জীবাষ্ম জ্বালানী হতে মাংস তৈরি!

1
282

আমাদের আধুনিক জীবনে যে সকল সুযোগ সুবিধা উপভোগ করছি অধিকাংশের পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানী মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছে। আজকাল সব জায়গায়ই জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার চোখে পরে। আমারা যে গাড়ী চালাচ্ছি, বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি এসবকিছুর মধ্যেও এর ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি নিজেদের সুবিধার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের ফলে এই গ্রহের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে চলছি।

আমরা যখন ভূগর্ভ থেকে কয়লা বা তেলের মতো জীবাশ্ম উত্তোলন করে তা পোড়াতে শুরু করি, এগুলো থেকে ক্ষতিকারক গ্রিনহাউজ গ্যাস আমাদের বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মূলত প্রাচীন জৈব উপাদান (পাতা, গাছ, ডায়নোসর) লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভূগর্ভে সংকুচিত হয়েই এসব জীবাশ্ম জ্বালানী তৈরি হয়ে থাকে। এসব উপাদান ‘জৈব’ (মানে এতে কার্বনের সংমিশ্রণ থাকে) হওয়ার কারণে যখন এদের পোড়ানো হয় তখন এর ভেতরে সঞ্চিত কার্বন মুক্ত হয়ে পুনরায় কার্বন-ডাই অক্সাইড হিসেবে বায়ুমন্ডলে মিশে যায়।

এই শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস মোটা কম্বলের মতো পৃথিবীকে আবৃত করে রাখে এবং তাপমাত্রা শুষে নিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। আমরা যতো বেশি জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করবো ততই এই কম্বলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি করে একে আরও মজবুত করে তুলব। ফলে আমাদের আরামদায়ক পরিবেশ তৈরীতে এর আর কোন ইতিবাচক ভূমিকা থাকবেনা। আমাদের মাঝে জীবাশ্ম জ্বলানী পোড়ানোর প্রবৃত্তি থাকার কারণে, ৬ লক্ষ বছর পূর্বে বায়ুমন্ডলে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড ছিল বর্তমানে তা থেকে বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সুতরাং ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যাবহার সীমিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ন। আপনি যদি অনুসন্ধান করেন তবে সব জায়গায়ই জীবাশ্ম জ্বালানী খুঁজে পাবেন। তবে আমরা বাজি ধরতে পারি আপনি কখনই ধারণা করেননি চীজ বার্গার এদের মধ্যে এটি থাকতে পারে। আতংকিত হবেন না। পশুখাদ্য প্রস্তুতকারীরা এখনো প্রাণীদের খাদ্যের মাঝে পেট্রোকেমিক্যাল (যদিও হরমোন ককটেল, এন্টিবায়োটিক ইত্যাদিকে অতীত উদাহরণ হিসেবে ধরছিনা) মেশানো শুরু করেনি। কিন্তু বার্গারসহ যে সকল প্রাণীজ পণ্য মানুষ ভোগ করে সেগুলোর উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহৃত হয়।

বস্তুত, এক ক্যালোরি উদ্ভিজ প্রোটিনের তুলনায় এক ক্যালোরি প্রাণিজ প্রোটিন তৈরীতে প্রায় দশগুণ বেশি জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহৃত হয়। মাংসের ধরণের উপর নির্ভর করে কিছু ক্ষেত্রে আরো বেশি পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বলানী ব্যবহার করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, শস্য খাওয়ানো গরুর মাংস প্রতি এক ক্যালোরি উৎপাদন করতে ৩৫ ক্যালোরি জীবাশ্ম জ্বালানী প্রয়োজন হয়। এটা একটা বিশাল ব্যাপার।

কিভাবে এই ভয়াবহ বিষয়টি সত্য হতে পারে? তাহলে চলুন বিষয়টিকে খোলস থেকে বের করে আনিঃ  

১. গরু জীবাশ্ম জ্বালানী খাচ্ছেঃ

মাংস উৎপাদনে কিভাবে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহৃত হয় সেটা বোঝার জন্য আমাদের পশু খাদ্য তৈরীর উৎসে নজর দিতে হবে। গবাদি পশুর খাদ্য তৈরীতে প্রায় শতকর ৭৫ ভাগ জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহৃত হয়।

ফুড রেভুল্যুশন নেটওয়ার্কের এক নিবন্ধে ডেভিড পিমেনটেল বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর ভুট্টা, ৩১.১ মিলিয়ন হেক্টর সয়াবিন উৎপাদন প্রক্রিয়া পশুসম্পদের খাদ্য উৎপাদনের জন্য বন্টন করে দেয়া হয়েছে (এই সংখ্যা দক্ষিণ আমেরিকায় উৎপন্ন শস্য পশুখাদ্যের সাথে যুক্ত করা হয়নি)। যেখানে এগ্রোকেমিক্যাল রূপে বিশাল আকারের জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

পিমেনটেল ফুড রেভুল্যুশন নেটওয়ার্ককে বলেন, “ ভুট্টা যা পশুখাদ্য তৈরীতে ব্যবহৃত হয় তা উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন পড়ে। আর এসবকিছুই তেলের উপর নির্ভরশীল। কার্যত একটি ষাঁড় তার জীদদ্দশায় ২৮৪ গ্যালন তেল খরচ করে থাকে।”

পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মাংসের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১৮০ মিলিয়ন টন সার ব্যবহৃত হচ্ছে পশু খাদ্য উৎপাদনে। এই সার অথবা তেল ব্যবহারের মাত্রা ২০৫০ সালে আনুমানিক ২৩০ মিলিয়ন টন অথবা ৭.৩ বিলিয়ন গ্যালনে গিয়ে পৌছুবে। যার সবকিছুই পেট্রোকেমিক্যাল।

২. কল-কারখানা, খামার চালনায় জীবাশ্ম জ্বালানীঃ

আগের দিনে খামারীরা বেশিরভাগ কাজই করতো হাতের মাধ্যমে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির যুগে নানা রকম যন্ত্রপাতি দিয়েই চাষের কাজ সম্পন্ন করা হয়। এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খামারে প্রায় ১৭ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহৃত হয় এবং এর বেশিরভাগই খামার, কারখানার শক্তি সরবরাহের কাজে লাগানো হয়।

প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে “৯০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গত হয় জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করার ফলে।”

কৃষি ভিত্তিক কারখানাগুলো (যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্টের প্রায় ৯৯ ভাগ খামারি পশু উৎপাদন করা হয়)  স্বল্প পরিসরের পশু উৎপাদনের চেয়ে বেশি শক্তি খরচ করে থাকে। একটু চিন্তা করলে দেখবেন ২০,০০০ মুরগী দ্বারা পূর্ণ একটি শেড ঠান্ডা রাখতে কি পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন অথবা পশ্চিমা দেশে শীতের মাঝামাঝি সময়ে মারাত্মক ঠান্ডায় শূকরদের উষ্ণতায় ব্যবহৃত তাপ খরচের মাত্রা।

আমেরিকার ২০,০০০ কারখানায় বায়ু চলাচল, উষ্ণ রাখা, ঠান্ডা রাখা এবং পরিষ্কার রাখায় প্রচুর পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করতে হয়।

৩. খামার থেকে ঘরের টেবিল পর্যন্ত পৌছুতে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারঃ

জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায় ১ কিলোগ্রাম মুরগীর মাংস প্রস্তুত করতে ২.৫ ইউনিট, সূকরের মাংসের জন্য ৬.৩ ইউনিট এবং প্রায় ৪.৭ ইউনিট জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করতে হয় প্রতি কেজি গরুর মাংস প্রস্তুত করতে। এই শক্তি ব্যবহৃত হয় জবাই করা থেকে শুরু করে প্রতি কিলোগ্রাম মাংস প্রক্রিয়াজাত করা পর্যন্ত। আর পৃথিবীব্যাপী ৭০ বিলিয়ন পশুর মাংস প্রক্রিয়াজাত করার জন্য প্রতিবছর জবাই করা হচ্ছে এবং এর পেছনে বিশাল পরিমাণের শক্তি খরচ হচ্ছে।

আবার এসব মাংস প্যাকেটজাত করা এবং বিক্রয়কেন্দ্রে পৌছে দেয়ার জন্যেও বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। সাসটেইনেবিলিটির এক গবেষণা অনুসারে “আমাদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যবহৃত শক্তির প্রায় ২৩ শতাংশ এর প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং প্যাকেজিং এর জন্য বরাদ্দ করা হয়।”

এদিকে আমরা দোকান থেকে কেনা মাংস বাড়িতে নেয়ার জন্য যে শক্তির ব্যবহার হচ্ছে সেটা হিসেবেই ধরছিনা। সাসটেইনেবল টেবিলের হিসেব মতে ৩২ শতাংশ শক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে বাড়িতে খাদ্য প্রস্তুতের জন্য রান্না এবং ঠান্ডা করার কাজে।

৪. গ্রিজি বার্গারের মূল অর্থঃ

এখন আপনি জেনেছেন কিভাবে জীবাশ্ম জ্বালানী প্রাণীজ পণ্য তৈরী হয়। আর আমেরিকানরা প্রতিবছর গড়ে ২০৯ পাউন্ড মাংস খেয়ে থাকে। এই পরিমাণকে যদি জনসংখ্যার সংখ্যা দিয়ে গুণ করি তাহলে আমরা সহজেই পেয়ে যাবো ৬২৭ বিলিয়ন পাউন্ড মাংস প্রতি বছরে খাওয়া হচ্ছে আমেরিকা জুড়ে। যদি একটি হ্যামবার্গার(আধা পাউন্ডের) প্রস্তুত করা হয়  তাহলে ৪০ মাইল গাড়ি চালালে যে পরিমাণ জ্বালানী পুড়বে ঠিক একই পরিমাণ জ্বালানী এতে ব্যবহৃত হয়। তার মানে এক পাউন্ডের বার্গার তৈরী করতে ৮০ মাইল গাড়ি চালানোর সমান জ্বালানী ব্যবহৃত হচ্ছে। এই হিসাবটি সমগ্র আমেরিকার মাংস ভোক্তার সাথে তুলনা করলে তারা প্রায় ১৬,৭২০ মাইল ড্রাইভ করার সমান বার্ষিক জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়ছে।

picture1

এ থেকেই বুঝা যাচ্ছে আমাদের খাওয়া খাবার কিভাবে আমাদের গ্রহকে প্রভাবিত করছে। খাদ্য উৎপাদনের প্রতিটা স্তর থেকে আমাদের খাদ্যভ্যাস দ্বরা ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেই চলেছি। সৌভাগ্যবশত, আমাদের হাতে এই খাদ্যভ্যাস পরিবর্তন করে ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনার চাবিকাঠি  রয়ে গিয়েছে। যে ব্যক্তি উদ্ভিদ- ভিত্তিক খাদ্য অনুসরণ করে তারা প্রতি একক ক্যালোরিতে ১০ গুণ কম জীবাশ্ম জ্বালানী খরচ করে থাকে।

এসব কিছুই কমতে পারে যদি আমরা পছন্দ পরিবর্তন করতে পারি। আমাদের চাহিদা অবারিত থাকার কারণে পশু শিল্প দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। যদি আমরা তাদের অর্থ দেয়া বন্ধ না করি তবে এই ক্ষতির মাত্রা কমবেনা।

-শফিকুল ইসলাম
অর্থনীতি বিভাগ (অনার্স শেষবর্ষ), সরকারী সা’দত কলেজ, টাঙ্গাইল
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.