চীনে ৪৮ বছর বয়সী এক নারী স্ট্রোক করেন। নতুন পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর রিপোর্ট থেকে দেখা গেল, তাঁর হৃদপিণ্ডে আঙুলের সমান লম্বা সুঁচ বিঁধে আছে!এই নারীর স্ট্রোক হওয়ার কয়েক মাস আগেই এই সুচ তাঁর বুকে বিঁধে। যদিও ঠিক কিভাবে এই ঘটনা ঘটেছিল তা রিপোর্ট থেকে জানা যায় নি। সুঁচটি টিস্যুর বিভিন্ন স্তর ভেদ করে অবশেষে তাঁর হৃদপিণ্ডের মাংসে আটকে যায়।
সুঁচটি হৃদপিন্ডে অবস্থানকালে, একে ঘিরে শারীরবৃত্তীয় কারণে শক্ত সুরক্ষা আবরণ (Calcified Mass) তৈরী হয়, যা পরবর্তীতে রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে দেয়। সেই জমাট রক্তপিণ্ড রক্তনালী বেয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছালে তাঁর বেশ কয়েকটি স্ট্রোক হয়।
পুরানো অন্তত ১৬টি মেডিক্যাল কেস থেকে দেখা যায়, যেসব রোগীর হৃদপিণ্ডে বাহ্যিক কোনো বস্তু পাওয়া যায়, তাঁরা সাধারণত বুকে ব্যথ্যা, জ্বর, অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন এবং হৃদপিণ্ডের সংক্রমণের মতন কিছু লক্ষণ দেখান। ‘জার্নাল অফ মেডিকেল কেস রিপোর্ট’ এ প্রকাশিত এই ঘটনাপ্রসঙ্গে কর্তব্যরত ডাক্তাররা লিখেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীদের সমস্যা সঠিকভাবে নির্ণীত হয় এবং সংশ্লিষ্ট রোগীর ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা করা হয়।
রোগিণী কয়েক মিনিট অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার পরপরই মেডিকেলে আসেন। এর আগে একবার মস্তিষ্কে প্রদাহের এক ঘটনার পর থেকে তাঁর কথা বলতে সমস্যা হত বলে তিনি সাথে করে তাঁর আত্মীয়কে নিয়ে আসেন তাঁর হয়ে কথা বলার জন্য। সেই আত্মীয় ডাক্তারদের জানান, সপ্তাহ খানেক আগে যখন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন, তখন তাঁর জ্বর আর কাশি ছিল- দেখে মনে হচ্ছিল যেন সাধারণ সর্দি কাশি।
কিন্তু রোগিনীর বুকের এক্স-রে ইমেজে তাঁর হৃদপিণ্ডের কাছে দুই টুকরা বাহ্যিক বস্তু দেখা যায়। তাঁরপর, বস্তুটিকে আরো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য ডাক্তারগণ ইকো-কার্ডিওগ্রাম (echocardiogram, হৃদপিণ্ডের একধরণের আল্ট্রাসাউন্ড ইমেজ) থেকে হৃদপিণ্ডের পেশীর সাথে লাগানো অবস্থায় প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা জমাটবদ্ধ একটি বস্তুপিণ্ড দেখতে পান।
রোগীর আত্মীয়ের কাছ থেকে ডাক্তাররা জানতে পারেন, চিকিৎসার জন্য আসার প্রায় তিন মাস আগেই কিছু একটা তাঁর বুকে বিদ্ধ হয়।
পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের পর ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত আসেন যে, বস্তুটি একটি সুঁচ এবং দৈর্ঘ্যে প্রায় এক আঙুল লম্বা। সুচটি একেবারে হৃদপেশী ভেদ করে অন্য পাশের ফুসফুসকে পর্যন্ত ছিদ্র করেছিল। তবে, ফুসফুসের ক্ষতটি আপনাআপনি সেরে যাওয়াতে এই নারীর বেলায় শুধু সামান্য কাশি আর জ্বর দেখা গিয়েছিল।
হৃদপিণ্ডছেদী আঘাতের পরেও রোগী বেঁচে থাকায় ডাক্তারগণ ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেন। ত্বকে প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়ার মতন কিছু ব্যাকটেরিয়া বহন করে বলে সুঁচ বা অন্য যে কোনো বাহ্যিক বস্তুই সংক্রমণ ঘটাতে পারে। তবে, বাহ্যিক কোনো বস্তু শরীরে, বিশেষ করে হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করলে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি হয়। কেননা, ঐ বাহ্যিক বস্তুর উপস্থিতির কারণে হৃদপিণ্ডের ভালভগুলোতে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহের ব্যাঘাত ঘটে। যার ফলে, দেহের রোগপ্রতিরোধে কাজ করা সংক্রমণরোধী কোষগুলি তখন হৃদপিণ্ডে পৌঁছাতে পারে না। আর এসব কোষ (বিভিন্ন ধরণের শ্বেতরক্তকণিকা) রক্তের মাধ্যমেই স্থানান্তরিত হয়।
নিউইয়র্কের ম্যানহাসেট-এ অবস্থিত ‘নর্থওয়েল হেলথস নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউট’ এর ভাসক্যুলার নিউরোলজির প্রধান ডাঃ রিচার্ড বি. লিবম্যান বলেন, ‘হৃদপিণ্ডের প্রদাহ খুব একটা সহজপ্রাপ্য ঘটনা নয়, আবার এধরণের ঘটনার কথা একদম যে শোনা যায় না, তা-ও নয়। হৃদপিণ্ডের ‘ভালভে’ (Heart valve) পৌঁছাতে পারে এমন কোনো সংক্রমণের কারণেই সাধারণত হৃদপিণ্ডে সংক্রমণ দেখা দেয়। যেমন, দাঁতের চিকিৎসার সময়, মুখ থেকে ব্যাকটেরিয়া রক্তে মিশে শেষ পর্যন্ত হৃদপিণ্ডে পৌঁছে”।
তাই বলে, এরকম হৃদপিণ্ডের মধ্যে বাহ্যিক কোনো বস্তুর কারণেই হৃদপিণ্ডে সংক্রমণের ঘটনা খুবই বিরল। লিবম্যান বলেন, কারণ যা-ই হোক না কেন, হৃদপিণ্ডের সংক্রমণ খুব মারাত্মক। যথাযথ এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের মাধ্যমে এর চিকিৎসা সম্ভব হলেও, অনেক সময় চিকিৎসা পরবর্তী নানান জটিলতা দেখা দেয়।
এই সংক্রমণ রক্তকে জমাট বাঁধাতে পারে। সেই জমাট রক্তপিণ্ড পরে বিভিন্ন টুকরায় বিভক্ত হয়ে রক্তপ্রবাহের সাথে মিশে শরীরের যেকোনো জায়গায় যেতে পারে, এমনকি মস্তিষ্কেও। “মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর,” ডাঃ লিবম্যান বলেন, “এই জমাট-রক্তের কণাগুলো দুই ধরণের স্ট্রোক ঘটাতে পারে। জমাটরক্তের কণাগুলো যেহেতু রক্তনালীকে ব্লক করে দেয়, তাই রক্তস্বল্পতাজনিত স্ট্রোক হতে পারে; অথবা কণাগুলো রক্তনালীতে প্রদাহ ঘটাতে পারে, যার কারণে, রক্তনালীগুলোর গাত্র পাতলা হয়ে যায়, এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়”।
রোগিনীর মস্তিষ্কের একটি সিটি স্ক্যান (CT scan) রিপোর্টে তাঁর মস্তিষ্কের বেশ কয়েকটি স্থানে স্ট্রোক হতে দেখা গেছে। ডাক্তাররা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রোগীর হৃদপিণ্ড ও ফুসফুস থেকে সুঁচটি বের করে নেন। আলোচ্য কেস রিপোর্ট অনুযায়ী, হৃদপিণ্ডস্থিত যেকোনো বাহ্যিক বস্তুকে অন্য কোনো জটিলতা দেখা দেয়ার পূর্বেই বের করে ফেলার জন্য সময়মত অস্ত্রোপচার জরুরী।
ডাক্তাররা লিখেছেন, “এই নারীর ক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা প্রদানে বিলম্ব হয়েছিল। যে কারণে তাঁর চিকিৎসা বেশ জটিল হয়ে দেখা দিয়েছিল”। তাঁরা বলেন, সৌভাগ্যক্রমে, তিনি সন্তোষজনকভাবে আরোগ্য লাভ করেন এবং স্নায়ুতন্ত্রের কোনো সমস্যা ছাড়াই তাঁকে হাসপাতাল ত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়।
⚫ ডা: সুমধু চক্রবর্ত্তী