মৃত্যুর সৌন্দর্য ও অমরত্বের জটিলতা

0
914

স্বাভাবিকভাবে যদি মানুষ মারা না যেত, তাহলে আজকের প্রজন্মের জীবিত মানুষেরা কীভাবে বসবাস করতো? কিংবা আজকে আমরা যারা বেঁচে আছি তারা যদি নিজেদের শারীরিক কর্মকাণ্ডকে নিষ্ক্রিয় করে মৃত্যুর দিকে না যাই তাহলে উত্তর প্রজন্মের অনাগত ছেলেমেয়েরা কীভাবে বসবাস করবে? মানুষের উৎপত্তির সেই আদিযুগ থেকে এখন পর্যন্ত তো আর কম সংখ্যক মানুষের জন্ম হয়নি। মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়েছে। হিসেবের সুবিধার্থে ধরে নিলাম তাদের কেহই মারা যায়নি, সকলেই বেঁচে আছে আজকের দিন পর্যন্ত। তাহলে এত পরিমাণ বেঁচে থাকা মানুষের জায়গা কীভাবে হতো ছোট এই পৃথিবীতে?

সামান্য সময়ের জন্য আশার কথা অবশ্য শুনতে পারি, সেসব মানুষের সকলে যদি আজকে জীবিত মানুষদের সাথে দাঁড়ায় তবে পৃথিবী তাদের কষ্ট করে হলেও জায়গা দিতে পারবে। ছোট পৃথিবীটা এত ছোট নয়। মাঝে মাঝে বলা হয়ে থাকে, বর্তমান পৃথিবীতে যে পরিমাণ জীবিত মানুষ আছে সে পরিমাণ মৃত মানুষও নেই।[1] মানে লক্ষ লক্ষ বছরের মৃত মানুষ আজকের জীবিত মানুষের তুলনায় সংখ্যাগত দিক থেকে কম। তাহলে তাদেরকে হিসাবের ভেতর ধরে নিলেও সকলকে পৃথিবীতে জায়গা করিয়ে নেয়া যাবে।

কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন আছে, তারা হবে ‘শুধুই তারা’। যদি তারা বেঁচে থাকতো তাহলে নিশ্চয় বংশবিস্তার করতো। ধরি কম করে হলেও তারা প্রতি একশো বছরে পাঁচটি করে সন্তান উৎপাদন করতো। এই হারে উৎপাদন করতে থাকলে তিরিশ-চল্লিশ লক্ষ বছরে কত পরিমাণ মানুষ পাওয়া যেত? প্রতিটি মানুষ প্রতি একশত বছরে পাঁচটি করে সন্তান উৎপাদন করল, এরপর উৎপন্ন হওয়া নতুন সন্তানেরাও ১৭/১৮ বছরে সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হয়ে যাবে। তারাও শত বছরে পাঁচটি করে সন্তান উৎপাদন করবে এবং নব-উৎপাদিত উত্তর-উত্তর প্রজন্মের সন্তানেরাও অল্পতেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বংশধর বাড়াতে থাকবে।

এই প্রক্রিয়া যদি বাধাহীনভাবে চলতে থাকে তাহলে মানুষের জন্মের একটা গুণোত্তর ধারার সৃষ্টি হবে। মৃত মানুষদেরকে জীবিত ধরে মনে মনে যে সহজ সরল সমান্তর ধারার হিসাব করা হয়েছিল সেটা আর সরল থাকে না। গুণোত্তর ধারাতে হুট করে অল্প সময়তেই অনেক বড় আকারের জনসংখ্যা পাওয়া যাবে। পৃথিবী এত পরিমাণ মানুষকে জায়গা দিতে নিশ্চয়ই পারবে না। সেসব মানুষ বেঁচে থাকলে খাবার দাবার, পানি, আরাম আয়েশ, বিনোদন, বিদ্যুৎ এগুলো কীভাবে সরবরাহ করা সম্ভব হতো? পৃথিবীর সঞ্চিত সম্পদ তো সীমাবদ্ধ। কিংবা আমরাই যদি স্বার্থপরভাবে আমাদের উত্তর উত্তর প্রজন্ম পর্যন্ত বেঁচে থাকি তবে কীভাবে শৃঙ্খলা বজায় থাকবে? একসময় তো দেখা যাবে সমস্ত পৃথিবীটাকেই যদি খাদ্য হিসেবে ধরে নেয়া হয় তাহলে সেই পৃথিবী দিয়েও কয়েক বেলার যোগান হবে না।

এ নাহয় গেল মানুষের উদাহরণ, আর বাকি কোটি কোটি প্রজাতির জীবদের নিয়ে হিসাবটা করলে কীরকম হবে? মানুষের ক্ষেত্রে ধরে নিয়েছিলাম প্রতি একশ বছরে উৎপাদিত হয় পাঁচজন সন্তান। লক্ষ লক্ষ প্রাণী ও উদ্ভিদ আছে যারা প্রতি বছরেই হাজার হাজার বংশধর তৈরি করে। লক্ষ লক্ষও করে। মূলত আমরা চাইলেও সবাই অমর থাকতে পারবো না। সকলে মিলে অমর থাকার ব্যাপারটা গাণিতিকভাবেই শুধু দেখানো যায়। বাস্তবে সম্ভব হয় না। সামান্য একটা অণুজীবের উদাহরণ দেখা যাক। একটি অতিক্ষুদ্র এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব Paramecium উপযুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাবার-দাবার পেলে গড়ে প্রতি ২৭ ঘণ্টায় একবার করে বিভাজিত হয়। এককোষী সরল জীব, তাই দ্বি-বিভাজন বা বাইনারি ফিউশনের মাধ্যমে বিভাজিত হয়। ই প্রক্রিয়ায় কোষগুলো একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি হয় এবং এভাবে বিভাজন চলতেই থাকে। এখানে কিন্তু বিভাজনের ফলে মাতৃ প্যারামেসিয়ামটি মরে যায়নি, বেঁচে আছে দুটি/চারটি/আটটি পৃথক সত্ত্বায়।

এভাবে সন্তান সন্ততি সহ সকলে গুণোত্তর ধারায় বিভাজন অব্যাহত থাকলে চল্লিশটি বিভাজন শেষে তাদের সকলের মোট আয়তন হবে এক ঘনফুটের মতো। একই হিসেবে সকলে মিলে এক ঘনফুট হবার পরে যদি আরো ৯০ বার বিভাজিত হয় তাহলে তাদের সকলের মোট আয়তন হবে সূর্যের আয়তনের সমান! শুধু একটি প্যারামেসিয়াম মাত্র ১৩০ বার বিভাজিত হলেই সূর্যের সমান আয়তনের হয়ে যাবে। এক ঘনফুট হতে লাগা ৪০ বিভাজন + বাকি ৯০ বিভাজন, মোট ১৩০ বিভাজন। এই পরিমাণ বিভাজিত হতে তাদের সময় লাগবে মাত্র ১৪৬ দিন। কিন্তু বাস্তবে তারা এমন একটি পৃথিবীতে তারা বাস করছে যে, পৃথিবীর মতো তের লক্ষটি গ্রহ সূর্যের ভিতরে অনায়াসে স্থান করে নিতে পারে। এবং এই পৃথিবীও টিকে আছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। ১৪৬ দিনেই শেষ হয়ে যায়নি।

এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব প্যারামেসিয়াম, যারা গড়পড়তা প্রতি ২৭ ঘণ্টায় একবার করে বিভাজিত হয়।
এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব প্যারামেসিয়াম, যারা গড়পড়তা প্রতি ২৭ ঘণ্টায় একবার করে বিভাজিত হয়।

গায়েবী পদ্ধতিতে যদি খাবার-দাবার সরবরাহ করা যেত তবে মাত্র একটা অণুজীব থেকেই কয়েক মাসে পৃথিবীতে একটা সূর্যের জন্ম হতো। এমনটা কখনোই সম্ভব নয়। প্রকৃতি ভারসাম্যে থাকতে পছন্দ করে। একটা জীব চাইলেও অমর থাকতে পারে না, কিংবা উত্তরোত্তর বংশধর তৈরি করতে পারে না। কোনো না কোনো একভাবে সে মারা যাবে কিংবা অন্য কোনো প্রাণী তাকে মেরে ফেলবে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীবদের খেয়ে শেষ করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু প্রাণী। সেই প্রাণীদের খেয়ে তাদের কমিয়ে রাখে ছোট ছোট কিছু মাছ। ছোট মাছদের আবার খেয়ে যায় মাঝারি অনেক মাছ। এই মাঝারি মাছ যায় বড় মাছের পেটে। বড় মাছদের খাই আমরা বা অন্যরা। ক্রমান্বয়ে খেয়ে চলা এই প্রক্রিয়াটির নাম খাদ্য পিরামিড। খাদ্য পিরামিড বা খাদ্যজালের অস্তিত্ব আছে বলেই পৃথিবীতে প্রাণের এত বৈচিত্র্য আছে।

পানিতে একটি ক্ষুদ্র বাস্তুসংস্থান যেখানে ছোটদেরকে ক্রমান্বয়ে বড়রা খেয়ে চলে।
পানিতে একটি ক্ষুদ্র বাস্তুসংস্থান যেখানে ছোটদেরকে ক্রমান্বয়ে বড়রা খেয়ে চলে।

এখন একটু আগের কথায় ফিরে তাকাই, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণুজীব যদি মারা না পড়তো তাহলে খাদ্যচক্রে আমাদের খাদ্য কিংবা অন্য প্রাণীদের খাদ্য কীভাবে আসতো? একটা সুস্থ সবল কড মাছ প্রতি বছরে ২০ থেকে ৫০ লক্ষ ডিম পাড়ে। এত বিশাল পরিমাণ ডিমের ৯৯% ডিম প্রথম মাসেই ধ্বংস হয়ে যায়। বাকি থাকা ১% এর মাঝে প্রথম বছরে ৯০ শতাংশই নানা কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। তারমানে প্রথম এক বছরে কড মাছের বংশধর ৯৯.৯৯%ই যায় নষ্ট হয়ে। এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া ডিম কিংবা শিশু কড মাছই হয়ে যায় অন্য কোনো প্রাণের জীবন ধারণের খোরাক।

সামুদ্রিক কড মাছ। এরা এক বছরে প্রচুর পরিমাণে ডিম পাড়ে, কিন্তু সে ডিমের ৯৯ ভাগেরও বেশি পরিমাণ ধ্বংস হয়ে যায়।
সামুদ্রিক কড মাছ। এরা এক বছরে প্রচুর পরিমাণে ডিম পাড়ে, কিন্তু সে ডিমের ৯৯ ভাগেরও বেশি পরিমাণ ধ্বংস হয়ে যায়।

এক প্রাণ নষ্ট করে আরেক প্রাণের বেঁচে থাকার কথা যদি শুনতে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির কোনো সদস্যের খারাপ লেগে থাকে তাহলে তাকে দেখতে হবে স্বয়ং হোমো স্যাপিয়েন্স নিজে কত হাজার হাজার প্রাণীর জীবন নষ্ট করে। আমি দেখছি মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর সবচে বড় খুনি। প্রত্যেকটা বেলার আহারের সাথে সাথে আমরা মানুষেরা শত শত প্রাণ ধ্বংস করে চলছি। আজকে যে কাগজে কোনো বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা পড়ছি সে কাগজও কিন্তু এসেছে কোনো একটা প্রাণ, গাছকে মেরে ফেলার ফলেই।

মানুষ যখন মরে যায় তখন তাকে পুড়িয়ে ফেলা হয় কিংবা কবর দেয়া হয়। সে কবরের আশে পাশে গাছে উঠে, বড় হয়, ফল ধরে। কেউ যদি স্মৃতি রক্ষার জন্য বড়ই, খেজুর বা তাল গাছে লাগায় তাহলে সেই গাছ পাচিত মৃতদেহের শক্তি (জৈব সার) পেয়ে ফেনিয়ে বেড়ে উঠবে। গাছের শিকড় বেয়ে নানা উপাদান উপরে উঠে যায়। মৃতদেহের অণু-পরমাণু, ইলেকট্রন-প্রোটন চলে যেতে পারে ফলের মাঝে। সেই ফল যদি কেউ খায় তাহলে যুক্তিবিদ্যায় কার অংশবিশেষ খাওয়া হলো? আমাদের মতো সভ্য মানুষদের শুনতে যতই খারাপ লাগুক না কেন এটাই বাস্তবতা। আমরা জটিল এক বাস্তুসংস্থানে একে অপরের সাথে বাধা। নিজেরাই নিজেদের খেয়ে চলছি, ধ্বংস করে চলছি, সৃষ্টি করে চলছি। নিজেদের ভোগ করার লীলা শেষ হলে পরে অন্য কারো ভোগের সুবিধায় নিজেদের উৎসর্গ করছি। জীববিদ্যায় এই ব্যাপারটার নাম রিসাইকেলিং বা চক্রাকার প্রক্রিয়া।

এখানে আমরা যারা একটু শুচিবাই তাদের ক্ষেত্রে কথাটাকে একটু অন্যভাবে বলা যায়। কবরের লাগানো গাছ হতে মৃতদেহের অণু-পরমাণু খেয়ে চলছি এটা না মানলেও চলবে। অণু-পরমাণু কোনো ব্যক্তিসত্তার নিজস্ব সম্পদ নয়। আমাদের শরীর গঠনকারী অধিকাংশ অণু-পরমাণু এসেছে নক্ষত্রের বিস্ফোরণ হতে সৃষ্ট ভারী মৌলের অবশেষ হতে। প্রতিটা অণু-পরমাণুর উপর অধিকার আছে বিশ্বজগতের প্রত্যেকটা বস্তুর, প্রত্যেকটা সত্ত্বার। যার দেহাবশেষের কল্পনা আমরা করছি সেই দেহটিই হয়তোবা এসেছে অন্য কারো দেহাবশেষ থেকে। যে সত্ত্বাকে আমরা প্রাণ বা জীব বলে জানছি তার সবই ছিল নিষ্প্রাণ অতিভারী কোনো নক্ষত্রের অভ্যন্তরে থাকা জড় পদার্থ। এককালে কোনো সত্ত্বা জড় ছিল, কালের বিবর্তনে সে জড়ে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে এবং কালেরই বিবর্তনে সেই প্রাণের সত্ত্বা আবার জড় হয়েছে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা প্রাণই নক্ষত্রের উপাদানে গঠিত। সকলেই আমরা জড় নক্ষত্রের সন্তান। You, me, all of us are made of star stuff.

এভাবেই বাস্তুসংস্থান এবং খাদ্যচক্রের সক্রিয়তায় প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় থাকে। দেখা যাচ্ছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যু থেকে সৌন্দর্যময় আর কিছুই হতে পারে না। কথাটা শুনতে আমাদের মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষদের খুব একটা খারাপ লাগতে পারে কিন্তু আসলে এটাই সত্য যে, মৃত্যু আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। এই প্রক্রিয়া না থাকলে আমরা কয়েক ডজন বছর তো দূরের কথা কিছু সময়ের জন্যও পৃথিবীতে থাকতে পারতাম না।

কেন মারা যাই
কোনো জীবের জীবনের সমাপ্তি হয় মৃত্যুর মাধ্যমে। একটি জৈবিক সিস্টেম যদি তার কার্যকরীতা হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ সকল প্রকার শারীরিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে তাহলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তা-ই হলো মৃত্যু। আসলে মৃত্যু ব্যাপারটা একটু ধোঁয়াশাচ্ছন্ন, মৃত্যু আসলে কী তা শতভাগ সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। যেমন গভীর কোমায় থাকা ব্যক্তিও মাঝে মাঝে এমন নিষ্ক্রিয় আচরণ করে যা মৃতের মতো বলে মনে হয়, কিন্তু আদতে সে বেঁচে আছে। মানুষেরা কেন মারা যায় তার একটা কারণ পাওয়া গেছে ক্রোমোজোমে থাকা টেলোমিয়ারের মাঝে। তার উপর এটি শুধু শারীরিক মৃত্যুর ব্যাখ্যা।

প্রত্যেক মানুষ বেড়ে উঠে সামান্য একটি কোষ হতে। এই কোষ উত্তরোত্তর বিভাজিত হবার মাধ্যমে মানুষকে বড় করে তোলে। কোষ বিভাজনের সময় অবশ্যম্ভাবী বিভাজিত হয় কোষের ভেতরে থাকা ক্রোমোজোম। ক্রোমোজোমের শেষ প্রান্তে অবস্থান করে টেলোমিয়ার। কোষের উত্তরোত্তর বিভাজনের ফলে টেলোমিয়ারটি ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে। কারণ বিভাজনের সময় ক্রোমোজোমের অন্যান্য অংশের মতো এই অংশটির প্রতিলিপি তৈরি হয় না। ক্রমে ক্রমে ক্ষয়ে যেতে থাকে শুধু। টেলোমিয়ার দিনে দিনে যত ক্ষয় হয়ে চলবে মানুষের কোষের কার্যকারিতা ততই কমবে। একসময় যখন টেলোমিয়ার তার ক্ষয়ের সীমাস্থ মান অতিক্রম করে ফেলে তখন আর কোষ বিভাজিত হয় না। ফলে পুরাতন কোষগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে নতুন কোষের সৃষ্টি হয় না। ধীরে ধীরে জীর্ণ হয়ে মানুষ মারা যায়। এটাই স্বাভাবিক মৃত্যু।

ক্রোমোজোমের প্রান্তে থাকে টেলোমিয়ার। যার উপস্থিতির ফলে ক্রোমোজোমের দুই প্রান্ত কখনো এক হয়ে যায় না।
ক্রোমোজোমের প্রান্তে থাকে টেলোমিয়ার। যার উপস্থিতির ফলে ক্রোমোজোমের দুই প্রান্ত কখনো এক হয়ে যায় না।

দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মানুষের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না। এসব ক্ষেত্রে যদি শরীরের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ, যা জীবন রক্ষার জন্য অতীব জরুরি, তার কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সেই শারীরিক সিস্টেম নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। একেও আমরা মৃত্যু বলে থাকি। তাহলে আমরা কি মনে মনে এই টেলোমিয়ারকে ‘ভিলেন’ বলে জানব? না, টেলোমিয়ার আমাদের টিকে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান। ব্যাপারটা একটু ভেতর থেকে দেখি।

ক্রোমোজোম বিভাজিত হয় DNA-র বিভাজনের কারণে। DNA-তেই প্রাণের সকল তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে। কেউ কালো হবে নাকি ফর্সা হবে, লম্বা হবে নাকি খাটো হবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকবে নাকি অল্পতেই রোগ বাধিয়ে ফেলবে এদের সবই নির্ধারণ করে DNA-তে থাকা নানান কোড। ডিএনএ বিভাজনের এই প্রক্রিয়াকে বলে ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ (DNA Replication)। DNA বিভাজনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজটি করতে দরকার পড়ে RNA-র। ক্রোমোজোমে RNA কিছুটা জায়গা দখল করে। সেখানে RNA-কে স্থান দিতে হলে DNA-কে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। DNA যদি জায়গা দিতে গিয়ে কিছুটা ক্ষয়ে যায় তাহলে সেটা প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ এর ফলে DNA তে থাকা অনেক তথ্য হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাওয়া তথ্যের মাঝে খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও থাকতে পারে। কিন্তু ভাগ্যবশত এমনটা হয় না। DNA ক্ষয়ে যায় না, ক্ষয়ের কাজটা করে টেলোমিয়ার অংশটি। টেলোমিয়ার ক্ষয়ে ক্ষয়ে কমে গিয়ে RNA-কে স্থান করে দেয়।

একদিক থেকে টেলোমিয়ার ক্ষয়ে গিয়ে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করছে আবার এর ক্ষয়ের ফলেই মানুষের মরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা যদি আসলেই বেঁচে থাকতে চাই, প্রজাতিকে অক্ষতভাবে টিকিয়ে রাখতে চাই তাহলে সাদরে মৃত্যুকে গ্রহণ করে নিতে হবে। এখানেই মৃত্যুর মাহাত্ম্য, প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এটা সৌন্দর্যময় মৃত্যু।

ডিএনএ প্রতিলিপির সময় টেলোমিয়ার ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যায়। ছবিঃ বিজ্ঞান পত্রিকা।
ডিএনএ প্রতিলিপির সময় টেলোমিয়ার ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যায়। ছবিঃ বিজ্ঞান পত্রিকা

আশা

কিছু কিছু জীবের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে সামান্য ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন গলদা চিংড়ি। এদের কোষে টেলোমারেজ নামে একধরনের এনজাইম থাকে যা টেলোমিয়ারকে ক্ষয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। এই সুরক্ষা পাবার ফলে ফলে এদের দেহকোষ অনির্দিষ্টকাল ধরে উত্তরোত্তর বিভাজিত হতে পারে এবং ক্ষয় পূরণ করতে পারে। এই চিংড়ির দেহে বার্ধক্য আসে না ফলে এরা অনির্দিষ্টকাল বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বড় হতে থাকে। সবচেয়ে বড় যে গলদা চিংড়িটি ধরা পড়েছে তার বয়স ছিল ৭০ বছর এবং ওজন ১২ পাউন্ড। এসব চিংড়িকে সাধারণত এত বড় আকারে দেখা যায় না। মরণ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে বা খাদ্য হিসেবে অন্যের পেটে না গেলে এরা সাধারণত মারা যায় না।

৭০ বছর বয়সের গলদা চিংড়িটি।
৭০ বছর বয়সের গলদা চিংড়িটি।

কিন্তু সকল প্রাণীতে এই এনজাইমটি থাকে না। তাদের বেলায় কী ব্যবস্থা নেয়া যায়? উপরের আলোচনা থেকে স্বাভাবিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, যদি কোনোভাবে কোনো উপাদান বা ওষুধ দিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া টেলোমিয়ারকে আবার বৃদ্ধি করা যায় তাহলে মানুষ হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বছর বেঁচে থাকতে পারবে। বিজ্ঞান এখন মানুষের হাতের মুঠোয়, তাই বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে এমন কিছু কি তৈরি করা যায় না? হ্যাঁ, বিজ্ঞানীরা এমন কিছু তৈরি করতে পারেন যা ব্যবহার করে টেলোমিয়ারকে পুনরায় আগের অবস্থানে আনা যায়। যেমন চিংড়ির মতো টেলোমারেজ এনজাইম প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু এরকম প্রক্রিয়া কখনো নির্ভুল হয় না। প্রকৃতিতে কোনো জৈবিক সিস্টেমই নির্ভুল নয়। সহজাত অনির্ভুল বৈশিষ্ট্যের কারণেই ডিএনএ’র প্রতিলিপি করার সময় ভুল হতে দেখা যায়।

এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে ক্যানসার। মানুষের জন্ম হতেই কিছু ক্যানসার কোষ সুপ্ত অবস্থায় থাকে। দেহ আবার এই কোষগুলোকে বিভাজিত হতে দেয় না, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ রাখে। টেলোমারেজ এনজাইম দিয়ে টেলোমিয়ারের বৃদ্ধি তরান্বিত করলে ঐ ক্যানসার কোষগুলো সক্রিয় হয়ে উঠবে। এতে হিতে বিপরীত হবে। দেখা যাচ্ছে অমরত্ব অর্জনের ধাপগুলো এতটা সহজ নয়!

তবে বিজ্ঞানীরা এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন। যতগুলো সমস্যা আছে তার সবগুলোকে নিয়ে কাজ করে সমাধান করে ২০৪৫ সালের মাঝে অমর মানুষ তৈরি করবেন বলে তারা ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও অমর বলতে গাণিতিকভাবে ইনফিনিটি পরিমাণ বছরকে বোঝানো হয়, তবুও মানুষ যদি কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকে সেটাকে আমরা আপাতত অমর বলতে পারি। বিজ্ঞানীরা কয়েকশত কিংবা কয়েক হাজার বছর বাঁচার উপায় বের করতে পারলে আমরা সেটাকে অমর বলে ধরে নেব আপাতত।

২০৪৫ সালের মাঝে মানুষ অমরত্ব লাভ করবে এই শিরোনামে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ।
২০৪৫ সালের মাঝে মানুষ অমরত্ব লাভ করবে এই শিরোনামে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ।

যুক্তির খাতিরে ধরে নেই মানুষ অমর হবার পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পেরেছে এবং তার সফল প্রয়োগ করতে পেরেছে। তাহলে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে? প্রথম সমস্যা খাদ্য, সেটা হয়তো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাধান করা যেতে পারে। যেমন মাংস তৈরি করার জন্য মেশিন বানানো যেতে পারে। এটা অসম্ভব নয়। কিছু কিছু কোম্পানি তো ঘোষণাই দিয়ে দিয়েছে কয়েক বছরের ভেতর খাবার প্লেটে নিয়ে আসবে কৃত্রিম মাংস। সন্তান সন্ততির ভরণপোষণ, সেটাও নাহয় হয়ে গেল। কিন্তু একসময় এত পরিমাণ মানুষ হয়ে যাবে যে, দেখা যাবে পৃথিবীতে আর জায়গা নিচ্ছে না। এমন অবস্থায় একটা সমাধান হতে পারে মহাকাশে বসতি স্থানান্তর। মহাকাশের অধিকাংশ স্থানই প্রাণবান্ধব নয়। বেশিরভাগ স্থানই বসবাসের অনুপযোগী। ধরে নেয়া যাক বিশাল মহাকাশে যে যে অংশে প্রাণবান্ধব অঞ্চল আছে সেগুলোতে বসবাস করতে পারবে মানুষ।

যদিও এসব স্থানে পৌঁছানো এবং বসবাসের অবকাঠামো তৈরি করা মাত্রাতিরিক্ত চ্যালেঞ্জিং তারপরেও এখানে ধরে নেয়া হয়েছে মানুষের প্রযুক্তি এতই উন্নতি হয়েছে যে চাইলেই তারা যেকোনো গ্রহে উড়ে যেতে পারে এবং দিনের পর দিন থাকতে পারে। সেখানে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য ও শক্তি সেখান থেকেই পায় কিংবা নিজেরা উৎপাদন করে নেয়, যদিও বাস্তবতা অনেক ভিন্ন।

প্রথম দিকে বলা গুণোত্তর ধারায় সন্তান উৎপাদন যদি চলতে থাকে তাহলে কোটি বছরে সেসব গ্রহও ভরে যাবে। তারপর কী? এরপর আর কিছুই নেই। মানুষ চাইলেই নতুন একটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে পারে না। গণহারে সকলকে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। ধ্বংস হবার আগে রেখে যেতে হবে আবর্জনাপূর্ণ এক মহাবিশ্ব। জীবনকে, পরিবেশকে ও মহাবিশ্বকে সুন্দর রাখতে মৃত্যুই সবচেয়ে ভূমিকা পালন করে। জীবনটাকে সুন্দর সুশ্রী করার তাগিদেই উৎপত্তি হয়েছে মৃত্যুর।

তবে এক্ষেত্রে ধর্মকর্ম কিছুটা আশার বাণী শোনাতে পারে। প্রায় সকল ধর্মেই এমন বিশ্বাস আছে যে, মৃত্যুর পরে আরো একটি জীবন আছে এবং সেই জীবন অনন্তকালের। হিন্দু ধর্মে আছে পুনঃ-পুনঃ জীবন লাভের ধারণা। যারা ধর্মকর্মে খুব আস্থাবান তাদের জন্য মৃত্যুতে নিশ্চয় কোনো উৎকণ্ঠা থাকার কথা নয়, পৃথিবীর জীবনে মরে গেলেও তো আরেক জীবন পাওয়া যাচ্ছে।

জটিলতা

এতো হিসাব দেখার পরেও যদি কেউ চেতন বা অবচেতন মনে অমর হবার জন্য লালায়িত হয়ে থাকে তাদের জন্য এখানে দুয়েকটি গল্প বলতে চাই।

গ্রীক মিথলজিতে টিথোনাস ছিল একজন রূপবান যুবক, যে ছিল অমরত্বপিয়াসী। ঊষার দেবী আরোরা তার প্রেমে পড়েন এবং তাকে আরোরার আবাসস্থলে নিয়ে যান। এরপর দেবতাদের রাজা জিউসের কাছে অনুরোধ করেন টিথোনাসকে যেন অমরত্ব দেয়। টিথোনাস অমরত্ব পায় ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে তার যৌবন চলে যায়। নিশ্চল ও অক্ষম হয়ে যেতে থাকে সে। জীবন হয়ে উঠে শেষ বয়সের অসুস্থ জীবনের মতো কষ্ট ও দুর্বিষহ যন্ত্রণায় জর্জরিত। মনঃপ্রাণ দিয়ে সে কামনা করে মৃত্যুর। কিন্তু মৃত্যু আসে না। করুণ সুরে দেবীর কাছে আর্তি জানায় “আমাকে মৃত্যুর অধিকার দাও। তোমার বর ফিরিয়ে নাও। জীবনের এককালে সকলেই মৃত্যুর স্বাদ নিয়ে প্রশান্তি লাভ করে, আমি কেন তার ব্যতিক্রম হব? আমি কেন হব প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত?” কিন্তু তার সে করুণ আর্তি দেবতার কান গলিয়ে যেতে পারে না।

গ্রীক পুরাণের অমরত্বপিয়াসী টিথোনাস অমরত্ব পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার ফলাফল ভালো হয়নি।
গ্রীক পুরাণের অমরত্বপিয়াসী টিথোনাস অমরত্ব পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার ফলাফল ভালো হয়নি।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস পাঁচ খণ্ডে অতি ছোট গল্পের (short shortstory) একটি সংকলন বের করেছিল। এতে অনেকগুলো অতিছোট গল্প ছাপা হয়েছিল। সেখান থেকে একটা গল্প তুলে ধরছি।

এক মুঠো ছাই

পুরনো জিনিসপত্রের দোকানে একসঙ্গে আমি এত বোতল দেখিনি কত রকমের বোতল যে সেগুলো কত রকমের রঙ সেসব বোতলের কোনোটা গোল কোনোটা চ্যাপ্টা, কোনোটা পেটমোটা, কোনোটা চারকোনা, কোনোটা লম্বা, কোনোটা কেবল শিশি, কোনোটা আঁকাবাঁকা একটা বোতল এদের ভেতরে একটু আলাদা মনে হলো এক কোনায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আমি যখন ওই বোতলটা কিনতে চাইলাম; দোকানি বলে- ওটা বিক্রির জন্য নয় ওর নাম সিবিল

-সিবিল? তোমার সব বোতলেরই কি নাম আছে?
-না
কেবল ওর নাম আছে
আমি তুলে একটু ঝাঁকালাম
দোকানি বলে- অমন করে ঝাঁকাবে না সিবিল ঝাঁকানো পছন্দ করে না
-ও বলেছে
?
দোকানি মাথা নাড়ে

তুলে নিয়ে যা দেখলাম ভেতরে একটু ছাই কেবল
বেশ পুরনো কালের বোতল বোধকরি রোমানরা যখন ব ব্রিটেনে রাজত্ব করছিল সেই সময়ের
– বোতলটা কি রোমানদের সময়ের
?
– ঠিক তাই
ওটা রোমানদের সময়ের বোতল
-এত পুরনো
?
-হ্যাঁ

– সিবিলও কি সেই সময়ের
?
-হ্যাঁ
শোন তাহলে বলি
দোকানদার সিবিলের গল্প বলতে চায়
বলে- সিবিল ছিল একজন নারী পুরোহিত যাকে ইংরেজরা বলে প্রিসটেস সে অত্যন্ত যত্ন করে তার কাজ করত তার কাজ এত ভালো ছিল এক দিন স্বয়ং ঈশ্বর আকাশ থেকে নেমে এসে বললেন- বল সিবিল, তুমি কি চাও?
-কি চেয়েছিল
?
-ও চেয়েছিল ইটারনাল লাইফ বা অনন্ত জীবন
কিন্তু ওর এই চাওয়াতে ছিল একটু ভুল
-তাই হয় সব সময়
চাওয়াতে সব সময় একটা ভুল থেকে যায় বলি আমি
-একদিন সিবিল বুড়ো হলো
চুল সাদা দাঁত নেই ওর চারপাশে যারা ছিল সবাই মারা গেল ও বেঁচে আছে শরীরটা কুঁচকে গেছে এক সময় দেখা গেল হাড় আর চামড়া ছাড়া আর কিছু নেই ও বেঁচে আছে এক সময় সেই চামড়া আর হাড় সম মিলেমিশে হয়ে গেল একমুঠো ছাই তখনো ও বেঁচে এখন এই বোতলে যা দেখছ সেই ছাই সিবিল
-এখনো বেঁচে আছে
?
দোকানি মাথা নাড়ে

খুব সাবধানে আমি বোতল নামিয়ে রাখি
ফিরে আসব শুনতে পাই পাতার ভেতরে বাতাস যেমন করে খেলা করে তেমন ফিসফিস স্বরে বোতলের ভেতর থেকে কে যেন বলছে- ‘আমি মরতে চাই’

(ভাষান্তর: সালেহা চৌধুরী। সাপ্তাহিক ২০০০; ঈদসংখ্যা ২০১১ তে সংকলিত।)

মানুষ অমরত্ব লাভ করলে তার ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে তার কিছু কাল্পনিক ধারণা নিয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল “নিশির জন্য ভালোবাসা” নামে একটি সায়েন্স ফিকশন গল্প লিখেছিলেন, যা “বেজি” নামের বইতে সংকলিত হয়। সেখানে মানুষ কোনো এক উপায়ে কোনো ক্ষতি ছাড়াই টেলোমিয়ারের ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে যায়। দুই হাজার বছর পর দেখা যায় বেঁচে থাকা মানুষ তাদের স্বল্প মস্তিষ্কে সব তথ্য জমা করে রাখতে পারে না। কয়েক শত বছর পরপরই স্মৃতি মুছে ফেলতে হয়। সেই পৃথিবীতে একটা মেয়ে মা হবার জন্য মনে প্রাণে আকুল হয়ে থাকলেও মা হতে পারে না। নিয়ম নেই। অতিরিক্ত মানুষের জায়গা আর পৃথিবীতে নেই। মানুষ মারতে সক্ষম অত্যন্ত শক্তিশালী ভাইরাস দিয়ে সম্পূর্ণ মানুষের এক তৃতীয়াংশ শেষ করে দিতে হয়। একসময়ে খাবার, পানি ফুরিয়ে আসে। বাঁচতে হলে মরতে হবে। মানুষকে টিকিয়ে রাখতে হলে নিজেকে মৃত্যুর কাছে সপে দিতে হবে। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে জানায় পৃথিবীর ভারসাম্য রাখতে হলে অর্ধেক মানুষ কমিয়ে ফেলতে হবে। সেটা করবে প্রত্যেক মানুষ। একজনকে মারলে বাঁচার অধিকার পাবে, না মারলে নিজে মরতে হবে। হয় মারো, নয় মরো। ভাবা যায় কী নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেখানে! নিশি কোমল হৃদয়ের, সে কাওকে মারতে পারবে না, তাই তাকে সাহায্য করতে আসে তার ভালোবাসার স্বামী। স্বামী নিজ হাতে তার এত শত বছরের ভালোবাসাকে গলা টিপে শেষ করে, তাতে থাকে না কোনো ক্রোধ, জিঘাংসা, প্রতিহিংসা। সেখানে ঐ অবস্থায় মেরে ফেলাটাই ভালোবাসা।

আসলে এটা ভাবতে আমাদের বুকে যতই খালি খালি হয়ে যাওয়া অনুভূতি হোক না কেন সবশেষে এটাই সত্য হয়ে দাঁড়ায় ‘মৃত্যু জীবনেরই একটি অংশ’। ডেথ ইজ অ্যা পার্ট অব লাইফ।

তাহলে আমাদের কী করা উচিৎ
এতক্ষণ আমরা দেখলাম মৃত্যু অনেক মাহাত্ম্যপূর্ণ ব্যাপার। তাহলে আমরা সকলে মরে যাই না কেন? আমাদের কি উচিৎ হবে না মাহাত্ম্যের জন্য তাড়াতাড়ি করে গণহারে মরে যাওয়া? খেয়াল করি, এখানে মৃত্যু উপকারী বলতে মরে যাওয়াকে বলা হয়নি, বলা হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা। এখন যদি সকলে মিলে একসাথে আত্মহুতি দেই তাহলে মানবজাতি তথা পৃথিবীর ক্ষতি ছাড়া উপকার হবে না। একমাত্র স্বাভাবিক মৃত্যুই পারে সমাজে ও বাস্তুসংস্থানে সর্বোচ্চ পরিমাণ ইতিবাচক প্রভাব রাখতে। আর স্বাভাবিক মৃত্যুর সময়সীমা কত হবে কিংবা কী পরিমাণ মানুষ ভূমিতে বেঁচে থাকবে তা পরিবেশই ঠিক করে দিবে। পরিবেশের মাঝে থেকে পরিবেশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর ক্ষমতা মানুষের নেই।

একটি বনের বাস্তুসংস্থানের ছোট একটি উদাহরণ দেখি। কোনো বনে বাঘ ও হরিণের পরিমাণের তুলনামূলক চিত্র- বনে যদি কোনো একভাবে বাঘের পরিমাণ বেড়ে যায় তাহলে সেখানে হরিণের পরিমাণ কমে যাবে। কারণ নতুন যুক্ত হওয়া বাঘগুলোর খাবারের জন্য বেশি পরিমাণ হরিণ নিধন করতে হবে। এতে করে হরিণ কমে যাবে। অন্যদিকে হরিণ কমে গেলে বাঘের খাবার কমে যাবে। বাঘের খাবার কমে গেলে ধীর প্রক্রিয়ায় বাঘের পরিমাণ কমে যাবে। বাঘের পরিমাণ কমে গেলে হরিণ নিধন কমে যাবে। নিধন কমলে ধীরে ধীরে আবার হরিণ বাড়তে শুরু করবে। হরিণ বাড়লে বাঘের জন্য খাবার বেড়ে যাবে। খাবার বাড়লে সফল বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়া সহ অন্যান্য জটিল বাস্তুসংস্থানিক প্রক্রিয়ায় বাঘের পরিমাণ বেড়ে যাবে। বাঘ বেড়ে গেলে আবার খাদ্য হিসেবে হরিণের ব্যবহার বেড়ে যাবে, ফলে হরিণ কমতে থাকবে।  … ব্লা… ব্লা… ব্লা। এভাবে যতদিন পর্যন্ত একটা সাম্যাবস্থায় না আসবে ততদিন পর্যন্ত এই চক্রাকার প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। এটা পরিবেশের অমোঘ নিয়ম, কোনো মানুষের বা কোনো জীবের পক্ষেই এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।

বাস্তুসংস্থানের উদাহরণে দেখা যাচ্ছে বাঘের পরিমাণ বৃদ্ধিই পরবর্তীতে তার পরিমাণ কমে যাবার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেই নিজের মৃত্যুর কারণ। মানুষ সহ অন্য সবার বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য। মানুষ কি পরিবেশের বাইরে?

তবু মনে চায়…
প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের চাহিদা অমর হবার। বুদ্ধিমত্তা বিকাশের আগে থেকেই মানুষ অমর হতে চেয়েছে। মূলত মানুষ নয়, সকল প্রাণীই অমর হতে চায়। আমাদের যদি অমরত্বের জন্য দুর্দম্য আকাঙ্ক্ষা থেকে থাকে তাহলে আমরা এটা ভেবে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারি যে আমরা একদিক থেকে আসলেই অমর! অ্যামিবা, হাইড্রা, প্যারামেসিয়াম এদের কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে তারা স্বাভাবিকভাবে মারা যাচ্ছে না। একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি… এভাবে নিজেদের সত্ত্বাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা যদি বিবর্তনের পথে সেই ক্ষুদ্র এককোষী সরল অণুজীব থেকেই ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে এসে থাকি তাহলে আমাদের শরীরের কারা বাস করছে? সেই আদি প্রাণই কিন্তু বেঁচে রয়েছে আমাদের প্রতিটি কোষে কোষে। আদি এককোষী প্রাণ আমাদের মাধ্যমে আজ পর্যন্ত অমর হয়ে আছে। তেমনই আমাদের সন্তান সন্ততির রক্তে রক্তে শিয়ার শিরায়ও আমাদের সত্ত্বাই বয়ে চলবে।

এক প্রজন্ম বেঁচে থাকে তার পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে।
এক প্রজন্ম বেঁচে থাকে তার পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে।

আজকের কুশীলব বেঁচে থাকবে তার অনাগত উত্তর প্রজন্মের ধারায়। সেই উত্তর প্রজন্মের সুখ শান্তির জন্য কত কিছুই না করবে আজকের মানুষ। একসময় নিজের অবস্থান ছেড়ে দিয়ে তাদের মাঝে নিজেকে, নিজের সবকিছুকে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে যাবে। এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।

মৃত্যুর উৎপত্তি কেন হয়েছে? বিবর্তনের পথে পেছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে অমর হবার জন্যই অর্জিত হয়েছিল মৃত্যুর ক্ষমতা। নিজের স্বত্বাকে যদি পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়া না যায় তাহলে কি প্রাণের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা থাকে? কোনো প্রাণী অমর হলেও আসলে তারা অমর নয়। স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু না ঘটলেও রোগ-ব্যাধি-দুর্ঘটনা সহ অনেকভাবেই মারা যেতে পারে। অমর হয়েও অমর নয়। এমতাবস্থায় অমর হবার চেয়ে মরণশীল বংশবৃদ্ধির পন্থাই উত্তম। টিকে থাকার তাগিদেই মৃত্যুর উৎপত্তি।

মন্তব্য

এখন যদি কেউ আমাকে বলে এতক্ষণ তো বকবক করলেন এখন মৃত্যু নিয়ে আপনার চাহিদা কী? তাহলে আমিও অত্যন্ত স্বার্থপরভাবে বলব আমি বাঁচতে চাই অনেক দিন। তবে আমার জীবনে যদি সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি হয়ে থাকে তাহলে বেশি দিন বাঁচতে চাই না। যতদিন পর্যন্ত সফল হবার জন্য বারবার চেষ্টা চালানোর সামর্থ্য আমার আছে ততদিন পর্যন্ত শুধু। অথর্ব হয়েও বেঁচে থাকতে চাই না। আজীবন তরুণ থাকতে চাই।

আমি যদি এমনভাবে তরুণ থাকার কথা বলি তাহলে এর পরেই আরেকটা কথা চলে আসে, আমাদের কি উচিৎ হবে না যত অক্ষম বুড়ো আছে তাদের মেরে ফেলা? পৃথিবীতে এমন অনেক জাতিই ছিল যারা অক্ষম বুড়োদের মেরে ফেলতো। জাপানে এক জাতি ছিল যারা বুড়ো বাপকে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসে দূরের পাহাড়ে। আমাদের দেশেও একসময় ‘ডোম’ নামের এক জাতির মানুষেরা বুড়ো অক্ষমদের পিটিয়ে কিলিয়ে মেরে ফেলতো। এটাই তাদের সংস্কৃতি। এর মধ্যে কোনো পাপবোধ নেই। সেই ব্যাপারে তাদের অনুভূতি কী ছিল সেটা আমি জানি না। তবে আমি কিংবা আমাদের মতো সভ্য মানুষেরা এটা ভেবে শিওরে উঠি। আমার মনে হয় মানুষের যে মন আছে সেটা বোঝা যায় বড়দের প্রতি তার মায়া দেখে। সেজন্যই আমরা উন্নত মানুষ কারণ আমরা বড়দের সম্মান করি, অসুস্থদের সেবা করি। মেরে ফেলি না।

চিত্রঃ বৃদ্ধ বয়স্কদের বাদ দিয়ে আমাদের সমাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তারাও আমাদের সিস্টেমের অংশ। মানবতা থাকার কারণেই আমরা মানুষ। আর সে মানবতার অন্যতম প্রকাশ বয়স্কদের সেবাযত্ন করা। সর্বোপরি আজকের তরুণরাও একদিন তরুণত্ব ছেড়ে বৃদ্ধ হবে।

মানবীয় অনুভূতি ছেড়ে বিজ্ঞানের ভাষায় বললে বুড়োদের নিয়ে আমাদের কী করা উচিৎ সেটা বিজ্ঞান বলে দিতে অক্ষম। বুড়োদের মেরে ফেললে কী কী সুবিধা হবে, কী কী অসুবিধা হবে কিংবা বুড়োদের সেবা করে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখলে কী কী সুবিধা হবে, কী কী অসুবিধা হবে তা শুধু বলে দিতে পারে। কি করা উচিৎ সেটা বিজ্ঞান বলে দিতে পারে না, বুঝবে মানুষেরা, সিদ্ধান্ত নিবে তারা। বিজ্ঞানের ভাষায় কখনোই বলা যাবে না তারা অক্ষম অকর্মণ্য। কোনো না কোনো একভাবে তারা আমাদের উপকারে আসছেনই। সেটা চোখে ধরা নাও দিতে পারে। বয়স্করাও আমাদের সিস্টেমের অংশ।

তথ্যসূত্র

  1. প্রাণের মাঝে গণিত বাজে (বীজগণিতের গান), সৌমিত্র চক্রবর্তী, অনুপম প্রকাশনী, ২০১৩, পৃষ্ঠা: ২৭-২৮
  2. মাসিক জিরো টু ইনফিনিটি, এপ্রিল ২০১২
  3. http://en.wikipedia.org/wiki/Death
  4. বিবর্তনের পথ ধরে, বন্যা আহমেদ, অবসর প্রকাশনী
  5. জীবনের গল্প (দ্বিতীয় খণ্ড), সৌমিত্র চক্রবর্তী, ছায়াবীথি প্রকাশনী
  6. চিরায়ত পুরাণ (Classical Mythology), অনুবাদঃ খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ফ্রেন্ডস বুক কর্নার
  7. http://en.wikipedia.org/wiki/Tithonus
  8. সাপ্তাহিক ২০০০, ঈদসংখ্যা ২০১১
  9. দৈনিক প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘অন্য আলো’ মার্চ ২, ২০১২।
  10. খাবার প্লেটে শীঘ্রই শোভা পাবে কৃত্রিমভাবে তৈরি মুরগির মাংস, বিজ্ঞান পত্রিকা।
  11. বার্ধক্য প্রতিরোধের বিজ্ঞান উন্মোচিত, বিজ্ঞান পত্রিকা।

পাদটীকা:

[1] মৃত মানুষের পরিমাণ বর্তমানের জীবিত মানুষের চেয়ে বেশি না কম তা বলা আসলে মুশকিল। সমস্যাটা হচ্ছে মানুষের শুরু কখন থেকে হয়েছে সেটা নির্ণয় করাতে। পৃথিবীতে প্রথম যে প্রাণীটি হোমো স্যাপিয়েন্স হয়ে হেঁটেছিল তাকেই ধরতে হবে প্রথম হিসেবে। এটা জানা হয়ে গেলে, তখনকার মানুষের গড় আয়ু, উচ্চতা, বংশবৃদ্ধি, মৃত্যুহার ইত্যাদি বের করা যায় জীববিদ্যা আর পরিসংখ্যান ব্যবহার করে। গাণিতিক হিসেবে অন্তত মুল তথ্যের কাছাকাছি পরিমাণে উপনীত হওয়া যায়। পপুলেশন অব রেফারেন্স ব্যুরোর হিসাব মতে মৃত মানুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৭৬০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। আর তার বিপরীতে জীবিত মানুষের পরিমাণ মাত্র ৭০০ কোটি। আকাশ পাতাল ফারাক! তাহলে প্রতিটি জীবিত মানুষের পেছনে পড়ছে ১৫ জন করে মৃত মানুষ। মূলত বর্তমান পৃথিবীর জনসংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে বলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিরুৎসাহিত করতে এমন করে বলা হয় “বর্তমান পৃথিবীর জীবিত মানুষের সংখ্যা সকল কালের সকল মৃত মানুষের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে।” আর ব্যুরোর এই হিসাব ত্রুটিমুক্ত নয়। তারপরেও যদি ধরে নেয়া হয় এত পরিমাণ মানুষ মৃত এবং কোনো উপায়ে তারা আজকের পৃথিবীতে জীবিতদের সাথে এসে বসে তবেও তাদেরকে পৃথিবী জায়গা দিতে পারবে। উল্লেখ্য পৃথিবী স্বাভাবিকভাবে ১৫ হাজার কোটির মত মানুষ জায়গা দিতে সক্ষম।

-সিরাজাম মুনির শ্রাবন
সহ-সম্পাদক, বিজ্ঞান ব্লগ
[লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল]

বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশিত ভিডিওগুলো দেখতে পাবেন ইউটিউবে। লিংক:
১. স্পেস এক্সের মঙ্গলে মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা
২. মাইক্রোস্কোপের নিচের দুনিয়া

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.