বিজ্ঞান পত্রিকা

আইএস সৈন্যদের ক্যাপ্টাগন মাদক কতটা কার্যকর

যুদ্ধক্ষেত্রে আইএস সৈন্যগণ ক্যাপ্টাগন নামের একটি মাদক বড়ি সেবন করে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই মাদকের প্রতিক্রিয়া কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে? গুজব রয়েছে যে ক্যাপ্টাগন সেবনে আইএস সৈন্যরা একেকজন উদ্যমী হয়ে ওঠে এবং অতিমানবীয় যোদ্ধায় পরিণত হয়। আসলেই কি তাই?

ক্যাপ্টাগন ট্যাবলেট নিয়ে এইসব গুজবের উত্তর পেতে এবং যথযথ তথ্য সংগ্রহের জন্য ড্রাগ বিশেষজ্ঞদের স্মরনাপন্ন হওয়া যাক। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও দর্শন বিজ্ঞানের অধ্যাপক নিকোলাস রাসমুসেন এর কাক্যাপ্টাগন ট্যাবলেট আসলে দু’টি ড্রাগ থিওফাইলিন (theophylline) এবং অ্যাম্ফিটামিন (amphetamine) এর সংমিশ্রনে তৈরি। এই সংমিশ্রনটি এমনিতে মানবদেহে নিষ্ক্রিয় থাকে কিন্তু সেবনের পর উপাদানসমূহে বিশ্লেষিত হয়ে যায় এবং আলাদাভাবে দুটি ড্রাগ সক্রিয় হয়ে ওঠে।

থিওফাইলিন ড্রাগটি ক্যাফেইনের মতোই কাজ করে তবে এটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচল পথেও কাজ করে এবং শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় ব্যাবহৃত হয়। অপরদিকে, অম্ফিটামিন হলো ক্যাপ্টাগনের মুল মনোনিয়ন্ত্রক ড্রাগ। অ্যাম্ফিটামিন সবকিছুর গতিবৃদ্ধি করে। এটি আনন্দের অনুভুতি বিবর্ধিত করে এবং সজাগভাব বৃদ্ধি করে। এটি ঘুম এবং খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে।

তবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক কার্ল হার্টের মতে ক্যাপ্টাগন নানাবিধ আম্ফিটামিনের উৎসের মধ্যে অপেক্ষাকৃত মৃদু। তিনি বলেন এটি একটি নিন্মমানের অ্যাম্ফিটামিন। এটি অন্য একটি ড্রাগ অ্যাডেরলের চেয়ে মৃদু। অ্যাডেরল আচরণগত সমস্যায় ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমনটি ক্যাপ্টাগনও একসময় ব্যবহৃত হতো। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে মনোযোগ প্রদান জনিত বৈকল্যে ভোগা রোগীদের এটি সেবন করতে দেয়া হতো। এটির অন্য কিছু উত্তেজকের মতো খুব বেশী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, কিন্তু একই সাথে এটি খুব বেশী কার্যকরও নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচলন হ্রাস পেলেও ক্যাপ্টাগন মধ্যপ্রাচ্যে জনপ্রিয়া হয়ে হওয়। গত একদশক ধরে এটি সৌদি আরবের একটি বড় সমস্য হয়ে দেখা দিয়েছে।

শারীরিক প্রভাব: কার্ল হার্ট বলেন, অ্যাম্ফিটামিন সেবনে যেমন হয় ক্যাপ্টাগন সেবনের ফলেও একজন ব্যক্তির রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, হৃদস্পন্দন এবং সতর্কভাব বৃদ্ধি পায়। এটি অন্যান্য উত্তেজক ড্রাগের মতোই কাজ করে; এটি সেবনে কর্মোদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়, আক্রমনাত্মক মনোভাব বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করা যায়। নিন্মমাত্রার সেবনে পার্শ্বপতিক্রিয়া খুব কমই থাকে। কার্ল হার্টের তথ্য অনুযায়ী, “আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই এমন মানুষ বাস করে আসছেন যারা নিয়মিত অ্যাম্ফিটামিন সেবন করেন। আমরা কফিজাতীয় পানি বেশী মাত্রায় পান করলে যেমন প্রতিক্রিয়া হয় এর প্রতিক্রিয়াও তেমনই। তবে উচ্চমাত্রায় সেবন করলে অ্যাম্ফিটামিনের বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়া শুরু করে।”

হার্ট বলেন, যেসব মানুষ উচ্চমাত্রায় এটি সেবন করেন তাঁরা ঘুমাতে বা খেতে পারেন না যা থেকে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। তবে এসব সমস্যা যতটা না ড্রাগটি সেবনে হয় তারচেয়ে বেশী হয় ঘুম ও খাদ্যের অভাব থেকে।

অতিমানবীয় শক্তিমত্তা?

ক্যাপ্টাগনের বিষয়ে দাবী করা হয় এটি স্পর্শ বা ব্যাথায় অনুভুতি দূর করে দেয়, কিন্তু বিশেষজ্ঞগণ এই দাবী উড়িয়ে দেন। তাঁরা বলেন, এটি কোনো জাদুকরী ব্যাথানাশক নয়। বরং ব্যাথাহীনতা অনুভুত হয় অতিউদ্যমের ফলে। অতিউদ্যোমী ব্যক্তি কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগ নিবিষ্ট করে থাকেন, ফলে তিনি ব্যাথ্যা ইত্যাদির প্রতি মনোযোগ দেন কম। কার্ল হার্ট দাবী করেন, মিডিয়া যেমন প্রচার করছে ক্যাপ্টাগন সেবনে একজন সৈন্য অতিমানবীয় যোদ্ধায় পরিণত হয় এটি আদৌ তেমন নয়। তিনি বলেন, যদি সত্যিই এমন হতো তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের নিশ্চিতভাবে ক্যাপ্টাগন সেবন করতে দেওয়া হতো। (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের অন্যান্য কিছু শক্তিবর্ধক সেবন করতে দেওয়া হয়েছিলো।)

তবে তারপরও ক্যাপ্টাগন সেবনে একজন ব্যক্তি নিজেকে উৎকৃষ্ট ও শক্তিধর মনে করতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন এটি অনভিজ্ঞতা প্রসুত আচরণ। প্রথমদিকে এধরনের তীব্র অনুভুতি তৈরি হলেও সেবনের অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে এধরনের আচরণ স্তিমিত হয়ে আসবে। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো ড্রাগে আসক্ত কিংবা এমনকি অ্যালকোহলেও আসক্ত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি ক্যাপ্টাগন সেবনে খুবই মৃদু প্রভাব অনুভব করবেন।

তবে আইএস এর ক্ষেত্রে ক্যাপ্টাগন সেবনের কথা বলা হলেও এমনও হতে পারে যোদ্ধারা যা গ্রহণ করছে তা ক্যাপ্টাগন নয়। বিশেষজ্ঞদের ধারনা অনুযায়ী সিরিয়াতে ক্যাপ্টাগনের নামে যা চলছে তা কেউ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্যাপ্টাগনের নামে অন্য একটি ড্রাগ  মেথাম্ফিটামিন চালু থাকতে পারে।

 

Exit mobile version