থাকে। যখন একাধিক তরঙ্গ পরষ্পরের সাথে ধাক্কা খায় তখন যদি তরঙ্গশীর্ষ-তরঙ্গশীর্ষ  ও তরঙ্গপাদ-তরঙ্গপাদ সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তবে তারা পরস্পরকে জোরদার করে একটি বড় বিস্তারের তরঙ্গ সৃষ্টি করে। একে গঠনমূলক ব্যতিচার বলা হয়, এবং তরঙ্গ দুটো “সম দশায়” আছে। অন্যদিকে, একটি তরঙ্গের তরঙ্গশীর্ষ অন্য তরঙ্গের তরঙ্গপাদের সাথে মিললে তারা পরস্পরকে নাকচ করে দেয়, এবং “বিপরীত দশায়” পড়ে। এই অবস্থাকে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার বলে।

নিউটনের বলয়ে উজ্জ্বল বলয়গুলোর ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে যেখানটায় লেন্স এবং প্রতিফলক পাতের মধ্যকার ফাঁক এমন হয় যে লেন্স থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গ ও পাত থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গের পার্থক্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (তরঙ্গদৈর্ঘ্য হলো একটি তরঙ্গশীর্ষ অথবা তরঙ্গপাদ থেকে নিকটবর্তী আরেকটি তরঙ্গশীর্ষ অথবা তরঙ্গপাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব) পূর্ণ সংখ্যার (১, ২, ৩…) গুণিতক হারে হয়, এক্ষেত্রে গঠনমূলক ব্যতিচার ঘটে। অন্যদিকে, ধ্বংসাত্মক ব্যতিচারে কালো বলয়গুলো কেন্দ্র থেকে এমন দূরত্বে থাকে যেখানটায় দুটি প্রতিফলিত তরঙ্গের মধ্যকার পার্থক্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অর্ধপূর্ণ সংখ্যার (০.৫, ১.৫, ২.৫…) গুণিতক হয়, অর্থাৎ  লেন্স থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গ ও পাত থেকে প্রতিফলিত তরঙ্গ একে অন্যকে নাকচ করে দেয়। লেন্স থেকে প্রতিফলিত রশ্মি তল থেকে প্রতিফলিত রশ্মিকে নাকচ করে দেয়।

এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে ঊনিশ শতকে আলোর কণাতত্ত্বকে ভুল বলা হয় এবং তরঙ্গতত্ত্বকে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বিশ শতকের শুরুতে আইনস্টাইন দেখান যে আলোক তড়িৎ ক্রিয়াকে (বর্তমানে টেলিভিশন এবং ডিজিটাল ক্যামেরায় বহুল ব্যবহৃত) কণাতত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়- যেনো আলোর কোয়ান্টাম বা গুচ্ছকণা একটি পরমাণুকে আঘাত করে একটি ইলেকট্রনকে বের করে আনছে। তাই বলা যায় যে আলো তরঙ্গ ও কণা উভয়ধর্মী আচরণ করে।

সম্ভবত তরঙ্গতত্ত্বের ধারণা মানুষের চিন্তায় এসেছিলো সমুদ্রে বা পুকুর-ডোবায় ঢিল ছুঁড়লে যে ঢেউতরঙ্গের সৃষ্টি হয় সেটি দেখে। প্রকৃতপক্ষে, আপনি যদি কখনো পুকুরে একই সাথে দুটি ঢিল ছুঁড়ে থেকে থাকেন তবে আপনি হয়তো ব্যতিচার দেখেছেন (চিত্রের মতো)। ওয়াইন বাদে অন্যান্য তরল পদার্থে-ও একই ধরণের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কণাতত্ত্বের ধারণা চিন্তায় আসে হয়তো নুড়িপাথর, বালি দেখে। কিন্তু আলোর কণা ও তরঙ্গ দ্বৈত অবস্থার ধারণা- একই জিনিসকে একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ ধর্ম প্রদর্শন করতে দেখা- আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এতোটাই অচিন মনে হয় যে যেনো আপনি পিঠা ভেবে এক খণ্ড বেলেপাথর খেয়ে ফেলতে পারছেন।

এই রকমের দ্বৈততা অর্থাৎ পুরোপুরি ভিন্ন দুটি তত্ত্বের মাধ্যমে একই ঘটনাকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারা কিন্তু মডেল-নির্ভর বাস্তববাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যেহেতু প্রতিটি তত্ত্বই নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যকে বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা করতে পারে, একটি অন্যটির চেয়ে বেশি ভালো বা বেশি বাস্তব এমনটি বলা যায় না। আমাদের মনে হচ্ছে, পুরো মহাবিশ্বের সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে এমন কোনো একক গাণিতিক তত্ত্ব বা মডেল সম্ভবপর নয়। বরং আমরা যেমন প্রথম অধ্যায়ে বলেছিলাম, আমরা পরস্পর সংযুক্ত একগুচ্ছ তত্ত্বের সমন্বয় পেতে পারি, যেটিকে আমরা এম-তত্ত্ব বলতে পারি। এম-তত্ত্বের প্রতিটি সদস্যতত্ত্ব একটি নির্দিষ্ট পরিসরের ঘটনাসমূহ ভালোভাবে বর্ণনা করতে পারে। যেখানটায় সদস্যতত্ত্বগুলোর পরিসীমা বা পরিসর সমাপতিত হয়, সেখানটায় ফলাফল একই হয়ে থাকে, ফলে বলা যায় যে সব তত্ত্ব মূলত একটি একক তত্ত্বের বিভিন্ন অংশ। কিন্তু কেবল একটিমাত্র তত্ত্ব প্রকৃতির সব বল, সেই বলগুলোর সাথে কণিকাগুলোর মিথস্ক্রিয়া, এবং স্থান-কালের যে কাঠামোয় এইসব কিছু সংঘটিত হয়- অর্থ্যাৎ মহাবিশ্বের সমস্ত জিনিসকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। যদিও এই ধারণা সনাতনী পদার্থবিজ্ঞানিদের একটি একক ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের স্বপ্নকে সত্য করে তোলে না তবুও এটি মডেল-নির্ভর বাস্তববাদের নির্মাণকাঠামোয় গ্রহণযোগ্য।

আমরা পঞ্চম অধ্যায়ে দ্বৈততা এবং এম-তত্ত্ব নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো, কিন্তু তার আগে আমরা প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আধুনিক দৃষ্টিকোণের ভিত্তি কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং বিশেষ করে কোয়ান্টাম তত্ত্ব মোতাবেক বিকল্প ইতিহাসের ধারণা সম্পর্কে জেনে নেবো। এই ধারণা মতে, মহাবিশ্বের কোনো একক অস্তিত্ব না ইতিহাস নেই, বরং মহাবিশ্বের সম্ভাব্য সকল ধরণের অস্তিত্বই যুগপৎভাবে বিরাজমান- একে কোয়ান্টাম উপরিপাতন (quantum superposition) বলা হয়। আপনি হয়তো ভাবছেন যে এই তত্ত্বটি সেই ‘ঘর ছাড়লেই টেবিল অদৃশ্য হয়ে যায়’ তত্ত্বটির মতো উদ্ভট, কিন্তু এখন পর্যন্ত তত্ত্বটি যতো পরীক্ষানিরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে তার সবগুলো পাস করেছে।

[বইটির সূচিপত্র তখা সব পর্বের লিংক দেখুন এখানে]

মূল: স্টিফেন হকিং ও লিওনার্দো ম্লোডিনো

অনুবাদ: -আশরাফ মাহমুদ
গবেষক, কবি ও লেখক
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.