সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর পরিকল্পনা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ১১ অক্টোবর সিএনএন ডট কম-এর সম্পাদকীয়তে ওবামার এই লক্ষ্য তুলে ধরা হয় এভাবে, “২০৩০ সালের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ প্রেরণ এবং তাদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা। সেই সাথে লম্বা সময়ের জন্য সেখানে মানুষের বসবাস নিশ্চিত করা একটি চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা।”
নাসার পরিচালক চার্লস বোলডেন এক ব্লগ পোষ্টে প্রেসিডেন্টের এই উৎসাহকেই প্রতিধ্বণিত করেন এবং নাসার পরিকল্পনা বর্ণনা করেন। ব্লগ পোষ্টে প্রেসিডেন্টের একজন সিনিয়র উপদেষ্টা জন হার্ডেন সহলেখক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে বলা হয়, “সরকারী বেসরকারী অংশীদারীত্ব কাজে লাগিয়ে মহাশূন্যে একটি টেকসই পদ্ধতিতে মানুষের বসবাস এবং কাজ করার পরিবেশ চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
নাসার প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক জার্নাল রিপোর্ট অনুযায়ী উচ্চাভিলাসী এই প্রকল্প পরিচালনা করার ক্ষেত্রে মহাকাশচারীদের ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উপর চালিত এক নতুন গবেষণায় দেখা যায়, মঙ্গলের দীর্ঘ ভ্রমণে মহাকাশীয় বিকিরণে মহাকাশচারীদের মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এবং তাঁদের দেহকেও অচল করে দিতে পারে।
গতবছর পরিচালিত ছয় সপ্তাহের এই গবেষণাটির ফলাফল এটাই ইঙ্গিত করছে যে, ছয় মাস ব্যাপী একটি একমুখী ভ্রমণ মস্তিষ্কের একটি বিশাল এলাকায় বড় ধরণের ক্ষতি সাধন করতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়েশন অনকোলজির অধ্যাপক এবং প্রধান গবেষক চার্লস লিমোলি বলেন, “মঙ্গলের উদ্দেশ্যে দুই-তিন বছর ব্যাপী সময়ের জন্য প্রেরিত মহাকাশচারীদের জন্য এটা খুব একটা ইতিবাচক খবর নয়।”
এদিকে নাসা বলছে তারা এজেন্সিগুলোতে অর্থায়ন করছে যেন মহাকাশচারীদের আসন্ন ঝুঁকি সম্পর্কে আরো পরিষ্কার ধারোনা পাওয়া যায়।
বিকিরণ বিপদ সমূহ
মহাকাশচারীগণ মহাকাশে দুই ধরণের বিকিরণ সমস্যার মুখোমুখি হবেন। এক হচ্ছে সূর্য থেকে আসা সৌর বিকিরণ যার সাথে থকবে অতি বেগুনী রশ্মি, রঞ্জণ রশ্মি, প্রোটনস এবং ইলেকট্রোনস। অন্যটি হচ্ছে মহাজাগতিক বিকিরণ। যা গভীর সৌরজগতের সকল স্থান থেকে আসতে থাকবে। আর এগুলোতে যুক্ত থাকবে সৌর বিকিরণ থেকে অনেক বেশি মারাত্মক পারমাণবিক কণা।
লিমোলির গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল মহাজাগতিক বিকিরণের কারণে মানুষের কি কি সমস্যা হতে পারে তা নির্ধারণ করা। লিমোলি বলেন পূর্বে এমন কোন গবেষণায় এমন কিছু দেখা যায়নি বললেই চলে।
এখন পর্যন্ত বহু মাস মানুষ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে অবস্থান করে এসছে। রাশিয়ার নভোচারী ভ্যালেরি পলয়াকভ Mir মহাকাশ স্টোশন এর বাইরে একনাগারে ৪৩৮ দিন মহাকাশে অবস্থান করে দীর্ঘ সময় কক্ষপথে সময় কাটানোর রেকর্ড গড়েন।
যাইহোক Mir মহাকাশ স্টোশন (যা এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছেনা) এবং মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীর অনেক কাছে অবস্থিত। পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ার একটি প্রাকৃতিক চৌম্বকীয় এলাকা যা সূর্য এবং গভীর সৌর জগৎ থেকে আসা পারমাণবিক কণার চার্জ পথচ্যূত করে। এই এলাকাটিই কক্ষপথের গবেষণাগারের মহাকাশচারীদেরকে ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে রক্ষা করে থাকে। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পলয়াকভ এবং অন্যান্য মহাকাশচারীদের ক্ষেত্রে কক্ষপথে অবস্থানের জন্য তাঁদের মস্তিষ্কের কোন ক্ষতি হয়নি।
যে সব মহাকাশচারীগণ ঝুঁকি নিয়ে চাঁদে ভ্রমণ করেছিলেন এই ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের সুরক্ষিত এলাকা ভেদ করে তাঁদের ক্ষেত্রে বিকিরণ সমস্যাটি সহনীয় মাত্রায় ছিল। কারণ পুরো ভ্রমণটি ছিল মাত্র দুই সপ্তাহ সময়ের। ২০১৩ সালের ইদুরের পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে বিকিরণ আলজেহইমার রোগকে দ্রুততার সাথে সক্রিয় করে তুলতে সাহায্য করতে পারে।
নিউইয়র্কে ব্রুকহেইভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে নাসার মহাকাশীয় বিকিরণ গবেষণাগারে স্তন্যপায়ীর উপর পারমাণবিক কণা বর্ষণ করে দেখেছেন। গবেষকরা দেখেন ক্রমাগত বিকিরণের ফলাফল ব্যাথাহীন হলেও এটি স্তন্যপায়ীদের মস্তিষ্কে ব্যপক ক্ষতি সাধন করবে। তাঁরা আরও বলেন, বেশ কিছু ছবিতে দেখা যায় প্রাণীদের মস্তিষ্কের কোষে ডেনড্রাইটস এবং স্পাইনস কোষগুলোর পরিষ্কার অবনতি ঘটেছে। যার ফলে স্নায়ুগুলোর মাঝে সংকেতে আদান-প্রদানে বাধা সৃষ্টি হবে।
লিমুলি লাইভ সাইন্সকে বলেন, ডেনড্রাইটস এবং স্পাইনস ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া মানে একটি গাছের মতো যা তার পাতা ও ডাল হাড়িয়ে ফেলেছে। যা গাছের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে চলে। এই শারীরিক ক্ষতি প্রাণীদের শেখা এবং মনে রাখার ক্ষেত্রে বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে। আর মহাকাশচারীদের ক্ষেত্রে বিকিরণের ফলাফল হিসেবে তাঁদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্বল করে দেবে।
আশা করছেন শেষপর্যন্ত নাসা নিরাপদেই তাঁদের মহাকাশচারীদের মহাকাশে প্রেরণ করবেন।
ত্রিশ মাসের একটি ভ্রমণ
নাসা ৩০ মাসের একটি মহাকাশ ভ্রমণ সূচী নির্ধারণ করেছে। ৬ মাস থাকবে আসা যাওয়ার ভ্রমণ সময়, সাথে ১৮ মাস হচ্ছে লাল গ্রহটিতে অবস্থান সময়। যেখানে মহাকাশচারীরা সর্বমোট ১ sievert (Sv) বিকিরণের মুখোমুখি হবেন। লিমুলি বলেন, একজন মস্তিষ্ক ক্যান্সারের রোগী বিকিরণ চিকিৎসা নেয়ার সময় যে পরিমাণ ভোগে সে তুলনায় এর এক ডোজের দশ গুণ বেশি বিকিরণ সহ্য করতে হবে মহাকাশচারীদের। যদিও ক্যান্সারের রোগীরা সুস্থ হয় তবে তারা মাথা খাটানোর কার্যক্রমে পিছিয়ে যেতে থাকে।
নাসার এক কর্মকর্তা বলেন, মহাকাশচারীদেরকে দুটি উপায়ে মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে।একটি হচ্ছে, নিষ্কিৃয় পদ্ধতিতে পনির সাথে পুরু ধাতব ঢাল বা সুরক্ষাস্তর স্থাপন করে যা বিকিরণ আটকাতে মহাকাশযানের চারদিকে অথবা মহাকাশচারীদের ঘুমানোর ঘরের চারদিকে এই আবরণ স্থাপন করে। মহাজাগতীয় বিকিরণ অনেক সুতিক্ষ্ণ। যাইহোক, রক্ষাকবচটি যথেষ্ট পুরু হবে বিকিরণ আটকানোর জন্য।
অন্যটি হচ্ছে সক্রিয় পদ্ধতিতে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্ষেত্র স্থাপন করে বিকিরণ প্রতিহত করতে। লিমুলি বলেন, তাঁদের দল এবং অন্যান্যরা মিলে আর একটি পদ্ধতিতে পরীক্ষা চালাচ্ছে। একপ্রকার ঔষধ তৈরী করার চেষ্টা করা হচ্ছে যা বিকিরণ রোগ প্রতিরোধ করবে এমনকি স্নায়ু পুন:স্থাপনের কাজ করবে।
নাসা আশা করছে মঙ্গলের ভ্রমনটি একটি অসাধারণ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে এবং মহাকাশচারীরা ফিরে আসার জন্য যথেষ্ট সুস্থ থাকবে।
-শফিকুল ইসলাম