বিজ্ঞান পত্রিকা

কেন প্রাণীদের চাকা নেই?

মানুষের ইতিহাসে কিছু মৌলিক আবিষ্কার আছে যেগুলোকে মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। অমল দাশগুপ্ত তার মানুষের ঠিকানা বইটিতে পাথরের হাতিয়ার, আগুন, কৃষিকাজ, চাকা ইত্যাদিকে একেকটা বিপ্লবের চিহ্ন হিসেবে ধরেছেন। হাতিয়ার মানুষের ক্ষমতা দিয়েছে বাড়িয়ে। আগুন মানুষকে দিয়েছে সুরক্ষা। কৃষিকাজ মানুষকে খাবারের নিশ্চিত উৎস দিয়েছে। এর ফলে শিকারী আর রাখাল মানুষ থিতু হওয়ার সুযোগ পায়। চাকা যে পরিবহনে কেবল সাহায্য করেছে শুধু তাই নয়। চাকা ব্যবহার করে মানুষ নানা জটিল যন্ত্র তৈরি করেছে। যেমন কুমারের চাকা। যে কোন জটিল যন্ত্রে আমরা চাকা বা গোলাকার যন্ত্রাংশের ব্যবহার দেখি।

আমরা প্রাণিজগতের সাথে মানুষের একটা তুলনা করতে পারি। মানুষ যেসব প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে কোটি কোটি বছর আগে থেকে সেসব প্রকৃতিতেই বিদ্যমান ছিলো। মানুষের অনেক আগে থেকেই পিঁপড়ারা কৃষিকাজ করে। তারা যে কেবল ছত্রাক চাষ করে শুধু তাই নয়, মানুষের দুধের জন্য গরু পোষার মতো তারা জাবপোকাও পোষে। রাডার কিন্তু নতুন কিছু নয়। বাদুড় আর ডলফিনেরা বহু আগে থেকেই রাডারের মূলনীতি ব্যবহার করে চলাচল করছে। অন্ধকারে দেখার জন্য আমরা ইনফ্রারেড চশমা ব্যবহার করি। সাপের কিন্তু চশমা লাগে না। সে এমনিতেই অন্ধকারে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলো বুঝতে পারে। এর মাধ্যমে সে অন্ধকারে শিকার ধরতে পারে।

অন্তত দুইজাতের মাছ আছে যারা দেহে ব্যাটারী বা বিদ্যুতকোষ ধারণ করে। একজাতের হঠাৎ বৈদ্যুতিক ঝলক দিয়ে শিকার ধরে। অন্য জাতের মাছ দেহের চারপাশে একটি বিদ্যুৎক্ষেত্র তৈরি করে। এ বিদ্যুতক্ষেত্রের তারতম্য অনুভব করে তারা চলাচল করে।

মানুষের অনেক আগেই স্কুইডেরা জেট ইঞ্জিন দিয়ে পানিতে যাতায়াত করে বেড়ায়। বীভাররা জলে বাঁধ দিয়ে নিজস্ব হ্রদ তৈরি করে। ছত্রাকেরা এন্টিবায়োটিক তৈরি করে ব্যক্টেরিয়াদের প্রতিহত করে, যাতে খাবারের জন্য তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে না হয়।

প্রাণিজগতে এত সুক্ষ্ণ প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যবহার আছে তা বিস্ময়কর। আমরা এক অর্থে প্রকৃতির নকল করে চলেছি। তারপরেও খটকা থেকে যায়। বোকার মত প্রশ্ন আসে, প্রাণীজগতে চাকা নেই কেন?

চাকা হচ্ছে সেই জিনিস যা মানুষকে গতি দিয়েছে। বলা যায়, চাকাই পৃথিবীকে গোল করেছে মানুষের কাছে। জেনারেটর, টার্বাইন থেকে গোলাকার চাকা সরিয়ে নাও, কোথাও বিদ্যুৎ তৈরি হবে না। মটর বা প্রপেলার থেকে চাকতি, গোল অক্ষদন্ড সরিয়ে নাও – প্লেন বা মটরগাড়িতে যাতায়াত বন্ধ। কারখানা চলবে না, ঘুরবে না ঘাঁনি, পেষনযন্ত্র। ধান থেকে চাল পাবে না কেউ। এই যে চাকা এত প্রয়োজনীয় জিনিস, কেন আসলে প্রাণীজগতে চাকা নেই? মানুষের দুইটি পা না থেকে যদি গোল চাকা থাকতো তাহলে কেমন হতো?

ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগে, চারপেয়ে ঘোড়া সহ যে কোন জন্তু মানুষকে দৌড়ে হরিয়ে দিতে পারতো। এমনকি ক্যাঙ্গারুর দুইটি পা থাকলেও সে আমাদের চাইতে জোড়ে দৌড়ায়। চাকা আবিষ্কারের অনেক পরে আমরা ঘোড়া টানা গাড়ি আবিষ্কার করি। ঘোড়ার কাছে সেই গাড়িটা এমন একটি যন্ত্র যা কিনা তাকে ধীরগতির করে দেয়। মাত্র কিছুদিন আগে আমরা ইঞ্জিন দিয়ে গাড়ি চালানো শিখলাম। তারপরেই কেবল আমরা চিতা, ঘোড়া সহ অন্যান্য প্রাণীকে ইঞ্জিনগাড়িতে চড়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিতে পারি।

তবে এ দৌড় প্রতিযোগিতায় শর্ত প্রযোজ্য। গাড়ি ঘোড়ার তুলনায় জোড়ে দৌড়াতে পারে একমাত্র পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তায়। গাড়ির সাথে ঘোড়ার প্রতিযোগিতা যদি হয় এবড়োথেবড়ো ক্ষেতে কিংবা উঁচুনিচু বন্ধুর পথে? ঘোড়া তো দূরে থাক একটা ছোট্ট মাকড়শাই পারে গাড়িকে এই প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিতে।

বোঝাই যাচ্ছে, চাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো রাস্তা

তাহলে আমরা বোকার মতো আরেকটি প্রশ্ন করতে পারি। কেন প্রাণিরা রাস্তা তৈরি করতে শিখলো না? বীভারের জলবাঁধ কিংবা বাবুই পাখির নান্দনিক বাসার তুলনায় রাস্তা তৈরিতো ছেলেখেলা মাত্র।

এখন আমরা একটা বড়ো রকমের সমস্যার সমনে এসে দাঁড়াই। রাস্তা তৈরি কারিগরী দিক দিয়ে সহজ হলেও এটা একটা ভীষণ বিপজ্জনক কাজ। যদি হারিণ বনের মধ্যে যাতায়াতের জন্য একটা রাস্তা তৈরি করে, বাঘও সেই রাস্তার সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। এই ঘটনা কেন ঘটবে না তার একটা ডারউইনীয় ব্যাখ্যা আছে রিচার্ড ডকিন্সের স্বার্থপর জিন‘ (দ্য সেলফিশ জিন) গ্রন্থে। বিবর্তন একটি স্বার্থপর খেলা। হরিণরা রাস্তা তৈরির মাধ্যমে বাঘেরও উপকার করে ফেলতে পারে। অথচ বাঘকে কোন কষ্ট করতে হবে না বা কোন মূল্যই দিতে হবে না এ রাস্তা তৈরির জন্য।

প্রাকৃতিক নির্বাচন এমন রাস্তা তৈরিকেই সমর্থন করতে পারে যে রাস্তায় কেবল নির্মাতা প্রাণীই চলাচল করতে পারে। যেমন উঁইপোকার তৈরি সুরঙ্গ। কোন প্রাণী কষ্ট করে রাস্তা তৈরি করলে অন্যরা কোন শক্তির অপচয় না করেই রাস্তার সুবিধাটা নিতে পারে। সে অতিরিক্ত শক্তিটা ব্যবহার করে আরো খেয়েদেয়ে মোটাতাজা হয়ে নিজেদের বংশবৃদ্ধি করবে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে প্রথম নির্মাতা প্রাণীর বংশধরের সংখ্যা সুবিধাপ্রাপ্ত প্রাণীদের তুলনায় কমে যাবে।

মানুষ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি করেছে যেখানে সবাই কর দিতে বাধ্য। সে কর আয়কর বা ভ্যাট যাই হোক। কর থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে রাষ্ট্র রাস্তাঘাট তৈরি করে। সরকার, পুলিশ, আয়কর বিভাগ, গণপূর্ত ইত্যাদি ব্যবস্থার মধ্যে আমাদের থাকতে হয়। যদি কেউ বলে, রাষ্ট্র আমাকে রাস্তাঘাট তৈরি করে দিয়ে অনেকে উপকার করলেও আমি ট্যাক্স দিবো না, তাহলে তাকে ধরে জেলে ঢোকানো হয়। দুঃখের বিষয়, মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী ট্যাক্সধারণাটা আবিষ্কার করতে পারে নি।

ব্যাক্টেরিয়াদের ফ্লাজেলা যদিও দেখতে চাবুকের মতো – কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই এটা ‘ঘোরে’, চাক্রিক প্রপেলার ব্যবহার করে

বে ব্যতিক্রম আছে। কিছু ব্যাক্টেরিয়াতে প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগে থেকেই চাকার মতো অঙ্গানু বিবর্তত হয়েছে। তাদের দেহে সুতার মত অঙ্গাণু আছে যাকে ফ্লাজেলা বলে। এই ফ্লাজেলা দেহের সাথে একধরনের চাকা দিয়ে যুক্ত। এ চাকা সত্যি সত্যিই ঘোরে। চাকার সাথে ফ্লাজেলা একটি অক্ষদন্ড বা শ্যাফটের মাধ্যমে যুক্ত। চাকা ঘুরলে ফ্ল্যাজেলাতে একটি চাক্রিক গতি তৈরি হয়। এর মাধ্যমে ব্যাক্টেরিয়া তরল বা অর্ধতরল মাধ্যমে চলাচল করে। একটি ক্ষুদ্র ইঞ্জিন দিয়ে ব্যক্টেরিয়া এই চাকা ঘোরায়। এই চাকা ব্যাক্টেরিয়ার কোষপ্রাচীরের মধ্যে একটি গর্তের মধ্যে যুক্ত। হুইটেকারের জীবনের পাঁচ রাজ্য ধারণায় ব্যাক্টেরিয়াকে কোন প্রাণী (animal) ধরা হয় না।

এত ক্ষুদ্র ব্যাক্টেরিয়া চাকা তৈরি করতে পারলো, এর মধ্যেই উত্তর কেন বড় প্রাণীদের দেহে চাকা নেই। বড় প্রাণীর দেহে বড় চাকা লাগবে। এই চাকা প্রাণীর বড় হওয়ার সাথে সাথেই বড় হয়ে উঠতে হবে। এর বাইরের দেহ হতে হবে নখের মতো মৃত অথচ খুরের মতো শক্ত কোষ দিয়ে তৈরি। এ চাকা ঘুরাতে প্রয়োজন হবে রক্তপ্রবাহ, যা চাকার অক্ষদন্ডকে কোনভাবে ঘুরাবে। আবার এই চাকাকে কর্মক্ষম রাখতে এর ভেতরেও রক্তের প্রবাহ থাকতে হবে। তখন সমস্যা দাঁড়াবে এই চাকার ভেতরের রক্তনালী দেহের রক্তনালীর সাথে যুক্ত হবে কিভাবে? আধুনিক কারিগরী দৃষ্টিকোন দিয়ে এই সমস্যার সমাধান আছে। তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিতে পারি কোন প্রাণী এই চাকা অর্জন করে নিতে পারে। তাহলে তখন প্রশ্ন দাঁড়ায় ঐ প্রাণীর মধ্যবর্তী প্রজাতী দেখতে কেমন হবে? আসলে অভিব্যক্তি প্রক্রিয়া হঠাৎ করে লাফ দিয়ে মাটি থেকে পাহাড় সমান অগ্রগতি লাভ করে না। প্রাণীর অভিব্যাক্তি খুব ধীরে ধীরে হয়। কারিগরী দিক দিয়ে প্রাণী দেহে চাকা তৈরি সম্ভব হলেও বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোন হতে সম্ভাব্য নয়। [Richard Dawkins এর Why don’t animals have Wheels অবলম্বনে, ইতিপূর্বে বিজ্ঞানব্লগে প্রকাশিত]

-আরাফাত রহমান

প্রভাষক, অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

Exit mobile version